প্রিয় টিউনাররা, সবাইকে আবারও সালাম এবং শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজ আমার টিউনের বিষয় আবিষ্কারকদের গুরু এডিসনকে নিয়ে। আমি এর আগেও কিছু স্মরণীয় ব্যক্তিদের নিয়ে টিউন করেছি। আশা করি আপনারা সেসব টিউন থেকে নতুন কিছু শিখতে পেরেছিলেন। তাইতো আজ আমি আপনাদের জানাতে এলাম ইতিহাসের অন্যতম আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসন সম্পর্কে। এ টিউনে আপনারা তার জিবন, আবিষ্কার ও তার জীবনের কিছু মজাদার ঘটনা। তো আর কথা না বাড়িয়ে আপনাদের দোয়া সাথে নিয়ে শুরু করছি আমার আজকের টিউন।
টমাস আলভা এডিসন ছিলেন একজন মার্কিন উদ্ভাবক এবং সফল ব্যবসায়ী। তার জন্ম ১৮৪৭ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি। তিনি গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরা এবং বাল্ব সহ বহু যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। তার এসব উদ্ভাবন বিংশ শতাব্দীর জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। এবং এখনো সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন লক্ষ্য কোটি বার তার আবিষ্কৃত জিনিস ব্যবহার করা হয়।
এডিসন ইতিহাসের অতিপ্রজ বিজ্ঞানীদের অন্যতম একজন বলে বিবেচিত হন। তার নিজের নামে ১,০৯৩টি মার্কিন পেটেন্টসহ যুক্তরাজ্যে, ফ্রান্স এবং জার্মানির পেটেন্ট রয়েছে। টেলিযোগাযোগ খাতে তার বহু উদ্ভাবনের মাধ্যমে তার অবদানের জন্য তিনি সর্বস্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে তার আবিষ্কার গুলোর মধ্যে রয়েছে স্টক টিকার, ভোট ধারনকারী যন্ত্র, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারী, বৈদ্যুতিক শক্তি, ধারনযোগ্য সংগীত এবং ছবি। তিনি তার জীবনের শুরুর দিকে একজন টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ করেছেন। বাসস্থান, ব্যবসায়-বানিজ্য বা কারখানায় বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ও বন্টনের ধারনা এবং প্রয়োগ দুটিই এডিসনের হাত ধরে শুরু হয় যা আধুনিক শিল্পায়নের একটি যুগান্তকারী উন্নতি। নিউইয়র্কের ম্যানহাটন দ্বীপে তাঁর প্রথম বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়। এই মহান বিজ্ঞানীর জীবনাবসান ঘটে ১৯৩১ সালের ১৮ই অক্টোবর।
একজন মহান ও চিরস্মরণীয় বিজ্ঞানী, যার বিখ্যাত আবিষ্কারগুলো মানুষের জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। কিন্তু জানতে কি ইচ্ছা করে না, তার ছেলেবেলা সম্পর্কে? চলুন তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠার দিনগুলোর কথা জেনে নিই।
১৮ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও-র মিলান শহরে জন্ম নেন এডিসন। তার বাবার নাম স্যামুয়েল এডিসন ও মার নাম ন্যান্সি এডিসন। তাদের সবচেয়ে ছোট এবং সপ্তম সন্তান ছিলেন এডিসন। এডিসনের বাবা স্যামুয়েল ছিলেন কানাডা থেকে নির্বাসিত একজন রাজনৈতিক কর্মী। স্কুলশিক্ষিকা মায়ের প্রভাব অনেক বেশি ছিল এডিসনের প্রতি। অল্প বয়সেই জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছিলেন এডিসন। বড় হতে হতে একরকম বধির হয়ে যান তিনি। ছোটবেলায় এটার জন্য নানা সমস্যায় পড়লেও বড় হয়ে সবার কাছে আজগুবি সব গল্প বানিয়ে বলতেন। তার আজগুবি গল্পগুলোর মধ্যে একটি হলো ট্রেন দুর্ঘটনায় কানে আঘাত পাওয়ার পর থেকে কানে কম শুনা।
১৮৫৪ সালে এডিসনের পরিবার চলে যায় মিশিগানের পোর্ট হুরনে। সেখানেই স্কুলে যোগ দেন এডিসন। কিন্তু তার স্কুল জীবন তিন মাসের বেশি ছিল না। তিনি অসম্ভব মেধার অধিকারী ছিলেন। স্কুলের গন্ডিবাঁধা পড়াশুনা তাঁর নিকট একঘেঁয়েমি মনে হত। পড়াশুনায় কোনো মনোযোগ নেই, শিক্ষকদের অভিযোগ শুনে ক্ষুব্ধ হতেন। স্কুলের শিক্ষকরাও তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন না। রেভেরেন্ড অ্যাঙ্গল নামের এক শিক্ষককে একদিন পেছন হতে 'বোকা' বলেছিলেন এডিসন। এতে ভীষণ ক্ষেপে যান তিনি। ফলস্বরূপ তিন মাসেই স্কুলজীবনের সমাপ্তি ঘটে এডিসনের। এর পর আর কোনদিন স্কুলে যাননি এডিসন। শিক্ষকদের এই বিরূপ আচরণ ছোট্ট এডিসনের মনে যেন খারাপ প্রভাব না ফেলে সেজন্য স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে এডিসনের মা। তারপর থেকে তার মা-ই তার শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করে গেছেন। তিনি বাসায় বসেই তাঁকে পড়ানো শুরু করেছিলেন।
মাত্র ১১ বছর বয়সেই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রচুর বই পড়ে ফেলেন এডিসন। জ্ঞানচর্চায় তাঁর আগ্রহ প্রকাশ পায় ব্যাপক ভাবে। ১২ বছর বয়সে এডিসন ভাবলেন তিনি যা শিখেছেন, সেগুলোকে কাজে লাগানো উচিত। বাবা-মায়ের কাছে অনুমতি চাইলেন বাড়ির কাছে গ্র্যান্ড ট্র্যাংক রেইল রোড লাইনে পত্রিকার হকার হিসেবে কাজ করার। হকার হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর এ্ক সময় এডিসন জানতে পেলেন একটি ছোট ছাপাখানা যন্ত্র কম দামে বিক্রি হবে। তিনি যে সামান্য অর্থ জমিয়েছিলেন তাই দিয়ে ছাপাখানার যন্ত্রপাতি কিনে ফেললেন। এডিসন নিজেই ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক হেরাল্ড’ নামের ছোট একটি পত্রিকা বের করা শুরু করেন। একদম নতুন তরতাজা খবর থাকায় ট্রেনযাত্রীরা এডিসনের পত্রিকা পড়া শুরু করেন। একইসঙ্গে সংবাদ সংগ্রহ করা, সম্পাদনা করা, ছাপানো, বিক্রি করা সহ সমস্ত কাজ করতেন। অল্পদিনেই তাঁর কাগজের বিক্রির সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। লাভ হল একশো ডলার।
নানা বিষয়ে আগ্রহ থাকার কারণে এডিসন নতুন কিছু পেলেই খুঁটিয়ে দেখতেন এডিসন। একদিন এডিসন লক্ষ করলেন, একটি ছেলে রেল লাইনের উপর খেলা করছে। দূরে একটি ওয়াগন এগিয়ে আসছে। ছেলেটির সেদিকে নজর নেই। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে হাতের কাগজ ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন লাইনের উপর। আর ছেলেটি কেউ নয়। স্টেশন মাস্টারের একমাত্র ছেলে। কৃতজ্ঞ স্টেশন মাস্টার যখন এডিসনকে পুরষ্কার দিতে চাইলেন, এডিসন সে সময় টেলিগ্রাফ শেখবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কারণ স্টেশন মাস্টার ছিলেন টেলিগ্রাফ অপারেটরও। স্টেশন মাস্টার রাজি হলেন মহানন্দে। আর কয়েক মাসের মধ্যেই এডিসন টেলিগ্রাফি শেখা রপ্ত করে নিলেন। এর সঙ্গে সাংকেতিক লিপি ও তার অর্থ বুঝতে সক্ষম হলেন। ১৫ বছর বয়সে টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ করা শুরু করেন এডিসন। পরের পাঁচ বছর আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে কাজ করেন তিনি। এর মধ্যেই টেলিগ্রাফ এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের প্রযুক্তি নিয়ে প্রচুর লেখাপড়া ও গবেষণা করেন তিনি।
