AI কি হবে গুগলের মতো বিশাল ক্ষমতার? নাকি হবে চালের মত সস্তা ব্যবসা?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কি হবে পৃথিবীর পরবর্তী গুগল? নাকি সব বড় AI কোম্পানিগুলো আসলে ঢুকে পড়েছে এমন এক প্রতিযোগিতায়, যেখানে তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও শেষ পর্যন্ত বিক্রি করছে এক বস্তা চালের মতো সাধারণ পণ্য? এই প্রশ্ন শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, AI ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ নিয়ে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও চমকপ্রদ একটি বিতর্ক।

বিশিষ্ট প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী মার্ক আন্দ্রিসেন সম্প্রতি এই বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন, যা পুরো AI ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটি নতুন চিন্তার খোরাক জোগাচ্ছে। সান ফ্রান্সিসকোতে Ray Summit-এ তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে AI ব্যবসার দুটি ভিন্ন দিক, এবং এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তির একচেটিয়া ক্ষমতা, প্রতিযোগিতা এবং লাভের প্রশ্ন।

AI ব্যবসার প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি, গুগলের মতো আধিপত্য

প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, AI স্টার্টআপগুলো এখন এমন এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, যেখানে ‘জয়ীই সবকিছু পাবে’। অর্থাৎ, একটি বড় কোম্পানি যদি সবচেয়ে শক্তিশালী AI মডেল তৈরি করতে পারে, তবে তারা পুরো বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে এবং বাকি সবাইকে পেছনে ফেলে দিয়ে একচেটিয়া মুনাফা অর্জন করবে। এই ধারণা অনেকটা গুগলের সার্চ ইঞ্জিনের সাফল্যের মতো।

আন্দ্রিসেন বলেন, “যদি কোনো একটি কোম্পানি সবচেয়ে ভালো AI মডেল তৈরি করতে পারে, যা বাকি সব মডেলের চেয়ে বেশি দক্ষ, তখন তারা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করতে পারবে। যেমনটা গুগল সার্চের ক্ষেত্রে ঘটেছে। ”

গুগল তার সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে এমন একটি মডেল তৈরি করেছে, যা পৃথিবীর সমস্ত তথ্যের জন্য মানুষকে একটি নির্ভরযোগ্য জায়গা দিয়েছে। এটি শুধু তাদের সার্চ ব্যবসার জন্য নয়, বরং বিজ্ঞাপণ এবং অন্যান্য সার্ভিসের মাধ্যমে গুগলকে অসীম মুনাফার পথে নিয়ে গেছে। অনেকেই মনে করেন, AI ইন্ডাস্ট্রির বড় কোম্পানিগুলোও একইভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।

AI ব্যবসার দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি, চালের মতো সস্তা পণ্য?

তবে মার্ক আন্দ্রিসেনের বক্তব্যে উঠে এসেছে আরেকটি বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি। এটি কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক, তবে বাস্তব। AI স্টার্টআপগুলো আসলে একটি ‘Race to the Bottom’ বা নীচের দিকে ছুটছে। অর্থাৎ, বুদ্ধিমত্তা বিক্রি করা হতে পারে চাল বিক্রির মতো সস্তা একটি ব্যবসা, যেখানে মুনাফার পরিমাণ খুবই কম এবং পণ্যগুলোর মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই।

তিনি বলেন, AI ইন্ডাস্ট্রি এমনও হতে পারে যেখানে স্টার্টআপগুলো মুনাফার জন্য প্রতিযোগিতা করতে করতে শেষ পর্যন্ত খুবই কম লাভজনক এবং তেমন কোনো পার্থক্যবিহীন পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হতে পারে।

আন্দ্রিসেনের মতে, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে AI বিক্রি করা হবে অনেকটা চাল বিক্রির মতো—সস্তা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের। “সবার হাতে একই ধরনের প্রযুক্তি থাকবে, এবং শেষ পর্যন্ত কেউ খুব বেশি লাভ করতে পারবে না, ” তিনি মন্তব্য করেন।

আন্দ্রিসেন বলেন, "শেষমেশ যে কেউ LLM (Large Language Model) তৈরি করতে পারবে। ওপেন-সোর্স LLM রয়েছে, নতুন LLM স্টার্টআপগুলো প্রতিদিনই গড়ে উঠছে। সবাই ইন্টারনেট থেকে তথ্য স্ক্র্যাপ করতে পারবে, GPU কিনতে পারবে, আর প্রায় একই ফলাফল পাবে। ”

এমনকি খুব দ্রুতই AI ব্যবসা চাল বিক্রির মতো হয়ে যেতে পারে, যেখানে সবাই একই ধরনের পণ্য তৈরি করছে এবং তা সস্তা দামে বিক্রি করছে।

LLM (Large Language Model) মডেলগুলো এখন ওপেন-সোর্স হয়ে গেছে। ইন্টারনেট থেকে তথ্য স্ক্র্যাপ করা, প্রয়োজনীয় GPU কিনে নেওয়া—এগুলো এখন অনেক সহজলভ্য। ফলে নতুন নতুন স্টার্টআপগুলো প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে, এবং তারা প্রায় একই ধরনের ফলাফল নিয়ে আসছে। এর ফলে মূল্যের পার্থক্য তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ছে এবং মুনাফার পরিমাণও সীমিত হয়ে যাচ্ছে।

ওপেনএআই এর ভবিষ্যৎ, গুগল নাকি চালের ব্যবসা?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, OpenAI কি ভবিষ্যতের গুগল হতে চলেছে? নাকি তারা এক বিশাল অর্থ বিনিয়োগ করে এমন এক ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে, যেখানে মুনাফার আশা ক্ষীণ? Ray Summit-এর দ্বিতীয় দিনে এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর পাওয়া গেছে। সেদিনই OpenAI ঘোষণা করেছিল তারা নতুন করে $6.6 বিলিয়ন বিনিয়োগ সংগ্রহ করেছে, যা কোম্পানির মূল্য দাঁড় করিয়েছে $157 বিলিয়ন।

OpenAI এর প্রধান প্রোডাক্ট অফিসার কেভিন ওয়েল এই বিষয়ে কথা বলেন এবং উল্লেখ করেন, "আমি খুশি যে ওপেন-সোর্স মডেলগুলো আছে। এটা আমাদের AI কে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ দিচ্ছে, যা আমাদের মিশনের একটি অংশ। ”

Meta এর লামা মডেলের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “মার্ক জাকারবার্গের ওপেন-সোর্স মডেলের কৌশল চমৎকার, এবং আমি তার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। কিন্তু OpenAI এর শক্তিশালী মডেলগুলো ভবিষ্যতে মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী এবং নিরাপদ অপশন হবে। ”

OpenAI ইতিমধ্যেই তার Whisper মডেলসহ কিছু ওপেন-সোর্স প্রয়াস চালু করেছে, তবে তাদের প্রধান ফোকাস এখনো ক্লোসড মডেল (Closed Model) গুলোর উপর। ওয়েল উল্লেখ করেন যে, “যখন প্রতিযোগীরা আমাদের ধরার চেষ্টা করবে, আমরা ততদিনে আরও তিন ধাপ এগিয়ে যাব। ”

উৎপাদন খরচ এবং AI-এর ভবিষ্যত মুনাফা

তবে ওয়েল এক পর্যায়ে স্বীকার করেন যে, AI ব্যবসার মুনাফা আদায়ের সময় খুব বেশি দীর্ঘ হতে পারে না। “যদি আপনি $3 খরচ করে কিছু তৈরি করতে পারেন, তাহলে $5, 000 চার্জ করে দীর্ঘ সময় টিকে থাকা কঠিন হবে, কারণ কেউ এসে আরও সস্তা মূল্যে সেই কাজটি করে দেবে। ”

এটি প্রমাণ করে, AI ইন্ডাস্ট্রির অনেক বড় কোম্পানির লাভ করার সময়সীমা খুবই সীমিত হতে পারে। যদিও OpenAI দ্রুত গতিতে বাড়ছে, তবে তারা এখনও প্রচুর মানি বার্ন (Money Burn) করছে। বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় $7 বিলিয়ন ফান্ড সংগ্রহ করার পর, তাদের উপর লাভজনক হওয়ার চাপ বেড়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ

মার্ক আন্দ্রিসেনের বক্তব্য আমাদের সামনে দুটি ভিন্ন ভবিষ্যৎ চিত্র তুলে ধরেছে। একদিকে, AI এমন এক শক্তিশালী প্রযুক্তি হয়ে উঠতে পারে যা পুরো বিশ্বের তথ্যপ্রাপ্তি, যোগাযোগ এবং বাণিজ্যে বিপ্লব ঘটাবে, ঠিক যেমন গুগল করেছে সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে। কিন্তু অন্যদিকে, AI এমন এক ব্যবসাও হতে পারে যেখানে কম্পানি গুলোর মুনাফার আশা কম এবং প্রতিযোগিতা তীব্র।

AI প্রযুক্তি এখনো নতুন, এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে এক জিনিস পরিষ্কার—বুদ্ধিমত্তা বিক্রির বিষয়টি যে চাল বিক্রি করে লাভ করার মতো হতে পারে, সেটাও এক সম্ভাবনা। AI-এর ভবিষ্যৎ কি গুগলের মতো অসীম মুনাফার দিকে নিয়ে যাবে, নাকি চালের মতো একটি সাধারণ পণ্য হয়ে উঠবে, তা কেবল সময়ই বলে দেবে।

-

টেকটিউনস টেকবুম

Level 2

আমি টেকটিউনস টেকবুম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 461 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস