কেমন আছেন আপনারা সবাই? অনেক দিন পর আপনাদের জন্য লিখতে বসলাম। আজ আমার আলোচনার বিষয় লিপ ইয়ার নিয়ে। তো চলুন আমাদের আলোচনা শুরু করি।
আমার একটা বন্ধু ছিলো। কিন্তু সে খুবই অভাগা ছিল। সে কখনোই প্রতি বছর তার জন্মদিন পালন করতে পারতো না। কারন সে তার জন্ম তারিখই খুজে পেতো না ক্যালেন্ডারে। প্রতি চার বছর পর পর সে জন্ম তারিখ খুঁজে পেতো। এখন ২০১৬ সাল। সে এ বছর খুবই খুশি। কারণ এ বছর ক্যালেন্ডারে সে তার জন্ম তারিখ দেখতে পাচ্ছে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে তার জন্মদিন। দীর্ঘ চার বছর পর সে কেক কাটবে।
আসলে ওর মত অনেকের জন্য অনেক সময় দুঃখ হয় যাদের জন্ম তারিখ ঠিক ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ। কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই তিন বছর একটা করে দিন থাকে না আর ৪ নাম্বার বছরে একটা দিন উদয় হয়? ছোটকাল থেকেই আমরা জানি এক বছরে থাকে ৩৬৫টা দিন। এর কারণটাও আমরা জানি। তারপরও একবার বলে নিই। কারন ছোট্ট পৃথিবীটাকে বিশাল সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন। যেসব বছরে ৩৬৫ দিন থাকে সেসব বছরেই ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের হয়। কিন্তু আবার কখনো কখনো, ঠিক চার বছর পর পর ফেব্রুয়ারি মাস হয় ২৯ দিনের এবং ৪ নাম্বার বছরের শেষে যোগ হয় আরো একটা দিন, মোট ৩৬৫+১=৩৬৬ দিন পায় বছরটা। আর এই ২০১৬ সালও ৩৬৬ দিনের বছর। এতবড় উদ্ভট কাহিনীটাকে ইংলিশে বলা হয় লিপ ইয়ার আর খাটি বাংলায় অধিবর্ষ।
এইতো মনে হয় বাংলা ক্যালেন্ডার গুলোতে সেদিনই লিপ ইয়ার যুক্ত হল। কিন্তু আসলে সেদিন নয়। ভাষা গবেষক ড.শহীদুল্লাহ ১৯৮৭ সালের দিকে একটা সিদ্ধান্ত দেন যে ইংরেজি সনের মতই বাংলা সনের বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত মাসে ৩০ দিন আর আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ৩১ দিনের রাখবে। এতে করে ফাল্গুন মাসে একটা করে দিন বাড়বে। আর ফাল্গুন মাসটা এজন্য নির্বাচন করা হয়েছিলো কারন এটা এমন যে সেটা ঠিক ঘুরেফিরে ফেব্রুয়ারি মাসেতেই পড়ে। কিন্তু ইসলামিক ক্যালেন্ডারে লিপ ইয়ারের বিষয়টা তেমন ভাবে আসে না, কারন ইসলামিক ক্যালেন্ডার বানানো হয় চাঁদকে কেন্দ্র করে, সূর্যকে নয়।
চলুন এবার জানি ফেব্রুয়ারি কেন ৩০ দিনের হলো না।
Lets go to ইতিহাস:
খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬ সালের দিকে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার আর তার পার্সোনাল সেক্রেটারি 😛 অর্থাৎ জোতির্বিদ সো-সি-জে-নি-স এই দুজন মিলে এটা হিসেব করেন যে পৃথিবীকে পুরো সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসতে আসলে সঠিক সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টার মতো। তখন ৭টা মাসকে গিফট দেয়া হয়েছিলো ৩০ দিন আর ৫টা মাসকে দেয়া হয়েছিলো ৩১ দিন। জুলিয়াস এখানে একটা দুই নাম্বারি করেছিলো। সে করছে কি মাসের গননা শুরু করছে উদ্ভট ভাবে। মানে আমরা এখন জানুয়ারি মাসকে প্রথম মাস জানি, কিন্তু সে এটাকে এগারতম মাসে ফেলে দিয়েছিলো। তাহলে বারোতম মাস ছিলো ফেব্রুয়ারি। আর ৫ম মাসের নামটা ছিলো বিদঘুটে, কুইন্টালিস। এই নামটা জুলিয়াসের পছন্দ হয়নি। সে নিজের নাম জুলিয়াস টাই রেখেছিলো ৫ম মাসটাকে। সেটাই এখন আমাদের সময়ের জুলাই মাস। জুলিয়াসের তান্ডবের পর আরেক সম্রাট তান্ডব চালাতে আসেন নিরীহ মাসগুলোর উপর। তিনি ছিলেন রোমান সম্রাট অগাস্টাস। তিনি তখন ৬ষ্ট মাসের উপর তান্ডব চালায়। তখনকার দিনে ৬ নাম্বার মাসটার নাম ছিলো সেক্সটিলিস। এই সম্রাটও নিজের নাম থেকে অগাস্ট নামটা রাখেন মাসটার, যেটা আমাদের এখনকার অগাস্ট মাস। এই দুই তান্ডবের সম্রাট তখনকার দিনের বছরের শেষ মাস ফেব্রুয়ারি থেকে ১টা করে মোট দুটো দিন ছিনিয়ে নিয়ে জুলাই আর অগাস্টের শেষে যোগ করে দেয়। ফলে এই দুটো মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনের হয়। তাহলে ফেব্রুয়ারি মাসের একটা খুত পাওয়া গেলো তাই নাহ! এইটার দুইটা দিন কম। এই বিষয়টা মনে রাখবেন। পরবর্তীতে কাজে আসতে পারে।
জুলিয়াস ভাই যে হিসাবটা করেছিলো সেটা ছিলো এক বছরে পৃথিবীর পুরো সূর্যকে ঘুরে আসতে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টার কাছাকাছি লাগে। তবে পোপ গ্রেগরি ১৫৮০ সালের দিকে সেটা নিখুঁতভাবে হিসেব করে দেখেন আরো কম সময়টা, শুধু মাত্র ৩৫৬ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের মত। খেয়াল করেন, প্রতি বছর ৩৬৫ দিনের পরেও আমরা ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড পাচ্ছি, কিন্তু সেটা বছর শেষে ক্যালেন্ডার গুলোতে আসছে না। কারন ক্যালেন্ডারে ঘন্টার হিসাবের কোনো স্থান নেই। কিন্তু আবারো খেয়াল করো, যদি প্রতি বছর এই সময়টুকু না ধরে একদম সরাসরি ৪ বছর পর ধরি, তাহলে মোট ৪ গুনন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড হবে। মানে প্রায় চব্বিশ ঘন্টার একটু কম সময় পাবো আমরা যেটা একটা দিনের দৈর্ঘ্যের সমানই প্রায়। কিন্তু কোথায় যাবে প্রতি চার বছরে এই একটা দিন সময়? ক্যালেন্ডারে যদি ৩৬৫ দিন করে প্রতিটি বছর গননা করা হয়? সেই একটা বাড়তি দিনকে প্রতি চার বছর পর পর যোগ করে দেয়া হয়েছিলো ক্যালেন্ডারে। যেই দিনটা গিফট দেয়া হয় ফেব্রুয়ারি মাসকে। তাই ফেব্রুয়ারি মাস চার বছর পর পর ২৯ দিনের হয়। যেটাকে খাটি বাংলায় অধিবর্ষ আর খাটি ইংলিশে লিপইয়ার বলে।
লিপ ইয়ারেরও খুত আছেঃ
একটু আগেই বলেছিলাম পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরতে ঠিক ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা লাগে না, লাগে আরো কম। ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। তাহলে বছর শেষে বাড়তি সময় ঠিক ৬ ঘন্টা পাচ্ছি না, পাচ্ছি ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। তাই আমরা প্রতি বছর বাড়তি সময় পাই
= 6 ঘন্টা – 5 ঘন্টা 48 মিনিট 47 সেকেন্ড
= 11 মিনিট 13 সেকেন্ড
আর প্রতি চার বছরে / লিপ ইয়ারে বাড়তি সময় পাই
= 4 X 11 মিনিট 13 সেকেন্ড
= 44 মিনিট 52 সেকেন্ড
চিন্তা করেন, প্রতি চার বছরে ১ দিন ক্যালেন্ডারে বাড়লেও ৪৪ মিনিট ৫২ সেকেন্ড করে বেড়ে যাওয়াটা ক্যালেন্ডারে উল্লেখ করে না কেউই!!
