পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান পতঙ্গটি হচ্ছে মৌমাছি। এদেরকে 'মধুমক্ষিকা' বা 'মধুকর'ও বলা হয়। এরা এমন একটি জাতি যাদের রয়েছে মানুষের মতো উন্নত সমাজতন্ত্র-রাজতন্ত্র। আজকে এই বুদ্ধিমান আর পরিশ্রমী প্রাণীটি সম্পর্কে আমরা জানব।
আকার এবং কাজের ভিত্তিতে মৌমাছিদেরকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ–
রাণী মৌমাছি মৌচাকের সবচেয়ে বড় মৌমাছি কারণ এর দৈর্ঘ্য অন্যান্য মৌমাছিদের থেকে একটু বেশি। একটি মৌচাকে একটিই মাত্র রানী মৌমাছি থাকে। রাণী মৌমাছির প্রধান কাজ ডিম পাড়া যেহেতু একমাত্র এই মৌমাছিটিই সন্তান জন্মদানের সক্ষম এবং একটি মৌচাকে মৌমাছির সংখ্যা বাড়িয়ে তোলে। রানী মৌমাছি তার জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই কিছু পুরুষ মৌমাছি এবং কিছু শ্রমিক মৌমাছিদের সাথে নিয়ে আকাশে উড়ে যায় এবং সেখানে পুরুষ মৌমাছিগুলোর সাথে মিলিত হয়। তবে পুরুষ মৌমাছিগুলো রানী মৌমাছির সাথে মিলিত হওয়ার পরপরই মৃত্যুবরণ করার যে গল্পটি বলা হয় সেটি আসলে বানানো একটি রসালো গল্প বলে গবেষকরা মনে করেন। মিলিত হওয়ার পর রানী মৌমাছি তার সাথে করে নিয়ে যাওয়া সেই শ্রমিক মৌমাছিদের নিয়ে আবার মৌচাকে ফিরে আসে। রাণী মৌমাছি পাঁচ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
পুরুষ মৌমাছি হুল বিহীন মধ্যম আকৃতির হয়ে থাকে। এরা খুবই অলস প্রকৃতির এবং এতটাই অলস যে কখনো কখনো তাদের নিজেদের খাবার নিজেরা নিয়ে খেতে চায় না, শ্রমিকদের খাইয়ে দিতে হয়। তাদের একমাত্র কাজ রানী মৌমাছির সাথে মিলিত হওয়া। এদের আয়ুষ্কাল ১.৫ মাস থেকে ২ মাস পর্যন্ত।
হুলযুক্ত অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মৌমাছিটি হচ্ছে শ্রমিক মৌমাছি। অন্যভাবে বলা যায়, রাণী মৌমাছি এবং পুরুষ মৌমাছি বাদ দিয়ে বাকি সকল মৌমাছিকে শ্রমিক মৌমাছি বলা হয়। মৌচাকের যাবতীয় কাজকর্ম এরাই করে থাকে। এদেরকে একমাস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে দেখা যায়।
প্রজাতির দিক থেকে মৌমাছির সংখ্যা ২০ হাজারের মতো বা এর থেকেও বেশি। এসব প্রজাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো
এ ধরনের মৌমাছিরা খুব ভালো মধু সংগ্রাহক। তাদের বসতি থেকে গড়ে ৫০ থেকে ৮০ কেজি মধু পাওয়া যায়।
এরা খুব কম পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে। এক একটি বসতি থেকে গড়ে ২০০ থেকে ৯০০ গ্রাম মধু পাওয়া যায়।
এদেরকে ইতালীয় মৌমাছিও বলা হয়। গড়ে ২৫ থেকে ৪০ কেজি মধু পাওয়া যায় এদের বসতি থেকে।
এই মৌমাছিগুলো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, শ্রীলংকা ইত্যাদি অর্থাৎ এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে পাওয়া যায়। এদের বসতি থেকে গড়ে ৬ থেকে ৮ কেজি মধু পাওয়া যায়।
মৌমাছিদের অন্যতম একটি জাত হচ্ছে 'হুলবিহীন মৌমাছি'। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে এসব মৌমাছি পাওয়া যায়। এদের যে হুল নেই এমনটা নয় বরং এদের হুল পরিপূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়ায় এদেরকে এই নামে ডাকা হয়। ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম মধু থাকে এদের উপনিবেশে।
মৌমাছিরা যৌন প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে থাকে। একটি রানী মৌমাছি সাধারণত জীবনে একবার একাধিক পুরুষ মৌমাছির সাথে মিলিত হয়। এক্ষেত্রে মিলনের পর পুরুষ মৌমাছিগুলো মারা যায় না বা অন্যান্য পুরুষ মৌমাছি, যারা রানী মৌমাছির সাথে মিলিত হতে পারেনি, তারা কষ্ট পেয়ে আত্মহত্যাও করে না। লোকমুখে বলা মারা যাওয়ার বা আত্মহত্যার কাহিনীটি আসলে অতিরঞ্জিত। রাণী মৌমাছি একসাথে ২০০০ থেকে ৩০০০ টি ডিম দিয়ে থাকে। ডিমগুলো আবার ২ ধরনেরঃ
নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম হয় রানী মৌমাছির। ডিমগুলোর বয়স ৩ দিন হওয়ার পর সেগুলো লার্ভাতে পরিণত হয়। ৩ দিন হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি লার্ভাকে বিশেষ একপ্রকার জেলী খেতে দেওয়া হয় যাতে লার্ভা গুলো দ্রুত বেড়ে উঠতে পারে। এই জেলিকে 'রয়েল জেলি' বা 'রাজ সুধা' বলা হয়। তিন দিন পর মৌমাছিরা বুঝতে পারে কোনগুলো রানী মৌমাছি, কোনগুলো পুরুষ মৌমাছি এবং কোনগুলো কর্মী বা শ্রমিক মৌমাছি হবে। তাই এরপর থেকে শুধুমাত্র রানী মৌমাছিকেই ওই স্পেশাল জেলি খেতে দেওয়া হয়। আর অন্যান্য সাধারণ মৌমাছিদেরকে শুধু মধু খেতে দেওয়া হয়। ৬ দিন পর মৌচাকের প্রকোষ্ঠগুলোকে, যেগুলোর ভেতরে লার্ভা রয়েছে, সেগুলো মোম দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। রানী মৌমাছির মোম ভেদ করে বাহিরে আসতে ১৬ দিন সময় লাগে। শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছির সময় লাগে ২২ দিন, শ্রমিক মৌমাছির জন্মের ২৪ দিন পর পুরুষ মৌমাছির জন্ম হয়।
মৌমাছির বাসস্থান বা উপনিবেশ বা আবাসস্থলকে মৌচাক বলা হয়। একে আবার মধু এবং পরাগের দোকানও বলা হয়। মৌচাক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট এবং মোম দিয়ে তৈরি হয়। প্রকোষ্ঠগুলো ষড়ভুজাকার। মৌমাছিরা তাদের সংগ্রহ করা মধুর কিছু অংশ মৌচাক তৈরিতে ব্যবহার করে। মধু থাকে মূলত মৌচাকের প্রকোষ্ঠগুলোর ভেতরে। তবে সেখানে মৌমাছির লার্ভা এবং ডিমও থাকতে পারে।
একটি মৌচাকে ২০ থেকে ৫০ হাজার মৌমাছি থাকে। একটি রাণী মৌমাছি, ৫ থেকে ৬ শত পুরুষ মৌমাছি এবং অবশিষ্টগুলো থাকে কর্মী মৌমাছি।
দেহ ৩ খন্ডে বিভক্ত, চারটি ডানা আছে এবং দৈর্ঘ্য ১ থেকে ১.৫ সেন্টিমিটার। যা ইঞ্চিতে ১/২ থেকে ৩/৪ ইঞ্চি হয়ে থাকে।
মৌমাছিরা যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে পারে। মৌমাছিদের মৌচাক দেখে গবেষকেরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। মৌচাকের প্রকোষ্ঠগুলোর ষড়ভুজাকার গঠন তার প্রমাণ।
একপ্রকার মিষ্টি এবং ঘন তরল পদার্থ হচ্ছে মধু। মৌমাছি এবং অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে মধু তৈরি করে থাকে। মধু উচ্চ ঔষধিগুণাবলী সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল। প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে মধুতে। গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, সুক্রোজ, মন্টোজ, অ্যামাইনো এসিড, খনিজ লবণ এবং এনজাইম থাকে মধুতে। তাছাড়া মধু আমাদের ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫, বি-৬, আয়োডিন, জিঙ্ক, কপার ইত্যাদির যোগান দেয়। মধুতে চর্বি এবং প্রোটিন না থাকায় রান্নাতে মিষ্টির পরিবর্তে মধু ব্যবহার করতে উৎসাহ দেওয়া হয়।
মৌচাক থেকে মধু এবং মোম পাওয়া যায়। মৌচাকে থাকে ষড়ভুজাকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য প্রকোষ্ঠ। এখানে মধু জমা থাকে। মৌচাক অর্থাৎ মৌচাকের গঠন হচ্ছে মৌমাছিদের বুদ্ধিমত্তার একটি নিদর্শন। মৌমাছি পালনকারীরা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। তারা মধু সংগ্রহ করে তাদেরকে মৌয়াল বলে। মধু বহুবিধ ভেষজ উপাদান সম্পন্ন একটি তরল। আর মোম সাধারণত বিভিন্ন শিল্পে প্রলেপ দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া প্রসাধনী শিল্পেও মোমের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে।
মৌমাছির হুলে যে বিষ থাকে তা রোগ নিরাময়ে কার্যকরী বলে গবেষকরা মনে করেন। সাধারণত বাতজনিত রোগের চিকিৎসায় এই বিষ ব্যবহার করা হয়। মৌমাছির বিষে রয়েছে মিথানয়িক এসিড বা ফর্মিক এসিড বা HCOOH.
পুরো বিশ্বের মোট খাদ্য উৎপাদনে ৮৫ থেকে ৯০ ভাগই মৌমাছির প্রত্যক্ষ ভূমিকার কারণে উৎপাদিত হয়ে থাকে। তাই বলা হয়, মৌমাছি না থাকলে চার বছরের মধ্যেই উদ্ভিদ ও মানবজাতির অস্তিত্ব বিলুপ হয়ে যাবে। আমরা জানি, পরাগায়নের মাধ্যমে ফসল উৎপন্ন হয়। আর পরাগায়নের ৯০ ভাগই মৌমাছিদের দ্বারা হয়ে থাকে। আর এ কারণেই এমনটা বলা হয়।
মৌমাছিরা তাদের নিজস্ব বাসস্থানে যদি অপরিচিত কোনো মৌমাছিকে দেখে তাহলে তারা সেটিকে হত্যা করে ফেলে। কেননা, এসব মৌমাছিরা সাধারণত মধু চুরি করে নিয়ে যেতে আসে।
মৌমাছিরা সাধারণত ৩ ভাগে ভাগ হয়ে থাকে। এক ভাগ ঘরে অবস্থান করে (মধু পাহারা দেয়, ডিম বা লার্ভার দেখাশোনা করে ইত্যাদি), অন্য ভাগ মধুর সন্ধান করতে চলে যায় এবং অপর ভাগ মধু খায়।
সন্ধানী মৌমাছিরা মধু কোথায় আছে এবং কোথায় কিভাবে যেতে হবে তা বাড়িতে এসে সেখানে অবস্থানরত অন্যান্য মৌমাছিদেরকে বুঝিয়ে বলে। গন্তব্য আর পথ কেমন হবে সে সম্পর্কেও তাদেরকে ধারণা দেয়। যেমন– কত দূরে যেতে হবে, কোন দিকে যেতে হবে, পথটা কি আঁকাবাঁকা নাকি সোজা, পথে কেমন সমস্যা হতে পারে ইত্যাদি।
এধরনের লেখা আরও পেতে এই একাউন্টটি ফলো দিয়ে রাখতে পারেন এবং নিয়মিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক যেকোনো তথ্যের আপডেট পেতে টেকটিউনস এর সাথেই থাকুন।
আমি জান্নাতুল ফেরদৌস ইভা। এসএসসি ২০২২, ময়মনসিংহ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 14 টি টিউন ও 14 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 8 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 8 টিউনারকে ফলো করি।