অ্যাপলের আইফোন ছিল বিগত দশকের সবচে সফল টেক প্রোডাক্ট। টাচস্ক্রিন স্মার্টফোন এবং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন প্ল্যাটফর্মের যুগের সূচনা তাঁদের হাত ধরে। কিন্তু যেকোনো কোম্পানীর যুগান্তকারী প্রতিটি সফল প্রোডাক্টের পেছনে লুকিয়ে থাকে অসংখ্য ব্যর্থ প্রোডাক্টের গল্প, পরবর্তীতে যেগুলো কাজ করে সতর্ককারী শিক্ষনীয় গল্প হিসেবে, যেসকল গল্প থেকে শিক্ষা নিতে পারে কোম্পানি নিজে এবং পরবর্তীকালের উদোক্তারা।
তো জেনে নেয়া যাক গত দশকের সবচে বড় টেক প্রোডাক্ট ফেইলিওরগুলোর মধ্যে দশটির গল্পঃ
এইচডি ডিভিডি (HD DVD)
২০০২ সালের শেষের দিকে তোশিবা (Toshiba) এবং এনইসি (NEC) ডিভিডির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন উত্তরসূরি হিসেবে এইচডি ডিভিডি (HD DVD) তৈরী করে। একইসময়ে শক্তিশালী আরো আটটি ইলেকট্রনিক কোম্পানির সঙ্গে পার্টনারশীপে সনি প্রতিযোগী মডেল ব্লু-রে (Blu-Ray) ফরম্যাট তৈরী করছিল।
সনির নিজের মুভি স্টুডিওসহ ছিল ব্যাপক মিডিয়া পার্টনারশীপ। অন্যান্য বড় স্টুডিওগুলোকেও নিজেদের ফিল্ম ব্লু-রে ফরম্যাটে লঞ্চ করার ব্যাপারে কনভিন্স করতেও সক্ষম হয় সনি। ডিস্কের যুদ্ধ ২০০৮ সালে শেষ হবার সময় কোম্পানিগুলো এইচডি ডিভিডী থেকে নিজেদের সাপোর্ট সরিয়ে নেয়। আর প্রডাক্ট ব্যর্থ হবার কারণে তোশিবার লস হয় প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
গুগললাইভলি (Google Lively)
২০০৮ সালে লিন্ডেন ল্যাবের ভার্চুয়াল জগত সেকেন্ড লাইফের সফলতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গুগল নিজের ওয়েব বেইজড ভার্চুয়াল এনভায়রনমেন্ট, লাইভলি লঞ্চ করে। কিন্তু সেকেন্ড লাইফের মতন আলাদা অ্যাপ্লিকেশনের বদলে গুগল লাইভলিকে লঞ্চ করে কয়েকটি ভার্চুয়াল চ্যাটরুমের কালেকশন হিসেবে যা ওয়েব ব্রাউজারের মাধ্যমে এক্সেসিবল।
লাইভলির আইডিয়া ইন্টারেস্টিং হলেও সেকেন্ড লাইফের মতন ত্রিমাত্রিকভাবে অতটা উন্নত ছিল না, একইসাথে ব্যবহারের দিক থেকে ফেসবুক এবং অন্যান্য ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মের তুলনায় ছিল কঠিন। লঞ্চ করবার কয়েকমাস পরই লাইভলি প্রজেক্ট অনেকটা নীরবেই বন্ধ করে দেয়া হয়।
মাইক্রোসফট জুন
২০০১ সালে আইপড লঞ্চের মাধ্যমে ডিজিটাল মিউজিককে আমূল পাল্টে দেয় অ্যাপল। পাঁচ বছর পর মাইক্রোসফট আইপডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জুন লঞ্চ করে। পজিটিভ রিভিউ থাকা সত্ত্বেও মার্কেটে দেরীতে ঢোকা, দূর্বল মার্কেটিং এফোর্ট এবং বড় মিউজিক লেবেলগুলোর সাপোর্ট না পাওয়ায় জুন ফ্লপ করে। বিক্রি না বাড়লেও ২০১২ সালে বন্ধ করার আগ পর্যন্ত ছয়টি প্রজন্ম মাইক্রোসফট জুন চালু রাখে।
উইন্ডোজ ফোন (Windows Phone)
আইফোন বাজারে আসার তিন বছর এবং অ্যান্ড্রয়েডের দুবছর পর, ২০১০ সালে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ফোন সেভেন লঞ্চ করে। মার্কেটে দেরীতে প্রবেশের চড়ামূল্য দিতে হয় মাইক্রোসফটকে। কারণ ততদিনে মানুষ আইফোন এবং অ্যান্ড্রয়েডে খাপ লজাইয়ে নিয়েছিল বেশ ভালোভাবে।
উইন্ডোজ ফোনের সম্প্রসারনের জন্যে বেপরোয়া মাইক্রোসফট ২০১৪ সালে নোকিয়ার হ্যান্ডসেট ইউনিট কিনে নেয়, এক বছর পর যা বিলিয়ন ডলারের মূল্যহ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের জন্য। আজকের দিনে (২০১৭) মাইক্রোসফটের রাজত্ব পুরো স্মার্টফোন মার্কেটের ১%-এরও কম অংশে।
ব্ল্যাকবেরী স্টর্ম (BlackBerry Storm)
আইফোনের আবির্ভাবের পর স্মার্টফোন মার্কেট লিডার ব্ল্যাকবেরি টাচস্ক্রিন ফোনের আইডিয়া নাকচ করে দেয়। তারা দাবী করে কর্মজীবি ব্যবহারকারীরাা সবসময় কীবোর্ড ব্যবহার করবেন। কর্মজীবিরা আইফোন কেনা শুরু করলে তারা ব্ল্যাকবেরী স্টর্ম লঞ্চ করে। স্টর্মের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা কীবোর্ড টাচের মাধ্যমে টাইপ করা যেতো। টাচস্ক্রিন এবং কী-বোর্ডের সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিল তারা।
তবু অদ্ভুত মেকানিজমের দ্রুত ফ্লপ করে, ভ্যারাইজন ২০০৮ সালে বিক্রি হওয়া ১ মিলিয়ন স্টর্মের বেশীরভাগ পরিবর্তন করে দে। এতে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি লস হয় তাঁদের। ব্ল্যাকবেরীর শেয়ারে ধস নামে এবং সবশেষে ২০১৬ সালে তারা নিজেদের মোবাইল ফোন তৈরি বন্ধ করে দেয়।
এইচপি টাচপ্যাড (HP Touchpad)
অ্যাপলের আইপ্যাডের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ২০১১ সালের জুলাইতে এইচপি নিজেদের টাচপ্যাড মার্কেটে লঞ্চ করে। কিন্ত মাত্র একমাস পর প্রতিযোগীতামূলক মোবাইল মার্কেট থেকে সরে দাড়াতে এইচপি টাচপ্যাডসহ ওয়েবওএস রানিং ডিভাইসগুলো আর কন্তিনিউ না করার ঘোষনা করে। মজুদে সব টাচপ্যাড মাত্র ৯৯ ডলার দরে বিক্রি করে দেয় এইচপি। টাচপ্যাড ইতিহাসের সবচে ক্ষণস্থায়ী ট্যাবলেটগুলোর একটি।
ফেসবুক্ হোম (Facebook Home)
অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসগুলো পুরোপুরি দখল করতে ২০১৩ সালে ফেসবুক নিজেদের ফেসবুক হোম লঞ্চ করে। ফেসবুক হোম ছিল এমন একটি লঞ্চার যা দ্বারা ব্যবহারকারীরা দ্রুত টিউন করা এবং দেখা, সঙ্গে অন্যদের ম্যাসেজ করতে পারতো। লক স্ক্রিণেও ফেসবুক হোম ফেসবুক এবং অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশোনে নটিফিকেশন প্রদর্শন করত।
ফেসবুক হোম ছিল আলাদা অপারেটিং সিস্টেম তৈরী না করে বরং মোবাইলের বিদ্যমান অপারেটিং সিস্টেম নিজেদের আয়ত্ত্ব আনার একটি প্রয়াস। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত নটিফিকেশন এবং দূর্বল প্রাইভেসির কারণে ফেসবুক হোম প্রচুর বাজে রিভিউ পায়। ফেসবুক হোম ফ্লপ হবার কারণে ফেসবুককে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হয়, এবং মেসেঞ্জারকে আলাদা একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তারা।
গুগলগ্লাস (Google Glass)
২০১৩ সালে বিশেষ একটি প্রোগ্রমের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে গুগল গ্লাস লঞ্চ করা হয়, পরে একইবছর সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রাথমিকভাবে দরপ্রতি গুগল গ্লাসের মূল্য ১৫০০ ডলার হলেও বাণিজ্যিকভাবে লঞ্চের জন্য মূল্য কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় গুগল।
টেক এন্থুসিয়াস্টরা গুগল গ্লাসকে অভিহিত করেন “নেক্সট বিগ থিং” হিসেবে, কিন্তু ব্যবহারকারীদের চেহারায় ক্যামেরা বসাবার ফলে প্রাইভেসি নষ্ট হবার যে সম্ভাবনার উদয় হতে পারে, গুগল তা বিবেচনায় আনে নি। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রাঙ্গনে গুগল গ্লাস নিষিদ্ধ করে, ভোক্তাদের বড় অংশ অদ্ভুত আকৃতি এবং উচ্চমূল্যের কারণে গ্লাসকে পছন্দ করে নি। ২০১৫ গুগল গ্লাস প্রজেক্ট বন্ধ করলেও অদূর ভবিষ্যতে গ্লাসের নেক্সট জেনারেশন ভার্সন লঞ্চ করার আশ্বাস দেয়।
অ্যামাজন ফায়ার ফোন (Amazon's Fire Phone)
২০১৪ সালে অ্যামাজন ভেবেছি কিন্ডল ফায়ার ট্যাবলেটের মতন তাঁদের ফায়ার ফোনও সফলতার মুখ দেখবে। কিন্তু অলরেডি যারা আইফোন এবং অ্যান্ড্রয়েড ব্যবফারকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। প্রথম মাসেই স্মার্টফোনের মডেলটির দাম দুই বছরের কন্ট্রাক্টসহ ১৯৯ ডলার থেকে ৯৯ সেন্টে নামিয়ে আনে অ্যামাজন। বছরের শেষে অবিক্রিত ফোনগুলোর কারণে ১৭০ মিলিয়ন ডলারের মূল্যহ্রাসের সম্মুখীন হয় অ্যামাজন। ২০১৫ সালে ফায়ার ফোনের প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়া হয়।
স্যামসাং-এর গ্যালাক্সি নোট সেভেন (Samsung's Galaxy Note 7
ত্রুটিপূর্ণ ব্যাটারির কারণে ২০১৬ সালে স্যামসাং-এর ব্যাপক সমাদৃত নোট সেভেন বিস্ফোরিত হওয়া শুরু করে। আকস্মিক এই দূর্ঘটনার কারণে লক্ষ লক্ষ সেট ফিরিয়ে নেয়া এবং বিক্রি বন্ধ রাখায় ২.৩ বিলিয়ন ডলারের মূল্যহ্রাস এবং ব্যাপক পরিমাণ সম্ভাব্য বিক্রি হাতছাড়া হয় স্যামসাংয়ের।
এতবড় বিপত্তির পরও স্যামসাংয়ের নতুন গ্যালাক্সি নোট এইটের প্রাথমিক চাহিদা বেশ ভালোই ছিল যা ব্র্যান্ড হিসেবে মানুষের কাছে স্যামসাংয়ের গ্রহণযোগ্যতার দিকটিই তুলে ধরে। এরূপ স্ক্যান্ডালের পরও কলঙ্কের দাগ তাঁদের গায়ে লাগেনি।
আমি কাউসার হামিদ জাওয়াদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 5 বছর 8 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।