রহস্যের ভারী এক চাদর দিয়ে ঢাকা আমাদের এই মহাবিশ্ব। আধুনিক এই যুগে এসেও এখনও বহু কিছু আমাদের কাছে অজানা, আমাদের ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। মহাবিশ্ব তো দূরের কথা, পৃথিবী সম্পর্কেই বা আমরা কতটুকু জানি? তবুও সেই অজানার পেছনেই আমরা ছুটে বেড়াই জানার আকুলতায়। এই জানতে চাওয়ার আকুলতা থেকেই আজ আমাদের পা পড়েছে চাঁদের মাটিতে, সবচেয়ে গভীরতম মহাসাগরের অন্ধকার জগতেও সাঁতরে গিয়েছি আমরা, জানতে পেরেছি অণু -পরমানুর মত অতিক্ষুদ্র ও অদৃশ্য জিনিসের কথা। থেমে থাকেনি আমাদের অবাধ কৌতূহলের সেই অশ্বটি। রহস্যময় এই মহাবিশ্বের এরকমই একটি বিষয় হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল। একে নিয়ে জানার কৌতূহলতার কোন অন্ত নেই।
ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্তের প্রথম জানান ঘটে আইনস্টাইনের তত্ত্ব E = mc2 দ্বারা। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এটা অনুমান মনে করা হলেও, ১৯৭১ সালে এসে এর প্রথম দেখা মেলে গবেষকদের চোখে। তাহলে ব্ল্যাক হোল কি? কোথায় এর উৎপত্তিস্থল? কেনই বা হয়? এটা কালো হয় কেন? আজকে আমরা এই আর্টিকেলটির মাধ্যমে চেষ্টা করবো একে নিয়ে আলোচনা করার। চলুন জেনে নেওয়া যাক এর ব্যাপারে।
ব্ল্যাক হোল আসলে কি?
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অদ্ভুত এক বিস্ময়ের নাম হচ্ছে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। কিন্তু এর রং কালো কেন বা এর নামকরণ কেন ব্ল্যাক হোল করা হলো? এর জন্য আমাদের আগে একটু আলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হবে। আমরা জানি আলো সাতটি রঙ্গের সমন্বয়ে তৈরি। বেগুনী, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। আলো যখন কোন পৃষ্ঠতল বা সার্ফেসে পড়ে, তখন তা প্রতিফলিত হওয়ার কারণে আমরা চোখে আমাদের চারপাশ দেখতে পাই, কোন জিনিসের কি রং তা জানতে পারি। কিন্তু যখন সেই আলোটা প্রতিফলিত হয় না বা সেই পৃষ্ঠতলটি সেই আলোর রশ্মি টাকে শোষণ করে নেয়, তখন সেটা কালো দেখায়। এজন্যই অন্ধকারে আমরা দেখতে পাই না।
ব্ল্যাক হোল অনেকটা একি ভাবেই কাজ করে। বিশাল বিশাল তারকারা, যা অনেক সময়ে আমাদের সূর্যের থেকে কয়েকগুন বড় হয়ে থাকে, যখন তাদের মৃত্যুক্ষণের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং শক্তিশালী এক বিস্ফোরণের কারণে এর অবসান ঘটে যাকে সুপারনোভা (Supernova) বলে। বিস্ময়কর বিষয় হল, এই তারকাগুলো শেষ হয়ে যাওয়ার পড়েও এদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির একটি অবশিষ্টাংশ রেখে যায়। এর মধ্যাকর্ষণ শক্তি এতটাই শক্তিশালী হয় যে, কোন বস্তু, এমনকি আলো পর্যন্ত এর থেকে পালাতে পারেনা। এটি যেকোনো আলোর রশ্মিকে শোষণ করে নেয়, এবং তার জন্যে এর রং কালো দেখায়। এর থেকেই এর নাম দেয়া হয় ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর।
কিন্তু এখানে একটা কথা আছে। যেকোনো তারকাই কিন্তু ব্ল্যাক হোল হতে পারেনা। আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, কোন তারকার মূল ওজন বা core mass যদি সূর্যের ৩ গুন বা তার বেশী হয়, তখনই সেই তারকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং সুপারনোভায় পরিণত হয়। বলতে গেলে, বিশাল তারকার মৃত্যুতেই জন্ম নেয় এই ব্ল্যাক হোল, অনেকটা পৌরাণিক জগতের ফিনিক্সের মত।
অদৃশ্য হওয়ার কারণে আমরা ব্ল্যাক হোল সরাসরি দেখতে পাই না, কিন্তু বিশেষ কিছু যন্ত্র ও টেলিস্কোপের মাধ্যমে এর আচার-আচরণ ও চারিত্রিক মূলমন্ত্রগুলো আমরা ধারণা করতে পারি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, ব্ল্যাক হোল তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে শক্তিশালী গামারশ্মি নিঃসরণ করে, যার কারণে অনেক ছোট ছোট তারকাকাকে ভক্ষন করলেও, অন্য অনেকসব ছোট ছোট তারকার জন্ম দেয়।
এর আয়তন কত?
একেক ব্ল্যাক হোলের আয়তন একেক রকম হয়। এর কোন নির্দিষ্ট মাপ নেই। ওজন ও আয়তনের অপর নির্ভর করে এর শ্রেণীবদ্ধ ও নামকরণ করা হয়।
অনেক গবেষক বিশ্বাস করেন, শুধু আমাদের ছায়াপথেই ১ কোটি থেকে ১০০০ কোটি পর্যন্ত ব্ল্যাক হোল আছে। আগে থেকেই অনেক গবেষকের ধারণা ছিল, মধ্যকারের ব্ল্যাক হোল গুলোর বোধহয় কোন অস্তিত্ব নেই, তবে সাম্প্রতিক কিছু তথ্যে তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়। এগুলো আসলেই অস্তিমান।
কিভাবে গবেষণা করা হয় ব্ল্যাক হোলের?
অদৃশ্য হলেও আমাদের কৌতূহলের সীমানা ছাপিয়ে যেতে পারেনি। শক্তিশালী সব যন্ত্রপাতি ও স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এর পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। মূলত ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মেপেই এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায় ও বোঝা যায় এটা আসলে কতটা ক্ষমতার অধিকারী। কোন তারকাকে যদি অস্বাভাবিক ভাবে কোনকিছুর চারপাশে ঘুরপাক খেতে দেখা যায়, তখনি বিজ্ঞানীরা ধরে নেয় এখানে একটি ব্ল্যাক হোল আছে এবং তা নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। যখন তারকাগুলো ঘুরপাক খায়, তখন তারা উচ্চমাত্রার অসংখ্য এক্স-রে নিঃসরণ করে, যা নাসার টেলিস্কোপের দ্বারা মাপা যায়। এই তথ্য জোগানের ফলেই বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এর বিশিষ্টের সম্পর্কে জানতে পারে।
ব্ল্যাক হোলের শারীরিক অংশ গুলো কি কি?
ব্ল্যাক হোলের মূলত ৩ টি অংশ থাকে, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ইভেন্ট হরাইজন (Event Horizon)এবং সিঙ্গুলারিটি (Singularity)।
পৃথিবীর জন্য কতটা ভয়ংকর এই কৃষ্ণগহ্বর?
না ভয়ের কিছু নেই। পৃথিবী নিরাপদই আছে, কারণ হুমকির মুখে ফেলার মত আমাদের কাছাকাছি ভয়ংকর সেরকম কোন ব্ল্যাক হোল নেই। আর যদি থাকতোও, তবুও ভয়ের কোন কারণ ছিল না, কারণ তাহলে, পৃথিবী ও তার আশেপাশের গ্রহগুলো এর চারপাশে প্রদক্ষিণ করত যেভাবে আমাদের সূর্যের চারপাশে করে। সেই সাথে, আমাদের গালাক্সির সূর্যের এতটাও ওজন বা ক্ষমতা নেই যে, সে ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে।
শেষ কথা
এই মহাজগতের অন্তহীন এই ধাঁধা আমরা হয়ত কখনই উদ্ঘাটন করতে পারবোনা। এক রহস্যের উন্মোচনের অন্তে আরেক রহস্যের জন্ম হবে। তবে এটুক নিশ্চিত যে আমাদের জানবার ইচ্ছা শেষ হবার নয়। ব্ল্যাক হোলের মত আরও শত শত আশ্চর্যজনক বিষয় আমাদের সামনে আসবে, আমাদের ভাবিয়ে তুলবে, চিন্তা করাবে আর কতটা বিস্ময়ের ভাণ্ডার আমাদের জ্ঞানের বাহিরে রয়েছে। আর ব্ল্যাক হোল আমাদের দেখাতে পারে যে ভয়ংকর হলেও এর অস্তিত্বটা কত চমৎকার। আশাকরি আর্টিকেলটি পড়ে সবার ভালো লাগবে এবং আপনাদের জ্ঞানের আরেকটু প্রসার ঘটবে। যদি ভালো লেগে থাকে, টিউমেন্ট করে জানাবেন আপনার মতামত, এবং আর কি কি বিষয়ে আপনারা জানতে চান। চেষ্টা করবো সেইগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরার। সেই পর্যন্ত সবাই ভালো থাকুন ও জ্ঞান অর্জনের পথে হাঁটতে থাকুন এবং আমায় ফলো করতে ভুলবেন না।
আমি সাদাফ সাদ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 1 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 2 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।