১৮৬৬ সালে ১৯ বছর বয়সে কেন্টাকির লুইসভিলে চলে যান এডিসন। সেখানে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের হয়ে কাজ শুরু করেন। রাতের পালায় ডিউটি থাকায় সে সময় তিনি লেখাপড়া এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ করতেন। ১৮৬৮ সালে এডিসনের বাবা-মা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁদের দেখতে বাড়িতে ফিরে যান এডিসন। বুঝতে পারেন এখন থেকে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। বাড়ি থেকে এডিসন চলে যান বোস্টনে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন কোম্পানির হয়ে কাজ শুরু করেন। সে সময় বোস্টন ছিল আমেরিকার বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। এডিসন এই সুযোগটাকে কাজে লাগান। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরির কাজে হাত দেন। এভাবেই তৈরি করে ফেলেন ইলেকট্রনিক ভোটিং রেকর্ডার, যার মাধ্যমে খুব অল্প সময়েই সুষ্ঠুভাবে ভোট গণনা করা যেত। ধীরে ধীরে বোস্টনে এডিসনের পরিচিতি বাড়তে থাকে। তাঁর উদ্ভাবিত পণ্য মানুষ কিনতে শুরু করে এবং এডিসন আরো নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
তিনি ১৮৬৯ সালে বোস্টনে চাকরিরত অবস্থায় একটি যন্ত্র আবিষ্কার করলেন যা দিয়ে ভোল্ট গণনা করা যায়। এই যন্ত্রের গুণাগুণ বিবেচনা করে উদ্ভাবক হিসেবে তাঁকে পেটেন্ট দেওয়া হল। আর এই পেটেন্ট এডিসনের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এরপর বোস্টন শহর ছেড়ে চলে এলেন নিউইয়র্কে। হাতে মোটেও পয়সা নেই। খাওয়া হয়নি দুদিন ধরে। এক টেলিগ্রাফ অপারেটরের সাথে পরিচয় ঘটল। সে এডিসনকে এক ডলার ধার দিয়ে গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানির ব্যাটারি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেখানে দুদিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন তিনি খেয়াল করলেন ট্রান্সমিটারটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। ম্যানেজারের অনুমতিক্রমে তিনি অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রান্সমিটারটি মেরামত করে ফেললেন। এর ফলে তিনি কারখানার ফোরম্যান হিসেবে চাকরি পেলেন। তাঁর মাইনে ছিল ৩০০ ডলার। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজের যোগ্যতা বলে ম্যানেজার পদে উন্নীত হলেন।
এডিসন ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। একবার স্টাফোর্ড জংশনে রাত্রিবেলায় ট্রেন ছাড়ার সিগনাল দেওয়ার কাজ পেলেন। রাত জেগে কাজ করতে হত এবং দিনের বেলায় সামান্য কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়ে নিজের গবেষণার কাজ করতেন। এ সময় তিনি একটি ঘড়ি তৈরি করলেন যেটি আপনা থেকেই নির্দিষ্ট সময়ে সিগনাল দিত। এর পরে বোস্টন শহরে কাজ করার সময় দেখতে পেলেন অফিস জুড়ে ভীষণ ইঁদুরের উৎপাত। তিনি হঠাৎ করে একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করলেন যা সহজেই ইঁদুর ধ্বংস করতে সক্ষম। তারপর তার জনপ্রিয়তা আর কে আটকায়। এই অর্থ দিয়ে তিনি নিজের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে গবেষণার কাজে লাগাতেন।
গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানি টেলিগ্রাফের জন্য এক ধরনের যন্ত্র তৈরি করত যার ফিতের উপর সংবাদ লেখা হত। এ সময় এডিসনের মনে হল বর্তমান ব্যবস্থার চেয়ে আরো উন্নত ধরনের যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব। এজন্যে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার। এ সময় চাকরিতে ইস্তফা দিলেন এডিসন। কয়েক মাস প্রচণ্ড পরিশ্রমের পর উদ্ভাবন করলেন এক নতুন যন্ত্র। এটি আগের চেয়ে অনেক উন্নত এবং সেই সঙ্গে এর উৎপাদন ব্যয়ও কম। তিনি এ যন্ত্রটি নিয়ে গেলেন গোল্ড ইনডিকেটর কোম্পানীর মালিকের নিকট। এতে মালিক খুশি হলেন। এডিসনকে জিজ্ঞাসা করলেন,
কত দামে সে যন্ত্রটি বিক্রি করবে?
