আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন টেকটিউনস কমিউনিটি? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আজকে অনেকদিন পর হাজির হলাম নতুন বিশ্লেষণ মূলক টিউন নিয়ে। আজকে আলোচনা করব TikTok নিয়ে।
TikTok, বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় অ্যাপ। ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয় এই অ্যাপ ঠিক কি কারণে এত জনপ্রিয় এটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে যারা এই অ্যাপটি ব্যবহার করে না তাদের প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে, এত জনপ্রিয়তার কারণ কি? এই মুহূর্তে ১.৫ বিলিয়নের বেশি ইউজার দ্বারা রেজিস্ট্রেশন করা এই অ্যাপটির সফলতার পেছনের কারণ নিয়েই আজকের এই টিউন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে, App Store এ সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাটাগরিতে প্রথম অ্যাপ হচ্ছে TikTok। একই ভাবে এটি Non Gaming অ্যাপ হিসেবেও প্রথম, আর এই অবস্থানে আসতে অ্যাপটির সময় লেগেছে মাত্র ২ বছর৷ অ্যাপটির কন্টেন্ট প্রতিনিয়ত ভাইরাল হচ্ছে ইউটিউব, ফেসবুক এবং নেটফ্লিক্সে। TikTok এর মুল কোম্পানির, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইউরোপ, ব্রাজিল, ভারত এবং চীনের মত লোকেশন রয়েছে ২০, ০০০ এর মত কর্মী।
অধিকাংশ মানুষ TikTok কে শুধুমাত্র গানের সাথে অভিনয় করার অ্যাপ হিসেবে দেখলেও, এটি এমন একটি অ্যাপ যাতে ইউজারদের চাহিদা মত সকল সুবিধা রয়েছে। ইউজাররা TikTok কে একই সাথে, মিমি শেয়ার, সাইন্স এক্সপেরিমেন্ট, সৃজনশীল কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যম হিসেবে ভাবে।
আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে কিভাবে এবং কোথা থেকে এসেছে এই ব্যাপক জনপ্রিয় অ্যাপটি। চলুন সেদিকে আলোকপাত করা যাক, TikTok এর মালিকানায় রয়েছে, ByteDance নামের একটি চীনা কোম্পানি। ByteDance প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১২ সালে এবং এত বর্তমান সদর দপ্তর বেইজিং এ। ByteDance এর বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা এটিকে বিশ্বের সর্বোচ্চ মূল্যায়নের কোন প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ByteDance এর প্রতিষ্ঠাতা Zhang Yiming ছিলেন মাইক্রোসফটের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একই সাথে চীনের ফেসবুক ভার্সন সহ একাধিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করে বেশ আলোচিত হয়েছেন।
২০১৬ সালে চীনে Doyenne নামে একটি শর্টফর্ম ভিডিও অ্যাপ লঞ্চ হয়। খুব কম সময়ের মধ্যে অ্যাপটি মিলিয়ন ইউজার তৈরি করতে সক্ষম হয়। ২০১৭ এর দিকে তারা তাদের এই ধারণা অন্যান্য দেশের মধ্যেও প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ কিন্তু সেই সময় তাদের বড় একটি প্রতিদ্বন্ধী অ্যাপ ছিল Musically যা তখন প্রথম সারির অ্যাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এখানে বলে রাখা ভাল Musically লঞ্চ করা হয় ২০১৪ সালে। Musically, এর মালিকানা কোম্পানি ২০১৭ সালের দিকে আর্থিক ভাবে কিছুটা সমস্যায় থাকলে ByteDance তাদের ১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয়। Musically কিনে নেয়ার পর ByteDance এটিকে TikTok এর সাথে মার্জ করে বিশ্বব্যাপী লঞ্চ করে।
ByteDance সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ দিয়ে তাদের বিজনেস শুরু করলেও এখন স্মার্টফোন তৈরির কথা ভাবছে। ইতিমধ্যে একটি ফোন লঞ্চও করেছে, তাদের নতুন ফোনের নাম দিয়েছে Smartisan Jianguo Pro 3। Smartisan Jianguo Pro 3 টি ২০১৯ সালের শেষ দিকে রিলিজ করা হয়।
বর্তমানে টিকটক হয়তো ব্যাপক ভাবে প্রোমোশন চাচ্ছে আর এজন্যই তারা সম্প্রতি ফ্রান্সের একটি নিউজ কোম্পানি কিনে নিয়েছে এবং Los Angeles এর একটি নিউজ কোম্পানির স্টেইক কিনেছে। একই ভাবে Reddit এর মেজর স্টেইক কেনার ইচ্ছে থাকলেও Tencent এর জন্য পেরে উঠছে না। অন্যদিকে TikTok এর এমন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টুল রয়েছে যা ৫০০০ ভিন্ন ভিন্ন নিউজ সোর্স থেকে মাত্র ২ সেকেন্ডে রিডারদের জন্য ৪০০ ওয়ার্ডের নিউজ আর্টিকেল তৈরি করে ফেলতে পারবে।
TikTok অন্য যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ থেকে পাওয়ারফুল টুল ব্যবহার করে যা ইউজারদের দেয় দুর্দান্ত সোশাল মিডিয়া অভিজ্ঞতা। TikTok আপনি যত বেশি ব্যবহার করবেন এটি ততবেশি শিখবে। এখানে ফলো অপশন থাকলেও তারা সব সময় ফলো অনুযায়ী ফিড দেবে এমনটি নয়। আপনি যেসমস্ত ভিডিওতে বেশি সময় দেবেন সেই ক্যাটাগরির ভিডিও গুলো বেশি আসা শুরু করবে, আর যেগুলো ইগ্নুর করবেন সেগুলো কম আসবে। আর এই ধারনাটি TikTok কে Facebook, YouTube, Spotify এবং Netflix থেকে আলাদা করেছে। এই প্ল্যাটফর্ম গুলোতে ইউজারদের পছন্দ ডিটেক্ট করতে AI ব্যবহৃত হলেও TikTok আক্রমণাত্মক ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইউজার কি দেখবে। যেখানে ইউজাররা কন্টেন্ট সিলেক্ট করতে পারে না।
বিজনেস স্ট্রেটেজি হিসেবে Bytedance, TikTok এর দুইটি ভার্সন তৈরি করেছে৷ একটি ভার্সন চীনে এবং অন্যটি বাকি বিশ্বে ব্যবহৃত হয়। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন TikTok কিভাবে আয় করে, স্বাভাবিক ভাবেই TikTok এডের মাধ্যমে আয় করে একই সাথে emoji, Sticker এর মত ভার্চুয়াল প্রোডাক্ট বিক্রি করেও আয় করে। আর ভার্চুয়াল পণ্য গুলো কেনাবেচা হয় ডিজিটাল কারেন্সির মাধ্যমে।
TikTok এতটাই জনপ্রিয় যে ভারত এবং চীনের প্রত্যন্ত তুলনামূলক গরিব অঞ্চল গুলোতেও অ্যাপটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। দেখা গেছে টিকটকের ২৫% ডাউনলোড আসে শুধুমাত্র ভারত থেকেই যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে৷
বিশ্বজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয় এই অ্যাপটি একই সাথে বেশ বিতর্কিত। সম্প্রতি তথ্য চুরি এবং অনলাইনে শিশু অধিকার খর্ব করার জন্য প্রতিষ্ঠানটি Children's Online Privacy Protection Act, অথবা COPPA, কে ৫.৭ মিলিয়ন ডলার জরিমানা দিতে হয়েছে। একই অপরাধে ইউটিউবকেও জরিমানা করা হয়েছে তবে তারা এখনো লড়াই করে যাচ্ছে।
অ্যাপটি চীনের হওয়াতে পুরো যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে গত বছর থেকে আলোচনায় রয়েছে৷ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের দাবী অ্যাপটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি করে চীনে হস্তান্তর করতে পারে। Mark Zuckerberg ও এই অ্যাপের বিরুদ্ধে কথা বলেছে।
Mark Zuckerberg ই নয় বড় বড় টেক কোম্পানি গুলোর লিডাররাও এই অ্যাপ নিয়ে তাদের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প কয়েকবার তার রাজনৈতিক বক্তব্যে অ্যাপটির বিরুদ্ধে কথা বলেছে।
ফেসবুকের ডেটা বিশ্লেষণে দেখা গেছে গত বছর ট্রাম্প তার বিভিন্ন প্রচারণায় ৮০, ০০০ ডলারের মত ব্যয় করছে এবং বিজ্ঞাপনটি দেখেছে প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন আমেরিকান। আরও জানা যায় বিজ্ঞাপণ গুলো ফ্লোরিডা, টেক্সাস এবং ট্রাম্প ভোট-প্রাপ্ত বেশ কয়েকটি রাজ্যকে টার্গেট করে দেয়া হয়েছিল।
২২ জুলাই পর্যন্ত ট্রাম্পের এই ধরনের বিজ্ঞাপণে সর্বোচ্চ ভিউ হয়েছে ৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপণে, যেখানে বলা হয়েছিল "TikTok is Spying on You"। জানা গেছে এই বিজ্ঞাপনটি ৪০০, ০০০ আমেরিকার নাগরিকদের কাছে পৌছাতে ৩, ০০০ ডলার ব্যয় করা হয়। ফেসবুক এর পরিষ্কার তথ্য বলছে ভিডিওটির অর্ধেক দর্শক ছিল মহিলা যাদের বয়স ১৮-৩৪ বছর। বাকি এড গুলো একই বয়সের পুরুষদের টার্গেট করে দেয়া হয়।
Social Media Research Centre এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ফেসবুকে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপণ বিশেষজ্ঞ, Tristan Hotham বলছেন তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই ট্রাম্প এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। এছাড়াও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র থেকে অ্যাপটি পুরোপুরি ব্যান করারও পরিকল্পনা করেছিল। একই সাথে তখন ভারতে সম্পূর্ণ ভাবে ব্যান করা হয় অ্যাপটিকে।
TikTok ব্যাপক ভাবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ জানতে হলে আপনাকে অ্যাপটি ইন্সটল দিতে হবে এবং কিছুক্ষণ ব্যবহার করতে হবে। অ্যাপটিতে এমন এলগোরিদম ব্যবহার করা হয় যেখানে ইউজারদের কাছে এটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠে৷ অ্যাপটিতে বিনোদন পাবার অন্যতম কারণ হতে পারে এর শর্টফর্ম বৈশিষ্ট্য।
যাইহোক TikTok যেভাবে নতুন প্রজন্মকে টার্গেট করেছে, হয়তো এটি বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী কোম্পানি হতে আর বেশি দেরি নেই।
তো কেমন হল এই বিশ্লেষণমূলক টিউনটি জানাতে অবশ্যই টিউমেন্ট করুন, পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন আল্লাহ হাফেজ।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।