ইতিহাসে জগৎবিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী অনেকেই রয়েছেন। তাঁরা যেমন ছিলেন বিজ্ঞানী ও গবেষক, ঠিক ধর্মীয় দিক দিয়ে ছিলেন আলেম, ধর্মপরায়ণ ও আধ্যাত্মিকতার সাধক পুরুষ। ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক মৌলিক বিষয় যাদের নিকট থেকে ধার করা, তাঁদের অন্যতম মুসলিম বিজ্ঞানী হলেন জাবের ইবনে হাইয়ান।
তিনি একইসাথে রসায়ন, বীজগণীত ও বিষবিদ্যার জনক। তাছাড়া আরোও বিভিন্ন বিষয়ের উপর সফল গবেষণা করেছিলেন।
তাঁর পূর্ণ নাম হল আবু মূসা জাবের বিন হাইয়ান বিন আব্দুল্লাহ আল-আজদি আল-কুফী। পশ্চিমারা তাঁর নাম পরিবর্তন করে জিবার বলে থাকে, যেন তাঁর নাম শুনে কেউ বুঝতে না পারে যে উনি একজন আরবীয় মুসলিম বিজ্ঞানী।
তিনি ১০১ হিজরী মোতাবো ৭২১ ঈসাব্দে ইরানের তুস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাইয়ান ছিলেন ইয়ামেনের আরব উপজাতি “আল-আজদ” গোত্রের। তিনি ইরাকের কুফা নগরীতে থাকতেন, যেখানে তিনি সুগন্ধির ব্যবসা করতেন।
জাবের ইবনে হাইয়ান ছেলেবেলা থেকেই জ্ঞান পিপাসু ছিলেন। তাঁর পিতা বুঝতে পারলেন যে, সুগন্ধি তৈরীর জ্ঞানার্জনের জন্য জাবের খুবই উৎসুক। তাই পিতা হাইয়ান তাঁকে এর নিয়ম শিক্ষা দেন।
যখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর, তখন তুসের একটি মসজিদে মহাপবিত্র আল-কোরআনের হাফেজ হন।
পিতার মৃত্যুর পর মায়ের সাথে পিতৃালয় ইয়ামেনে ফিরে যান। সেখানে থেকে আরব সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা শুরু করেন।
তিনি সেখানে হারবী আল হামেরীর কাছে অধ্যয়ন করতে থাকেন। তিনি তথায় খালিদ বিন ইয়াজিদের বই অধ্যয়ন করেন। তবে জাবের ব্যক্তিগতভাবে খালিদ বিন ইয়াজিদের সাথে দেখা করেননি। খালিদ বিন ইয়াজিদ হলেন রসায়ন সম্পর্কে কথা বলা প্রথম ব্যক্তি।
জাবের বড় হওয়ার পর, তিনি নিজেকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে জ্ঞান অন্বেষণ করতে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত করলে তাঁর মা সাথে যেতে চাইলেন। ফলে একা না গিয়ে তাঁর মাকে সাথে নেন ও সঙ্গে বই-পুস্তকগুলোও নিয়ে যান।
জাবের ইবনে হাইয়ান, যাহাব নামের এক মেয়েকে বিয়ে করেন। তার থেকে জাবেরের তিনটি ছেলে সন্তান হয়েছিল। বড় জনের নাম মূসা, আব্দুল্লাহ মেঝো ছেলে এবং ছোট ছেলে ইসমাঈল।
জাবের আরবে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার তৈরি করেছিলেন। সেখানে তিনি রসায়ন নিয়ে গবেষণা করতেন। তাঁর পূর্ববর্তী অনেক বইয়ের তথ্যকে তিনি ভুল প্রমাণ করেন। রসায়নে আসে এক নতুন দিগন্ত।
তাঁর প্রথম আবিষ্কারের পর তিনি তাঁর মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে হজ্বে গমন করেন। জাবির ইবনে হাইয়ানের বয়স যখন পয়তাল্লিশ বছর, তখন তাঁর প্রিয় দুজন ব্যক্তি তাঁর মা এবং প্রখ্যাত আলেম জাফর সাদেক মারা যান।
জাবের বিন হাইয়ান বাগদাদে পণ্ডিত, উচ্চবিত্ত, সাধারণ মানুষ এবং অন্যান্যদের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। খলিফা হারুন আল-রশিদ ক্ষমতা গ্রহণ করলে জাবেরের খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। তিনি নিত্যনতুন আবিষ্কার করতে থাকেন।
জাবের ইবনে হাইয়ানের কয়েকটি উপাধী রয়েছে। যেমন,
প্রায় ১৯৪ হিজরি মোতাবেক ৮১৪ ঈসাব্দে ইরাকের কুফা নগরীতে থাকাবস্থায় জাবের ইবনে হাইয়ান যখন অনুভব করলেন যে তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে, তখন তিনি উঠে অযু করলেন এবং ফজরের নামায পড়লেন। তখন নামাজে শেষ সিজদাবনত অবস্থায় ইহকাল ত্যাগ করেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন।
জাবের ইবনে হাইয়ান এমন অনেক পরিভাষা তৈরি করেছিলেন যা পশ্চিমারা এখনও ব্যবহার করে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে- রসায়ন, অ্যালেম্বিক, অ্যালকোহল, ক্যাফর, ক্ষার, এলিক্সির, অ্যাম্বার, অ্যালুম, অ্যান্টিমনি, সিনেবার, জিপসাম, আমলগাম এবং সোডা।
পরিভাষাগুলোর মূল আরবী ও ইংরেজী হল الكيمياء-Chemistry, الأمبيق-alembic, الغول-Alcohol, الكافور-Camphor, القلويات-Alkali, الإكسير-Elixir, العنبر-Amber, ألوم-Alum, الانتيمون-Antimony, سينابار-Cinnabar, جبس-Gypsum, الملغم-Amalgam, الصودا-soda
জাবির ইবনে হাইয়ান দর্শনের উপর তিনশ বই লিখেছেন। যুদ্ধের যন্ত্র তৈরির উপর এক হাজার তিনশ গ্রন্থ রচনা করেছেন। চিকিৎসার উপর একটি বিশাল বই লিখেছেন। ঔষধের উপর পাঁচশত বই লিখেছেন।
অ্যারিস্টটলের মতানুসারে যুক্তিবিদ্যার উপর বই লিখেছেন। ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতার উপর লিখেছেন এক হাজার বই। তিনি দার্শনিকদের পাঁচশত বই খন্ডন করে অনেকগুলো বই লিখেছেন। কারুশিল্পের উপর একটি বই রচনা করেন। কিতাবুর রহমত নামে একটি বই রচনা করেন, যার মধ্যে ধাতুকে স্বর্ণে রূপান্তর করার আলোচনা করেছেন।
তিনি বিষবিদ্যার উপর বই লিখেছেন। তাঁর বইটির ইংরেজী অনুবাদ The Book of Poisons and Repelling Their Harm, বইটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত।
বইটিতে বিষের নাম এবং প্রকারভেদ, মানুষ ও প্রাণীর উপর বিষেে বিভিন্ন প্রভাব, বিষক্রিয়ার লক্ষণ ও তার চিকিৎসা, বিষ থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
এতে বিষগুলোর আলোচনা ছিল বিভিন্ন উৎসে বিভক্ত। প্রাণীর বিষ যেমন, সাপ, বিচ্ছু ও অন্যান্য প্রাণী। গাছপালার বিষ যেমন, আফিম, তিক্ত তরমুজ। পাথরের মধ্যে পারদ, আর্সেনিক ও ভিট্রিওল ইত্যাদি।
তিনি অসংখ্য বই লেখেন যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। এগুলো ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক কিছুর মূলভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নেতৃস্থানীয় বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ইংরেজ দার্শনিক "বেকন" তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন: "জাবের ইবনে হাইয়ানই প্রথম যিনি বিশ্বকে রসায়নবিদ্যা শেখান, তিনিই রসায়নের জনক।
আমি মুফতি রাকিবুল ইসলাম হোযায়ফী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 7 টি টিউন ও 2 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
প্রযুক্তি যেন আপনাকে আল্লাহকে ভুলিয়ে না দেয়।