নিউরালিঙ্ক প্রযুক্তির সাহায্যে চিন্তার মাধ্যমে যেভাবে মানুষ পরিচালনা করতে পারবে ডিজিটাল ডিভাইস

Level 1
ইন্টার ফাস্ট ইয়ার, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ

প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের যুগে আমরা এমন এক সময়ে প্রবেশ করছি, যেখানে মস্তিষ্ক বা ব্রেন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) বা ডিজিটাল ডিভাইসের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যেমন কেউ যদি ভাবেন যে তিনি একটি কাপ তুলতে চান, এবং এই প্রযুক্তি সেই চিন্তাটিকে পড়ে নিয়ে রোবটিক হাতের মাধ্যমে কাপটি তুলতে পারবে।

চমকপ্রদ এবং রহস্যময় এই প্রযুক্তির নাম নিউরালিঙ্ক (Neuralink)। এটি মূলত একটি ব্রেন-কম্পিউটার ইন্টারফেস (BCI) ডিভাইস, যা মানুষের নিউরনগুলোর সাথে সরাসরি কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে সংযোগ তৈরিতে কাজ করে। নিউরালিঙ্কের লক্ষ্য হলো মানুষের চিন্তাশক্তি এবং প্রযুক্তির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা।

নিউরালিঙ্ক কীভাবে কাজ করে?

নিউরালিঙ্ক মূলত মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ু কোষের সাথে এক ধরনের সরু এবং নমনীয় ইলেকট্রোডের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে। এই ইলেকট্রোডগুলি মস্তিষ্কের সংকেত পড়তে, বিশ্লেষণ করতে এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে এই সংকেতকে প্রক্রিয়াকরণের জন্য ব্যবহার করে। মস্তিষ্কের সংকেতগুলো নিউরালিঙ্ক ব্লুটুথের মাধ্যমে সংযুক্ত ডিভাইসে পাঠায়। পদ্ধতিটিকে আরো পরিষ্কারভাবে বুঝতে হলে নিউরালিঙ্ক এই কাজ করার পদ্ধতিকে তিনটি ধাপে ভাগ করা যায়:

  1. ইলেকট্রোড স্থাপন: নিউরালিঙ্কের ইলেকট্রোডগুলি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই ইলেকট্রোডগুলি এতই সূক্ষ্ম যে, স্নায়ুকোষের ক্ষতি না করে মস্তিষ্কের সংকেত সংগ্রহ করতে পারে। এর ফলে মানুষের মস্তিষ্কের নিউরানাল কার্যকলাপ সংরক্ষণ করতে পারে।
  2. সংকেতের বিশ্লেষণ: নিউরালিঙ্কের ইলেকট্রোডগুলি মস্তিষ্ক থেকে প্রাপ্ত সংকেতকে ডেটা আকারে প্রক্রিয়া করে ব্লুটুথের মধ্যে কম্পিউটারে পাঠায়। কম্পিউটারের মাধ্যমে এই সংকেতগুলো বিশ্লেষণ করে অর্থ বোঝার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে মস্তিষ্কের চিন্তা ভাবনা বা কার্যকলাপ ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়।
  3. রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক: মস্তিষ্ক থেকে সংগৃহীত সংকেতের ভিত্তিতে নিউরালিঙ্ক রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক দিতে সক্ষম। এর মাধ্যমে প্যারালাইসিস রোগীদের বিভিন্ন শারীরিক অঙ্গ পরিচালনা করা যেতে পারে। যেমন, প্যারালাইজড ব্যক্তিরা কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন শুধু তাদের মস্তিষ্কের মাধ্যমে।

উদাহরণ:

ধরা যাক, কেউ চাচ্ছেন একটি কম্পিউটার টাইপ করতে, কিন্তু তিনি হাত ব্যবহার করতে পারেন না। নিউরালিঙ্ক ব্যবহার করে, তিনি শুধু মস্তিষ্কে টাইপ করার কথা ভাববেন। তার মস্তিষ্কের সিগন্যালগুলো নিউরাল লিঙ্কের মাধ্যমে কম্পিউটারে পাঠানো হবে, এবং কম্পিউটার সেই অনুযায়ী টাইপ করতে থাকবে।

সম্ভাব্য ব্যবহার এবং সুবিধা

নিউরালিঙ্ক কেবলমাত্র কোনো প্রযুক্তি নয়, এটি ভবিষ্যতের এক নতুন বিশ্বে প্রবেশের চাবিকাঠি। এর সম্ভাব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো খুবই বিস্তৃত। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তুলে ধরা হলো:

  • মস্তিষ্কের রোগের চিকিৎসা: আলঝেইমার বা পার্কিনসনের মতো রোগের চিকিৎসায় নিউরালিঙ্ক খুবই কার্যকর হতে পারে।
  • কৃত্রিম অঙ্গের নিয়ন্ত্রণ: প্যারালাইজড রোগীরা নিউরালিঙ্কের সাহায্যে তাদের মস্তিষ্কের মাধ্যমে কৃত্রিম অঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
  • মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধি: মানুষের স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তাশক্তি বাড়াতে নিউরালিঙ্ক ব্যবহৃত হতে পারে।
  • সরাসরি মেশিন নিয়ন্ত্রণ: মানুষ চিন্তার মাধ্যমে সরাসরি মেশিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
  • নতুন ধরনের যোগাযোগ: ভবিষ্যতে হয়ত আমরা কথা না বলেই, শুধু চিন্তার মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।
  • শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টি শক্তি ফেরত: নিউরালিঙ্কের মাধ্যমে দৃষ্টিহীন মানুষকে দেখতে বা শ্রবণশক্তি হারানো মানুষকে শুনতে পারবে। এটি মস্তিষ্কে সরাসরি সিগন্যাল পাঠিয়ে দৃষ্টিশক্তি বা শ্রবণশক্তি পুনরুদ্ধার করতে পারে।

নিউরালিঙ্কের সম্ভাব্য অসুবিধাগুলো

নিউরালিঙ্কের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অনেক সুবিধা থাকলেও, এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধা এবং ঝুঁকি রয়েছে। যেহেতু এটি মানুষের মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সংযুক্ত থাকবে, তাই বিভিন্ন প্রযুক্তিগত, শারীরিক এবং নৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।

শারীরিক ঝুঁকি:

  • সার্জারি ঝুঁকি: মস্তিষ্কে ইলেকট্রোড প্রতিস্থাপন করতে সার্জারি প্রয়োজন, যা জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অপারেশনের সময় সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ বা মস্তিষ্কের টিস্যুর ক্ষতি হতে পারে
  • দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: মস্তিষ্কের ভেতরে একটি বৈদ্যুতিক ডিভাইস দীর্ঘ সময় ধরে রাখা হলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কে ইনফেকশন বা ইলেকট্রোড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে।

প্রযুক্তিগত সমস্যা:

  • হ্যাকিং ঝুঁকি: যেহেতু নিউরালিঙ্ক একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস, তাই এটি হ্যাকিংয়ের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। যদি কোনো হ্যাকার মস্তিষ্কের সিগন্যাল বা ডিভাইসের কার্যক্রম হ্যাক করতে সফল হয়, তাবে এটি বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
  • প্রযুক্তিগত ত্রুটি: যেকোনো প্রযুক্তির মতো, নিউরালিঙ্কও ত্রুটি দেখা দিতে পারে। ডিভাইসটি সঠিকভাবে কাজ না করলে মস্তিষ্কের সিগন্যাল ভুলভাবে প্রক্রিয়াকরণ হতে পারে, যা স্বাস্থ্যগত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।

গোপনীয়তা এবং তথ্য সুরক্ষা:

  • ব্যক্তিগত ডেটা: নিউরালিঙ্ক মস্তিষ্কের সিগন্যাল এবং চিন্তার ডেটা সংগ্রহ করবে, যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত। এই ডেটা যদি সঠিকভাবে সুরক্ষিত না রাখা যায়, তাবে এটি অপব্যবহার হতে পারে। গোপনীয়তার লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে, এবং ডেটা কারো অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা হতে পারে।

নৈতিক এবং সামাজিক উদ্বেগ:

  • মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণ: কিছু লোক বিশ্বাস করে যে নিউরালিঙ্কের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে, যা স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে।
  • বৈষম্য সৃষ্টি: নিউরালিঙ্ক অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রযুক্তি হতে পারে, যা কেবল ধনী ব্যক্তিরাই ব্যবহার করতে পারবে। এতে সামাজিক বৈষম্য তৈরি হতে পারে, কারণ কেবল এক শ্রেণির মানুষই এর সুবিধা ভোগ করতে পারবে।

মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ও ব্যর্থতার ঝুঁকি:

  • মানসিক চাপ: নিউরালিঙ্কের মাধ্যমে মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা হলে, এটি মানুষের মনে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। অনেকেই মনে করতে পারেন যে তাদের চিন্তা বা আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
  • ব্যর্থতার ঝুঁকি: নিউরালিঙ্কের প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটি সফল সম্ভাবনা বেশী থাকলেও এটাতে ব্যর্থতার সম্ভাবনাও রয়েছে। যদি ডিভাইসটি কাজ না করে বা সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে এটি কেবল অকার্যকরই নয়, বিপজ্জনকও হতে পারে।

উদাহরণ:

ধরা যাক, একজন ব্যবহারকারী নিউরালিঙ্কের মাধ্যমে একটি রোবটিক হাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। যদি ডিভাইসটি হ্যাক হয়ে যায়, হ্যাকার তার মস্তিষ্কের সিগন্যাল পরিবর্তন করে রোবটিক হাতকে ভুলভাবে ব্যবহার করাতে পারে। এটি দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে এবং ব্যবহারকারীর শরীরের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

নিউরালিঙ্কের রহস্যময় দিক

নিউরালিঙ্কের এত এত সুবিধা রয়েছে, কিছু সম্ভাব্য অসুবিধাও রয়েছে এবং রয়েছে উদ্বেগ। এটার কোনো রহস্যময় দিক আছে যেগুলোর উত্তর প্রশ্নবিদ্ধ? হ্যাঁ, নিউরালিঙ্কের অনেক রহস্যময় দিক রয়েছে। যার উত্তর স্পষ্ট নয়। যেমন:

  • স্মৃতি ট্রান্সমিশন: কি মানুষ সরাসরি স্মৃতি বা চিন্তা ভাবনা অন্যদের কাছে পাঠাতে পারবে? যদি এটি সম্ভব হয়, তবে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে বিপুল পরিবর্তন আসবে।
  • মৃত্যুর পরে স্মৃতি সংরক্ষণ: মানুষের মৃত্যুর পর তার স্মৃতি ডিজিটাল রূপে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে কি? মানুষের স্মৃতি প্রযুক্তির মাধ্যমে ধরে রাখা সম্ভব হলে, তা মৃত্যুর পরও জীবনকে নতুন মাত্রা দেবে।

শেষ কথা

নিউরালিঙ্ক প্রযুক্তি আমাদের মানব সমাজকে অগ্রগতির নতুন এক স্তরে নিয়ে যেতে পারে। এর সম্ভাবনা সীমাহীন, কিন্তু এর সাথে বিপুল দায়িত্বও রয়েছে। মস্তিষ্কের সাথে প্রযুক্তির সরাসরি সংযোগ অবশ্যই বড় সুযোগ তবে এটি চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসবে। এটি কেবল রোগের চিকিৎসা বা মানব ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যই নয়, বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্কের নতুন সম্ভাবনাগুলিকে আবিষ্কার করার পথ তৈরি করবে।

তবে, এই প্রযুক্তির সফলতা নির্ভর করবে এর নৈতিক ব্যবহার এবং সঠিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর। নিউরালিঙ্ক হয়ত ভবিষ্যতের রহস্যময় প্রযুক্তির সূচনা করবে, যা মানবতার জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করবে, কিন্তু এর সাথে আমাদের অবশ্যই সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

Level 1

আমি মোঃ সানজিদ। ইন্টার ফাস্ট ইয়ার, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 11 টি টিউন ও 12 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 3 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস