আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন টেকটিউনস কমিউনিটি? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আজকের বিশ্লেষণমূলক এই টিউনে আলোচনা করব, কেন অ্যাপল Intel এর প্রসেসর রেখে ARM প্রসেসর ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পরবর্তী জেনারেশনের ডিভাইস গুলোতে ARM কি ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে।
মুল আলোচনায় যাবার আগে আমাদের জানতে হবে Intel প্রসেসর কি এবং ARM প্রসেসর কি? চলুন শুরু করি,
সকল মাইক্রোপ্রসেসর নির্দিষ্ট কিছু ইন্সট্রাকশন সেট নিয়ে গঠিত। ইন্সট্রাকশনে নির্দেশনা দেয়া থাকে প্রোগ্রাম এবং সফটওয়্যার গুলো কিভাবে কাজ করবে। একই সাথে আপনাকে মাথায় রাখতে হবে সকল প্রসেসরের ইন্সট্রাকশন এক নয়। কাজের সুবিধার্থে আলাদা প্রসেসর গুলোর ইন্সট্রাকশন আলাদা ভাবে দেয়া হয় আর এই জন্য সকল প্রসেসর সকল ডিভাইসের জন্য উপযুক্ত নয়।
পিসি বা কম্পিউটারে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে x86 প্রসেসর, অন্যদিকে মোবাইল ডিভাইস গুলোতে ব্যবহৃত হচ্ছে ARM প্রসেসর। পিসিতে চাইলেও এতদিন ARM প্রসেসর ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না কারণ এর ইন্সট্রাকশন কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের জন্য উপযুক্ত নয়। ×86 প্রসেসর তৈরিতে শীর্ষ স্থানীয় কোম্পানি হচ্ছে Intel, যাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে অ্যাপল সহ সকল কম্পিউটার ম্যানুফেকচার কোম্পানি নির্ভর করতো কিন্তু যখন অ্যাপল তাদের চরম উদ্ভাবনী ক্ষমতা দ্বারা, ARM প্রসেসরে পিসি রান করার যোগ্যতা অর্জন করে ঠিক তখনই পুরো চিপ ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়। অ্যাপল কিভাবে পুরো চিপ ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে জানতে, "অ্যাপল এবং M1 চিপ কিভাবে পুরো চিপ ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে" এই টিউনটি পড়ে আসতে পারেন।
আমরা একটু আগে জানলাম ×86 ভিত্তিক প্রসেসর গুলো কম্পিউটার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর x86 ভিত্তিক প্রসেসর হিসেবে প্রথম প্রসেসর ছিল Intel এর 8086 প্রসেসরটি যা বাজারে আসে ১৯৭৮ সালে। আর এর পর থেকে বাজারে আসতে থাকে বিভিন্ন কোম্পানির x86 ভিত্তিক প্রসেসর তখন বাজারে Intel এর পাশাপাশি আরও ছিল AMD এবং VIA। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ পিসি গুলোতে রয়েছে ×86 এর 64 বিট প্রসেসর যা একই সাথে x86-64 অথবা AMD64 নামে পরিচিত। AMD64 প্রসেসরটি মূলত AMD এর যার সূচনা হয় ২০০৩ সাল থেকে।
CISC এবং RISC হচ্ছে দুই ধরনের আর্কিটেক্ট বা ইন্সট্রাকশন সেট৷ CISC হচ্ছে Complex Instruction Set of Computing এবং RISC হচ্ছে Reduced Instruction Set Of Coputing। RISC হচ্ছে ARM প্রসেসরের ইন্সট্রাকশন সেট এবং CISC হচ্ছে X86 প্রসেসরের ইন্সট্রাকশন সেট।
CISC প্রসেসর গুলো প্রতিটি টাস্কের জন্য ছোট আকারের জটিল ইন্সট্রাকশন এক্সিকিউট করে এবং RISC একই কাজের জন্য বিশাল আকারের সিম্পল ইন্সট্রাকশন এক্সিকিউট করে।
CISC এবং RISC সংক্রান্ত কথা গুলো বুঝতে হলে আপনাকে আগে ভাল করে, "অ্যাপল এবং M1 চিপ কিভাবে পুরো চিপ ইন্ডাস্ট্রিতে বিপ্লব নিয়ে এসেছে" এই টিউনটি পড়ে আসতে হবে।
যাই হোক চলুন x86 এবং ARM এর মধ্যে মূল পার্থক্য গুলো জানা যাক। ARM প্রসেসর গুলোতে Transistor এর পরিমাণ x86 এর তুলনায় কম থাকে আর সেজন্য এই প্রসেসরে পাওয়ারের পরিমাণ কম লাগে। মূলত এই জন্যই X86 প্রসেসর দ্বারা চালিত পিসিতে যে পরিমাণে ব্যাটারি বা বিদ্যুৎ এর দরকার হয়, ARM চালিত মোবাইল ফোনে তেমন লাগে না। আমরা যদি ম্যানুফেকচারিং এর দিকে তাকাই তাহলে দেখব ARM ভিত্তিক চিপ গুলো তৈরি করে ARM Holdings এবং বেশ কয়েকটা চিপ উৎপাদক কোম্পানি হল, Samsung, NIVIDIA, Qualcomm ইত্যাদি৷ একই সাথে অ্যাপলও কিন্তু তাদের মোবাইল ডিভাইস গুলোর জন্য নিজস্ব ARM চিপ তৈরি করে।
তো এতক্ষণের আলোচনায় আমরা এতটুকু পরিষ্কার হলাম যে অ্যাপল তাদের মোবাইল ডিভাইস গুলোতে ব্যবহার করছে ARM প্রসেসর এবং পিসি ডিভাইস গুলোতে ব্যবহার করেছে X86 প্রসেসর। এবার জানব অ্যাপলের X86 চিপ ব্যবহারের ইতিহাস।
অ্যাপল ১৯৮৪ সালে যখন তাদের প্রথম Macintosh কম্পিউটার লঞ্চ করে তখন তারা সেটিতে নামের 68000 নামের একটি মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করেছিল। 68000 প্রসেসরটি তৈরি করেছিল Motorola। ১৯৯৪ সাল থেকে তারা PowerPC নামে নতুন প্রসেসরে শিফট করে। নতুন এই প্রসেসরটি তৈরি করেছিল Apple–IBM–Motorola একসাথে মিলিত হয়ে। আর এই PowerPC, ২০০৬ সাল পর্যন্ত অ্যাপল তাদের সকল ডেক্সটপ এবং ল্যাপটপে ব্যবহার করেছে।
২০০৬ সাল থেকে অ্যাপল নিজেদের ম্যাকবুক এবং ডেক্সটপ কম্পিউটারে intel এর প্রসেসর ব্যবহার শুরু করে আর এই পদক্ষেপ তখনকার সময়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একই সাথে উইন্ডোজ সহ অন্য কম্পিউটার গুলো অ্যাপলের সাথে সাথে Intel প্রসেসর ব্যবহার করে।
অন্যদিকে ARM প্রসেসর ব্যবহৃত হতে থাকে একই সাথে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইস এবং অ্যাপলের আইফোন আইপ্যাডে। সেই সময় X86 প্রসেসরে আধিপত্য বিস্তার করে intel এর প্রসেসর এবং স্মার্টফোনে ARM প্রসেসর।
২২ জুন ২০২০, সালে অ্যাপলের CEO, Tim Cook ঘোষণা করেন তাদের পরবর্তী জেনারেশনের অ্যাপল ডেক্সটপ এবং ল্যাপটপ নতুন প্রসেসর ব্যবহৃত হবে। এবং সেই প্রসেসর তৈরি করেছে অ্যাপল নিজে। আর সেই বিপ্লব সৃষ্টিকারী প্রসেসরই হল ARM ভিত্তিক M1 চিপ।
নতুন এই চিপে ম্যাকবুকেও চলবে আইফোন এবং আইপ্যাডের অ্যাপ। এই চিপটি মূলত আইফোন এবং আইপ্যাডের আর্কিটেকচার সেট এর মত করেই ডিজাইন করা। ম্যাকবুক ARM এ শিফট করার অন্যতম সুবিধা হবে তাদের আইফোন, আইপ্যাড অ্যাপ গুলো একই সাথে ম্যাকবুকেও রান করা যাবে৷ মোট কথা অ্যাপ রানে ডিভাইস গত কোন রেস্ট্রিকশন থাকবে না।
ARM ভিত্তিক প্রসেসর দিয়ে যে ডেক্সটপ অপারেটিং সিস্টেম রান করা সম্ভব এটার প্রমাণ আমরা পেয়েছি Raspberry Pi এর মাধ্যমে ৷ ARM ভিত্তিক Raspberry Pi তেমন ব্যবহৃত না হলেও M1 ভিত্তিক চিপ কিছুদিনের মধ্যেই আশা করা যায় ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হবে।
প্রসেসরে intel এর প্রভাব কমাতে ইতিমধ্যে অ্যাপল ঘোষণা দিয়েছে, Microsoft 365 এবং Adobe Creative Cloud সরাসরি নতুন M1 চিপে রান করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে ইউটিউবে, M1 প্রসেসরে চালিত ম্যাকবুকের একাধিক রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে। রিভিউ গুলোতে দেখা যায় ডিভাইস গুলোতে খুব ভাল ভাবেই ভারী ভারী সফটওয়্যার গুলো রান হয়।
উইন্ডোজ পিসিতে দীর্ঘ সময় ধরে X86 প্রসেসর ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তো ARM এ ডেক্সটপ অপারেটিং সিস্টেম রান করার প্রচেষ্টা শুধু মাত্র যে অ্যাপলের এমনটি বলা যাবে না। মাইক্রোসফটও ARM প্রসেসরে ডেক্সটপ রান করার চেষ্টায় আছে। মাইক্রোসফট কয়েক বছর আগে Windows 10 এর নতুন একটি ভার্সন তৈরি করে যা Windows 10X নামে পরিচিত৷ আর Windows 10X রান করানোর জন্য নির্ধারণ করা হয় ARM প্রসেসরের Microsoft SurfaceBook Pro X। তবে SurfaceBook Pro X এ উইন্ডোজের প্রধান 64 bit অ্যাপ গুলো রান করা সম্ভব হয় নি। 64 bit অ্যাপ রান করার জন্য সেখানে আলাদা Emulator এর দরকার হয়।
SurfaceBook Pro X ডিভাইসে সরাসরি Adobe Creative Cloud রান হওয়ায় বেশ বিতর্কিত হয়েছে ডিভাইসটি, সেই দিক বিবেচনায় অ্যাপল অনেক এগিয়ে গিয়েছে।
ARM এ শিফট করার মাধ্যমে নিজেদের মত করে প্রসেসর ব্যবহারের ক্ষমতা চলে যাবে অ্যাপলের হাতে। অ্যাপল মোবাইল এবং ডেক্সটপ অ্যাপ এর পার্থক্য দূর করে একটি সিঙ্গেল অ্যাপ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে। তখন কোনটি আইফোন অ্যাপ আর কোনটি ম্যাকবুক অ্যাপ সেটা নিয়ে কোন কথা হবে না। যেখানে গুগল, অ্যান্ড্রয়েড এর মাধ্যমে ফোন অপারেটিং সিস্টেমে এবং মাইক্রোসফট, উইন্ডোজ এর মাধ্যমে ডেক্সটপ মার্কেটে রাজত্ব করছে, সেখানে অ্যাপল একাই দুই প্ল্যাটফর্মে এগিয়ে যাবে। তবে একই সাথে আমাদের মাথায় রাখতে হবে অ্যাপল ইউজারদের পরিমাণ কম সুতরাং উইন্ডোজ বা গুগলকে টপকিয়ে যাওয়া এতটা সহজও নয়।
যেহেতু প্রযুক্তি দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে, অ্যাপল নিজেদের ARM প্রসেসরে ডেক্সটপ করছে সুতরাং উইন্ডোজ বা এন্ড্রয়েডও বসে থাকবে না তারাও হয়তো M1 এর মত চিপ তৈরি করবে যেখানে মাল্টিপল ডিভাইস গুলো এক অ্যাপ প্ল্যাটফর্মে চলে আসবে।
মাইক্রোসফটের রাজত্ব উইন্ডোজে এবং গুগলের রাজত্ব এন্ড্রয়েডে। মাইক্রোসফট দীর্ঘদিন চেস্টার পরেও স্মার্টফোন অপারেটিং সিস্টেমে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারে নি। কিন্তু গুগল ডেক্সটপ অপারেটিং এর দিকে যথেষ্ট এগিয়ে গিয়েছে। ARM ভিত্তিক প্রসেসর গুলোর ব্যবহার ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেলে ধারণা করা যায় গুগলের Chrome OS এর অগ্রগতিও দারুণ তরান্বিত হবে।
ইউজারদের ডিভাইসের ক্ষেত্রেই শুধু RICS আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এমনটি নয়। বিজনেসের ক্ষেত্রেও RICS ধারনাটি সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে। Amazon এমন ক্লাউড সার্ভার অফার করছে যা ARM প্রসেসরে চালিত। ২০২০ সালের মে মাসে Amazon তাদের AWS EC2, X86 এর পরিবর্তে ARM প্রসেসরে লঞ্চ করে।
তো কেমন হল এই বিশ্লেষণমূলক টিউনটি জানাতে অবশ্যই টিউমেন্ট করুন, পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন আল্লাহ হাফেজ।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।