আরেকটা জিনিস জানেন আপনারা যেটা হলো যেসব সাল গুলোর শেষে দুইটা শূন্য (০০) আছে তারা যদি ৪০০ দ্বারা ভাগ না যায় তবে সেগুলোও লিপ ইয়ার হবে না, মানে তাদের ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়তি একটা দিন যোগ হয়ে ২৯ দিন হবে না, যদিও তারা ৪ দ্বারা ভাগ যায়। যেমন ১৭০০, ১৮০০, ১৯০০ এই তিনটি সালের শেষে দুটো শূন্য আছে ঠিকই কিন্তু তারা ৪০০ দিয়ে পুরোপুরিভাবে ভাগ যায় না। তাই এদের ফেব্রুয়ারি মাসটা ২৯ দিনের হয়নি, ২৮ দিনের হয়েছিলো। কিন্তু ২০০০ সালে ফেব্রুয়ারি মাস ঠিকই ২৯ দিনের হয়েছিলো কারন ২০০০ সংখ্যাটা ৪০০ দিয়ে ভাগ যায়।
কোথায় থেকে আসলো এই ৪০০ বছরের হিসাব?
ধরেন আপনার জন্ম ১৮৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে 😝😝, তাই ঠিক চার বছর পর ১৯০০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯ তারিখ আসার কথা থাকলেও আসবে না, কারন ১৯০০ সংখ্যাটা ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না। তাই আপনার প্রথম জন্মদিন হবে আরো ৪ বছর পরে, ১৯০৪ সালের ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখ। আপনার জন্মের ঠিক আট বছর পর!! আহারে, বেচারা :v :v
প্রতি লিপ ইয়ারে ৪৪ মিনিট ৫২ সেকেন্ড সময়টা যে বেড়ে যায় আমাদের ক্যালেন্ডারে, আসলে সেটাকে কমানোর জন্যই প্রতি ৪০০ বছর পর পর লিপ ইয়ারকে স্থান দেয়া হয়েছে। কারন প্রতি ১০০ বছরের মধ্যে ২৫ টা লিপ ইয়ার থাকার কথা। কিন্তু সেটা না করে বিজ্ঞানীরা প্রথম ৯৬ বছরে চার বছর পরপর মোট ২৪টা লিপ ইয়ারকে বসাইছে। একশতম বছরকে লিপ ইয়ার উপহার দেয়া হয়নি। তাহলে ১০০ বছরে লিপ ইয়ারের জন্য ব্যবহার করা হয় ৯৬টা বছর, তাই ৪০০ বছরে মোট ব্যবহার হয় ৯৬ X ৪ = ৩৮৪টা বছর। আর এই ৩৮৪টা বছরে মোট লিপ ইয়ার হয় ২৪ X ৪ = ৯৬টা।
১টা লিপ ইয়ারে ক্যালেন্ডারে সময় বাড়ে মোট ৪৪ মিনিট ৫২ সেকেন্ড, তাই ৯৬টা লিপ ইয়ারে ক্যালেন্ডারে সময় বাড়ে-
= ৯৬ X ৪৪ মিনিট ৫২ সেকেন্ড
= ৪৩০৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড
= ৭১ ঘন্টা ৪৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড!!
