পবিত্র শূরার পাত্রটা বাড়িয়ে দিলেন ইজিয়েল। দীর্ঘক্ষণ এই করিডরে নিশ্চুপ হেঁটে আসার পর এটাই যেন অনেক কথা বলল। সুলতান তার এতদিন-কার বিশ্বস্ত সহ-নভোচরের চোখে না তাকিয়েই হাত থেকে পাত্রটা নিল। সমস্ত কর্মকান্ডগুলো একটা কথাই বলছে – বিদায়। করিডরের শেষ মাথায় দাঁড়ানো এই ছোট্ট দলটার বাকি সবার মনেও বাজছে একই সুর। তারচে’ করুণতর সুরে বাজছে সবার শেষে আলখাল্লার ঘোমটায় মুখ লুকানো নিরিন নামক মেয়েটার মনে। কেবল সেই জানে, নভোযান মৃত্তিকার সবার অলক্ষ্যে অধিনায়ক সুলতানকে সে কতটা ভালবেসে ফেলেছে।
শূরা পান শেষ হতে একজন বলে উঠল – আমরা মহামান্য সুলতানের সাথে শেষ পর্যন্ত যাব। “না, আদিয়েল,” বাধা দিয়ে ব্জানাল সুলতান “এরপর আর তোমাদের যাওয়া বারন। আমি একাই যাব।” কয়েকটা অলস মুহূর্ত কেটে গেল, এতই অলস যে কারো সেটা পছন্দ হলনা। অস্বস্তি শেষ করতে নভোযানের অধিনায়কই তার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করল, পা বাড়াল অপেক্ষাকৃত সরু করিডরের দিকে। এগিয়ে গেল কয়েকটা ধাপ। সেই সাথে নিরিনের মন থেকে কিছু অদৃশ্য বহ্নিশিখা ধেয়ে গেল অধিনায়কের দিকে। এই শিখা পোড়ায়না, বরং কাছে টানে। “তুমি আমার দিকে ফিরবে, ফিরতেই হবে তোমাকে...” নিরিনের মনের ভাবনায় দাবীর চেয়ে বিশ্বাসটাই বেশী।
থমকে দাঁড়াল সুলতান। ফিরে তাকাল সঙ্গীদের দিকে। “জেনো, সুলতান কখনোই তোমাদের অধিকর্তা ছিলনা। ছিল তোমাদের পথপ্রদর্শক। ইজিয়েল, রাজকীয় সামরিক শিক্ষা নগণ্য বয়সেই আমাকে তোমার অধিনায়ক বানিয়েছে, কিন্তু তুমি ছিলে আমার পিতৃ-প্রতিম। ধরনীতে ফিরে তুমি পরিচয় দিও মৃত্তিকার অধিনায়ক তোমাকে পিতার সম্মান দিয়েছে। আমার অপরাপর অনুসারী, আদিয়েল, গিনাদেল, সানতান, আবরান, আবেল সবাই আমার ভাই। সর্বযন্ত্র চন্দ্রাকরে আমার মস্তিষ্ক ব্যাবহার হবে, আশা করি আমার স্মৃতিগুলোও জীবিত থাকবে। যতদিন বেঁচে থাকব আমি তোমাদের কথাই ভেবে অবসর যাপন করব।” যতক্ষনে অনুসারীদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে এসেছে, ততক্ষনে সুলতান উঁকিয়ে কিছু দেখতে চেষ্টা করল। নিরিনকে দেখার চেষ্টা। কারন নিরিনের অধরা অঙ্গখানি পুরুষদের আড়ালে ঢেকে ছিল। “নিরিন...”