এডিসন দ্বিধান্বিতভাবে বললেন,
যদি পাঁচ হাজার ডলার দাম বেশি হয়, আবার তিন হাজার ডলার খুব কম হয় তবে কোম্পানী স্থির করুক তারা কি দামে যন্ত্রটি কিনবে।
কোম্পানীর মালিক এডিসনকে চল্লিশ হাজার ডলার দিয়ে বললেন,
আশা করি আপনাকে আমরা সন্তুষ্ট করতে পেরেছি।
এডিসন তো হতবাক! এই প্রচুর অর্থ বিজ্ঞানী এডিসনের জীবনে এক অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিল। এতদিন তিনি অন্যের অধীনস্থ হয়ে কাজ করতেন। সেখানে তাঁর স্বাধীনতা ছিল না। এবার কয়েক মাসের চেষ্টায় নিউজার্সিতে তৈরি হল তাঁর কারখানা। তিনি সেখানে দিবারাত্রি কাজ করতেন। রাত্রে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিতেন। এ কারখানাটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি গবেষণাগার। কয়েক বছরের মধ্যেই এডিসন প্রায় ১০০টির বেশি নতুন উদ্ভাবন করে তার পেটেন্ট নিলেন। এগুলি বিক্রি করে পেলেন প্রচুর অর্থ।
এডিসন এবার নিজের কারখানায় কাজ করতে করতে পুনরায় আকৃষ্ট হলেন টেলিগ্রাফির দিকে। অল্পদিনেই তৈরি হল ডুপ্লেক্স টেলিগ্রাফ পদ্ধতি। এর সাহায্যে দুটি বার্তা একই সাথে একই তারের মধ্যে দিয়ে দুই দিকে পাঠানো সম্ভব। এরপরে একই সময়ে একই তারের মধ্যে দিয়ে একাধিক বার্তা প্রেরণ করতে সক্ষম হলেন। আর এই পদ্ধতির সাহায্যে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার যে শুধু অসাধারণ উন্নতি হল তাই নয়, বরং খরচও কয়েকগুণ হ্রাস পেয়ে গেল।
তিনি ১৮৭৬ সালে তাঁর নতুন কারখানা স্থাপন করলেন মেনলো পার্কে। এখানে একদিকে তাঁর গবেষণাগার অন্যদিকে কারখানা। এই মেনলো পার্কে বিজ্ঞানী এডিসনের প্রথম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার টেলিফোন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল আবিষ্কার করেছিলেন টেলিফোন, কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা দেখা গিয়েছিল। এডিসন কয়েক মাসের চেষ্টায় তৈরি করলেন কার্বন ট্রান্সমিটার। আর এর সহায়তায় গ্রাহকদের প্রতিটি কথা স্পষ্ট এবং পরিষ্কারভাবে শোনা গেল। চতুর্দিকে সুনাম ছড়িয়ে পড়ল এডিসনের। এডিসন দীর্ঘদিন মানুষের শ্রবণ যন্ত্র নিয়েও কাজ করেছিলেন।
তিনি স্থির করলেন ইলেকট্রিক কারেন্টকে কাজে লাগিয়ে আলো জ্বালাবেন। সে সময় এক ধরনের বৈদ্যুতিক আলো ছিল কিন্তু তা ব্যবহারের উপযোগী ছিল না। প্রথমেই তিনি এমন একটি ধাতুর সন্ধান করেছিলেন যার মধ্যে কারেন্ট প্রবাহিত করলে উজ্জ্বল আলো বিকিরণ করে। তিনি বিভিন্ন রকমের ধাতু নিয়ে ১৬০০ রকমের পরীক্ষা করলেন। অবশেষে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তৈরি করলেন কার্বন ফিলামেন্ট। তিনি শুধু বাল্বের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলেন। এরপর সমগ্র বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনে তৎপর হলেন। তিনি তৈরি করলেন নতুন এক ধরনের ডাইনামো, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জেনারেটর থেকে শুরু করে ল্যাম্প তৈরি করা প্রভৃতি। নিউইয়র্কে প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র গড়ে উঠল যার অগ্রনায়ক ছিলেন বিজ্ঞানী এডিসন।
সে সময় নতুন আবিষ্কার হওয়া টেলিগ্রাফ যন্ত্রের একটা ত্রুটি ছিল। বহু দূরের দুই টেলিগ্রাফ কেন্দ্রের মাঝখানে যে কেন্দ্রগুলি ছিল সেগুলি আর দিক থেকে পাঠানো খবর গ্রহণ করতে ও তাতে পরিবর্তন করতে পারত। ফলে গোপনীয়তা বলতে কিছু থাকত না। এডিসন এই ত্রুটিটি ঠিক করে দিয়েছিলেন। সে কালে টেলিগ্রাফ যন্ত্রের একটি তার দিয়ে একটি খবরই পাঠানো যেত। এডিসন এক সঙ্গে অনেকগুলো খবর বিকৃতি ছাড়া পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। টেলিগ্রাফ সম্পর্কিত গবেষণা করতে করতে তিনি পাশাপাশি আরও কয়েকটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এ রকমই একটি যন্ত্রের নাম ‘রেমিংটন টাইপরাইটার’।
কিছু দিন পর আবিষ্কার করেন ‘মিমিওগ্রাফ’ নামের একটি যন্ত্র। এটি দিয়ে টাইপরাইটার বা হাতে লেখা চিঠি যত ইচ্ছা তত কপি করা যায়।
তিনি আবিষ্কার করেন ‘ফনোগ্রাফ’ নামক যন্ত্রটি। একটি ডায়াফ্রেমের সামনে কথা বললে সেটি কাঁপতে থাকে। এই কাঁপুনি একটি সুইচ দ্বারা নীচে রাখা ঘুর্ণায়মান মোমের সিলিন্ডারে দাগ ফেলতে থাকে। পরে সিলিন্ডারটি আবার প্রথম থেকে ঘোরালে ডায়াফ্রেমে পূর্বে উচ্চারিত কথাগুলো স্পষ্ট শোনা যায়। আধুনিক সিডি প্লেয়ারের এই প্রাথমিক ও সরল যন্ত্রটি আবিষ্কার করতে এডিসনকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল।
এডিসনের সব চেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী আবিষ্কার হল বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কার। আকাশের বিদ্যুতকে মানুষ তখন ব্যাটারিতে আটকাতে পেরেছিল। তার পরও কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি যে তা থেকে আলো পাওয়া সম্ভব। এডিসন নিজ মেধা ও প্রচেষ্টায় সেই অলৌকিকতাকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন। ১৮৭৯ সালে অক্টোবর মাসে তিনি স্থানীয় পার্ক বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন। আধুনিক যুগের সিনেমার আবিষ্কারকও ছিলেন তিনি। ১৮৯৭ সালের ২৭ এপ্রিল নিউইয়র্কে হাজার হাজার দর্শকের সামনে এডিসন তাঁর ‘কাইনেটোস্টোপ’ নামক যন্ত্রের সাহায্যে চলমান ছবি দেখিয়েছিলেন। শিল্প জগতে জন্ম দিয়েছেন নতুন একটি যুগের। তিনি সিমেন্ট, আধুনিক সহজে বহনযোগ্য ব্যাটারি, রাবার ইত্যাদি আবিষ্কার করেছেন।
পেটেন্ট অফিস থেকে জানা যায় এডিসন তাঁর সারাজীবনে মোট ১৪০০ যন্ত্রের জন্য পেটেন্ট নিয়েছেন। এ থেকেই তাঁর প্রতিভার বিস্তৃতির পরিমাপ আন্দাজ করা যায়। তিনি অনেক আবিস্কারের পথপ্রদর্শন করে গেছেন। নিজে চেষ্টা করে যদিও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, তবুও পরবর্তীতে তাঁর ধারণাকে পুঁজি করেই এসব তৈরি করা হয়। নিচে সেরকম কতগুলো চেষ্টার কথাই তুলে ধরা হলোঃ
