আমার লিখা এ পর্যন্ত প্রায় সবগুলো পোষ্টই ছিল লিনাক্স ওপেনসোর্স আর লিনাক্স নিয়ে। তাই আজ ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছি। আজকে লিখার বিষয় হল কম্পিউটার এনিমেশন ও বাংলাদেশে এর অপার সম্ভাবনা।
আসলে আমাদের আসেপাশে চলমান সকল কিছুই একেকটি এনিমেশন।অর্থাৎ কোন স্থির বস্তুকে এনিমেটেড করতে হলে প্রতি সেকেন্ডে তার অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করলে সেটা এনিমেটেড হয়ে যাবে আরো ভালো ভাবে বুঝতে নীচের ছবিটি দেখুন।
এটি কে বলাযায় বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এনিমেশন। এটি প্রায় ৫২০০ বছরের পূরনো চিত্রকর্ম। এখানে হরিনটির ৫টি চিত্র তৈরী করা হয়েছে যেখানে গাছ এবং অন্যসব কিছু ঠিক রেখে একটি হরিনকে ৫ বার অবস্থান পরিবর্তন করে আকা হয়েছে। এটিকে আমরা ৫ ফ্রেমের এনিমেশন বলতে পারি।
এবার ওপরে দেখুন সেই ৫টি ছবি কে একসাথে পর্যায়ক্রমে দেখানো হয়েছে। দেখলেন এটি একটি এনিমেশন হয়ে গেল। তবে দেখছেন নিশ্চই এনিমেশন টি স্মুথ না। কারন শুধু ৫টি ফ্রেম দিয়ে আপনি স্মুথ এনিমেশন পাবেন না এজন্য আপনাকে ২৪ ফ্রেমের এনিমেশন তৈরী করতে হবে।অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ২৪টি ফ্রেম পর্যায়ক্রমিক ভাবে দেখানো হলে আমাদের চোখ এটিকে স্মুথ এনিমেশন হিসেবে দেখাবে।
এখানে ডি শব্দটার মানে হচ্ছে ডাইমেশন। তার মানে টুডি এনিমেশনের ডাইমেশন হচ্ছে দুটি - প্রস্থ (y এ্যাক্সিস) এবং উচ্চতা (x এ্যাক্সিস)। অর্থাৎ আপনি যখন টমএন্ডজেরীর মত কার্টুন দেখেন তখন আপনি ক্যারেকটার এর প্রস্থ,উচ্চতা এবং এক পার্শ দেখতে পান। এটিই মূলত টুডি। নিচের ছবিটি একটি টুডি এনিমেশন।
৩ডি কে টুডি থেকে আলাদা করে যে বিষয়টি তা হল এর গভীরতা(z এ্যাক্সিস)। অর্থাৎ ৩ডিতে আপনি বস্তুর প্রস্থ উচ্চতা ছাড়াও এর গভীরতা কতটুকু তা দেখতে পারেন। সহজে বুঝতে হলে হাতে একটা আম নিন (যেহেতু আমের সিজন 🙂 ) চোখের সামনে ধরুন কি দেখতে পাচ্ছেন? আমটি কতটুকু লম্বা এবং কতটুকু চওড়া তাইনা এবার আমটিকে হাতদিয়ে ঘুরান। কি আমটার চারপাশ আপনি দেখতে পাচ্ছেন? এটাই হল (z এ্যাক্সিস) এর দ্বারা বস্তুটির গভীরতা বোঝায়।
এর মানে হল বস্তু কে আপনি চারপাশে ঘুরিয়ে দেখতে পারলেই সেটা হয়ে যাবে ৩ডি।
এনিমেশন এমন একটা বিষয় যেটা আপনি যে কোন দেশেই যান এর চাহিদা রয়েছে। কারন যেখানেই টিভি মিডিয়া রয়েছে সেখানেই বিজ্ঞাপন আর আজকাল এনিমেশন ব্যবহৃত হয়না এমন বিজ্ঞাপনের সংখ্যা অনেক কম। এনিমেশনের ব্যবহার ক্ষেত্র অনেক যেমন- টিভি বিজ্ঞাপন,কার্টুন,বাচ্চাদের শিক্ষামূলক মাল্টিমিডিয়া সিডি,আর্কিটেকচার,ফিল্ম স্পেশাল ইফেক্ট.... আরো অনেক কিছু। এখন আপনি জিজ্ঞেস করতে পারেন কোন ধরনের এনিমেশন আমার জন্য ২ডি নাকি ৩ডি।
৩ডি এনিমেশনটা তুলনামূলক সহজ এক্ষেত্রে আপনাকে এনিমেশনে ব্যবহৃত সফটওয়্যার গুলো আয়ত্বে আনতে হবে এছাড়াও যেটা প্রয়োজন হবে তা হল সৃজনশীলতা অর্থাৎ নিজের ক্রিয়েটিভিটি কে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছূ তৈরীকরা এবং থাকতে হবে ভালো পর্যবেক্ষন দৃষ্টি যেমন বাতাসে গাছের পাতা কিভাবে দুলছে, মানুষ কিংবা প্রানীর হাটাচলার সময় তাদের অঙ্গ সমূহের মুভমেন্ট অর্থাৎ বাস্তব বিষয়গুলি পর্যবেক্ষন করে সেটিকে এনিমেশনে কাজে লাগানো।
আর টুডি এনিমেশনের ক্ষেত্রে আপনার ছবি আকার দক্ষতা থাকতে হবে। কারন আপনাকে একটি টুডি ক্যারেক্টার কে সচল করতে প্রতি সেকেন্ডের জন্য ২৪টি ফ্রেম আকতে হবে। তাই টুডি এনিমেশন সময় ও ব্যায়সাপেক্ষ তবে এনিমেশন বাজারে টুডি এবং থ্রিডি উভয়এরই চাহিদা রয়েছে।
এটুকু বলতে পারি আপনি যদি সময় নিয়ে এনমেশন শিখতে পারেন এবং দক্ষতা অর্জনের পর সেটিদ্বারা আপনি মাসিক হাজার বিশেক থেকে তিরিশেক আয় করতে পারবেন প্রাথমিক অবস্থায়। আমাদের পার্শবর্তী দেশ ভারতের কথাই ধরি তাদের ও আমাদের এনিমেশনের সূচনা প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। আমাদের দেশে ত্রিমাত্রিক নামের এনিমেশন স্টুডিও ১৯৯৯ সালে"মানব কঙ্কালের ঢাকা ভ্রমন" নামে একটি এনিমেশন তৈরী করে যেটি সে সময়ে ইত্যাদিতে প্রচারিত হয়েছিল। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত দুটি দেশকে পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায় বর্তমানে যেখানে ভারতে শতশত আন্তর্জাতীক মানের এনিমেশন স্টুডিও ও এনিমেটর জনশক্তি সেখানে বাংলাদেশে রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি এনিমেশন স্টুডিও। আগেতো আমাদের দেশের এনিমেশনের কাজও ভারত থেকে করে আনা হত তবে বর্তমানে বাংলাদেশের কয়েকটি এনিমেশন স্টুডিও সেই চাহিদা পূরন করছে। তবে আসুন আপনাদের বলি কেন এনিমেশন বাংলাদেশে একটি সম্ভাবনার নাম-
উন্নত দেশসমূহ তাদের এনিমেশন তৈরীর খরচ কমানোর জন্য বিভিন্ন দেশে কাজ আউটসোর্সিং করে থাকে তুলনমূলক কম খরচে।
তো দেখলেন আমরা সবচেয়ে কমখরচে এনিমেশন তৈরী করে দিতে পারি যদি আমাদের পর্যাপ্ত দক্ষ এনিমেটর জনশক্তি থাকে। বর্তমানে ইন্ডিয়া সবচেয়ে কম খরচে এনিমেশনের কাজ করছে তাই তারা এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশী আয় করছে। তবে আমরা কেন নয়? কারন আমাদের প্রায় সকলের মধ্যে কিছুনা কিছু সৃজনশীলতা আছে এবং এনিমেশনের জন্য ব্যাবহৃত টুল গুলো আমাদের কাছে সহজ লভ্য আমরা যদি এনিমেশন শেখার জন্য কিছুটা সময় দেই এবং নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পারি তাহলে আমরাও বহির্বিশ্বের আউটসোর্সিং এর কাজ করে প্রচুর বৈদেশীক মূদ্রা অর্জন করতে পারি।
নাফিস বিন জাফর হচ্ছেন প্রথম বাংলাদেশী যিনি যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমী অফ মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সাইন্স বিভাগে অস্কার পেয়েছেন হলিউড ব্লকবাস্টার ফিল্ম পাইরেটস অব দা ক্যারাবিয়ান: এ্যাট ওয়ার্ল্ড এ্যান্ড এ ফ্লুইড ডাইনামিক্সের অসাধারন কাজ করার প্রেক্ষিতে। এওয়ার্ড টি তিনি তার আরো দুজন সহকর্মী ডগ রুবেল ও রিও সাকাগুচির সাথে পান।
বাংলাদেশের সাবেক সেনা কর্মকর্তা জাফর বিন বাশারের একমাত্র পুত্র নাফিসের জন্ম ঢাকায় ১৯৭৭ সালে। ১৯৮৯ সালে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনার চার্লসটনে চরে যান। তারপর পড়াশোনা শেষে তিনি যোগদেন স্বনামধন্য এনিমেশন স্টুডিও "ডিজিটাল ডোমেইনে"। নাফিস তার এনিমেটর দলের হয়ে এপর্যন্ত কয়েকটি হলিউড ফিল্মে কাজ করেছেন। যার মধ্যে উল্যেখযোগ্য হল ২০০৫ সালে "স্টিলথ", ২০০৬ সালে "ফ্লাগস অব আওয়ার ফাদার" এবং ২০০৭ সালে সর্বশেষ পাইরেটস অব দা ক্যারাবিয়ান: এ্যাট ওয়ার্ল্ড এ্যান্ড।
আপনাদেরকি মনে আছে "দুই বলদ" , " বাসে একদিন", "বেয়াক্কেল" নামের মজার এনিমেশন গুলির কথা? । মূলত এই সব মজারমজার এনিমেশন দিয়েই সোহেল আফগানী রানার পথ চলা শুরু। তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স ছাড়াই শুধু এনিমেশন সফটওয়্যারগুলির হেল্প ফাইল পড়ে এনিমেশন তৈরী করা শুরু করেন। তারপর বিভিন্ন টিভি বিজ্ঞাপন দেখে সেগুলো অনুকরণ করে নিজেই স্যাম্পল এনিমেশন তৈরী শুরু করেন। তারপর তিনি সেম্পল গুলো বিভিন্ন এডফার্মে গিয়ে দেখান। তার কাজ ভালো হওয়ায় তিনি বানিজ্যিক ভাবে কাজ ও পেয়ে যান। এরপর তিনি নিজেই ডিজিআর্ট মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশন নামে ফার্ম খোলেন। এ পর্যন্ত তার করা বিজ্ঞাপনের সংখ্যা অর্ধ শতাধিকেরও বেশী।
আরিফ আহমেদ কে বলা যায় বাংলাদেশের এনিমেশনের সূচনালগ্নে প্রথম দিককার একজন এনিমেটর এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ একজন এনিমেটর ও বটে। তিনি ১৯৮২ সালে মতিঝিল টিএন্ডটি হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৮৪সালে নটরডেমথেকে এইচএসসি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যা ও ইলেক্ট্রনিক্স বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করেন। তিনি ব্যাক্তিগত উদ্যোগেই এনিমেশন শেখা শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে থ্রিডি স্টুডিও ম্যাক্স ১ দিয়ে এনিমেশনের কাজ শুরু করেন। এখনো তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। তার কাজের প্রোফাইল অনেক বড় যা এখানে লিখে শেষ করা যাবেনা। আপনারা তার ওয়েবসাইট থেকে তা দেখতে পারবেন।তিনি সহ বাংলাদেশের আরো কয়েকজন স্বনামধন্য এনিমেটর মিলে "অরা এনিমেশন" নামে এনিমেশন স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেছেন যেখানে তিনি নিজেই এনিমেশন কোর্স পরিচালনা করে থাকেন।ওনার লক্ষ্য হচ্ছে নিজের এতবছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বমানের এনিমেশন জনশক্তি তৈরী করা। তিনি প্রায়শই এনিমেশন বিষয়ক সেমিনারের আয়োজন করে থাকেন যেখানে তিনি সাধারণ কম্পিউটার ব্যবহাকারীদের এনিমেশন বিষয়ে ধারনা দিয়ে থাকেন। নীচের ছবিটি একটি ওয়ার্কশপের যেখানে আমিও আছি 😉
আরিফ আহমেদের করা কিছুকাজঃ
কম্পিউটারের সাথে জহিরুলের পরিচয় ছোটবেলাথেকেই । তার বড় ভাই মনিরুল ইসলাম শরীফ একজন প্রোগ্রামার সে সুবাদ কম্পিউটারও তার হাতে আসে ছোটবেলায়। তবে তার প্রোগ্রামিং এর প্রতি তেমন ঝোক ছিলনা যতটা ছিল গ্রাফিক্স আর এনিমেশনের প্রতি। তাই তার বড়ভাই তাকে বুঝিয়ে বলে কিভাবে হলিউড ফিল্ম গুলোতে এনিমেশন স্পেশাল ইফেক্ট গুলো দেয়া হয় এবং তার হাতে তুলে দেয় ৩ ডি স্টুডিও ম্যাক্স ৩ সফটওয়্যার টি। ব্যাস তখন সে উৎসাহের সাথে সফটওয়ারটি দিয়ে এনিমেশন তৈরীর কাজে নেমে যায়। এরপর সে তার কয়েকজন সহপাঠি দের নিয়ে এনিমেটরের একটি গ্রুপ তৈরী করে যার নাম "সিনাপটিকসৃ স্টুডিও"। তারা একটি এনিমেশন ফিল্মের কাজে হাত দিয়েছিল যার নাম হল "খেরোহা" যেটির ট্রেইলার ও তারা প্রকাশ করে ছিল যা সেই সময় কম্পিউটার টুমরো নামের ম্যাগাজিন সিডিতে প্রকাশ করা হয়েছিল ( ট্রেইলারটি আপলোড করে এখানে লিন্ক দিয়ে দেব)।
তার ব্যাক্তিগত অর্জনের মধ্যে রয়েছে:
চতুর্থ নটরডেম কম্পিউটার উৎসব ২০০০ এ এই থ্রিডি প্রচ্ছদ ডিজাইন করে ১ম পুরষ্কার অর্জন করে
"মাই লিটল ওশান" নামে এই ৩ডি মডেল ডিজাইন করে জহিরুল 3dluvr.com এ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল
এতক্ষন যাদের কথা বললাম তাদের সবারই সফলতার কারন সৃজনশীলতার পূর্ন ব্যবহার, অধ্যাবসায় ও পরিশ্রম তাই আপনি যদি মনে করেন আপনি এনিমেশনে কিছুকরে দেখাতে পারবেন তাহলে এখনি লেগে পড়ুন এনিমেশন নিয়ে। আজকালতো মার্কেটে হাজারো রকমের এনিমেশনের উপর টিউটোরিয়াল পাওয়া যায় সেগুলো সংগ্রহ করুন, এনিমেশন সফটওয়্যার যেমন মায়া ,৩ডি স্টুডিও ম্যাক্স ইত্যাদি সংগ্রহ করে শেখার চেষ্টা করুন। টিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের এনিমেশন গুলো ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করুন তার পর টিভিসি গুলোর দেখাদেখি এনিমেশন সেম্পল তৈরীকরুন এগুলো আপনি যদি কোন এডফার্মে এ্যাপলাই করেন তাহলে সেম্পল গুলো প্রয়োজন হবে আপনার দক্ষতা প্রমানের জন্য।
জহিরুল এবং তার স্টুডিওর তৈরী করা এনিমেশন "Kheroha"
এ লেখাটির কিছু ছবি উইকিপিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তাই উইকিপিডিয়ার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি
আমি darklord। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 16 বছর 7 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 30 টি টিউন ও 111 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
Share your knowledge with others..........
আমাদের দেশের এই সব মেধাদের কাজে লাগানো দরকার। নতুন প্রজন্মকে এই শিল্প সম্পর্কে জানানো দরকার। এই মেধাবীদের এবং তাদের কাজ গুলোকে তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ভাল টিউন, ধন্যবাদ।