নব্বই দশকে বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা

নব্বই দশকের শুরুতে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল না। টেলি ডেনসিটি ছিল অনেক কম। তখন একমাত্র ভরসা ছিল বিটেকটিউনসবি'র ল্যান্ডফোন। সংযোগের ধারণ ক্ষমতা ছিল খুবই কম। প্রচুর চাহিদা থাকলেও প্রযুক্তিগত কারণে হুট করে তা বাড়ানো যেত না। যার ফলে তৎকালে ফোনের সংযোগ পাওয়াটা ছিল একটা সোনার হরিণ। সেই সময় জনৈক মাহমুদুল হক একটা ল্যান্ডফোনের সংযোগ পাওয়ার জন্য বিটেকটিউনসবি’র এক মিডলম্যানকে ২০, ০০০ টাকা ঘুস দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আর ফোনের সংযোগ পাননি, টাকাও ফেরত পাননি। এই তথ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লখ্য ১৯৯৮-৯৯ আর্থিক বছরের শেষ দিকে বিটেকটিউনসবি'র ৬৩১ টি এক্সচেঞ্জের মোট ধারণক্ষমতা ছিল ৪৭৪, ৩২২ লাইনের।

তবে যাই হোক না কেন নব্বই দশককে বলা যায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের টার্নিং পয়েন্ট। ঐ দশকে এই খাতে অনেক কিছুরই যেমন পরিবর্তন হয়েছে তেমন এর উন্নয়নও হয়েছে। যেমন এনালগ ল্যান্ডফোন সংযোগ গুলো ডিজিটালে রূপান্তর হয়েছে। রেডিও পেজার, কার্ড ফোন, মোবাইল ফোন ইত্যাদির ব্যবহার শুরু হয়। আগেই বলেছি সেই সময় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল টি এন্ড টি এর ল্যান্ডফোন। তবে তার ব্যবহার ছিল আবাসিক বা ব্যবসায়িক কাজের জন্য। তখন বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা কোন পাবলিক কল অফিস ছিল না। ছিল না ফোন-ফ্যাক্সের দোকান। তাই কল করার জন্য অনেকটা কয়েনবক্স পে-ফোনের ওপর নির্ভর করতে হত। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৫ সালের দিকে। তবে এটার ব্যবহার ঢাকাসহ দুই একটা বড় বড় শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক স্থানে এই ফোনগুলো দেখা যেত। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতাম মুহসিন হলে। কারও সঙ্গে কথা বলতে হলে হলের দেয়ালে লাগানো কয়েনবক্স পে-ফোন দিয়েই কল করতাম। ৫০ পয়সার একটা কয়েন বক্স এর মধ্যে প্রবেশ করিয়ে কথা বলা যেত। তবে সেটা লোকাল ফোনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। দূরবর্তী স্থানে কল করার জন্য তখন টি এন্ড টি অফিসে যেতে হতো। কল বুকিং দিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। আমার মনে আছে ঢাকা থেকে সেই সময় বগুড়াতে প্রতি মিনিট কল করার জন্য ২৫ টাকা চার্জ করতো। কল চার্জ ছিল যেমন বেশি তেমনি একটা কল করার জন্য অনেক সময় ব্যয় করতে হত।

ঐ দশকের শুরুতেই যোগাযোগের জন্য আরেকটি মাধ্যম চলে আসে। সেটার নাম হল রেডিও পেজার। এটা কোমরের বেল্টে লাগানো হতো। এটার ব্যবহার ছিল একমুখী। অনেকটা মোবাইল ফোনের মিসড কলের মতো। সেই সময় কেউ পেজারে মেসেস পাঠালে বিফ বাজতো। কোন নম্বর থেকে মেসেস এসেছিল তা জানা যেতো। তবে সেই সার্ভিসটা বেশিদিন টিকে থাকেনি।

কয়েনবক্স পে-ফোন সেবা নানা কারণে একটা সময় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এর পর চালু করা হয় কার্ডফোন। ঢাকার কমলাপুর রেলষ্টেশনে প্রথম কার্ডফোনটি বসানো হয় ১৯৯২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর। সেই সময় ৫০, ১০০ ও ২০০ ইউনিটের কার্ড পাওয়া যেত। যার মূল্যমান ছিল যথাক্রমে ১২০, ২১০ ও ৪০০ টাকা। সিডিউল ব্যাংক, ডাকঘর, ও টেশিসের বিক্রয়কেন্দ্র গুলো থেকে কার্ড বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। স্থানীয় কলের ক্ষেত্রে প্রতি ৩ মিনিটে ১ ইউনিট ধরা হতো। এন ডব্লিউ ডি ও আই এস ডি কলের ক্ষেত্রে বিটেকটিউনসবি’র কল চার্জ প্রযোজ্য ছিল। প্রতি ইউনিটের মূল্যমান ছিল ২ টাকা মাত্র। শুরু থেকেই এই মাধ্যমটি খুব জনপ্রিয়টা পায়। লাইন ধরে লোকজনকে কথা বলতে আমি দেখেছি। পরবর্তীতে যত্রতত্র বেসরকারী ফোন-ফ্যাক্সের দোকান চালু হয়। কতিপয় অসৎ ব্যক্তি সেলুলয়েড ফিল্ম স্ট্রিপ, ধাতব পদার্থ ইত্যাদি কার্ডফোনে ঢুকিয়ে বেশ কিছু ফোনসেট নষ্ট করে ফেলে। বুথ থেকে স্টিলের কর্ড যুক্ত হ্যান্ডসেট ছিড়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এই ফোনের আই এস ডি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে লাগিয়ে রাজস্ব চুরির কিছু ঘটনাও তখন ধরা পড়ে। যার ফলে কার্ডফোনের ব্যবহার আস্তে আস্তে হ্রাস পায়।

১৯৯৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে ব্যবহার শুরু হয় মোবাইল ফোন। সিটিসেল নিয়ে আসে প্রথম মোবাইল ফোন সংযোগ। তখন এটা শুধু বাংলাদেশেই প্রথম ছিল না। বলা চলে উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম মোবাইল ফোন অপরাটের ছিল সিটিসেল। শুরুতেই প্রতিটা সংযোগের দাম ছিল লক্ষ টাকার বেশি। কল চার্জ ছিল প্রতি মিনিট ১০ টাকা। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং নেটওয়ার্ক তেমন সম্প্রসারিত না হওয়ার কারণে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের কিছু বিত্তশালি মানুষ তখন ঐ মোবাইল ফোনের সেবা ব্যবহার করতো। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের ২৬শে মার্চ গ্রামীনফোনের বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা শুরু হয়। একই বছর অপারেশনে যায় “একটেল”। যা এখন রবি নামে পরিচিত। এর পর আসে “সেবা ওয়ার্ল্ড”। যা এখন বাংলালিংক নামে পরিচিত।

নব্বই দশকের শুরুতে ফোন ব্যবহারের ডেনসিটি অনেক কম থাকলেও শেষের দিকে তা বাড়তে থাকে। আরও ৩টি নতুন মোবাইল ফোন অপরেটর তাদের সেবা শুরু করে। যার ফলে ফোনের নেটওয়ার্ক দ্রুত সম্প্রসারণ হতে থাকে। নাগালের মধ্যে চলে আসতে থাকে এর সংযোগ ও ব্যবহার ফি। বিটেকটিউনসবি’র ল্যান্ডফোনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা অনেকটাই কমে আসে।

Level 4

আমি আব্দুল্লাহ আল ফারুক। Digital Marketer, Self Employed, Bogura। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 34 টি টিউন ও 20 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 23 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস