আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আশা করছি সবাই ভাল আছেন। আপনারা জানেন আমি প্রায়ই বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে বিশ্লেষণ মূলক টিউন করে থাকি। টিউন গুলোতে কোম্পানির বিভিন্ন ভাল দিক খারাপ দিক, তাদের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, সুযোগ প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি উঠে আসে। তো আজকেও এমন একটি টিউন নিয়ে হাজির হলাম। আজকে আমরা জানব Aggregation থিউরি নিয়ে।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী কোম্পানি গুলোর কথা যদি বলি তাহলে, Amazon, Google, Facebook এর কথা বলতে হবে। এই কোম্পানি গুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যেগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। Amazon, Google, Facebook ভিন্ন ভিন্ন বিজনেস মডেলে পরিচালিত হলে আমরা যদি গভীর ভাবে তাদের দিকে তাকাই তাহলে একটি ট্রিক্সই দেখতে পাবো৷ এই এক ট্রিক্স দিয়েই কিন্তু গত ২০ বছর ধরে তারা বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে আর এটি তাদের দিয়েছে এক বিজনেস সুপার পাওয়ার৷ আর তারা যে ট্রিক্সটি ব্যবহার করে এটি হচ্ছে Aggregation থিউরি।
Ben Thompson এই Aggregation থিউরির কথা প্রথম বর্ণনা করেন এবং Google, Facebook এর মত কোম্পানি গুলোর বৃদ্ধিতে এই থিউরির প্রভাব তার একটি সাক্ষাতকারে তুলে ধরেন।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল কাস্টমার তৈরি করা, এত এত সার্ভিসের ভীরে নিজের সার্ভিসকে কাস্টমারদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলা সবচেয়ে কঠিন কাজ। আর তাই বিদ্যমান কোম্পানি গুলো তাদের কাস্টমার ধরে রাখতে নিজেদের বিজনেসে যোগ করছে নতুন নতুন সার্ভিস।
চলুন এই Aggregation থিউরির কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। Uber এর কথাই ভাবুন। Uber আসার আগে কোন গাড়ি ভাড়া করার আগে একটি নির্দিষ্ট পক্ষের মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া করতে হতো৷ তাদের ছাড়া গাড়ি ভাড়া সম্ভব হতো না। তারা ড্রাইভারদের কন্ট্রোল করতো। সিস্টেমের বাইরে গিয়ে তাদের সাথে বিজনেস করা যেতো না। Uber এই সিস্টেমটি পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। এখন যেকেউ ড্রাইভার হতে পারে, ইউজাররা কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়াই গাড়ি ভাড়া করতে পারে। উবার এখানে ড্রাইভারদের কন্ট্রোল করছে না। তবে সার্ভিস ঠিক রাখার জন্য তারা কিছু ড্রাইভারদের বাদ দিচ্ছে, সেটা ভিন্ন কথা।
আপনি উবারের বিজনেস মডেল খেয়াল করুন, তারা প্যাসেঞ্জার এবং ড্রাইভারদের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করেছে, তাদের সবাইকে একত্র করছে এবং উবার সেখানে মিডিলম্যান হিসেবে কাজ করছে যা একটি Aggregation থিউরির প্রয়োগ।
চলুন আমরা দেখি গুগল কিভাবে এই Aggregation থিউরি কাজে লাগিয়েছে, ।
ইন্টারনেটে বিলিয়নের বেশি ইনফরমেশন, ডেটা এবং কয়েক মিলিয়ন ওয়েবসাইট রয়েছে। তো এই বিশাল পরিমাণ তথ্য থেকে ইউজারের প্রয়োজনীয় তথ্য বের করা খুব গুরুত্বপূর্ণ আর এই সমস্যাটির সমাধান দিয়েছে গুগল। Google এ সার্চ করার সাথে সাথে ইউজাররা পেয়ে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় তথ্য৷ নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে কিন্তু আর ইউজার গুগলে থাকছে না, কিন্তু এই পক্ষকে যুক্ত করে দিয়েছে Google।
বলতে গেলে পুরো ইন্টারনেটকেই Aggregate করেছে Google। আপনি নিজের অভ্যাস গুলোর দিকেই খেয়াল করুন, আপনি কয়টি ওয়েবসাইট বুকমার্ক করে রেখেছে? হাতে গুনা কয়েকটি, যখনই দরকার হচ্ছে গুগলে সার্চ দিচ্ছেন। গুগলে সার্চ দিচ্ছেন আশেপাশে ভাল কোন রেস্টুরেন্ট আছে কিনা। এটা ছিল গুগল সার্চের অবস্থা, গুগলের অন্যান্য প্রোডাক্ট গুলো যেমন, Gmail, Google Map ওইগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। সবচেয়ে শক্তিশালী Aggregation কাজে লাগিয়ে নিজেদের সুপার বিজনেস পাওয়ার দিয়েছে গুগল।
Ben Thompson এর থিউরি বলে আপনার বিজনেসে আপনাকে সাপ্লাইয়ার এবং কনসিউমারকে কানেক্ট করতে হবে এবং ডিস্ট্রিবিউটরকে মাঝখানে থাকতে হবে। বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিস্ট্রিবিউটর এবং সাপ্লাইয়াদের সাথে একীভূত হয়েছে। যেমন Ford কেবল গাড়িটিই এটি তৈরি করে না, এটি আপনার বিক্রি করে এমন ডিলারশিপটিকে ফ্র্যাঞ্চাইজ করে তবে ইন্টারনেট এটি পরিবর্তন করেছে। আপনি যদি cars, Ask.com অথবা Expedia এর দিকে তাকান তাহলে দেখবেন তারা সব কিছু এক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে বিভিন্ন পক্ষকে একত্রিত করছে।
আমরা যদি ফেসবুক দেখি, ফেসবুক তাদের এমন ভাবে তৈরি করেছে আপনি সব কিছু ফেসবুকে পাচ্ছেন। ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা থেকে শুরু করে, মেসেজিং, ভিডিও চ্যাটিং, মিটিং, কেনাকাটা সব কিছুই পাচ্ছে ফেসবুকে এর যে ভাল Aggregation এর উদাহরণ আর কি হতে পারে৷ কোন ইভেন্ট তৈরি করবে মানুষ ফেসবুকে ইভেন্ট খুলছে যা ইমেইলের মাধ্যমে ইনভাইটেশন পাঠানো থেকে অনেক সহজ। বিজনেস গুলো কাস্টমার পেতে ফেসবুক এডে বিনিয়োগ করছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।
এই Aggregation থিউরি পুরো টেক বিশ্বে যেমন দারুণ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে তেমনি এটি জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন বিতর্কের। ফলে বিভিন্ন কোম্পানি মুখোমুখি হচ্ছে Antitrust মামলার। গত বছর আমরা Amazon, Google, Facebook এর মত কোম্পানি গুলোকে Antitrust শুনানির মুখোমুখি হতে দেখেছি।
Aggregation থিউরির মন্দ দিক হচ্ছে আক্রমণাত্মক ভাবে কাস্টমার বা অডিয়েন্স ধরে রাখার চেষ্টা। এই বিষয়টি আপনাকে বুঝাতে আমি ফেসবুকের উদাহরণ দেব৷ চলুন ফেসবুকের একেবারে শুরুতে চলে যাই, আপনি যদি শুরু থেকে ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন তাহলে আমার সাথে অবশ্যই একমত হবেন।
ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয়েছিল, ফ্রেন্ডশিপ, নিউজ-ফিড, পারসোনাল মেসেজিং এর মাধ্যমে। তখনও ফেসবুকের কনভারসেশন রিয়েল টাইমে হতো না। বাজারে যখন রিয়েল-টাইম চ্যাটিং অ্যাপ গুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে তখনই ফেসবুক তাদের মেসেঞ্জারের আইডিয়া ডেভেলপ করতে থাকে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল যাতে ফেসবুকের ইউজাররা অন্য প্ল্যাটফর্মে না যায়।
পরবর্তী আমরা দেখেছি ফেসবুকে গেমিং নিয়ে আসা, ইউটিউবের মত ভিডিও স্ট্রিমিং নিয়ে আসা, মেসেঞ্জারে অডিও, ভিডিও কল এড করা, স্টোর ফিচার এড করা। সর্বশেষ করোনা মহামারীতে যখন Zoom এর মত প্ল্যাটফর্ম গুলো জনপ্রিয়তা পেতে থাকে তখন Messenger Room নিয়ে আসা। ফেসবুকের এই সকল ফিচারের মুল উদ্দেশ্যই ছিল আক্রমণাত্মক ভাবে ইউজারের ধরে রাখা৷ এই বিষয় গুলোর জন্যই Aggregation থিউরি বর্তমানে বেশ বিতর্কিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আপনি Walmart এর কথা চিন্তা করুন, একটি Walmart ফিজিক্যাল সুপার স্টোরের আশেপাশে আরও অনেক স্টোর থেকে। এখন ধরুন আপনার একটি ক্যান্ডলের দোকান রয়েছে আপনি Walmart এ সেগুলো পাইকারি দরে বিক্রি করতে চান বা তাদের সাথে বিজনেস করতে চান, সেক্ষেত্রে Walmart চাইলেও আপনার সাথে বিজনেস করতে পারবে না কারণ সেখানে জায়গা স্বল্পতা থাকতে পারে। এবার আমরা যদি এই Walmart কে ইন্টারনেট নিয়ে যাই, সেখানে অবশ্যই জায়গা স্বল্পতা বলতে কোন কিছু থাকবে না, যেকোনো বিজনেস তাদের সাথে এড হতে পারে এবং যেকোনো কাস্টমার তাদের প্রয়োজনমত প্রোডাক্ট কিনতে পারবে। এবার Walmart এর বিজনেস পাওয়ারের দিকে লক্ষ্য করুন। তারা কিন্তু ইচ্ছে মত সাপ্লাইয়ার এবং কাস্টমার ধরে রাখার ক্ষমতা রাখছে। কাস্টমাররা একই জায়গায় সব সুবিধা পাচ্ছে, কেনাকাটা করার জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে না, ফলাফল সরূপ ছোট বিজনেস গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
প্রতিটা টেক কোম্পানির বর্তমানে স্বপ্ন হচ্ছে নিজেদের সর্ব বৃহৎ সমন্বয়কারী হিসেবে তৈরি করা। তাদের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র কাস্টমারদের ক্যাপচার করা না পুরো মার্কেট-প্লেস ক্যাপচার করা। আর এই Aggregation থিউরি আপনার বিজনেসকে বৃহৎ থেকে বৃহৎ করে তুলতে সাহায্য করবে। Amazon বিজনেস শুরু করেছিল বই বিক্রি করার মাধ্যমে আর আজকে? কি নেই Amazon এ?
আপনি কখনো কখনো অবাক হতে পারেন, আমাদের বর্তমান ইন্টারনেট আগের চেয়ে অনেক ডাইনামিক, প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক তারপরেও কেন বাজারে নির্দিষ্ট স্ট্রিমিং সার্ভিস এবং ক্লাউড সার্ভিস গুলো আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে? এর উত্তর হচ্ছে বেশিরভাগ টেক CEO এবং বিনিয়োগকারীরা এই সমস্যার সমাধান করতে চান না তারা আক্রমণাত্মক ভাবে Aggregation থিউরি কাজে লাগিয়ে নিজেদের জায়গায় থাকতে চান।
কেমন লাগল আজকেই এই টিউনটি তা অবশ্যই জানাবেন। পরবর্তী টিউন পর্যন্ত ভাল থাকুন, আল্লাহ হা-ফেজ।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।