কিছুদিন আগে বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকায় উঠে এসেছে শাউমি সাম্যবাদী হয়ে গেছে, তারা তাদের মুনাফাতে এক ধরনের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের মুনাফা কখনো ৫% এর বেশি হবে না। কি কিছুটা অবাক হচ্ছেন?
অবাক হবারই কথা কারণ, কোন প্রযুক্তি নির্ভর কোম্পানি বর্তমান এই সময়ে কিভাবে এটা করতে পারে? তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক আসলে ঘটনাটা কি?
টিউনকে আমি ৪ টি প্রশ্নে ভাগ করব যার মাধ্যমে সম্পুর্ন বিষয়টি সম্পর্কে ধারনা পাবেন।
সহজ উত্তর হচ্ছে আরও বেশী টাকা কামানোর জন্য। অবাক লাগছে? অবাক হবার কিছু নাই। শাউমির ব্যবসায় মডেলটি তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন তাদের আয়ের ৭০% আসে ফোন থেকে ২০% আসে বিভিন্ন হার্ডওয়্যার যেমন, air purifiers, power banks এবং Internet Router এবং বাকি ৯% আসে তাদের ইন্টারনেট সার্ভিস থেকে।
তাদের ইন্টারনেট সার্ভিসের মধ্যে আছে তাদের Music Subscription, Cloud service, Xiaomi app store ইত্যাদি।
কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, তাদের প্রথম দুই ক্যাটাগরির মানে ফোন এবং হার্ডওয়্যারের মুনাফা ৫% এর নিচে রাখতে চায় কিন্তু ইন্টারনেট সার্ভিস এর না। শাউমি শুরু থেকে তদেরকে একটি ইন্টারনেট কোম্পানি হিসাবে পরিচিত করে এসেছে। তাদের IPO ডকুমেন্ট একই কথা উল্লেখ্য আছে। কোম্পানির নাম শাউমি, এটার অর্থও মোবাইল ইন্টারনেট এর সাথে সম্পর্কযুক্ত।
এখন আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে তারা কেন শুধুমাত্র তাদের ৯% ব্যবসায়কে বেশি ফোকাস প্রাধান্য দিচ্ছে? কোম্পানিটি যেহেতু কোন দাতা সংস্থা নয় সেহেতু তারা সবসময় এটা খেয়াল রাখবে যে কোথায় বিনিয়োগ করলে বেশি লাভ কোথায় করলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। তারা হার্ডওয়্যার বিজনেসে লস খাচ্ছিল সেই তুলনায় নেটওয়ার্ক এর দিকে বিজনেস মার্জিন ছিল লাভজনক আর এজন্য তারা এটার উপর বেশি গুরুত্ব দেয়৷
আসলে বর্তমানে ফোনের হার্ডওয়্যার থেকে লাভবান হওয়া কিছুটা কঠিন এবং কম লাভজনক কারণ বর্তমানে এই জায়গায় রাজত্ব করছে Apple এবং Samsung এর মত কোম্পানি গুলো কারণ তারা জানে এখান থেকে কিভাবে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
ইন্টারনেট সার্ভিসের ব্যবসায় বর্তমানে দারুণ এক ব্যবসায়, যা Amazon, Facebook, Google, Microsoft, Alibaba, tencent এর মত লাভজনক কোম্পানি গুলো প্রমাণ করে দিয়েছে। সুতরাং শাউমি তাদের প্রধান বিজনেস হিসাবে ইন্টারনেট সার্ভিসে বেশি বিনিয়োগ করতে চায়।
অন্যান্য গতানুগতিক ফোন কোম্পানি গুলো যা করে সেটা হচ্ছে তারা হার্ডওয়্যার বিক্রয় করে টাকা লাভ করতে চায় করে সেখানে শাউমি, প্রথমে কম মুনাফা করে ফোন বিক্রি করলেও পরবর্তীতে কাস্টমারেকে ধরে রাখতে চায় এবং তাদের সার্ভিস ব্যবহারে মাধ্যমে অধিক মুনাফা করতে চায়।
আমরা সবাই আসলে জানি যে কিভাবে প্রিমিয়াম সফটওয়্যার গুলো আয় করে। তারা প্রথমে ব্যবহারকারীকে এটা ফ্রিতে ব্যবহার করতে দিলেও পরবর্তীতে তাদের পে করতে হয় অথবা তারা এড দেখানোর মাধ্যমে আয় করে করে থাকে।
শাউমি হার্ডওয়্যার এ মুনাফা করছে না এটা মোটামুটি গুগল আর ফেসবুকের মত যেমন তারা ফ্রিতে তাদের সার্ভিস ব্যবহার করতে দিচ্ছে এবং আমরা সবাই জানি এটা করার পরেও গুগল ফেসবুক কতটা লাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং এটা এমনই এক ধরনের বিজনেস মডেল। শাউমি ঠিক এমনটাই চায়।
আমি মনে এখন পর্যন্ত আপনি এটা বুঝতে পেরেছেন যে শাউমি আসলে কখনো হার্ডওয়্যার থেকে অধিক লাভ করতে চায় নি কারণ ফোন থেকে বেশি লাভ করা মানে কম সার্ভিস ব্যবহারকারী পাওয়া, সার্ভিস থেকে কম অর্থের আগমন এবং একই সাথে সব মিনিয়ে কম মুনাফা আসা। সুতরাং ৫% লিমিট ছিল একটি বিবৃতি মাত্র এর মানে এই না যে তারা তাদের বিজনেস মডেল চেঞ্জ করবে। এটি কাস্টমারকে আকৃষ্ট করতে ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র যারা নিউজ গুলোর শিরোনাম পড়েছিল। এই স্টেটমেন্ট এর মাধ্যমে ক্রেতারা বেশি ফোন কিনতে আগ্রহী হয় এবং বিনিয়োগকারী শাউমিতে বিনিয়োগ করতে। এতেই বুঝা এটা ছিল একটি দুর্দান্ত PR campaign।
আমরা এতক্ষণ ইন্টারনেট সার্ভিস বিজনেস মডেল নিয়ে আলোচনা করছি, এই ধরনের ব্যবসায় মূলত দুটি উদ্দেশ্য থাকে যেমন একটি হচ্ছে, যতটা সম্ভব অধিক ইউজার তৈরি করা এবং সবাই এই সার্ভিস ব্যবহার করছে এবং এর পেছনে অর্থ ব্যয় করছে তা নিশ্চিত করা।
MIUI নামে শাউমির নিজস্ব একটি Android ভার্সন আছে, এবং শাউমি যেভাবে সফটওয়্যার এর দিকে ফোকাস করেছে এতে অবাক হবার কিছু নেই। মানুষ এই UI টি পছন্দ করবে এবং শাউমি এর মাধ্যমে তাদের সার্ভিস বিক্রয় করতে পারবে, এখানে এড শো করার মাধ্যমেও আয় করতে পারবে। এটাই তাদের উদ্দেশ্য। এমন বিজনেস মডেলের কাস্টমারের জন্য ভাল খারাপ দুটি দিকই আছে।
ভাল দিক গুলো হচ্ছে শাউমি যেহেতু তাদের নিজেদের ভার্সন তৈরি করেছে সুতরাং তারা তাদের ইউজারদের পর পর আপডেট সফটওয়্যার দিতে পারছে। ইউজাররা এর মাধ্যমে দীর্ঘ সময়ের সাপোর্ট পাচ্ছে। তাদের ইউজার কমিউনিটির মাধ্যমে ইউজাররা তাদের পছন্দ অপছন্দ জানাতে পারছে যার মাধ্যমে তারা আরও বেশি ইউজার ফ্রেন্ডলি সফটওয়্যার নিয়ে আসতে পারছে।
আর এর খারাপ দিক হচ্ছে শাউমি তাদের ইউজারদের শুধু মাত্র তাদের সফটওয়্যার ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করছে এর জন্য তারা অন্যান্য প্রিমিয়াম অ্যাপ থেকে ফিচার কপি করছে তারা ইউজারদের তাদের সিস্টেমের ভেতরই রাখতে চাচ্ছে। এর ফলাফল আপনি তাদের সফটওয়্যার সাবস্ক্রাইব করবেন আর তারা বারবার তাদের অ্যাপ গুলোই শো করবে এবং এখানে আপনার প্রাইভেসির প্রশ্ন থেকেই যায়।
যখন আমি দেখেছি শাউমি তাদের এই মডেলের কাজ শুরু করেছে এবং দক্ষতার সাথে চালিয়ে যাচ্ছে সাথে সাথে সেখানে কিছু দুর্বলতাও পেয়েছি।
প্রথমত তাদের লাভজনক অংশ মাত্র ৯% যা খুবই কম এর মাধ্যমে এটা বুঝায় যে স্ট্রেটেজি এখন পর্যন্ত এত টা ভাল করতে পারে নি।
ইউজাররা কম দামি হার্ডওয়্যার কিনতে চাইলেও তারা সার্ভিসের জন্য পে করতে চায় না। শাউমি যদিও বুঝতে পেরেছিল এটা বাড়ানো উচিৎ তারপরেও তাদের হার্ডওয়্যার বিক্রয় গত বছরে সার্ভিস থেকে বেড়ে গিয়েছিল। সার্ভিস এর বিজনেস সব সময়ই তাদের ছোট ছিল যা কোন ভাল দিক না। গত বছর শাউমি সার্ভিস থেকে মাত্র ১.৫ বিলিয়ন আয় করে যেখানে আই-ফোন আয় করে ত্রৈমাসিক ৯ বিলিয়নের উপরে। তো গ্লোবাল স্কেল বাড়াতে চাইলে শাউমিকে তাদের সার্ভিস এবং সার্ভিস ইউজার বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয়ত চীনে গুগলের সার্ভিস ব্লক থাকার কারণে সেখানে শাউমির বিজনেস মডেলটি ভালই কাজ করছে এবং ইউজাররা গুগলের অলটারনেটিভ এপ স্টোর পেয়ে সেখানে যথেষ্ট খুশি।
ইন্টানেশনালি শাউমির ব্যবহার বাড়ার কারণে তাদের গুগলের সাথেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতে পারে। এবং যেহেতু সব ফোনে ইতিমধ্যে গুগলের সার্ভিস চালু আছে সুতরাং এতে শাউমির সার্ভিস ব্যবহার কম হতে পারে এবং সেখান থেকে স্বাভাবিক ভাবে আয়ও কম আসবে। আবার শাউমি যখন একই এপ বানাচ্ছে সেটা এবং সেটা ইতিমধ্যে প্লে স্টোরে আছে ইউজাররা এজন্য বিরক্তিও হতে।
অন্য দিকে গুগল আপনাকে ওইসব অ্যাপ ব্যবহার থেকেও বিরত রাখতে পারে আর দুইটি কোম্পানির এমন আচরণ কখনো ব্যবহার কারীদের জন্য ভাল অভিজ্ঞতা হতে পারে না৷ শাউমি কিছুদিন আগে তাদের ইউজারদের ভোট নেয়ার জন্য পোল খুলেছিল কিন্তু লজ্জার বিষয় হচ্ছে সেখানে তাদের ইউজাররাই গুগলকে প্রাধান্য দেয়। এমতাবস্থায় পরবর্তীতে তারা পোলটি ডিলিট করে দেয়।
৩য় সমস্যা হচ্ছে যারা কম দাম দিয়ে ফোন কিনে তারা কম দামে সফটওয়্যার ব্যবহার করতে চায় আবার কেউ কেউ ফ্রি ইউজ করতে বেশি ভালবাসে যা শাউমি কখনো এটা চায় নি। আসল কথা হচ্ছে শাউমি যদি এই মডেলে সফল হতে চায় তাহলে তাদের বিত্তশালীদের টার্গেট করে MiMix এর মত আরও প্রিমিয়াম ফোন তৈরি করতে হবে এবং যারা তাদের সার্ভিস ব্যবহার করতে অপারগতা প্রকাশ করবে না। কিন্তু শাউমি আসলেই এমনটা করতে পারবে কিনা তা এখন দেখার বিষয় কারণ এমন একটি মার্জিন তৈরি করা শাউমির কেন যেকোনো কোম্পানির পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
আমি সোহানুর রহমান। সুপ্রিম টিউনার, টেকটিউনস, ঢাকা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 627 টি টিউন ও 200 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 118 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
কখনো কখনো প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর মত ঘটনা পুরো পৃথিবী বদলে দিতে পারে।