অর্থাৎ ৪০০ বছরের মধ্যে ৩৮৪ বছরে ক্যালেন্ডারে সময় বাড়ে ৭১ ঘন্টা ৪৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড।
আর বাকি রইলো কত? ১৬টা বছর। তাই নাহ! এর মধ্যে ৩৯৬ থেকে শুরু করে চার বছর পর ৪০০ তম বছরকে লিপ ইয়ার গিফট দিলে বাকি ৩৯৬-৩৮৪=১২ টা বছর কিন্তু লিপ ইয়ার পাবে না। ওদের বছর হবে ৩৬৫ দিনের পাক্কা হিসাবে। তখন ১টা বছরে ক্যালেন্ডারে সময় কমবে ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড, ১২টা বছরে ক্যালেন্ডারে সময় কমবে,
=১২ X ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড
= ৬৯ ঘন্টা ৪৫ মিনিট ২৪ সেকেন্ড।
আবার শেষের চারটা বছর লিপইয়ারের হিসাবে আগাবে বলে ক্যালেন্ডারে আবারো সময় বাড়বে
= ১১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড
তাহলে ৪০০ বছরে লিপ ইয়ারের অধিকারী মোট বছর
= ৩৮৪ + ৪ বছর
= ৩৮৮ বছর
তাহলে প্রতি ৪০০ বছরের ৩৮৮টা বছর ক্যালেন্ডারে সময় বেড়ে যায়
= ৭১ ঘন্টা ৪৭ মিনিট ১২ সেকেন্ড + ১১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড
= ৭১ ঘন্টা ৫৮ মিনিট ২৫ সেকেন্ড
আর বাকি ১২টা বছর ক্যালেন্ডারে সময় কমে যায় ৬৯ ঘন্টা ৪৫ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। keep it mind.. খুব কাছাকাছি নাহ এই দুইটা সময়ের মান!! মানে প্রতি ৪০০ বছরের মধ্যে - লিপ ইয়ারের ৩৮৮ বছরে ক্যালেন্ডারে যেটুকু সময় বাড়লো, লিপ ইয়ার ছাড়া বাকি ১২ বছরে ক্যালেন্ডারে যতটুকু সময় কমলো, এরা প্রায় পরস্পর সমান।
মানে ৩৮৮ বছরে ক্যালেন্ডার যেটুকু সময় এগিয়ে গিয়েছিলো, বাকি ১২ বছরে প্রায় সেটুকু সময়ই ক্যালেন্ডার পিছিয়ে গেছে। তাই প্রত্যেক ৪০০ বছর পর ক্যালেন্ডারের হিসাব প্রায় ঠিকঠাক হয়ে যায়। কিন্তু খেয়াল করে দেখেন, সময়ের পার্থক্য পুরোপুরি সমান না, পার্থক্য হচ্ছে-
৭১ ঘন্টা ৫৮ মিনিট – ৬৯ ঘন্টা ৪৫ মিনিট (সেকেন্ডের হিসাব নাই বা ধরলাম)
= ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট (!)
কি সর্বনাশ! প্রতি ৪০০ বছরে ক্যালেন্ডারের সময় বেড়ে যাচ্ছে ২ ঘন্টা ১৩ মিনিটের কাছাকাছি!
এভাবে প্রতি ৪০০ বছর পর পর ক্যালেন্ডারে ২ ঘন্টা ১৩ মিনিট করে বাড়লে কয়েক হাজার বছর পর এই বেড়ে যাওয়া সময় গুলো কোথায় যাবে? কে ওদের সুযোগ দিবে পৃথিবীতে?? সময়ের কোনো জায়গাই নেই পৃথিবীতে। সে শুধু সামনের দিকে চলে। এই হিসাব নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নাই! আমার মাথা ব্যাথা হইলেও সেটা দেখার কারোই সময় নাই.. তবে আপনাদের কারো এ বিষয়ে মাথা ব্যথা থাকলে আমারে জানাতে পারেন। দেখি ব্যথাটা কমাতে পারি কিনা। টিউমেন্ট করে জানাইয়েন। সাথে জানাবেন কেমন হয়েছে। আপনাদের অনুপ্রেরনার আশায় রইলাম।
অসাধারণ লেখেছো রুমি, ডাইরেক্ট নির্বাচিত টিউন মনোনয়ন দিয়ে দিলাম। ভালো টিউনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখ।