প্রিয় টিউনাররা,
আমি রুমি। আপনাদের কাছে আবারও ফিরে আসলাম স্টিভ জবস ও অ্যাপল সমগ্র নিয়ে। চলুন আর কথা না বারিয়ে কাজে চলে যাই।
স্টিভ জবসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ-
স্টিভ জবস, তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম একজন উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবক। তিনি পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ হিসেবেও স্বীকৃত। তিনি স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন-এর সাথে একত্রিত হয়ে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি পিক্সার এ্যানিমেশন স্টুডিওস-এরও প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৮৫ সালে অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্যদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে তিনি অ্যাপল ইনকর্পোরেশনের থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং নেক্সট কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে অ্যাপল কম্পিউটার যখন নেক্সট কম্পিউটারকে কিনে নেয়, তখন তিনি অ্যাপলে আবার ফিরে আসেন। তিনি ১৯৯৫ সালে "টয় স্টোরি " নামের একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রও প্রযোজনা করেছেন।
স্টিভ জবস ছিলেন কলেজ পালানো এক যুবক। তরুণ বয়সে মাদকও নিয়েছেন। ঘরছাড়া সন্ন্যাসী হবার ঝোঁকও ছিলো তার। তিনি ভারতবর্ষ ভ্রমণেও এসেছেন। কিন্তু সবকিছুতেই তার মধ্যে একঘেমেয়ি ছিলো। একথা স্টিভ নিজেই স্বীকার করেছেন। স্টিভের নিজের বক্তব্যেই ফুটে উঠেছে, ‘সাফল স্টিভ জবস একঘেমেয়িতে তৈরি।’
এখন চলুন তার জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
জীবনবৃত্তান্তঃ
স্টিভেন পল জবস ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। স্টিভ জবস, স্টিভ ওজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েন মিলে ১৯৭০ সালে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি পিক্সার স্টুডিও এবং নেক্সট নামে আরো দুটি সফল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জবস জন্মেছিলেন স্যান ফ্রান্সিস্কোতে। কিন্তু সুখকর ছিলো না তার ছোটোবেলা। জন্মের পরপরই তাকে দত্তক দিয়ে দেয়া হয়। পল ও ক্লারা জবস দম্পত্তি তাকে দত্তক নেন। তার নাম রাখা হয় স্টিভেন পল জবস। সামান্য ভালো খাবারের জন্য তাকে পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু তার প্রকৃত পিতা মাতা ছিলেন জোয়ন ক্যারোল এবং আব্দুল্লাহ ফাতাহ জান্দালি (সিরিয়া থেকে স্নাতোকোত্তর, পরবর্তীতে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েছিলেন)। ১৯৬১ জবস পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্টেন ভিউ এলাকায় বসবাস শুরু করে। এ স্থানটিই পরে সিলিকন ভ্যালিতে রূপ নিয়েছে।
জবস কুপারটিনো জুনিয়র হাই স্কুলে এবং হোমস্টিড হাই স্কুলে গিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই হিউলেট-প্যাকার্ড কোম্পানিতে লেকচারগুলোতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৬৮ জবস বর্তমান হিউলেট-প্যাকার্ডের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল হিউলেটের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। বিল হিউলেটের সঙ্গে স্পেয়ার পার্টস নিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি কাউন্টার তৈরির কাজ শুরু করেন। হিউলেটের কেবল জবসকে পুরোনো যন্ত্রাংশই দেনননি এসময় তিনি এইচপিতে জবসের ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থাও করেন। ১৯৭০ এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচিত হন আরেক স্টিভ, অর্থাৎ স্টিভ ওজনিয়াকের সঙ্গে। যেখানে পরবর্তীতে তিনি গ্রীষ্মকালীন কর্মচারী হিসাবে তার সঙ্গে কাজ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি হাইস্কুল শেষ করেন এবং পোর্টল্যান্ডের রিড কলেজে ভর্তি হন। সে সময় রিড কলেজ ক্যালিগ্রাফি কোর্সগুলো করাতো। সুযোগে তিনি মূল কোর্স বাদ দিয়ে ক্যালিগ্রাফি পড়েন। এর ফলেই ডেস্কটপ কম্পিউটারে চমৎকার সব ফন্ট যোগ হয়। এই সম্পর্কে তার বক্তব্য ছিল
"যদি আমি ওই কোর্সে না যেতাম তবে ম্যাকের কখনোই বিভিন্ন টাইপফেস বা সামঞ্জস্যপূর্ণ ফন্টগুলো থাকতো না।"
১৯৭৪ সালে জবস ক্যালির্ফোনিয়াতে পুনরায় চলে আসেন। এ সময় তিনি নিয়মিত ওজনিয়াকের সাথে হোমব্রিউ কম্পিউটার ক্লাবের সভাগুলোতে উপস্থিত থাকেন। তিনি ভিডিও গেমস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান "আটারি " তে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি এসময় মূলত ভারতে যাবার জন্য অর্থ জমানোর চেষ্টা করছিলেন। জবস ভারতে নিম কারোলি বাবার কাইনিচি আশ্রমে তার বন্ধু ড্যানিয়েল কটকের সাথে ভ্রমন করেন। আধ্যত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি ভারতে আসেন ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন।
১৯৭৩ সালের শেষ দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার লস গ্যাটোসে অ্যাটারি ইনকর্পোরেটেডে প্রকর্মী হিসেবে যোগ দেন জবস। ১৯৭৪ এর মাঝামাঝি সময় জবস ভারত ভ্রমণ করেন। নিম কারোলি বাবার সাথে সাক্ষাত্ করার জন্য জবস তার কৈঞ্চি আশ্রমে যান রিড কলেজের বন্ধু ড্যানিয়েল কোটকেকে সাথে নিয়ে। কিন্তু তা প্রায় জনশূন্য অবস্থায় ছিল, কারণ নিম কারোলি বাবা ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান। এরপর তারা চলে যান হরিয়াখান বাবার আশ্রমে। ভারতে তারা কয়েকবার বাস ভ্রমণ করেন। দিল্লি থেকে উত্তর প্রদেশ, সেখান থেকে ফিরে হিমাচল প্রদেশ এরপর পুনরায় দিল্লি ফিরে আসেন। সাত মাস অবস্থানের পর জবস ভারত ত্যাগ করেন।
ভারত থেকে ফেরার পর জবসের নতুন আবির্ভাব ঘটে। তার মস্তক মুন্ডিত ছিল এবং তিনি ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। এছাড়া তিনি বৌদ্ধধর্মের অনুসারি হয়ে ওঠেন।
এরপর জবস অ্যাটারিতে ফিরে আসেন এবং আর্কেড ভিডিও গেম ব্রেকআউটের জন্য সার্কিট বোর্ড তৈরির কাজে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। প্রত্যেক চিপের জন্য $১০০ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় অ্যাটারি। সার্কিট বোর্ড ডিজাইনে জবসের একটু বিশেষ জ্ঞান ছিল এবং তিনি ওজনিয়াকের সাথ সমানভাবে ফি ভাগ করে নেওয়ার চুক্তি করেন, যদি ওজনিয়াক চিপের সংখ্যা কমাতে পারেন। অ্যাটারি ইঞ্জিনিয়ারদের বিস্মিত করে, ওজনিয়াক চিপের সংখ্যা ৫০-এ নামিয়ে আনেন। ডিজাইন এতটাই দূর্ভেদ্য ছিল যে অ্যাসেম্বলি লাইন নকল করা প্রায় অসম্ভব ছিল। ওজনিয়াকের কাছে থেকে জানা যায় যে অ্যাটারি তাদেরকে মাত্র $৭০০ দিয়েছিল (প্রস্তাবিত $৫,০০০ এর পরিবর্তে), এতে ওজনিয়াকের অংশ দাড়ায় $৩৫০। অবশ্য, ওজনিয়াক ১০ বছর পর আসল বোনাসের পরিমাণ জানতে পারেন। তবে তিনি বলেন যে,
"যদি জবস তাকে এ সম্পর্কে জানাত এবং তার টাকাগুলোর প্রযোজনীয়তা সম্পর্কে বলত তাহলে আমি তা তাকে দিয়ে দিতাম"
টেলিফোন নেটওয়ার্ককে নিপূনভাবে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় টোন উত্পন্ন করতে, ওজনিয়াক একটি কম খরচের “ব্লু বক্স” তৈরি করেন। এতে দীর্ঘ দূরত্বের টেলিফোন কল বিনামূল্যে করা যেত। জবস সিদ্ধান্ত নেন যে তারা এটি বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করতে পারেন। এই অবৈধ ব্লু বক্সের চোরাগোপ্তা বানিজ্য ভালই চলে এবং এটি জবসের মনে বীজ বুনে দেয় যে ইলেকট্রনিক্স মজাদার এবং লাভজনক হতে পারে।
১৯৯৪ সালে একটি সাক্ষাত্কারে, জবস বলেন যে,
"ব্লু বক্স কিভাবে তৈরি করতে হয় তা বুঝে উঠতে আমাদের ছয় মাস সময় লেগেছিল।"
তিনি বলেন যে,
"যদি ব্লু বক্সগুলো তৈরি না হত, তাহলে হয়ত অ্যাপলও থাকত না।"
তিনি আরও বলেন যে,
"এটি তাদেরকে দেখিয়েছিল যে তা বড় কোম্পানিগুলোকে হারিয়ে দিতে পারে।"
১৯৭৫ সালে, জবস ওজনিয়াকের সাথে হোমব্রিউ কম্পিউটার ক্লাবের সভায় নিয়মিত উপস্থিত হতে শুরু করেন। তিনি এডুইন এইচ. ল্যান্ডের ব্যাপক প্রশংসা করেন, যিনি ইন্সট্যান্ট ফটোগ্রাফির উদ্ভাবক এবং পোলারইড কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৭৬ সালে, জবস এবং ওজনিয়াক নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। তারা তাদের কোম্পানির নাম দেন “অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানি”। প্রথম দিকে সার্কিট বোর্ড বিক্রয়ের মাধ্যমে তারা এই কোম্পানি চালু করেন। তখন ওজনিয়াক একক প্রচেষ্টায় অ্যাপল ১ কম্পিউটার উদ্ভাবন করেন। ওজনিয়াক কম্পিউটারটি জবসকে দেখালে, জবস তা বিক্রয় করার পরামর্শ দেন। এবং তখনই তারা এটিকে বিক্রয়ের জন্য রোনাল্ড ওয়েনকে সাথে নিয়ে জবসের গ্যারেজে অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়েন অল্প কিছু দিন ছিলেন। অতঃপর তিনি জবস এবং ওজনিয়াককে ছেড়ে চলে যান। অবশ্য, তিনিও ছিলেন অ্যাপলের প্রাথমিক সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ইন্টেলের তত্কালীন অর্ধ-অবসরপ্রাপ্ত পন্য বিপণন ব্যবস্থাপক মাইক মার্ককুলা তাদেরকে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন।
এ বছরই ৬৬৬.৬৬ ডলারে অ্যাপল ১ কম্পিউটার বিক্রি শুরু হয়। ১৯৭৭ সালের জুন মাসের ৫ তারিখে প্লাস্টিক কেসে রঙিন মনিটর সমৃদ্ধ অ্যাপল টু বাজারে আসে। এরপর একে একে স্টিভ জবসের হাত ধরে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির অনেক পণ্যই। তখন থেকেই তারা তাদের জনপ্রিয়তার বীজ বুনতে শুরু করে। ব্লু জিনস, টার্টলনেক ফুল হাতা কালো টি শার্ট আর কেডস পরিহিত স্টিভ মানেই আইকনিক অ্যাপল আর সাফল্যের প্রতিমূর্তি। তবে, স্টিভের সাফল্য একবারে আসেনি। তাকেও পার হতে হয়েছে চড়াই উৎরাই। ইনটেলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্টিভ জবস এবং স্টিভ ওজনিয়াক মিলে যে অ্যাপল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাকে নানা চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে, ঘটেছে নানা ঘটনা।
১৯৭৮ সালে, অ্যাপল মাইক স্কটকে প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের ১ তারিখে সাধারণ মানুষের জন্য পণ্য তৈরি করতে শুরু করে অ্যাপল। জবসের সম্পদ তখন পর্যন্ত দাঁড়ায় ২০০ মিলিয়ন ডলার।
১৯৮০’র দশকের প্রথম দিকে, জবস তাদের একজন ছিলেন যারা জেরক্স পার্কের মাউস নিয়ন্ত্রিত গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেসের বানিজ্যিক সম্ভাবনা দেখছিলেন, যা জবসকে অ্যাপল লিসা উদ্ভাবনে পরিচালিত করে। এক বছর পর, অ্যাপলের কর্মচারী জেফ রাস্কিন ম্যাকিন্টশ উদ্ভাবন করেন।
১৯৮৩ সালে, জবস পেপসি-কোলার জন স্কালীকে অ্যাপলের প্রধান নিবাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের জন্য প্রলুব্ধ করেন। জবস তাকে জিজ্ঞাসা করেন,
“তুমি কি তোমার জীবনের বাকিটা সময় চিনির পানীয় বিক্রয় করে কাটাতে চাও, নাকি আমার সাথে এসে বিশ্বকে বদলে দিতে চাও?”
“১৯৮৪” শিরোনামে একটি সুপার বোল টেলিভিশন বিজ্ঞাপন প্রচার করে। ১৯৮৪ সালের ২৪ জানুয়ারি, অ্যাপলের অংশীদারদের বার্ষিক সভায় জবস ব্যাপকভাবে উত্সাহী দর্শকদের সামনে ম্যাকিন্টশ উন্মোচন করেন।
জবস একজন প্ররোচনামূলক এবং সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও, সে সময়ের তার কিছু কর্মচারী তাকে মেজাজী হিসেবে দেখতেন। বাজারে সুবিধা করতে না পারায় জবসের সাথে স্কালীর কাজের সম্পর্কে অবনতি ঘটে, যা তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। জবস মধ্যরাতেও সভা চালিয়ে যান, লম্বা ফ্যাক্স পাঠান এবং সকাল ৭টায় নতুন সভা আহবান করেন।
স্কালী জানতে পারেন যে জবস পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের দ্বারা একটি অভ্যত্থান সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং মে ২৪, ১৯৮৪ তারিখে, সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি পরিচালনা পরিষধদের সভা আহবান করেন। অ্যাপলের পরিচালনা পরিষদ স্কালীর পক্ষ নেয় এবং জবসকে ম্যাকিন্টশ বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ফেলা দেওয়া হয়। জবস ধীরে ধীরে কাজে আসা বন্ধ করে দেন। মহাকাশচারী হিসেবে স্পেস শাটলে ওড়ার ব্যর্থ প্রয়াস এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি নতুন কম্পিউটার কোম্পানি চালু করার কথা বিবেচনা করে, তিনি অ্যাপল থেকে পদত্যাগ করেন। সেপ্টেম্বর ১২, ১৯৮৫ অ্যাপল সিইও জন স্কালি এবং প্রকৌশলীদের কর্পোরেটর ক্যুর কারনে অ্যাপল চেয়ারম্যান হিসেবে পদত্যাগ করেন জবস। বোর্ড মিটিংয়ে বলেন,
‘আমি অনেক কিছু ভাবছি। এখন আমার পুরো জীবন নিয়ে অ্যাপল থেকে বের হয়ে যাবার সময় হয়েছে। আমাকে এখন কিছু একটা করতে হবে। আমার বয়স ৩০ তো হলো।’
২০০৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি বলেন যে অ্যাপল থেকে বহিষ্কারের ঐ ঘটনাটি ছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঘটনা। তিনি বলেন,
“সফল হওয়ার ভার, নতুন করে শুরু করার আলোয় কেটে গিয়েছিল, সবকিছু সম্পর্কে কম নিশ্চিত ছিলাম। এটি আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে সৃজনশীল আংশে প্রবেশ করতে সহায়তা করে।”
তিনি আরও বলেন,
“আমি মোটামুটি নিশ্চিত এর কিছুই ঘটত না যদি না আমাকে অ্যাপল থেকে বহিষ্কার করা হত। এটি ছিল ভয়াবহ ওষুধের মত, তবে আমি মনে করি রোগীর এটি প্রয়োজন ছিল।”
এরপরই জবস নেক্সট কম্পিউটার নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অ্যাপল থেকে পদত্যাগের পর ১৯৮৫ সালে ৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে জবস প্রতিষ্ঠা করেন নেক্সট ইনকর্পোরেটেড (NeXt Inc.) এক বছর পর তার ভীষণ অর্থ সংকট দেখা দেয়, তার কোন পন্যও ছিলনা, ফলে তাকে বিনিয়োগকারীদের সরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তিনি বিলিয়নিয়ার রস পেরটের মনোযোগ আকর্ষণ করেন, যিনি কোম্পানিতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেন। নেক্সট ওয়ার্কস্টেশন অবমুক্ত হয় ১৯৯০ সালে, এর মূল্য ছিল ৯,৯৯৯ মার্কিন ডলার। অ্যপল লিসার মত নেক্সট ওয়ার্কস্টেশনও প্রযুক্তিগত দিক থেকে অগ্রবর্তী ছিল। শিক্ষাখাতের জন্য ডিজাইন করা হলেও, অধিক মূল্যের কারণে এটি বাজারে সুবিধা করতে পারেনি। জবস নেক্সটের পন্য বাজারজাত করেন অর্থনৈতিক, গবেষণা এবং শিক্ষাখাতের জন্য। এতে ছিল নতুন ধরণের উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, যার মধ্যে ম্যাখ কার্নেল, ডিজিটাল সিগনাল প্রসেসর চিপ এবং বিল্ট-ইন ইথারনেট পোর্ট উল্লেখযোগ্য। টিম বার্নার্স-লি সার্ন গবেষণা কেন্দ্রে একটি নেক্সট কম্পিউটারেঈ ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবন করেছিলেন।
সংশোধিত দ্বিতীয় প্রজন্মের নেক্সটকিউবও ১৯৯০ সালে অবমুক্ত হয়। জবস এটিকে প্রথম ইন্টারপার্সোনাল কম্পিউটার হিসেবে ঘোষণা করেন। এটিতে ছিল নেক্সটমেইল নামক মাল্টিমিডিয়া ইমেইল প্রযুক্তি। নেক্সটকিউবের মাধ্যমে ইমেইলের সাথে প্রথমবারের মত ভয়েস, চিত্র, গ্রাফিক্স এবং ভিডিও চিত্র আদান প্রদানের সুবিধা চালু হয়। জবস সাংবাদিকদের বলন,
“ইন্টারপার্সোনাল কম্পিউটার মানুষের যোগাযোগ এবং দলীয় কাজকর্মে বিপ্লব বয়ে আনবে।”
১৯৯৪ সালে কোম্পানি থেকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে তাদের ১.০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা অর্জিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে নেক্সট সফটওয়্যার ইনকপোরেটেড অবমুক্ত করে ওয়েবঅবজক্টস, যা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন ডেভলপমেন্টের জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক। ১৯৯৭ সালে অ্যাপল ইনকর্পোরেটেড কর্তৃক নেক্সট অধিগ্রহনের পর ওয়েবঅবজেক্টস ব্যবহৃত হয় অ্যাপল স্টোর, মোবাইলমি সেবা, এবং আইটিউনস স্টোর তৈরি এবং পরিচালনায়।
ফেব্রুয়ারি ৩, ১৯৮৬ লুকাস ফিল্ম-এর গ্রাফিক্স গ্রুপ ডিভিশন কিনে নেয় অ্যাপল। এটিই পরে পিক্সার অ্যানিমেশন স্টুডিওতে রূপ নেয়। এর মধ্যে ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কোম্পানিটিকে মূলধন হিসেবে দেওয়া হয়। নভেম্বর ২৯, ১৯৯৫ পিক্সারের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও নির্বাচিত হন স্টিভ। ডিজনির সাথে অংশীদারিত্বের অধীনে প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র হল টয় স্টোরি , যেটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৫ সালে। সেই ছবিতে জবসকে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে দেখানো হয়। মুক্তির পর এটি স্টুডিওর জন্য খ্যাতি এবং সমালোচনা উভয়ই বয়ে আনে। পরবর্তী ১৫ বছরে, পিক্সারের সৃষ্টিশীল প্রধান জন ল্যাসেটারের অধীনে, কোম্পানিটি কিছু বক্স-অফিস হিট চলচ্চিত্র প্রযোজনা করে। ফাইন্ডিং নেমো, দ্য ইনক্রেডিবলস, র্যাটাটুই, ওয়াল-ই, আপ এবং টয় স্টোরি ৩ এই প্রত্যেকটি চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমী পুরস্কার পেয়েছে। এই পুরস্কারটি ২০০১ সাল থেকে প্রচলিত হয়।
২০০৩ এবং ২০০৪ সালের দিকে, পিক্সারের সাথে ডিজনির চুক্তির মেয়াদ শেষ পর্যায়ে চলে আসার কারণে, জবস এবং ডিজনির প্রধান নিবার্হী মাইকেল ইসনাল চেষ্টা করেও নতুন অংশীদারিত্ব গঠনে ব্যর্থ হন, এবং ২০০৪ এর প্রথম ভাগে, জবস ঘোষণা করেন যে ডিজনির সাথে পিক্সারের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে তারা নতুন অংশীদারের সন্ধান করবেন।
২০০৫ সালের অক্টোবরে, ইসনারের স্থালাভিষিক্ত হন বব ইগার। তিনি ডিজনির সাথে জবস এবং পিক্সারের সম্পর্ক ঠিক রাখার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করেন। ২০০৬ সালের ২৪ জানুয়ারি, জবস এবং ইগার ঘোষণা করেন যে ডিজনি পিক্সারকে ৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অল-স্টক লেনদেনের মাধ্যমে ক্রয় করতে সম্মত হয়েছ। এই লেনদেন শেষ হলে, জবস দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির সবচেয়ে বড় অংশীদারে পরিণত হন, যার পরিমাণ কোম্পানির মোট তহবিলের প্রায় সাত শতাংশ। ডিজনিতে জবসের অংশীদারিত্ব ইসনারের অংশীদারিত্বকেও ছাড়িয়ে যায় (ইসনারের অংশীদারিত্ব ছিল ১.৭ শতাংশ)। এমনকি তা ডিজনি পরিবারের সদস্য রয় ই. ডিজনির অংশীদারিত্বের চেয়েও বেশি হয়ে পড়ে, ২০০৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যার অংশীদারিত্বের পরিমাণ ছিল প্রায় এক শতাংশ। জবস ডিজনির ৭ শতাংশ অংশীদারিত্ব পেয়ে যান এবং কোম্পানির সবচেয়ে বড় একক অংশীদার হিসেবে পরিচালনা পরিষদে যোগ দেন। জবসের মৃত্যুর পর ডিজনিতে তার অংশীদারিত্ব স্টিভেন পি. জবস ট্রাস্টে স্থানান্তরিত হয়, যা পরিচালনা করেন লরেন জবস।
১৯৯৬ সালে, অ্যাপল নেক্সটকে ৪২৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ক্রয়ের ঘোষণা দেয়। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে লেনদেন চূড়ান্ত হয়। এর মাধ্যমে অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা জবসের কোম্পানিটিতে প্রত্যাগমন ঘটে। ১৯৯৭ সালে স্টিভ জবস আবার ফিরে অ্যাপলকে দাঁড় করান। অনেক পরিবর্তন করা হয় এবং অনেক কিছু যোগ করা হয় অ্যাপলে। আগস্ট ৬, ১৯৯৭ মাইক্রোসফট ১৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে অ্যাপলে। তারপর তারা নভেম্বর ১০, ১৯৯৭ সালে অ্যাপল স্টোর চালু করে।
১৯৯৮ সালের মার্চে, অ্যাপলকে পুনরায় লাভজনক কোম্পানিতে পরিণত করা প্রচেষ্টা হিসেবে জবস নিউটন, সাইবারডগ এবং ওপেনডকের মত কিছু প্রকল্প বন্ধ করে দেন। জবস ম্যাকিন্টস ক্লোনের লাইসেন্সকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনেন, তিনি এটিকে প্রস্তুতকারকদের জন্য অনেক ব্যয়বহুল করে দেন। নেক্সটকে কিনে নেওয়ার ফলে, এর অনেক পণ্য অ্যাপলের পণ্যে পরিণত হয়, যেমন নেক্সটস্টেপ হয়ে যায় ম্যাক ওএস এক্স। জবসের নির্দেশনার অধীনে, আইম্যাক এবং অন্যান্য নতুন কিছু পণ্য প্রবর্তনের পর কোম্পানিটি উল্লেখযোগ্যভাবে বাজারে জায়গা করে নিতে শুরু করে। এরপর থেকে, আকর্ষণীয় ডিজাইন এবং শক্তিশালী বিপণন ব্যবস্থা অ্যাপলের জন্য খুব ভালোভাবেই কাজ করতে থাকে। ২০০০ সালে ম্যাকওয়ার্ল্ড আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে জবস দাপ্তরিকভাবে তার পদ থেকে “অন্তবর্তীকালীন” শব্দটি উঠিয়ে দেন এবং অ্যাপলের স্থায়ী প্রধান নির্বাহীতে পরিণত হন। জবস সে সময় ঠাট্টা করে বলেন যে তিনি “আইসিইও” শিরোনামটি ব্যবহার করবেন। স্টিভ জবস প্রতিষ্ঠানটির পণ্য পরিকল্পনায় ব্যপক পরিবর্তন আনেন এবং প্রতিষ্ঠানটি কম্পিউটারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরি করতে শুরু করে। এই সিরিজের প্রথম পণ্য ছিলো গান শোনার যন্ত্র আইপড। এরপর পণ্য তালিকায় যোগ হয় আইফোন। মূলত কম্পিউটারের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক পণ্যের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় অ্যাপলের জয়যাত্রা।
বহনযোগ্য মিউজিক প্লেয়ার আইপড, আইটিউনস ডিজিটাল মিউজিক সফটওয়ার এবং আইটিউনস স্টোর চালু করার মাধ্যমে কোম্পানিটি ভোক্তা ইলেক্ট্রনিক্স এবং সঙ্গীত বিপণন বাজারে হানা দেয়। ২০০৭ সালের ২৭ জুন, আইফোন অবমুক্ত করার মাধ্যমে অ্যাপল সেলুলার ফোন ব্যবসা শুরু করে। আইফোন হল স্পর্শকাতর পর্দা সমৃদ্ধ একটি সেল ফোন, যার মধ্যে একটি আইপডের বৈশিষ্ট্যসমূহও রয়েছে এবং নিজস্ব মোবাইল ব্রাউজারের মাধ্যমে, এটি মোবাইল ব্রাউজিং এর দৃশ্যপটে বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনে।
জবস তার পণ্য বিক্রয়ে দক্ষতার কারণে প্রসংশা এবং সমালোচনা উভয়ই পেয়েছেন। ২০০৫ সালে, জবস অ্যাপলের বার্ষিক সম্মেলনে কোম্পানির দূর্বল পূনর্ব্যাবহার পদ্ধতির সমালোচনায় সাড়া দেন। এর কয়েক সপ্তাহ পর, অ্যাপল ঘোষণা করে যে তারা তাদের খুচরা বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে আইপড ফেরত নেবেন। ২০০৬ সালে, তিনি অ্যাপলের পূনর্ব্যাবহার প্রক্রিয়ার পরিবর্ধন করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোন ক্রেতা নতুন ম্যাক ক্রয় করলেও এই সুবিধা পাবেন।
পাশাপাশি স্টিভ জবসের নেতৃত্বেই দূরদর্শী কম্পিউটিং পণ্য হিসেবে যোগ হয় পাওয়ার ম্যাক, আইম্যাক, ম্যাকবুক, এবং সর্বশেষ যোগ হয় বাজার-ছাপানো আইপ্যাড। ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারিতে স্বাস্থ্যগত কারণে দ্বিতীয় বারের মতো ছুটিতে যান ৫৬ বছর বয়সী স্টিভ। তিনি অর্নিদিষ্ট কালের জন্য ছুটি চেয়েছিলেন। তবে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণেই সংবাদ শিরোনামে এসেছেন তিনি। তিনি আইপ্যাড ২ বাজারে আনার সময় ছুটি ভেঙ্গে চলে এসেছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছুটিতে থাকলেও অ্যাপলের সব খুঁটিনাটিই খেয়াল করতেন। বিশেষজ্ঞরা তার বিষয়ে বলেন,
‘কাজের লোক, যে কিনা কাজ ছাড়া থাকতে পারে না।’
২০১১ সালের আগষ্টে, জবস অ্যাপলের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে তিনি কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বহাল ছিলেন। ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শেয়ার বাজারে অ্যাপলের পাঁচ শতাংশ দরপতন ঘটে। এই ক্ষুত্র দরপতন অ্যাপলে জবসের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত বহন করে। বিগত কয়েক বছর ধরে তার স্বাস্থ সমস্যা খবরের শিরোনাম হয়ে আসছিল এবং তিনি ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে চিকিত্সার জন্য ছুটিতে ছিলেন। ফোর্বস কর্তৃক প্রকাশিত হয় যে জবসের পদত্যাগ অ্যাপলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং সেই সাথে দ্য ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে পারে, যেখানে তিনি পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। ঘোষণার দিন ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির শেয়ারে ১.৫ শতাংশ দরপতন ঘটে।
বক্তব্যটির বাংলা অনুবাদ:
প্রথমেই একটা সত্য কথা বলে নিই। আমি কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় পাস করিনি। তাই সমাবর্তন জিনিসটাতেও আমার কখনো কোনো দিন উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। এর চেয়ে বড় সত্য কথা হলো, আজকেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান সবচেয়ে কাছে থেকে দেখছি আমি। তাই বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। কোনো কথার ফুলঝুরি নয় আজ, স্রেফ তিনটা গল্প বলব আমি তোমাদের। এর বাইরে কিছু নয়। আমার প্রথম গল্পটি কিছু বিচ্ছিন্ন বিন্দুকে এক সুতায় বেঁধে ফেলার গল্প।
ভর্তি হওয়ার ছয় মাসের মাথাতেই রিড কলেজে পড়ালেখায় ক্ষ্যান্ত দিই আমি। যদিও এর পরও সেখানে আমি প্রায় দেড় বছর ছিলাম, কিন্তু সেটাকে পড়ালেখা নিয়ে থাকা বলে না। আচ্ছা, কেন আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লাম? এর শুরু আসলে আমার জন্মেরও আগে। আমার আসল মা ছিলেন একজন অবিবাহিত তরুণী। তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। আমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমাকে এমন কারও কাছে দত্তক দেবেন, যাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। সিদ্ধান্ত হলো এক আইনজীবী ও তাঁর স্ত্রী আমাকে দত্তক নেবেন। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে দেখা গেল, ওই দম্পতির কারোরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেই, বিশেষ করে আইনজীবী ভদ্রলোক কখনো হাইস্কুলের গণ্ডিই পেরোতে পারেননি। আমার মা তো আর কাগজপত্রে সই করতে রাজি হন না। অনেক ঘটনার পর ওই দম্পতি প্রতিজ্ঞা করলেন, তাঁরা আমাকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, তখন মায়ের মন একটু গললো। তিনি কাগজে সই করে আমাকে তাঁদের হাতে তুলে দিলেন। এর ১৭ বছর পরের ঘটনা। তাঁরা আমাকে সত্যি সত্যিই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু আমি বোকার মতো বেছে নিয়েছিলাম এমন এক বিশ্ববিদ্যালয়, যার পড়ালেখার খরচ প্রায় তোমাদের এই স্ট্যানফোর্ডের সমান।
আমার দরিদ্র মা-বাবার সব জমানো টাকা আমার পড়ালেখার পেছনে চলে যাচ্ছিল। ছয় মাসের মাথাতেই আমি বুঝলাম, এর কোনো মানে হয় না। জীবনে কী করতে চাই, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা এ ব্যাপারে কীভাবে সাহায্য করবে, সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। অথচ মা-বাবার সারা জীবনের জমানো সব টাকা এই অর্থহীন পড়ালেখার পেছনে আমি ব্যয় করছিলাম। তাই আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং মনে হলো যে এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সিদ্ধান্তটা ভয়াবহ মনে হলেও এখন আমি যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন মনে হয়, এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা সিদ্ধান্ত ছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ডিগ্রির জন্য দরকারী কিন্তু আমার অপছন্দের কোর্সগুলো নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারলাম, কোনো বাধ্যবাধকতা থাকল না, আমি আমার আগ্রহের বিষয়গুলো খুঁজে নিতে লাগলাম। পুরো ব্যাপারটিকে কোনোভাবেই রোমান্টিক বলা যাবে না। কারণ তখন আমার কোনো রুম ছিল না, বন্ধুদের রুমের ফ্লোরে ঘুমোতাম। ব্যবহৃত কোকের বোতল ফেরত দিয়ে আমি পাঁচ সেন্ট করে কামাই করতাম, যেটা দিয়ে খাবার কিনতাম। প্রতি রোববার রাতে আমি সাত মাইল হেঁটে হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতাম শুধু একবেলা ভালো খাবার খাওয়ার জন্য। এটা আমার খুবই ভালো লাগত। এই ভালো লাগাটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
রিড কলেজে সম্ভবত দেশে সেরা ক্যালিগ্রাফি শেখানো হতো সে সময়। ক্যাম্পাসে সাঁটা পোস্টারসহ সবকিছুই করা হতো চমৎকার হাতের লেখা দিয়ে। আমি যেহেতু আর স্বাভাবিক পড়ালেখার মাঝে ছিলাম না, তাই যে কোনো কোর্সই চাইলে নিতে পারতাম। আমি ক্যালিগ্রাফি কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেরিফ ও স্যান সেরিফের বিভিন্ন অক্ষরের মধ্যে স্পেস কমানো-বাড়ানো শিখলাম, ভালো টাইপোগ্রাফি কীভাবে করতে হয়, সেটা শিখলাম। ব্যাপারটা ছিল সত্যিই দারুণ সুন্দর, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানের ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা আর্ট। আমি এর মধ্যেই মজা খুঁজে পেলাম। এ ক্যালিগ্রাফি জিনিসটা কোনো দিন বাস্তবজীবনে আমার কাজে আসবে—এটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু ১০ বছর পর আমরা যখন আমাদের প্রথম ম্যাকিনটশ কম্পিউটার (আমরা যাকে ম্যাক বলে চিনি) ডিজাইন করি, তখন এর পুরো ব্যাপারটাই আমার কাজে লাগল। ওটাই ছিল প্রথম কম্পিউটার, যেটায় চমৎকার টাইপোগ্রাফির ব্যবহার ছিল।
আমি যদি সেই ক্যালিগ্রাফি কোর্সটা না নিতাম, তাহলে ম্যাক কম্পিউটারে কখনো নানা রকম অক্ষর (টাইপফেইস) এবং আনুপাতিক দূরত্বের অক্ষর থাকত না। আর যেহেতু উইন্ডোজ ম্যাকের এই ফন্ট সরাসরি নকল করেছে, তাই বলা যায়, কোনো কম্পিউটারেই এ ধরনের ফন্ট থাকত না। আমি যদি বিশ্ববিদ্যালয় না ছাড়তাম, তাহলে আমি কখনোই ওই ক্যালিগ্রাফি কোর্সে ভর্তি হতাম না এবং কম্পিউটারে হয়তো কখনো এত সুন্দর ফন্ট থাকত না। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে এক সুতায় বাঁধা অসম্ভব ছিল, কিন্তু ১০ বছর পর পেছনে তাকালে এটা ছিল খুবই পরিষ্কার একটা বিষয়। আবার তুমি কখনোই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এক সুতায় বাঁধতে পারবে না। এটা কেবল পেছনে তাকিয়েই সম্ভব।
অতএব, তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে, বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো একসময় ভবিষ্যতে গিয়ে একটা অর্থবহ জিনিসে পরিণত হবেই। তোমার ভাগ্য, জীবন, কর্ম, কিছু না কিছু একটার ওপর তোমাকে বিশ্বাস রাখতেই হবে। এটা কখনোই আমাকে ব্যর্থ করেনি, বরং উল্টোটা করেছে। আমার দ্বিতীয় গল্পটি ভালোবাসা আর হারানোর গল্প। আমি খুব ভাগ্যবান ছিলাম। কারণ, জীবনের শুরুতেই আমি যা করতে ভালোবাসি, তা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমার বয়স যখন ২০, তখন আমি আর ওজ দুজনে মিলে আমাদের বাড়ির গ্যারেজে অ্যাপল কোম্পানি শুরু করেছিলাম।
আমরা পরিশ্রম করেছিলাম ফাটাফাটি, তাই তো দুজনের সেই কোম্পানি ১০ বছরের মাথায় চার হাজার কর্মচারীর দুই বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। আমার বয়স যখন ৩০, তখন আমরা আমাদের সেরা কম্পিউটার ম্যাকিন্টোস বাজারে ছেড়েছি। এর ঠিক এক বছর পরের ঘটনা। আমি অ্যাপল থেকে চাকরিচ্যুত হই। যে কোম্পানির মালিক তুমি নিজে, সেই কোম্পানি থেকে কীভাবে তোমার চাকরি চলে যায়? মজার হলেও আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটেছিল।
প্রতিষ্ঠান হিসেবে অ্যাপল যখন বড় হতে লাগল, তখন কোম্পানিটি ভালোভাবে চালানোর জন্য এমন একজনকে নিয়োগ দিলাম, যে আমার সঙ্গে কাজ করবে। এক বছর ঠিকঠাকমতো কাটলেও এর পর থেকে তার সঙ্গে আমার মতের অমিল হতে শুরু করল। প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ তার পক্ষ নিলে আমি অ্যাপল থেকে বহিষ্কৃত হলাম। এবং সেটা ছিল খুব ঢাকঢোল পিটিয়েই। তোমরা বুঝতেই পারছ, ঘটনাটা আমার জন্য কেমন হতাশাজনক ছিল। আমি সারা জীবন যে জিনিসটার পেছনে খেটেছি, সেটাই আর আমার রইল না। সত্যিই এর পরের কয়েক মাস আমি প্রচন্ড দিশেহারা অবস্থায় ছিলাম।
আমি ডেভিড প্যাকার্ড ও বব নয়েসের সঙ্গে দেখা করে পুরো ব্যাপারটার জন্য ক্ষমা চাইলাম। আমাকে তখন সবাই চিনত, তাই এই চাপ আমি আর নিতে পারছিলাম না। মনে হতো, ভ্যালি ছেড়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু সেই সঙ্গে আরেকটা জিনিস আমি বুঝতে পারলাম, আমি যা করছিলাম, সেটাই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। চাকরিচ্যুতির কারণে কাজের প্রতি আমার ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি। তাই আমি আবার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রথমে মনে না হলেও পরে আবিষ্কার করলাম, অ্যাপল থেকে চাকরিচ্যুতিটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো ঘটনা। আমি অনেকটা নির্ভার হয়ে গেলাম, কোনো চাপ নেই, সফল হওয়ার জন্য বাড়াবাড়ি রকমের কৌশল নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। আমি প্রবেশ করলাম আমার জীবনের সবচেয়ে সৃজনশীল অংশে।
পরবর্তী পাঁচ বছরে নেক্সট ও পিক্সার নামের দুটো কোম্পানি শুরু করি আমি, আর প্রেমে পড়ি এক অসাধারণ মেয়ের, যাকে পরে বিয়ে করি। পিক্সার থেকে আমরা পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার অ্যানিমেশন ছবি টয় স্টোরি তৈরি করি। আর এখন তো পিক্সারকে সবাই চেনে। পৃথিবীর সবচেয়ে সফল অ্যানিমেশন স্টুডিও। এরপর ঘটে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা। অ্যাপল নেক্সটকে কিনে নেয় এবং আমি অ্যাপলে ফিরে আসি। আর লরেনের সঙ্গে চলতে থাকে আমার চমত্কার সংসার জীবন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, এগুলোর কিছুই ঘটত না, যদি না অ্যাপল থেকে আমি চাকরিচ্যুত হতাম। এটা আমার জন্য খুব বাজে আর তেতো হলেও দরকারি একটা ওষুধ ছিল। কখনো কখনো জীবন তোমাকে ইটপাটকেল মারবে, কিন্তু বিশ্বাস হারিয়ো না। আমি নিশ্চিত, যে জিনিসটা আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেটা হচ্ছে, আমি যে কাজটি করছিলাম, সেটাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম।
তোমাকে অবশ্যই তোমার ভালোবাসার কাজটি খুঁজে পেতে হবে, ঠিক যেভাবে তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটিকে খুঁজে বের করো। তোমার জীবনের একটা বিরাট অংশজুড়ে থাকবে তোমার কাজ, তাই জীবন নিয়ে সত্যিকারের সন্তুষ্ট হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে এমন কাজ করা, যে কাজ সম্পর্কে তোমার ধারণা, এটা একটা অসাধারণ কাজ। আর কোনো কাজ তখনই অসাধারণ মনে হবে, যখন তুমি তোমার কাজটিকে ভালোবাসবে। যদি এখনো তোমার ভালোবাসার কাজ খুঁজে না পাও, তাহলে খুঁজতে থাকো। অন্য কোথাও স্থায়ী হয়ে যেয়ো না।
তোমার মনই তোমাকে বলে দেবে, যখন তুমি তোমার ভালোবাসার কাজটি খুঁজে পাবে। যেকোনো ভালো সম্পর্কের মতোই, তোমার কাজটি যতই তুমি করতে থাকবে, সময় যাবে, ততই ভালো লাগবে। সুতরাং খুঁজতে থাকো, যতক্ষণ না ভালোবাসার কাজটি পাচ্ছ। অন্য কোনোখানে নিজেকে স্থায়ী করে ফেলো না। আমার শেষ গল্পটির বিষয় মৃত্যু। আমার বয়স যখন ১৭ ছিল, তখন আমি একটা উদ্ধৃতি পড়েছিলাম—‘তুমি যদি প্রতিটি দিনকেই তোমার জীবনের শেষ দিন ভাব, তাহলে একদিন তুমি সত্যি সত্যিই সঠিক হবে।’ এ কথাটা আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল এবং সেই থেকে গত ৩৩ বছর আমি প্রতিদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করি—আজ যদি আমার জীবনের শেষ দিন হতো, তাহলে আমি কি যা যা করতে যাচ্ছি, আজ তা-ই করতাম, নাকি অন্য কিছু করতাম? যখনই এ প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে কয়েক দিন ‘না’ হতো, আমি বুঝতাম, আমার কিছু একটা পরিবর্তন করতে হবে।
পৃথিবী ছেড়ে আমাকে একদিন চলে যেতে হবে, এ জিনিসটা মাথায় রাখার ব্যাপারটাই জীবনে আমাকে বড় বড় সব সিদ্ধান্ত নিতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। কারণ, প্রায় সবকিছুই যেমন, সব অতি প্রত্যাশা, সব গর্ব, সব লাজলজ্জা আর ব্যর্থতার গ্লানি—মৃত্যুর মুখে হঠাৎ করে সব নেই হয়ে যায়, টিকে থাকে শুধু সেটাই, যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। তোমার কিছু হারানোর আছে—আমার জানা মতে, এ চিন্তা দূর করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে, সব সময় মনে রাখা যে একদিন তুমি মরে যাবে। তুমি খোলা বইয়ের মতো উন্মুক্ত হয়েই আছ।
তাহলে কেন তুমি সেই পথে যাবে না, যে পথে তোমার মন যেতে বলছে তোমাকে? প্রায় এক বছর আগের এক সকালে আমার ক্যানসার ধরা পড়ে। ডাক্তারদের ভাষ্যমতে, এর থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই আমার। প্রায় নিশ্চিতভাবে অনারোগ্য এই ক্যানসারের কারণে তাঁরা আমার আয়ু বেঁধে দিলেন তিন থেকে ছয় মাস। উপদেশ দিলেন বাসায় ফিরে যেতে। যেটার সোজাসাপটা মানে দাঁড়ায়, বাসায় গিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। এমনভাবে জিনিসটাকে ম্যানেজ করো, যাতে পরিবারের সবার জন্য বিষয়টা যথাসম্ভব কম বেদনাদায়ক হয়। সারা দিন পর সন্ধ্যায় আমার একটা বায়োপসি হলো। তাঁরা আমার গলার ভেতর দিয়ে একটা এন্ডোস্কোপ নামিয়ে দিয়ে পেটের ভেতর দিয়ে গিয়ে টিউমার থেকে সুঁই দিয়ে কিছু কোষ নিয়ে এলেন।
আমাকে অজ্ঞান করে রেখেছিলেন, তাই কিছুই দেখিনি। কিন্তু আমার স্ত্রী পরে আমাকে বলেছিল, চিকিৎসকেরা যখন এন্ডোস্কোপি থেকে পাওয়া কোষগুলো মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে পরীক্ষা করা শুরু করলেন, তখন তাঁরা কাঁদতে শুরু করেছিলেন। কারণ, আমার ক্যানসার এখন যে অবস্থায় আছে, তা সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা সম্ভব। আমার সেই সার্জারি হয়েছিল এবং দেখতেই পাচ্ছ, এখন আমি সুস্থ। কেউই মরতে চায় না। এমনকি যারা স্বর্গে যেতে চায়, তারাও সেখানে যাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি মরতে চায় না। কিন্তু মৃত্যুই আমাদের গন্তব্য। এখনো পর্যন্ত কেউ এটা থেকে বাঁচতে পারেনি। এমনই তো হওয়ার কথা। কারণ, মৃত্যুই সম্ভবত জীবনের অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। এটা জীবনের পরিবর্তনের এজেন্ট। মৃত্যু পুরোনোকে ঝেড়ে ফেলে ‘এসেছে নতুন শিশু’র জন্য জায়গা করে দেয়।
এই মুহূর্তে তোমরা হচ্ছ নতুন, কিন্তু খুব বেশি দিন দূরে নয়, যেদিন তোমরা পুরোনো হয়ে যাবে এবং তোমাদের ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আমার অতি নাটুকেপনার জন্য দুঃখিত, কিন্তু এটাই আসল সত্য। তোমাদের সময় সীমিত। কাজেই কোনো মতবাদের ফাঁদে পড়ে, অর্থাৎ অন্য কারও চিন্তাভাবনার ফাঁদে পড়ে অন্য কারও জীবনযাপন করে নিজের সময় নষ্ট করো না। যাদের মতবাদে তুমি নিজের জীবন চালাতে চাচ্ছ, তারা কিন্তু অন্যের মতবাদে চলেনি, নিজের মতবাদেই চলেছে। তোমার নিজের ভেতরের কণ্ঠকে অন্যদের শেকলে শৃঙ্খলিত করো না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, নিজের মন আর ইনটুইশনের মাধ্যমে নিজেকে চালানোর সাহস রাখবে। ওরা যেভাবেই হোক, এরই মধ্যে জেনে ফেলেছে, তুমি আসলে কী হতে চাও। এ ছাড়া আর যা বাকি থাকে, সবই খুব গৌণ ব্যাপার।
আমি যখন তরুণ ছিলাম, তখন দি হোল আর্থ ক্যাটালগ নামের অসাধারণ একটা পত্রিকা প্রকাশিত হতো; যেটা কিনা ছিল আমাদের প্রজন্মের বাইবেল। এটা বের করতেন স্টুয়ার্ড ব্র্যান্ড নামের এক ভদ্রলোক। তিনি তাঁর কবিত্ব দিয়ে পত্রিকাটিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। স্টুয়ার্ট ও তাঁর টিম পত্রিকাটির অনেক সংখ্যা বের করেছিল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে, আমার বয়স যখন ঠিক তোমাদের বয়সের কাছাকাছি, তখন পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিদায়ী সেই সংখ্যার শেষ পাতায় ছিল একটা ভোরের ছবি। তার নিচে লেখা ছিল— ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো । এটা ছিল তাদের বিদায়কালের বার্তা– “ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো”।
আমি নিজেও সব সময় এটা মেনে চলার চেষ্টা করেছি। আজ তোমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে আরও বড়, নতুন একটা জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছ, আমি তোমাদেরও এটা মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছি।
বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জবস ১৯৯১ সালে লরেন পাওয়েলকে বিয়ে করেন। সে ঘরে তাঁর এক ছেলে ও দুই মেয়ে। এক বান্ধবীর ঘরে আছে জবসের তরুণ বয়সের আরেকটি মেয়ে। ২০০৩ সালে তাঁর শরীরে টিউমার ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রোপচার না করায় বিপজ্জনক দিকে মোড় নেয় সেটি। অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হন। কিন্তু ২০০৮ থেকে আবার শরীর-স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে জবসের। ওজন কমে গিয়ে রোগা হয়ে পড়েন। এর পরের বছরও তাঁর স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। তবে ২০১০ সালে প্রচণ্ড কর্মোদ্যমী একজন মানুষ হিসেবে কাজে ফেরেন তিনি। তারপর আবারও অসুস্থতা ঘিরে ধরে তাঁকে। তাই সিইও থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
পদত্যাগপত্রে জবস লিখেছিলেন, ‘’আমি সব সময়ই বলি, যেদিন দেখব আমি আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারছি না, সেদিনই আপনাদের জানিয়ে দেব। সে দিনটা এসেছে।’’ জবস তাঁর কথা রেখেছেন। তবে তিনি কোম্পানির পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বহাল ছিলেন। ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শেয়ার বাজারে অ্যাপলের পাঁচ শতাংশ দরপতন ঘটে। এই ক্ষুত্র দরপতন অ্যাপলে জবসের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত বহন করে।
জবস অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী হিসেবে বছরে মাত্র ১ মার্কিন ডলার বেতন গ্রহন করতেন। অবশ্য তার কাছে অ্যাপলের ৫.৪২৬ মিলিয়ন শেয়ার ছিল, যার মূল্য ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়াও ছিল ডিজনির ১৩৮ মিলিয়ন শেয়ার, যার মূল্য ৪.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। জবস ঠাট্টস্বরূপ বলেন যে অ্যাপল থেকে তিনি বছরে যে ১ মার্কিন ডলার পান, তার ৫০ সেন্ট পান বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত হওয়ার জন্য এবং বাঁকি ৫০ সেন্ট পান নিজের কাজের জন্য। ২০১০ সালে ফোর্বসের হিসাব অনুসারে, তার সম্পত্তির পরিমাণ ৮.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম ধনী ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
জবস অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারে ভুগে ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর অ্যাপলের ওয়েবসাইট তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে। অ্যাপলের ওয়েবসাইটে স্টিভ জবসের মৃত্যুসংবাদ জানানোর পর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার থেকে শুরু করে বিশ্বনেতারাও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এই তালিকায় রয়েছেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, স্টিভের বন্ধু এবং অ্যাপল সহ প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ ওজনিয়াক, ফেসবুক প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গসহ আরো অনেকেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমও তাদের প্রথম পাতা জুড়ে স্টিভের স্মরণে আর্টিকেল ছেপেছে। প্রযুক্তিবিশ্লেষকরা তাকে নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন বিভিন্ন প্রযুক্তি সাইটে। টুইটার ফেসবুকেও উঠেছে বিভিন্ন মানুষের শোকের বার্তা। স্টিভের মৃত্যুর খবর শোনার পর বিল গেটস তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন,
‘পৃথিবী গৌরবজনক প্রভাববিস্তারী এক বিরল ব্যক্তিত্বকে প্রত্যক্ষ করেছে। আগামী অনেক প্রজন্ম তাকে স্মরণ করবে। আমরা যারা তার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, তারা সত্যিই ভাগ্যবান। নিশ্চিতভাবেই এ এক অসম্ভব সম্মানের বিষয়।’
গত শতকের ৭০ দশকের শুরু থেকে কাজ শুরুর পর কম্পিউটর জগতের চূড়োমনি হয়ে ওঠেন জবস ও গেটস। একজন অ্যাপলে, অন্যজন মাইক্রোসফটে। তাদের মধ্যে দুই প্রযুক্তি জায়ান্টের প্রধান হিসেবে অলিখিত এক প্রতিদ্বন্দিতায়ও ছিলো। দুজন দুক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। জবসের সঙ্গে দেখা প্রায় ৩০ বছর আগে, জানালেন গেটস। মৃত্যুর খবর শুনে তার প্রতিক্রিয়া ছিলো-
‘আমি ভীষণ মর্মাহত। তার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি আমার ও মেলিন্ডার (গেটসের স্ত্রী) সমবেদনা রইলো। সহানূভূতি প্রকাশ করছি সেই সব মানুষের প্রতিও, জবসের কাজ যাদের স্পর্শ করেছিলো।’
কারো প্রশংসা করতে গেলে জবস বলতেন, ‘ইনসেইনলি গ্রেট’। বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে একই বাক্যই উচ্চারণ করেছেন গেটস। তিনি আরো বলেছেন,
‘আমি ভাগ্যবান, তার সঙ্গে কাজ করতে পেরেছিলাম। তাকে আমি ভীষণ মিস করবো।’
জবসের মৃত্যুর পর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহকর্মী স্টিভ ওজনিয়াক জানিয়েছেন,
‘স্টিভের এভাবে চলে যাওয়া আমাকে নির্বাক করে দিয়েছে। আমার মন বসাতে পারছি না, কিছু করতে পারছি না। এটা যেনো জন লেননের চলে যাওয়া বা জেএফকে (প্রেসিডেন্ট কেনেডি)-এর চলে যাওয়া। আমার মধ্যে সে বিরাট এক শূন্যতা রেখে গেলো।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জবসের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে জানিয়েছেন,
"আমি আর মিশেল স্টিভের মৃত্যুতে খুবই দুঃখ পেয়েছি। মার্কিন উদ্ভাবকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠদের তালিকায় তিনি ছিলেন। তিনি গতানুগতিব ধারা থেকে ভিন্নাভাবে চিন্তা করার মতো যথেষ্টই সাহসী ছিলেন, সাহসী ছিলেন পৃথিবীকে বদলে দেবার মতো ভাবনায় বিশ্বাস করতে। আর সর্বপরি এসব করে দেখানোর ক্ষমতাও তার ছিলো।"
মার্ক জুকারবার্গ, পল অ্যালেন, মাইকেল ডেল, সের্গেই ব্রিন, ল্যারি পেজ, স্টিভ বলমারসহ অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন। জবস মারা যাবার পরই মিডিয়া জুড়ে তার মৃত্যুর খবরটি শিরোনামে চলে আসে। নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ইউএসএ টুডেসহ অনেক মিডিয়ায় শিরোনাম বসিয়েছে জবসের মারা যাবার খবরটি। নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে,
‘ভবিষ্যদ্রষ্টা জবস যিনি ডিজিটাল যুগে সঙ্গীত, মুভি এবং মোবাইল যোগাযোগে সংস্কৃতির পরিবর্তন এনেছেন।’
একরকম বক্তব্য ছেপেছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালও। ইউএসএ টুডে আরো জুড়ে দিয়েছে
‘মানুষের প্রযুক্তি ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন তিনি। এমনকি পাল্টে দিয়েছেন প্রযুক্তির ব্যবহারও।’
স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর বিশ্লেষকরা বলছেন,
‘অ্যাপলকে পছন্দ বা অপছন্দের তালিকায় ভাগ করা গেলেও স্টিভ একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি একথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। তিনি এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন যার বিষয়ে আসলে আমরা খুব বেশি কিছু জানিও না। তিনি আসলে অলক্ষ্যেই অনেক জীবনে প্রেরণাদায়ী এবং জীবন পরিবর্তনের রূপকার। তার কাজকে বিশ্লেষন করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, উদ্ভাবক, অন্বেষা, অনড় একগুঁয়ে আবার চরম নিয়ন্ত্রনাধীন, দক্ষ প্রসাশক এবং নেতা, শিল্পীর চোখ যার আছে ইঞ্জিনিয়ারিং মস্তিষ্ক, দারুন পারিবারিক এবং ‘ক্ষুধার্ত বোকা’। বিশ্লেষকরা তাকে আরো বলছেন, ‘তিনি বিনোদন তৈরি করেছেন, আনন্দ দিয়েছেন এবং নতুনত্ব এনেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা তিনি নিজের কাজকে ভালোবাসতেন সবচেয়ে বেশি।’
এত কিছু পরার পর নিশ্চয় মন কিছুটা খারাপ হয়ে গেছে? তো চলুন জানি অ্যাপল ও স্টিভ জবস সম্পর্কে কিছু মজাদার এবং অজানা তথ্য।
আজ আর না। ভুল ক্রুটি হলে ক্ষমা করবেন। অন্য কোন দিন আসব অন্য কোন বিষয় নিয়ে।
ধন্যবাদ।
আমি আবু হাসান রুমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 16 টি টিউন ও 156 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আরও একটি মাইরালা টাইপ টিউন করেছো রুমি 🙂 আর বরাবরের মতো এটাও প্রিয়তে। দিনদিন তো আমি তোমার হার্ডকোর এসি (ফ্যনের চাইতেও বড় কিছু) হয়ে যাচ্ছি। আশা করছি এসব মারদাঙ্গা টিউন করে সব সময় টেকটিউনসে নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখবে। আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তোমার সফলতা কামনা করছি।