ন্যানো টেকনোলজি বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় এবং কৌতুহলোদ্দীপক একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমাদের ব্যবহৃত ওয়াটার প্রুফ অর্থাৎ পানিতে ভিজে না এমন ঘড়ি, ফোন, প্রসাধনী, ব্যাগ ইত্যাদি ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে করা হয়েছে। আবার ধুলো ময়লা জমে না এমন বাড়ির রং, কাপড়, জুতা; স্মার্টফোনের স্ক্রিনের উপর ব্যবহৃত পাতলা শিট যা স্ক্রেচ প্রুফ, ডাস্ট প্রুফ– এসবও এই টেকনোলজি ব্যবহার করেই করা হয়েছে। একদিন হয়তো এমন পোশাক তৈরি করা হবে যাতে পানি লাগবেনা, ময়লা লাগবে না, এমনকি ধোয়ারও প্রয়োজন হবে না। আবার হয়তো চিকিৎসাক্ষেত্রে এমন কিছু তৈরি করা হবে, যা শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে যে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াগুলো রোগ তৈরি করছে সেগুলোকে ধরে ধরে একটা একটা করে মেরে ফেলবে।
বোঝাই যাচ্ছে ন্যানো টেকনোলজি কতটা নন্দিত হবে এবং হয়েছেও এই বিশ্বে। যেহেতু ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো বৈশিষ্ট্য সংবলিত প্রডাক্ট তৈরি করা যায়, তাই এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এই লেখায়। চলুন তাহলে শুরু করি।
ন্যানো টেকনোলজি বা ন্যানো প্রযুক্তি হচ্ছে কোনো পদার্থকে আনবিক বা পারমাণবিক পর্যায়ে পরিণত করা, পরিবর্তন করা এবং সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা। সাধারণত ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার স্কেলের মধ্যে এই কাজটি করা হয়।
ন্যানো হলো পরিমাপের একটি ক্ষুদ্র একক। ১ ন্যানো মিটার = ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ। এটা কিন্তু খুবই ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। আমাদের একটি চুলের ব্যাসই ৫০-৮০ হাজার ন্যানোমিটার। তাই বোঝাই যাচ্ছে ১ ন্যানোমিটার কতটা ছোটো। এমনকি এটি আমাদের শরীরে প্রবাহিত রক্ত কণিকার থেকে ১০ হাজার গুণ ছোট। তাই ন্যানো টেকনোলজি হলো ন্যানো পর্যায়ের টেকনোলজি বা ন্যানো পর্যায়ের প্রযুক্তি।
'রিচার্ড ফিলিপস ফেইনম্যান' বা 'Richard Phillips Feynman' (১১ই মে, ১৯১৮ – ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮); তার Plenty of Room at the Bottom শিরোনামের একটি লেকচারে দেখান, কিভাবে একটি পরমাণুকে সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে কাজে লাগিয়ে সুবিধা লাভ করতে পারি। পরবর্তীতে জাপানিজ বিজ্ঞানী 'নরিও টানিগুচি' বা 'Norio Taniguchi' আবার এই ন্যানো টেকনোলজির ধারণাটি সামনে নিয়ে আসেন। তবে ১৯৮১ সালে টানেলিং মাইক্রোস্কোপ বা অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর এই ধারণাটি বাস্তবে রূপ নেয়। কারণ এই মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে কোনো পদার্থের মধ্যে বিদ্যমান প্রতিটি পরমাণু আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যেতো। এখানেই শেষ নয় পরবর্তীতে আবিষ্কার হয় Atomic Force Microscope যার মাধ্যমে অ্যাটোমিক স্কেলে অনুকে দেখা, পরিমাপ করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। এরই একটি উদাহরণ হলো- এটমিক অ্যানিমেশন।
১. কোনো একটি পদার্থকে কেটে ছোট করলে তার ধর্মে কোনো পরিবর্তন আসে না। যেমন সিলিকনকে কেটে ছোট করলে সেটা একটা সিলিকনই থাকবে আবার 'তামা'কে কেটে ছোট করলে সেটাও একটা 'তামা'ই থাকবে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ট্রানজিস্টর তৈরি করতে মূলত এই কাজটিই করা হয় (আমরা জানি কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে যত বেশি ট্রানজিস্টর থাকবে তার ক্ষমতাও তত বেশি হবে)। এই কারণে ট্রানজিস্টর ধীরে ধীরে ছোট হতে থাকে। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রসেসরে অধিক ট্রানজিস্টর স্থাপন করা সম্ভব হয় এবং যন্ত্রটির ক্ষমতাও বেড়ে যায়। এখন চুল পরিমান একটা স্থানে ১৬ হাজার ট্রানজিস্টার বসানো যায়।
২. কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন ফসলের DNA কোড পরিবর্তন করে ঐ ফসলের বিভিন্ন মডিফাইড ফসল তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। যেমন ফুলকপির ডিএনএ কোড পরিবর্তন করে ব্রোকলি তৈরি করা হয়েছে। ব্রোকলি হচ্ছে ফুলকপির একটি মডিফাইড রূপ। এভাবে বিভিন্ন ফসলের DNA কোড পরিবর্তন করে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করা হয় যাদের উৎপাদন ক্ষমতাও সাধারণ উদ্ভিদের থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকে।
৩. ন্যানো টেকনোলজি চিকিৎসাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ন্যানো সাইজের রোবট তৈরি করে মানুষের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয় এবং সেই রোবটটিকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে বিভিন্ন ক্ষতিকারক কোষ ধ্বংস করা হয়। এ বিষয়ে বর্তমানে বিজ্ঞানীদের দূরদর্শী চিন্তা হচ্ছে এমন ন্যানো রোবট তৈরি করা যা শরীরে প্রবেশ করে মানুষের বয়স বৃদ্ধির জন্য দায়ী কোষ শনাক্ত করা এবং তাতে এমন পরিবর্তন আনা যাতে বয়সের পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়। তাছাড়া এই ন্যানো রোবটগুলো অন্যান্য কাজও করবে মানুষের শরীরের ভেতরে প্রবেশ করে। বলা যায়, চিকিৎসাক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার চিকিৎসাক্ষেত্রকে অনেক দূর অবধি এগিয়ে নিয়ে যাবে।
৪. এছাড়া লাগেজ, অ্যারোপ্লেন, বাইসাইকেল, স্পেসশিপ, টেনিস রেকেট, ভাজ করা যায় এমন ডিসপ্লে, গ্লাস, স্কিন টাচ ফোনের ওপর ব্যবহৃত স্ক্র্যাচ ফ্রি ডাস্ট ফ্রি আবরণ, ইউপি রশ্মি, ব্লু লাইট এমনকি রানার কাজে ব্যবহৃত ননস্টিক ফ্রাই পেনের উপর ব্যবহৃত লেয়ারটি; যা খাদ্যকে পুড়তে দেয় না, সেটিও ন্যানোটেকনোলজির সাহায্যে তৈরি করা হয়েছে।
ধরুন, আপনি এমন একটি পোশাক চান যেটা হবে ওয়াটার প্রুফ এবং ডাস্ট প্রুফ অর্থাৎ পানি বা ময়লা লাগবেনা। তাই এমন একটি পদার্থ দিয়ে পোশাকটি তৈরি করতে হবে যে পদার্থের ভেতরে এমন গুণ রয়েছে। যদি প্রকৃতিতে এমন কোনো পদার্থ পাওয়া না যায় তাহলে কৃত্রিমভাবে এমন একটি পদার্থ তৈরি করতে হবে যার মধ্যে এই গুণাগুণগুলো রয়েছে। ন্যানো টেকনোলজিতে ব্যবহার করে সাধারণত এই কাজটিই করা হয়। বিভিন্ন গুণসম্পন্ন পদার্থকে একত্রিত করে একটি পদার্থের মধ্যেই সেই গুণগুলোকে নিয়ে আসা হয়। এভাবে ন্যানো টেকনোলজি কাজ করে থাকে।
আবার কোনো বস্তু কি ধরনের আচরণ করবে বা তার ধর্ম কেমন হবে; তা ঠিক করে ঐ পদার্থের অনুগুলো কিভাবে সাজানো আছে তার উপর ভিত্তি করে। যেহেতু ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে কোনো বস্তুর অনুগুলোর মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন সাধন করা যায়, তাই একটি পদার্থের আনবিক পরিবর্তন করে আমরা সেই পদার্থের আচরণও পরিবর্তন করতে পারি এবং আমাদের প্রয়োজনমতো সেই পদার্থকে নিজেদের কাজে লাগাতে পারি।
আপনি যদি আনুষঙ্গিক এরকম আরও বিষয়গুলো জেনে নিজেকে আপডেটেড রাখতে চান তাহলে এই একাউন্টটি ফলো দিয়ে রাখতে পারেন। আর নিয়মিত এ ধরনের লেখা পেতে চোখ রাখুন টেকটিউনস এর পাতায়।
আমি জান্নাতুল ফেরদৌস ইভা। এসএসসি ২০২২, ময়মনসিংহ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 14 টি টিউন ও 14 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 8 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 8 টিউনারকে ফলো করি।