১৮৭৬ সালে এডিসনের আবিষ্কৃত একটি যন্ত্রকে বলা যায় আধুনিক উল্কিযন্ত্রের পূর্বসূরি। অবশ্য তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চিকন সুচ দিয়ে কাগজে ছাপার ব্যবস্থা করা। ১৮৯১ সালে স্যামুয়েল ও'রেলি প্রথম উল্কি আঁকার যন্ত্রের পেটেন্ট নেওয়ার পর এডিসনকে নকলের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। লোকের ধারণা ছিল যন্ত্রে আঁকা উল্কি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। তাই রেলির কাছে সবসময় উল্কিপ্রেমীদের ভিড় লেগেই থাকত। ও'রেলির সঙ্গে এডিসনের সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। তবে এক বীমা কোম্পানির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছক্কার ঘুঁটির মত পাঁচ ফোটার একটি উল্কি ছিল তাঁর বাম কব্জিতে।
১৮৯০ সালের দিকে খনি থেকে নিষ্কাশন করা লোহার মূল্য ধাই ধাই করে বাড়ছিল। চুম্বক ব্যবহার করে অপদ্রব্য থেকে লোহা আলাদা করার কথা ভাবলেন এডিসন। ১৪৫টি খনিতে প্রবেশ করার অনুমতি নিলেন। প্রচুর পয়সা ঢাললেন একটা যন্ত্র তৈরির পেছনে। কিন্তু কিছু কৌশলগত গোলযোগে সব চেষ্টা বিফলে গেল। ততদিনে লোহার মূল্য পড়তির দিকে। বাধ্য হয়ে গবেষণা থামিয়ে দিলেন মাঝপথে। তবে তাঁর দেখানো পথ ধরে এখন বৈদ্যুতিক চুম্বক ব্যবহার করে ওই কাজ করা হচ্ছে।
বিদ্যুতের মিটার কোথায় নেই! আর ওটাও এসেছে এডিসনের মাথা থেকে। বিদ্যুতের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে এডিসনই প্রথম তৈরি করেন মিটার। এতে দুটি দস্তার পাত জিংক সালফেট দ্রবণে ডোবানো থাকত। বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার অনুযায়ী এক পাতের দস্তা গলে অন্য পাতে জমা হতো। মাসের শেষে পাতটি ওজন করে বের করা হত ব্যবহারের পরিমাণ।
বাতি আবিষ্কারের পথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছিলেন এডিসন। বায়ুশূন্য টিউব নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে মাথায় আসলো ফলমূল সংরক্ষণের উপায়। তিনি বললেন,
'টিউবে পচনরোধী তরলে মৌসুমি ফল ও শাকসবজি রেখে ভেতরের বায়ু টেনে বের করে নিতে হবে। তারপর টিউবের মুখ বন্ধ করে রেখে দেওয়া যাবে বহুদিন।'
গাড়ির চাকা ঘোরাতে এডিসন ব্যাটারির শক্তি ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন। পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ব্যাটারিও বানিয়ে ছিলেন। তবে তিনি এমন এক ব্যাটারি বানাতে চেয়েছিলেন যা একবার চার্জ করলে একশ মাইল নির্বিঘ্নে চলতে পারে। কিন্তু ১০ বছর চেষ্টা শেষে রণে ভঙ্গ দিলেন, কেননা ততদিনে গ্যাসোলিন জ্বালানি সবার নাগালে আসতে শুরু করেছে। তাঁর পরিশ্রম একেবারে বৃথা যায়নি। সিগন্যাল বাতি বা খনিতে বহনযোগ্য আলো জ্বালাতে ওই ব্যাটারি কাজে লেগে গেল। একসময় এডিসনের ব্যাটারি সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসাতেও পরিণত হয়।
আলো ঝলমলে জীবনের পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন কম দামে নিরাপদ ঘর। উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কনক্রিট, গড়ে তুললেন এডিসন সিমেন্ট কম্পানি। তাঁর ফর্মুলায় বাড়ি বানানোর প্রক্রিয়াটাও সহজ। কাঠ দিয়ে ফাঁপা কাঠামো গড়ে মাঝে ঢেলে দিতে হবে কনক্রিট। কয়েকদিন পরে জমাট বাঁধলে কাঠ সরিয়ে নিলেই হলো। পদ্ধতিটা খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। দক্ষ কারিগরের অভাব যেমন ছিল, তেমনি বাড়িগুলোও অতটা দৃষ্টিনন্দন হতো না। তবে এখন অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে তাঁর সেই কৌশলের আধুনিক সংস্করণ।
কনক্রিটের ভূত ভালোভাবেই ঢুকেছিল এডিসনের মাথায়। তা না হলে আসবাব গড়তেও সবার আগে কনক্রিটের চিন্তা আসবে কেন? যুক্তি ছিল, ওজন একটু বেশি হলেও এ আসবাবের গ্যারান্টি আজীবনের। মাত্র দুই’শ ডলারে গ্রাহকের ঘর সাজিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ১৯১১ সালে বাথটাব, পিয়ানো ও কেবিনেট তৈরি করে প্রদর্শনীর জন্য পাঠান নিউইয়র্কে। টেকসই আসবাবের শক্তি পরীক্ষায় বহনকারী কর্মীদের ওপর নির্দেশ ছিল, যেভাবে খুশি খামখেয়ালিপনায় আসবাব বহন করা যেতে পারে। কিন্তু প্রদর্শনীর দিন এডিসনকে কোথাও দেখা গেল না। কথিত আছে, জিনিসগুলো সে যাত্রায় টিকতে পারেনি।
গ্রামোফোনের পেটেন্ট নেওয়ার পর এর বহুমুখী ব্যবহারের চিন্তা করেছিলেন। এরপর বানালেন কথা বলা পুতুল। পুতুলের শরীরে বসানো হতো খুদে গ্রামোফোন, হাত-পা জোড়া হতো আলাদাভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের ছোট্ট মেয়েদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কারখানায়। তাদের মর্জিমাফিক গান-কবিতা রেকর্ড করে সরবরাহ করতেন। রেকর্ডিং তখন সবে প্রাথমিক পর্যায়ে। পুতুলের ভেতরে গান বাজত কখনো প্রায় নিঃশব্দে, কখনো বিকট ঘড় ঘড় শব্দে। বাজখাই স্বরের পুতুলগুলো শিশুরা মোটেও ভালোভাবে গ্রহণ করেনি।
১৯২১ সালে তাঁর ৭৫ বছর পূর্ণ হয়। নিউইয়র্কের টাইমস পত্রিকা আমেরিকার মধ্যে সব চাইতে জনপ্রিয় ব্যক্তি কে, তা যাচাইয়ের জন্য একটি সমীক্ষা করে। ফলাফল অনুসারে দেখা যায় সব চাইতে জনপ্রিয় ব্যক্তি টমাস আলভা এডিসন। ফ্রান্সে তাঁকে দেওয়া হয় ‘কমান্ডার অব লিজিয়ন অনার’ উপাধি, ইতালিতে তাকে ‘কাউন্ট’ উপাধি দেওয়া হয়। তাঁর নিজ দেশ আমেরিকায় তিনি দেশসেবার জন্য স্বর্ণপদক সহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন, ভূষিত হয়েছেন বহু সম্মানজনক উপাধিতে। সরকার এডিসনের ছবি ও তাঁর আবিষ্কৃত প্রথম বৈদ্যুতিক বালবের ছবি দিয়ে ডাকটিকিট বের করেছিল। তিনি পৃথিবীতে রেখে গেছেন অসংখ্য আবিষ্কার যা তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে।
আমি আবু হাসান রুমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 16 টি টিউন ও 156 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
এতো বড় টিউন কেমনে করো রুমি? আমি তো পুরাই ইমপ্রেসড! প্রিয়তে রাখলাম। তোমার সবগুলো টিউন মিলিয়ে জীবনী সংকলন বের করুম। তুমি কি বলো?