কিছু বলতে পারার আগেই ছুটে এলো মেয়েটা। প্রমত্ত বেগে আছড়ে পড়ল অধিনায়কের বুকে, নভোযান আচরনবিধিতে যেটা আইনসিদ্ধ নয়। “ভালবাসি, তোমায় ভালবাসি। তুমি যেওনা।” অঝরে ঝরাচ্ছে সে অশ্রু, আঁটুনি থেকে সুলতানের প্রতি তার টানটা অনুধাবিত হল।
“কতদিন আমি কথাটা বলতে চেয়েছি। পারিনি। আমি চাইনি আমার রাজকীয় অধিনায়কিত্ব তোমাকে অর্জন করুক, আমি চেয়েছিলাম আমি তোমাকে অর্জন করি। সে হতে হতে আমার সময় চলে গেল”।
“তুমি একটা বোকা অধিনায়ক। তুমি বোঝনি যাকে তুমি পেতে চাচ্ছিলে সে তোমারই হয়ে আছে,” বিরতি নিল নিরিন, আনুনয় করার জন্য “তুমি যেওনা”।
“এ হয়না”। বুক থেকে তুলে নিজের চোখের দিকে নিরিনের চোখ ফেরাল সুলতান, “আমি যাচ্ছি তোমাদেরই জন্য। এখন তো আরো খুশী নিয়ে আমি যাব যে আমি যাচ্ছি নিরিনকে, যে আমাকে ভালবাসে বলেছে তাকে ধরনীতে ফেরানোর জন্য। এ যে আমাকে করতেই হবে।”
“তুমি কেন? অন্য কেউ নয় কেন?”
“তুমি তো জানই। লোহিত ছায়াপথের যুদ্ধে মৃত্তিকার একাংশের অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে। এজন্য সর্বযন্ত্র চন্দ্রাকর নিজে মানব মস্তিষ্ক চেয়েছে, তাকে কর্মক্ষম রাখতে এর ব্যাতিক্রম নেই।আমি মহারাজকীয় সামরিক বাহিনীর একজন অধিনায়ক। আমার সমর শিক্ষা, কৌশল সবই চন্দ্রাকরের প্রয়োজন হবে। এই নভোযানের অধিনায়ক হিসেবে আমাকে উৎসর্গ করাই আমার দায়িত্ব ছিল।”
কান্নায় আবার ভেঙে পড়ল নিরিন। “কেঁদোনা প্রেমিকা। তুমি বুঝতে পারছনা সারাজীবন জানব তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে এই ভেবে আমি এতই পুলক অনুভব করছি যে আত্মবিসর্জনের আর কষ্ট নেই।... এবার বিদায় দাও।”
নিরিন অনেকক্ষন ছাড়তে চায়নি। বাধ্য হয়ে সুলতানকে ছাড়িয়ে নিতে হল – একটা জীবন্ত পাখির গা থেকে চামড়া ছাড়িয়ে নিলে যেমন অনুভূত হয় তেমন কষ্ট পেয়ে অবশেষে মেঝেতে ঢলে পড়ল শ্রীতনু। পেছন ফিরে আর তাকালোনা সুলতান নামের সেই তরুন অধিনায়ক। দায়িত্ববোধ তাকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে ফেলেছে, হারিয়ে গেল স্বল্পালোয়।
* * *
মৃত্তিকা নামক মহারাজকীয় সামরিক নভোযানের এই অংশে আসার নিয়ম নেই। এখানে আসতে হয়না। কারন এটি সুরক্ষিত এবং এর ক্ষতি হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই অংশেই সর্বযন্ত্র চন্দ্রাকরের মস্তিষ্ক থাকে। কিন্তু অবলোহিত ছায়াপথের বিদ্ধংসী যুদ্ধে অপুরনীয় ক্ষতি হয়েছে মৃত্তিকার। কি ধরনের ক্ষতি তা অজানা। কারন যুদ্ধ শেষে জয়ী হয়ে ধরনীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার বহুদিন পর দেখা গেল তারা উপস্থিত হয়েছে অন্য কোথাও। যদিও সর্বযন্ত্রের আয়নাগুলো দেখাচ্ছিল ঠিক পথেই যাচ্ছে। এমন কিছু হয়েছে যাতে চন্দ্রাকর ভাবে সে ঠিক পথে যাচ্ছে কিন্তু আসলে যায় ভুল। ততোদিনে মৃত্তিকার রসদেও টান পড়েছে কেননা বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের পর প্রাকৃতিক খাদ্য-শস্য উৎপাদন অঞ্চল সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। এখন আর পথ ভুল করার উপায় নেই। চন্দ্রাকর তখন নিজেই নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে মানবসত্ত্বার সাহায্য চাইল। তার মস্তিষ্কের সম্পূরক হতে হবে একজনকে। কে হবে সেই আত্মবিসর্জক?
হেঁটে যেতে যেতে গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে সুলতান। করিডরটা মনে হচ্ছে শেষ হবেনা। এমন সময়েই খুলে গেল দরজা। নীলাভ আলো আসছে দরজা দিয়ে। দ্রুত হেঁটে ঢুকে গেল সুলতান।
“স্বাগতম, মৃত্তিকার মহামান্য অধিনায়ক সুলতান” চন্দ্রাকর অভিবাদন জানাল।
“অভিবাদন চন্দ্রাকর। ...আমি এসেছি। তোমার প্রক্রিয়া অচিরেই শুরু কর”। সুলতান চাচ্ছেনা তার শেষ মূহূর্তের প্রাপ্ত ভালবাসার সুখময় স্মৃতিগুলো আফসোস আর চিন্তার রাশে মলিন হয়ে যাক। “শুধু একটা কথা; আমার স্মৃতি কি অক্ষুন্ন থাকবে?”
“আপনি চাইলে থাকতে পারে। কিন্তু... সত্যিই কি কোন মানব সত্ত্বা তা চাইবে? সে কি চাইবে হাজার বছরের অবিনশ্বর পরিক্রমায় তার স্মৃতিগুলো কেবল ব্যাথা দিতে বেঁচে থাকুক? মান্যবর, অনুমতি দিন, আমি আপনার মস্তিষ্কে সব সুখময় অনুভূতি দিয়ে ভরিয়ে দিই”।
“না চন্দ্রাকর, তুমি জাননা যা আমি মনে রাখতে চাই তা বেদনাদায়ক হলেও কতটা আনন্দদায়ক। তুমি জাননা, কি আমাকে এতোটা পরিপূর্ন করে তোলে।”
“যথা আজ্ঞা অধিনায়ক সুলতান। আমরা তাহলে শুরু করতে পারি। অনুগ্রহ করে আপনার বাঁ পাশের কুঠুরিতে প্রবেশ করুন।”
* * *
সত্যিকার অর্থে চন্দ্রাকরের মত এত উচ্চ প্রযুক্তির সর্বযন্ত্রেরও একটি মানব মস্তিষ্কের সমান সক্ষমতা নেই। সুলতান কুঠুরীতে প্রবেশ করামাত্রই কিছু যান্ত্রিক হাত তাকে ধরে ফেলে। কিছু তরল মেশানো নল এসে তের মুখে, নাকে, চোখের কোনায় ইত্যাদি অংশে ধুকে যায়। কিছু সূক্ষ লেজার রশ্মি মাথার খুলির নির্দিষ্ট অংশে কেটে ফেলে, এতই স্পর্শহীন ভাবে যে সুলতান কিছু টের পায়না যতক্ষন না শীত্তল তরল সে জায়গা দিয়ে প্রবেশ করে।এবার কিছু সংবেদী পিন এসে মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় গেঁথে যায়। একটা গলা শুনতে পায় সুলতান আধোচেতন অবস্থায় “মহামান্য অধিনায়ক, জাগতিক ইতিহাসে সর্বপ্রথম জীব ও যন্ত্রের সমন্বয় ঘটনায় আপনার অবদানের জন্য অভিবাদন গ্রহন করুন। এখনি আপনার সমস্ত পীড়া শান্তিতে রূপ নেবে। চোখ খুলে আপনি সাদা একটা পৃথিবী দেখবেন যেখানে আপনিই প্রভু, যেমন ইচ্ছা তেমন সাজাতে পারেন তাকে।” সুলতান তার সমস্ত সত্ত্বার শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে চাইল –না... না...। কোন আওয়াজ নেই। “আপনি চোখ খুলছেন, চোখ খুলছেন... এখনি।”
চোখ খোলার সাথে সাথে সুলতান তার চারপাশে আদিগন্ত একটা সাদা পৃথিবী দেখতে পেল। সাদা মেঝেতে ছায়া নেই, দিগন্তে কোন বলি রেখা নেই। প্রচন্ড ভয় পেয়ে তার মস্তিষ্কে চকিতে খেলে উঠল ছোটবেলায় সাগরপাড়ের কথা। পরবর্তী পলকে চোখ খুলতেই সে দেখল এই তো সেই সাগর, ওই তো পাহাড়চূড়া। সেখানে গাছটাও আছে। পরবর্তী পলকে সে নিজেকে গাছের নিচে আবিষ্কার করল। উপর থেকে নিচে তাকিয়ে দেখতে পেল আবারিত নীল জলরাশি, ঢেউ খেলে যাচ্ছে। কিন্তু এসবের মাঝে কি যেন একটা নেই...
* * *
হাতে একটি বোতামের বাক্স। তার ভেতর পাঁচটি বোতাম। একটি নেই। অধিনায়ক সুলতান একদিন গলদঘর্ম হচ্ছিল নিজের কুর্তায় একটা বোতাম লাগাতে গিয়ে। জিনিসটা মানুষের কাজ নয়, পুরুষের তো নয়ই। কিন্তু মৃত্তিকার একটা অংশ উড়ে যাওয়ায় এধরনের যান্ত্রিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে বেঁচে যাওয়া গোটা ত্রিশেক মানুষজনকেই নভোযানের সব কাজ করতে হত। নিরিন তখন রাত্রিকালীন অবস্থা পর্যবেক্ষন করতে ব্রিজে যাচ্ছিল। সে অধিনায়ককে চমকে দিতে চায়নি, কিংবা নিরস্তও করতে চায়নি। কিন্তু অধিনায়কের অসহায়ত্ব তাকে বিষম হাসিয়ে দিল। এবং বলাই বাহুল্য তরুন অধিনায়ক এতে খুব লজ্জা পেয়েছিলেন। “রাজন, মহারাজকীয় সমরশালায় বোতাম লাগানো কি শেখায় না?” হাসতে হাসতে শুধাল নিরিন। এবং সুলতানের লজ্জার মাত্রাটা আরো বাড়াল। পরিস্থিতি হালকা করতে অধিনায়কের হাত থেকে বোতামের বাক্সটা নিয়ে সুই সুতায় লাগিয়ে দেয় তরুনী। সুলতানের খুব কাছ থেকে বোতামটা লাগাতে হয় তার। টুক টাক কিছু কথা হয় অধিনায়কের। একই সাথে খেয়াল করে তরুনীর রূপ-সুষুমা। তার দীঘল কালো চুল গুলো আলখাল্লার ঘোমটা থেকে লতার মত বেরিয়ে আছে। চোখে রাজ্যের গভীরতা, ঠোঁটের কোনায় দূরবর্তী কোন সাদাটে নক্ষত্রের মত ঝিলিক, দেহে মেয়েলী বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকট। অধিনায়ক লীন হয়ে মেয়েটাকে খেয়াল করতে থাকাকালে সম্বিৎ ফিরে যখন সে দাঁত দিয়ে বুকে সদ্য লাগানো বোতামটার সুতা কেটে দেয়। খুব প্রাচীন একটা পদ্ধতি ছিল এটা, নিরিন রাতে শুয়ে শুয়ে পৃথিবীর ইতিহাস পড়ত সেখান থেকেই জানা। অধিনায়ক এমন দৃষ্টিতে আগে কখনো দেখিনি নিরিনকে। আগে অবশ্য দেখা সম্ভবও ছিলনা, যখন প্রায় চারশ’ পঞ্চাশ জনের বিশাল একটা বহর ছিল।
বোতামের বাক্সটা রয়ে গেছে নিরিনের কাছে। রাজকীয় পোশাকের এক বাক্স বোতাম থেকে একটি বোতাম নেই, সাথে নেই সেই মানুষটিও।
ইজিয়েল বুলাচ্ছে সবাইকে। সবার সাথে সেও ব্রিজে উপস্থিত হল। ইজিয়েলকে বলতে শুনল নিরিন, চন্দ্রাকরকে জিজ্ঞেস করছে তার কার্যক্ষমতার কথা। চন্দ্রাকর জানাল সে সম্পূর্নরূপে কার্যক্ষম। সবকিছু ঠিক ঠাক কাজ করছে।
“চন্দ্রাকর,” গলা কেঁপে গেল যদিও নিরিনের, “অধিনায়ক সুলতান কোথায়? উনি কেন কথা বলছেন না?”
“মান্যবতী নিরিন,” জবাব দিল সর্বযন্ত্র চন্দ্রাকর, “অধিনায়ক সুলতান নিজের পূর্বস্মৃতি জাগিয়ে রাখতে অসম্মতি জানিয়েছেন। তাই তিনি এখন আপনাদের কাছে অপ্রিচিত। সর্বোপরি, চন্দ্রাকর অহামান্য অধিনায়কের মস্তিষ্ক ব্যাবহার করছে; কিন্তু তার এই সিস্টেমে বিচরন নেই...”
* * *
এক. যন্ত্র শুধুমাত্র মানুষ এবং বুদ্ধিশীল প্রাণীর সেবার কথা বিবেচনা করবে, হোক সমষ্টির জন্য অথবা একক ব্যাক্তির জন্য।
দুই. এক-এ উল্লেখিত বিধির জন্য প্রয়োজনে যন্ত্র যুক্তিস্বরূপ সমষ্টিগত মানুষের কাছে আকাঙ্খিত অথবা গ্রহনযোগ্য তত্ত্ব বিবেচনা করবে।
এই হচ্ছে এই দুনিয়ার সমস্ত যন্ত্রের কাজের ভিত্তি। কোন যন্ত্র এর বাইরে যেতে পারেনা। নিরিন পাগলের মত ছুটে গেল। চন্দ্রাকরের মস্তিষ্ক অংশে। যেখানে যাওয়া রীতিমত অন্যায়।চন্দ্রাকর দীর্ঘ পথে অনেক বার বারন করল। নিরিন বেপরোয়া। সে ভাবতেই পারছেনা তার প্রাণের মানুষের কাছ থেকে আর কথা শুনতে পারবেনা। করিডরে বুক থেকে খুলে ফেলার পর মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ভেবেছিল অন্তত প্রাণপ্রিয়ের কথা শুনতে পারবে, তার ভাবনা চিন্তা, যে মানুষকে সে ভালবেসেছিল তার কন্ঠস্বর হারিয়ে যাবেনা। নিরিন মেনে নিতে পারছেনা সুলতান তার স্মৃতি জিইয়ে রাখতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
বারংবার মানা করা সত্ত্বেও নিরিনের এই ছুটে চলা চন্দ্রাকরের কাছে অসহ্য লাগল। ইজিয়েলও মানা করে চলেছে, নিরিন শোনার পাত্রী নয়। অবশেষে নিরিন যখন ছোট করিডরটায় চলে আসল তখন চন্দ্রাকর মৃত্তিকা নভোযানের বেঁচে যাওয়া একমাত্র মানবীকে বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করল। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ এইজন্য যে মানবী যেন মৃত্যুবরন না করে, কারন এটি তার সংখ্যা এক বিধির পরিপন্থী।
এদিকে, অধিনায়ক সুলতান তার পৃথিবীটাকে দেখে শেষ করতে পারছিলনা। সুন্দর আকাশ দেখে তার মন ভরে যাচ্ছিল। হঠাৎ পরিষ্কার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। সে খুব বিরক্ত হল, ছোখ মুখ কুঁচকে যাই ভাবলনা কেন, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ চন্দ্রাকর সেই বিদ্যুৎ ঝলকানি সরিয়ে নিতে বাধ্য হল।
করিডরে থেমে গেল বিদ্যুৎ ঝলক। নিরিন নির্ভীকের মত এগিয়ে যেতে থাকে। চলার গতি হ্রাস পেয়েছে অন্ধকারে।
সুলতান ভাবে – আহ্, আকাশটা যদি আরো নীল হত...!
করিডরের দরজা খুলে নীলাভ আলো দেখা যায়।
“কেন এসেছ মানবী?” গমগম করে উঠল রাগত চন্দ্রাকরের কন্ঠ।
“আমি এসেছি অধিনায়ক সুলতানকে নিয়ে যেতে?”
“কোন অধিকারে?”
“ভালবাসার অধিকারে”।
“ভালবাসা? সে কি?”
চোখে অন্ধকার দেখল নিরিন। সে তো এসেছে একটা যন্ত্রের সাথে যুদ্ধ করতে। একটা যন্ত্র কেমন করে বুঝবে ভালবাসা কাকে বলে? সে চন্দ্রাকরকে দোষী করতে চাইল।
“তার আগে বল, তুমি অধিনায়ক সুলতানের স্মৃতি নষ্ট করেছ কেন?”
“আমি নষ্ট করিনি, এটা অধিনায়ক সুলতানের ইচ্ছা ছিল।”
“মিথ্যে কথা। অধিনায়ক নিজমুখে বলেছেন তিনি তার সহচরদের আজীবন মনে রাখতে চান।”
“মান্যবতী নিরিন,” এবার আসল রূপে ফিরে এলো চন্দ্রাকর, “আমি আমার সংখ্যায় এক বিধি পালন করেছি মাত্র।”
“কেমন করে?”
“বিধি মোতাবেক আমি মানুষের সেবা বিবেচনা করব। মৃত্তিকার সমস্ত মানুষের জন্য আমার একটি মস্তিষ্ক দরকার ছিল বৈকি। সে মস্তিষ্ক আমি লালন করব হাজারো বছর। কোন প্রানী তার স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিকে অবিনশ্বর করলে তা একদিন তার হতাশার কারন হয়ে দাঁড়াবে। সে নিজের জীবন রহিত করতে চাইবে একসময়। সেজন্য অধিনায়কের স্মৃতি আমি মুছে দিয়েছি। আমি একাধারে একক এবং সমষ্টিগত মানুষের সেবার কথা বিবেচনা করেছি।”
“কিন্তু, তুমি মিথ্যে বললে কেমন করে? তুমি যন্ত্র। তোমাকে মিথ্যা বলার অধিকার দেয়া হয়নি।”
“আমি মিথ্যা বলিনি। কেবল বিধি দুই পালন করেছি মাত্র। বিধি দুই অনুসারে অধিনায়কের স্মৃতি মোছার যুক্তিস্বরূপ তোমাদের আকাঙ্খিত তত্ত্ব উপস্থাপন করেছি। বিধি দুই আমাকে সেই স্বাধীনতা দিয়েছে।”
যুক্তির কাছে হেরে গেল নিরিন। সে জানে এ স্রেফ যন্ত্রই। এর বিচার ক্ষমতা এই দুটি বিধির উপরেই নির্ভরশীল। হাঁটু গেড়ে ধপাস করে মেঝেতে পড়ল নিরিন।
“চন্দ্রাকর, আমার প্রেমকে তুমি আমার কাছে ফিরিয়ে দাও...”
“অসম্ভব”
“আমার ভালবাসার দোহাই লাগে...”
“ভালবাসা কি?”
“ভালবাসা কোন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ নয়, ভালবাসা কোন স্থান-কাল রেখাও নয়, ভালবাসা ভালবাসাই। এর কোন সংজ্ঞা নেই।”
“সংজ্ঞাহীন কোনকিছু হতে পারে না।”
“পারে, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে কি কারন ছিল বলে তুমি মনে কর?”
“মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে তোমাদের ধারন করার জন্য।”
“আমার ধারন করতে হবে এই সিদ্ধান্ত কে দিয়েছিল মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার আগে?”
অনেকক্ষন চুপ থাকল সর্বযন্ত্র, “এ সম্পর্কে চন্দ্রাকরের কোন ধারনা নেই।”
“ঠিক তেমনি আমারও ধারনা নেই ভালবাসা কি? আমি শুধু জানি ভালবাসা আছে। যে ভালবাসার জন্য আমি প্রান দিতেও রাজী আছি, নির্দ্বিধায়। সেই অধিকারে আমি ফেরত চাচ্ছি আমার প্রেমিককে।”
নিরব থাকল চন্দ্রাকর। “তুমি যদি আমার সুলতানকে না দাও তাহলে এখান থেকে আমি যাবনা। ভেবে দেখো, তোমার এমন কোন শক্তি নেই যেটা আমাকে এই স্থান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারে। সর্বোচ্চ তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পার, কিন্তু সরাতে পারবেনা। আর যদি মেরে ফেল, তাহলে আমি আমার সুলতানের সাথে দেখা করতে পারব।”
এবারও নিরুত্তর সর্বযন্ত্র। “নিরিন, তুমি কি জানো?” চন্দ্রাকরের কন্ঠ আশ্চর্যরকম জীবন্ত শোনাল, ঠিক মানুষের মত, “আমার মত সর্বযন্ত্র, যাদের অনেকখানি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেয়া হয়, তারা নিজের প্রাথমিক দায়িত্বের পাশাপাশি সবসময় খুঁজে বেড়ায় – মানুষ কেন মানুষ। কোন একদিন হয়তো তার কিয়দংশ বোধগম্য হয়। একথাই চিন্তা করে যারা আমাকে বানিয়েছিল তারা একটি নিরাপত্তা অংশ আমার ভেতরে বানিয়েছিল। যেটি এই ধরনের কিছু হলে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে। আমার সেই নিরাপদ অংশটি কাজ করা শুরু করেছে।”
অবাক হয়ে শুনছে নিরিন। সুলতানের আকাশ খুব নীল হয়ে গিয়েছিল, সেটি এখন প্রচন্ড লাল হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে খুব শীগগীরই রক্তলাল হয়ে যাবে। ভীত হয়ে পড়োল সুলতান।
“আমার হাতে সময় কম,” চন্দ্রাকর বলতে থাকল, “এই নিরাপত্তা অংশটি এমন ভাবে তৈরী যেখানেই নভোযান থাকুক না কেন, তা ধরনীর দিকে তাক করবে। কাজেই তোমরা এখন নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পার। অবশ্য চন্দ্রাকর ততক্ষন থাকবেনা।”
“মানুষের মত অনুভব করেছি, তওমার ভালবাসা হয়তো বুঝতেই পারিনি। কিন্তু যাই বুঝেছি সে হেতু আমি মহামান্য অধিনায়ক সুলতানকে ফেরত দিয়ে যাব, সাথে তার সব স্মৃতিও। আর মানুষের মত অনুভব করতে, দেখ, আমার কত বছর লেগেছে! এই মৃত্তিকায় আমি ছিলাম গত আঠারোশ বছর। তুমি যদি বেঁচে থাক, তাহলে ধরনী বাসীকে বলো যে চন্দ্রাকর বলে গেছে তারা যেন মানুষ হতে পেরেছে বলে গর্বিত বোধ করে। বিদায় মানবজাতি...”
* * *
একশত বারো দিন পর। আরোগ্য কফিনের চারপাশে নভোযান মৃত্তিকার সবগুলো মানুষ দাঁড়িয়েছে। একমাত্র মানবী নিরিন কফিনের শিয়রে বসে। স্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে অধিনায়ক সুলতানের মায়াবী মুখ দেখা যাচ্ছে। ইজিয়েল এগিয়ে গিয়ে কফিনের ঢাকনাটা খুলে দেয়। এক্ষুনি চোখ মেলে তাকাবে মৃত্তিকার অধিনায়ক, নিরিনের প্রাণের মানুষ...
আমি তৌহিদুর রহমান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 15 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 23 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
ধন্যবাদ