জাপানিজ ফোন জায়েন্টদের উত্থান এবং পতনের গল্প

টিউন বিভাগ প্রযুক্তি কথন
প্রকাশিত
জোসস করেছেন
Level 34
সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা

আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আপনারা জানেন আমি প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে বিশ্লেষণ মূলক টিউন করে থাকি। টিউন গুলোতে কোম্পানির বিভিন্ন ভাল দিক খারাপ দিক, তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, সুযোগ প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি উঠে আসে। তো আজকেও এমন একটি টিউন নিয়ে হাজির হলাম।

অনেকে জানে আবার হয়তো জানে না, জাপান একসময় মোবাইল প্রযুক্তিতে ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে। ১৯৯৮ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মত, জাপানের একটি ট্রেড শোতে মোবাইলের মাধ্যমে ভিডিও কল করা হয়। তখন প্রযুক্তিটি বিশ্বজুড়ে চালু হবার প্রায় ১ দশক আগেই প্রদর্শন করা হয়েছিল। ২০০১ সালে Sharp লঞ্চ করে বিশ্বের প্রথম Mass-Market ক্যামেরা ফোন। তখন Matsushita p2101 ফোন উপযুক্ত 3g ফোন হিসেবে দেখা আত্মপ্রকাশ করে। এর কয়েক বছর পর বাজারে আসে Sharp 912 ফোন, যাতে ছিল মোবাইল পেমেন্ট, 3 এর বেশি মেগাপিক্সেল ক্যামেরা, এবং ডিজিটাল টিভি স্ট্রিমিং সুবিধা। তখনো কিন্তু আইফোন বা অ্যান্ড্রয়েড ফোন লঞ্চ হয় নি।

নব্বইয়ের দশকে প্রযুক্তি গত ভাবে এতটা উন্নত থাকার পরেও কিভাবে বা কেন জাপানি কোম্পানি গুলো পিছিয়ে গিয়েছিল এটা জানার আগ্রহ সবারই থাকতে পারে। আর আজকের এই বিশ্লেষণ মূলক টিউনে আমি আলোচনা করার চেষ্টা করব জাপানিজ ফোন কোম্পানি গুলোর দুর্দান্ত উত্থান এবং বিপর্যয়কর পতন নিয়ে।

বর্তমান জাপানের স্মার্টফোন মার্কেট

যদি বর্তমানের দিকে দেখি, কিছুদিন আগে শুনা যায় Sony এর মত অন্যতম জনপ্রিয় স্মার্টফোন কোম্পানি তাদের স্মার্টফোন বিজনেস বাদ দেয়ার কথা ভাবছে। জানা যায় তারা শেষ কোয়ার্টারে মাত্র ৬০০, ০০০ এর মত স্মার্টফোন বিক্রি করে, যেখানে Samsung এর মত কোম্পানির এটি একদিনের বিক্রয়। তাছাড়া আরও জানা গেছে Sony এর মোট উপার্জনের মাত্র ৪% আসে স্মার্টফোন থেকে।

জাপানের দেশীয় বাজারেও জাপানি কোম্পানি গুলোর আধিপত্য বজায় নেই। জাপানের স্মার্টফোন বাজারে সবচেয়ে বেশি মার্কেট দখল করে আছে Apple যার পরিমাণ ৪৩%। দ্বিতীয় অবস্থানে Sharp থাকলেও এর বেশির ভাগ শেয়ার এখন তাইওয়ানের Foxconn এর দখলে। অন্যদিকে Fujitsu, Kyocera, Sony এর মত দেশি কোম্পানি গুলো একসাথে ৩০% এর কম মার্কেট দখল করে আছে। দেশের ভেতরেই যেখানে এই অবস্থা, দেশের বাইরে বলতে গেলে স্মার্টফোন কোম্পানি গুলোর বিজনেস নেই বললেই চলে। আর এই সব ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় জাপানি স্মার্টফোন গুলো আলটিমেটলি হারাতে বসেছে।

স্মার্টফোনে জাপানের স্বর্ণযুগ

নব্বইয়ের শেষ এবং ২০০০ এর শুরুর দিকে জাপানি কোম্পানি গুলো স্মার্টফোন প্রযুক্তির দিক থেকে ছিল সবার থেকে এগিয়ে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনে এগিয়ে থাকার পেছনে ছিল তিনটি কারণ,

প্রথমত সেই সময়টিতে যুদ্ধ পরবর্তী শিল্পায়ন জাপানের কোম্পানি গুলোকে জায়েন্টে পরিণত করে। ১৯৮৯ সালের দিকে, Sony, Panasonic, Toshiba সহ আরও ৩২ টি কোম্পানি মার্কেট ক্যাপিটালের দিকে ছিল বিশ্বের টপ ৫০ কোম্পানির তালিকায়। আর অধিকাংশ কোম্পানি গুলো প্রযুক্তি কোম্পানি হওয়াতে উদ্ভাবনে তারা ছিল এগিয়ে।

দ্বিতীয় কারণ ছিল, জাপানের মিলিয়নের বেশি জনগণের মধ্যে ছিল প্রচুর ইলেক্ট্রনিক পণ্যের ভোক্তা৷ অর্থনৈতিক ভাবে অগ্রসর থাকায় জনগণের টেক প্রোডাক্টের দিকে ছিল ব্যাপক আগ্রহ। রোবটিক্স তথা নতুন সকল প্রযুক্তিই আকৃষ্ট করতো জাপানি ভোক্তাদের।

তৃতীয়ত জাপানের ছিল, NTT DOCOMO, KDDI, Soft Bank এর মত তিনটি বৃহৎ মোবাইল Carrier সার্ভিস। নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির জন্য অন্যদেশের সাহায্যের দরকার ছিল না বলে তারা সহজেই নিজেদের জনগণের জন্য ইন্টারনেট সার্ভিস ইকো-সিস্টেম তৈরি কর‍তে পেরেছিল।

নব্বইয়ের শেষ দিকে জাপান তাদের SMS প্রোটোকলকে ইমেইল সার্ভিসে রিপ্লেস করে এবং এর মধ্যমে তারা, Email, Weather, Stocks, Sports এর মত আরও সেবা গ্রাহকদের জন্য নিয়ে আসে। তারা ১৯৯৯ সালে তৈরি করে কাস্টম মোবাইল ইন্টারনেট প্রযুক্তি। প্রযুক্তিটি i-mode নামে পরিচিত ছিল। মোবাইল ফোকাস ইন্টারনেট ব্যবহারকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় এই প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির ফিচার গুলো ছিল CHTML, Payment, Advertising ইত্যাদি।

২০০৪ সালের মধ্যে তারা পেমেন্টের জন্য কাস্টম ওয়ালেট সুবিধা নিয়ে আসে। যেখানে NFC এর মাধ্যমে দেশজুড়ে সহজ পেমেন্ট সুবিধা পেতে থাকে গ্রাহকরা।

গ্রাহকদের গ্রহণযোগ্যতা হারানোর কারণ গুলো

কোম্পানি গুলো কেবল নতুন প্রযুক্তিই নিয়ে আসছিল না, তারা ইউজারদের বিভিন্ন ভাবে তাদের ইন্টারনেট সার্ভিস ব্যবহার করতেও বাধ্য করছিল। যেমন তারা দেশিয় ফোন মেকারদের বাধ্য করছিল যেন তারা ফোনগুলোতে ডেডিকেটেড i-mode বাটন দিয়ে দেয়। তারা ইউজারদের নিজস্ব ওয়ালেট সেবা ব্যবহার থেকে শুরু করে সব কিছু ব্যবহার কারাচ্ছিল। এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছিল জাপানের গ্রাহকরা বাকি বিশ্ব থেকে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।

আর তখন গ্রাহকরা নতুন কিছু চাইতে থাকে। তারা নতুন কোন প্রযুক্তি বা কোম্পানি চায়, যারা বিদ্যমান প্রযুক্তির সাথে সাথে সকল সার্ভিস গুলো এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসবে, এবং বিশ্বব্যাপী তারা এক হতে পারবে। আর এটার জন্য জাপানের গ্রাহকদের ২০০৮ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

জাপানি কোম্পানি গুলোর খারাপ দিনের শুরু

হটাৎ করে জাপানে প্রবেশ করে iOS, এবং Android। আর দেশটিতে এই দুই অপারেটিং সিস্টেম প্রবেশের পর থেকেই দেশীয় কোম্পানি গুলোর খারাপ দিনের শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই iOS, এবং Android অপারেটিং সিস্টেম জাপানিজ মডেল গুলোর incompatible ছিল।

যেখানে জাপানিজ মডেল গুলোর Weather, Stock, Text মেসেজ সার্ভিসের জন্য বিশেষ কাস্টম অবকাঠামোর প্রয়োজন হতো, সেখানে iOS, এবং Android এর জন্য এগুলোর প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। স্ট্যান্ডার্ড ডেটা প্লেনের মাধ্যমে অ্যাপ ব্যবহারে আগের কোন কিছুর প্রয়োজন হতো না।

iOS, এবং Android এর স্ট্যান্ডার্ড প্ল্যানের ফলে ইউজারদের আর কাস্টম মেইড ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয় নি তারা সরাসরি রিয়েল ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায়। ফোনে যখন HTML ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ চলে আসে, তখন জাপানের বিদ্যমান প্রযুক্তি রাতারাতি আউটডেটেড হয়ে যায়।

কেন জাপান স্মার্টফোন তৈরিতে সব সময়ের জন্য পিছিয়ে যায়

ইউজাররা গুগল এবং অ্যাপলের দিকে এগিয়ে যায়। End-to-End সার্ভিস বাজারে চলে আসাতে আগের মত ফোন ডিজাইনের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক প্রোভাইডারদের আধিপত্য কমে যায়। মোবাইল গুলো স্বাধীন ভাবে ডিজাইনের সুযোগ পায়। হার্ডওয়্যার গুলোতে আসে ইউনিক সব ডিজাইন। ফোন গুলো পায় বড় স্ক্রিনের টাচস্ক্রীন ডিসপ্লে।

সুতরাং জাপানের সাথে, চীন, তাইওয়ান, কোরিয়ার মত দেশ গুলোর Differentiation কমতে থাকে, Competition বাড়তে থাকে এবং সব মিলিয়ে Profitability ও নিচের দিকে যেতে থাকে। এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যায় যখন ২০০৮ সালে Soft Bank আইফোনের সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। Soft Bank আলাদা হয়ে যাওয়ায় দেশ জুড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী নেটওয়ার্ক সার্ভিসদের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক প্রোমোশন চালানো শুরু করে।

একই সাথে সমসাময়িক গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস জাপানেও আঘাত হানে, যেখানে জাপান আগে থেকে অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা চাপে ছিল।

জাপানের ফোন কোম্পানি গুলোর সিদ্ধান্তহীনতা

এই সময় জাপানের ফোন কোম্পানি গুলোও খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে৷ ইতিমধ্যে তাদের ফোন গুলো গ্রহণযোগ্যতা হারাতে শুরু করেছিল। তবে কোম্পানি গুলোর ফোনের পাশাপাশি অন্যান্য বিজনেস ইউনিটও ছিল। তাই তারা তাদের বিজনেস বাঁচাতে সেই সমস্ত ইউনিট গুলোর দিকে গুরুত্ব দিতে থাকে। নতুন ক্যাটাগরির ফোনে বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার চেয়ে তারা বাকি ইউনিট গুলোতেই মনোনিবেশ করে।

২০০৮ সালে যেমন Mitsubishi Electronic তাদের বিজনেস নিয়ে বিপদে ছিল, তেমনি Sanyo তাদের ফোন বিজনেস Kyocera এর কাছে বিক্রি করে দেয়। অন্যদিকে Hitachi, Casio এক সাথে মার্জ হয়ে যায় এবং ২০১৩ পর্যন্ত তারা একসাথে স্মার্টফোন বাজারে আনলেও, ২০১৬ সালে NEC এর মধ্যে হারিয়ে যায়। Toshiba তাদের শেষ অ্যান্ড্রয়েড ফোন লঞ্চ করেছিল ২০১৪ সালে। Sharp তাদের ৬৬% শেয়ার বিক্রি করে দেয় Foxconn এর কাছে। এবং সর্বশেষ Panasonic, ২০১৯ সালে তাদের Luga i7 ফোন লঞ্চ করে।

বর্তমান এবং শেষ অবস্থা

শেষ পর্যন্ত জাপান বাজারে রয়েছে Kyocera যারা সাধারণত Rugged ফোন বিক্রি করে, Fujitsu, Aero লাইন ফোন বিক্রি করে। আর এই সকল জাপানিজ কোম্পানি গুলোর মধ্যে একমাত্র Sony তাদের কোন শেয়ার অন্য কোম্পানির কাছে বিক্রি করে নি এবং এখনো যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ভোক্তাদের জন্য স্মার্টফোন তৈরি করছে।

এখানে বলে রাখা ভাল জাপানে এখনো মোবাইল ওয়ালেট সিস্টেমটি রয়েছে যা ২০০৪ সালে চালু হয়েছিল। তাছাড়া দেশটিতে এখনো iMode বেশ জনপ্রিয় যা ৮০ মিলিয়নেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার ধারণ করছে এবং শুনা গেছে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ফিচার ফোন গুলোতে এই সার্ভিসটি থাকবে।

শেষ কথাঃ

Sony যদি পুরোপুরি তাদের স্মার্টফোন উৎপাদনে আগের মত ফিরেও আসে তাহলেও জাপানের আগের স্বর্ণযুগ ফিরে পাবার সম্ভাবনা নেই। সময়ের সাথে ইউজাররা নতুন কিছু চাইবে, আরও স্বাধীনতা চাইবে এটাই স্বাভাবিক। ইউজারদের চাহিদা বুঝতে না পেরে এক সময়ের বড় বড় টেক জায়েন্ট হারিয়ে যাবার উদাহরণ নতুন নয়।

Level 34

আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।

কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস