এক নতুন দিগন্তের পথে চীনের যাত্রা! চীনের চিপমেকিং (Chip Making) নিয়ে যে গল্পটা আজ শোনা যাচ্ছে, সেটা যেন এক রূপকথার মতো। একটা সময় ছিল যখন চীন প্রযুক্তির দুনিয়ায় কেবলমাত্র কাঁচামাল সরবরাহকারী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ, সেই চীনই চিপ তৈরির যন্ত্রপাতিতে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে সারা বিশ্বের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে! এটা কি কেবল অর্থের খেলা, নাকি এর পেছনে রয়েছে এক গভীর পরিকল্পনা?
আমরা যখন চীনের এই বিশাল বিনিয়োগের দিকে তাকাই, তখন আমাদের বুঝতে হবে, এটি শুধুই একটি অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নয়। বরং এটি এক নতুন দিগন্তের দিকে চীনের যাত্রা। একটি দিগন্ত যেখানে তারা প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, চিপ, নিজেরাই উৎপাদন করতে চায়। চীন এখন আর অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে চায় না। তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে, নিজেদের ভাগ্য গড়ে তুলতে চাইছে।
চীনের এই বিশাল বিনিয়োগের পেছনে যে লক্ষ্যটা কাজ করছে, তা হলো ২০২৪ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার চিপমেকিং যন্ত্রপাতিতে খরচ করা। আমরা যদি একটু গভীরে যাই, তাহলে দেখতে পাবো, চীনের এই পরিকল্পনা নিছক ভবিষ্যতের জন্য একটা প্রস্তুতি। চীন মনে করে, আগামী দিনগুলোতে প্রযুক্তির বাজারে চিপের চাহিদা বহুগুণে বাড়বে। তাই তারা এখন থেকেই প্রস্তুত হতে চাইছে।
চীনের এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে এক ডজনেরও বেশি নতুন চিপ তৈরির Fab (ফ্যাব) অনলাইনে আসছে। এটা শুধু বড় বড় কোম্পানির জন্য নয়, ছোট এবং মাঝারি আকারের চিপ নির্মাতাদের জন্যও বিশাল একটি সুযোগ। SMIC (Semiconductor Manufacturing International Corp.) এবং Hua Hong-এর মতো বড় নামগুলো তো আছেই, কিন্তু চীনের এই নতুন উদ্যোগের সাথে সাথে ছোট চিপ নির্মাতারাও তাদের অবস্থান শক্ত করছে।
এখানে একটা বিষয় ভাবার মতো—বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি, তখন চীন কিভাবে এতো বড় বিনিয়োগ করছে? আসলে, চীন একমাত্র দেশ যে গত বছরের তুলনায় তাদের ফ্যাব টুলে (Fab Tools) ব্যয় বাড়িয়েছে। তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি উত্তর আমেরিকার মতো বড় বড় অর্থনীতিও যেখানে খরচ কমাচ্ছে, সেখানে চীন নিজের অবস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে।
চীনের এই উদ্যোগ কেবলমাত্র তাদের জন্যই লাভজনক নয়, বরং গ্লোবাল চিপমেকিং শিল্পের দিকটাও বদলে দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Applied Materials, Lam Research, KLA এবং জাপানের Tokyo Electron, নেদারল্যান্ডসের ASML-এর মতো কোম্পানিগুলো চীনা বাজার থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব অর্জন করছে। ASML-এর জন্য প্রায় ৪৯% এবং Applied Materials-এর জন্য প্রায় ৩২% রাজস্ব চীনা কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এসেছে।
এটা প্রমাণ করে, চীনের এই আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্লোবাল চিপমেকিং ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্রবিন্দুতে চীনকে নিয়ে এসেছে। চীনের বাজারে যাদের অংশগ্রহণ নেই, তারা হয়তো এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে পারবে না। চীনের এই বিনিয়োগের ফলে বিশ্বব্যাপী চিপমেকিং শিল্পে ক্যাপিটাল ইনটেনসিটি বেড়েছে, যা ২০২১ সাল থেকে পরপর চার বছর ধরে বার্ষিক ১৫% এর বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা কতদিন চলবে? Nikkei রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে চীনের নতুন সেমিকন্ডাক্টর সুবিধাগুলিতে ব্যয় স্বাভাবিক হওয়ার আশা করা হচ্ছে। তবে, এই সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্রপাতিতে ব্যয় বাড়বে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ এবং জাপানে। এই অঞ্চলগুলোও নিজেদের চিপ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এতে একটা জিনিস পরিস্কার, চীনের এই বিশাল বিনিয়োগ শুধু তাদের নিজেদের প্রযুক্তি উন্নতির জন্য নয়, বরং বিশ্ববাজারের দিকনির্দেশনাও পাল্টে দিচ্ছে। চীন এখন বিশ্ব চিপমেকিং ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে, যা অন্য দেশগুলোর জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।
এই গল্পের শেষ এখানেই নয়, বরং এটা কেবলমাত্র শুরু। চীনের এই চিপমেকিং বিপ্লব বিশ্বকে নতুন দিগন্তের পথে নিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির এই দুনিয়ায় চীন এখন শুধু একজন খেলোয়াড় নয়, বরং একজন নেতা। তাদের এই যাত্রা যে বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারকে নতুন নতুন সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে, তা এখন স্পষ্ট। অন্য দেশগুলোও কি এই নতুন দুনিয়ায় নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে? সেটাই এখন দেখার বিষয়।
-
টেকটিউনস টেকবুম
আমি টেকটিউনস টেকবুম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 470 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।