প্যারেন্টিং- “আদর্শ বাবা-মা এর কর্তব্য”

টিউন বিভাগ এডুটিউনস
প্রকাশিত
জোসস করেছেন

'সন্তানবাৎসল্য' বিষয়টি শুধু মানুষের নয়, বরং বলা চলে সকল জীবেরই প্রকৃতি প্রদত্ত একটি অনন্য সহজাত প্রবৃত্তি। আর মানুষের জন্য এটি আরও অর্থবহ এবং ব্যাপক ব্যঞ্জনাময়। কারণ, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রকৃতি প্রদত্ত হলেও তাকে সত্যিকার অর্থে বজায় রাখার দায়িত্ব মানুষেরই।

অন্যান্য জীবের যেখানে শুধু টিকে থাকার সংগ্রাম, সেখানে মানুষকে নামতে হয় অস্তিত্ব-সৌকর্য সমৃদ্ধির সংগ্রামে। আর 'প্যারেন্টিং' বিষয়টি এই প্রক্রিয়ারই আওতাধীন। অন্যান্য জীবের যেখানে প্রকৃতি প্রদত্ত সন্তানবাৎসল্যেই সীমাবদ্ধ বাবা-মা'র ক্রিয়াকলাপ, সেখানে মানুষকে আরও অগ্রসর হতে হয়েছে ও হচ্ছে 'সন্তানের জীবনের প্রকৃত কল্যাণ কীসে' এই ভাবনার বিশ্লেষণে। আর 'প্যারেন্টিং' সেই বিশ্লেষণেরই বিশেষ একটি অনুষঙ্গ।
প্যারেন্টিং (Parenting) একটি ইংরেজি শব্দ। সন্তান লালনপালনের সামগ্রিক প্রক্রিয়াই প্যারেন্টিং হিসেবে বিবেচিত।

সন্তান মানবজীবনের পরিপূর্ণতার প্রধানতম অনুষঙ্গ। এমনকি মানবসভ্যতার অস্তিত্বের অপরিহার্য বিষয়ও এটি। আজকের সন্তান আগামী সভ্যতার ধারক। তাই আজকের প্যারেন্টিংই আগামী প্রজন্মের সভ্যতার ভিত্তি।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বর্তমানের এই উৎকর্ষতা মূলত প্যারেন্টিং উৎকর্ষতারই অবদান।

শিকার যুগের বাবা-মা সূচনা করেছে পশুপালন যুগের এবং তা সন্তানকে শিখিয়েছে। সেই সন্তান কালক্রমে হয়ে উঠেছে পশুপালন যুগের দক্ষ প্রজন্ম। এরপর সেই প্রজন্ম সূচনা করেছে কৃষি যুগের এবং তা সন্তানকে শিখিয়েছে। সেই সন্তান কালক্রমে হয়ে উঠেছে কৃষি যুগের দক্ষ প্রজন্ম এবং মাথায় এনেছে এই আধুনিকতার ধারণা। সেই ধারনায় প্যারেন্টিং করে সন্তান মানুষ করেছে। কালক্রমে সেই সন্তানই হয়ে উঠেছে এই আধুনিক উৎকর্ষতার গর্বিত প্রজন্ম।

এটা হলো প্যারেন্টিং এর গড়পড়তা ইতিহাস। কিন্তু এই ইতিহাসই সব নয়। এর মধ্যেই রচিত হয়েছে কতশত ব্যক্তিক ট্রাজেডি! কতো শিকারী বাবা-মা তার সন্তানকে পশুপালনের আপডেট ধারণায় উৎসাহিত করেনি! বরং বাধ্য করেছে পশ্চাদপদ হতে। এমনকি সেই পশ্চাতপদতায়ও সন্তানকে পিষ্ট করেছে নানান কিছিমের কূপমন্ডুকতায়। অর্থাৎ সন্তানবাৎসল্য বলি হয়েছে সন্তানের জীবনবিধ্বংসী ভুল প্যারেন্টিং এ।
এভাবে পশুপালন, কৃষি, এমনকি এই আধুনিক উৎকর্ষতার যুগেও বহু ভুল প্যারেন্টিং এর বলি হয়ে নিঃশেষ হচ্ছে কতশত সন্তান!

কেনো ভুল প্যারেন্টিং?

আলোকিত মনের অভাব, নার্সিসিস্ট প্রবণতা, মানসিক ক্ষুদ্রতা, পশ্চাৎপদ পরিমণ্ডল, মেকি সাধুতা, বোধের দৈন্যতা ইত্যাদি বদ বৈশিষ্ট্যসমূহই ভুল প্যারেন্টিং এর বুনিয়াদ। এখন দেখা যাক উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ কীভাবে ভুল প্যারেন্টিং এর নিয়ামক।

আলোকিত মনের অভাব: মনের আলো মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের সাধিত ভূষণ। যে মানুষ যতোবেশি মনকে আলোকিত করতে পেরেছে, ততোবেশি মনুষ্য-উৎকর্ষতার শীর্ষে তিনি। আর এ উৎকর্ষতা আসে শিক্ষা ও সাধনার সুষম প্রয়াস থেকে।
এরূপ আলোকিত মানুষই আলোকিত পথের দিশারি। তাঁদের হাতেই নির্মিত হয় নতুন প্রজন্মের মানবিক প্রজেক্ট। অপরদিকে আলোহীন মানুষের মনে কেবলই কূপমন্ডুকতা। সে যেমন নিজে আঁধারে কলুষিত, বিভ্রান্ত; তেমনি অন্যের জন্যেও সে কলুষতা ও বিভ্রান্তির কারণ। এমনকি এ ধরনের মানুষ নিজ সন্তানের জীবনেও ঘনিয়ে দেয় বিভ্রান্তির আঁধার। তারা সন্তানের শিশু মানসিকতায় পুশ করে বন্য বৈশিষ্ট্যের যতোসব বিষ। এই বিষেই বিদায় নেয় মনুষ্যত্বের সতেজতা এবং বক্রতা আর বর্বরতার বুনিয়াদ বসে ঐ সন্তানের মানসিকতায়। এভাবে ভুল প্যারেন্টিং এর খেসারতে খর্বিত হয় অনেক সন্তানের আগামীর সম্ভাবনা।
নার্সিসিস্ট প্রবণতা: এই প্রবণতার মানুষগুলোর প্রধান হিসেবই হলো নিজেরটা। ন্যায্যতা কিংবা যৌক্তিকতার চেয়ে তারা জীবনকে ভরে ফেলতে চায় প্রাপ্তির প্রাচুর্যে। এই প্রাপ্তির ধরন অবশ্য সবসময় সব নার্সিসিস্ট পারসনের একরকম নয়। কারও নেশা বৈষয়িক সম্পদে, কারও আবার প্রশংসা বা ক্ষমতায়। কিন্তু এগুলো তারা শুধু অন্যের থেকে পেতেই চায়, দিতে চায়না; 'মন শুধু নিতে জানেগো, দিতে জানেনা—!' গানটির মতো আর কী!
প্যারেন্টিঙে এই ধরনের বৈশিষ্ট্য সন্তানের জীবনে ন্যায্যতা, যৌক্তিকতা ইত্যাদি গুণাবলির সংকট সৃষ্টি করে, যা মানবিক উৎকর্ষতার অন্যতম অন্তরায়।

মানসিক ক্ষুদ্রতা: উদারতা মনুষ্যত্বের মহান নিয়ামক। পক্ষান্তরে মানসিক ক্ষুদ্রতা মানুষকে নীচে নামায়, জীবনকে কলুষিত করে। জগতের যতো মহান ও কল্যাণকর দৃষ্টান্ত, তার সবই মানুষের মহানুভবতা ও উদারতার ফসল। তাই উদারতাহীনতা, অর্থাৎ মানসিক ক্ষুদ্রতা, মানবতার মজলিসে মানহীন মুদ্রা।
আপনার মানসিক ক্ষুদ্রতার প্যারেন্টিং আপনার সন্তানের প্রকৃত জীবন-সমৃদ্ধির সূচনা করেনা। বাবা-মা এর উদারতা প্রসূত প্যারেন্টিং সন্তানকেও করে তোলে প্রকৃত বড় মাপের মানুষ। তাই আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে, সন্তানের সামনে কিংবা সন্তানকে সাথে নিয়ে আপনার মানবকল্যাণমূলক কাজ হতে পারে সন্তানের জীবনের জন্য বেটার প্যারেন্টিং এর একটি অনন্য উদাহরণ।
পশ্চাৎপদ পরিমণ্ডল: উপযুক্ত শিক্ষার আলো বঞ্চিত পরিমণ্ডলের মানুষগুলো জীবনের নানা অনুষঙ্গে পশ্চাৎপদ। এমন পরিমণ্ডলের বেশিরভাগ মানুষ উচ্চতর মানবীয় বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যূত অনেকটাই। তাই তাদের অজ্ঞতার প্রভাব প্যারেন্টিঙে ওলক্ষণীয়। যার নিজের জীবনেই জ্ঞান ও শিক্ষার আলো নেই, সে কীভাবে সন্তান বা অপরের জীবনে আলো জ্বালাবে? তাই পশ্চাৎপদ পরিমণ্ডল থেকে সন্তানের সমৃদ্ধ জীবনের যথার্থ প্যারেন্টিং আশা করা অবাস্তব।

মেকি সাধুতা: মেকি সাধুতা অর্থাৎ ভণ্ডামি মানবচরিত্রের খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম। বাবা-মার এ বদগুণ সন্তানে সঞ্চালিত হতে পারে খুব সহজেই। কারণ সন্তান শৈশবে সবচেয়ে বেশি অনুকরণ করে বাবা-মাকে। তাই আপনি যদি প্রকৃতই আপনার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করার প্যারেন্টিং দিতে চান, তাহলে আপনাকেও হতে হবে মেকি নয়, প্রকৃত সাধু(ভাল মানুষ)। 'অমুক কাজ ভাল নয়, অমুক কাজ ভাল' ; এভাবে বাণী দেয়ার চেয়ে আপনার ভাল ভাল কাজগুলো হতে পারে আপনার সন্তানের জন্য কার্যকর শিক্ষা। মনে রাখবেন, আপনি আপনার সন্তানের জন্য উপদেশদাতা হওয়ার চেয়ে রোলমডেল হওয়া বেশি জরুরি, বেশি কল্যাণকর।

বোধের দৈন্যতা: প্রত্যেক মানুষ নিজের ভাল চায়, সন্তানের ভাল চায়, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বোধের দৈন্যতায় মানুষ অনেক সময় নিজেরও ক্ষতি করে এবং সন্তানের জন্যেও বয়ে আনে অপূরণীয় ক্ষতি। যেমন, আপনি চাচ্ছেন আপনার সন্তান ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হোক, কিন্তু আপনার সন্তানের সেটা পছন্দ নয়। তার টেনডেন্সি শিক্ষকতায়। এখন যদি আপনার পছন্দ আপনার সন্তানের পছন্দ না হওয়া সত্ত্বেও তার উপর তা জোর করে চাপিয়ে দেন, এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আমাদের বুঝতে হবে, ব্যক্তি বিশেষে পছন্দ/ঝোঁক ভিন্ন হতেই পারে। আর কারও সহজাত ঝোঁককে অবমূল্যায়ন করে প্রকৃতপক্ষে তার কোনো উপকার করা যায়না।
উন্নত জাতিসমূহের এই সঠিক বোধের প্যারেন্টিংই তাদের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ প্রজন্মের বুনিয়াদ হয়েছে।

এছাড়াও অতিরিক্ত শাসন, বয়স অনুযায়ী স্বাধীনতা না দেওয়া, অন্যের সাথে তুলনা করে চাপে রাখার কৌশল, অতি আদর ইত্যাদি জীবনবিমুখী বিষয়গুলি ব্যাড প্যারেন্টিং এর আওতাভুক্ত ধরা হয়।
সুতরাং, আমরা যদি আমাদের সন্তানদের প্রকৃত কল্যাণার্থে প্যারেন্টিং থেকে এসব খারাপ দিকগুলো বাদ দিয়ে কল্যাণমুখী বিশেষজ্ঞ মতামতভিত্তিক প্যারেন্টিং এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারি, তাহলে আমাদের সন্তানদের জীবনের সুষম সমৃদ্ধির পথ মসৃণ হবে এবং সেই সাথে সহজ হবে কাঙ্ক্ষিত জাতীয় উৎকর্ষতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন।
—-

Level 0

আমি মোঃ ইফরান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 2 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস