ফুটবল জাদুকর ম্যারাডোনার সেই বিখ্যাত গোলটি সম্পর্কে কে না জানে? যে গোলের কারণে তিনি 'হ্যান্ড অফ গড' -এর তকমা পেয়েছিলেন। এই একটি গোল নিয়ে কতই না আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্লেষণ হয়েছে। ফুটবলে আর যেনো এরকম বিতর্কিত ঘটনা না ঘটে অর্থাৎ ফুটবল যেনো পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা পায় সেই জন্য ফুটবলে সংযোজন করা হয়েছে ভিএআর (VAR) নামক প্রযুক্তি। 'ভিএআর' মানে কি? -এই প্রযুক্তি সম্পর্কে অনেকেই হয়তো বেখবর থাকতে পারেন। প্রযুক্তিটি ফুটবল খেলার বয়সের তুলনায় একেবারেই নতুন। চলুন জেনে নেই এ সম্পর্কে বিস্তারিত।
'ভিএআর এর পূর্ণ রুপ হলো- ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি' অর্থাৎ ইংরেজিতে (VAR)- Video Assistant Referee. খেলার মাঠে রেফারিকে ১ সেকেন্ড বা তারও কম সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতিতে সব সিদ্ধান্ত নিখুঁত নাও হতে পারে। তাই খেলার সময় রেফারিকে সহযোগিতা করার জন্য অর্থাৎ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য 'ভিএআর' প্রযুক্তির প্রবর্তন করা হয়। 'ভিএআর' কোনো সয়ংক্রিয় বারোবটিক প্রযুক্তি নয়৷ এটি তত্তাবধান করেন তিন সদস্য বিশিষ্ট রেফারি প্যানেল। একজন মূলত থাকেন ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি এবং একজন থাকেন তার সহযোগী। তৃতীয় ব্যক্তি ভিডিও রিপ্লে নিয়ন্ত্রণ করেন৷ তারা তিনজনই ভিডিও নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বসে বিভিন্ন কোণ থেকে ভিডিও দেখেন এবং বিশ্লেষণ করেন। এরপর তারা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মাইকের মাধ্যমে রেফারিকে জানিয়ে দেন, ফলে রেফারি অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল সিদ্ধান্ত থেকে রেহাই পান।
'ভিএআর' প্রযুক্তি বিশেষভাবে চারটি বিষয়ের উপর নজর রাখে। প্রথমটিঃ রেফারি যাতে সহজেই গোল নির্ধারণ করতে পারেন। গোলটি সঠিকভাবে করা হলো কিনা বা ভুলভাবে গোল হলো কনা তা যাচাই করা৷ দ্বিতীয়টিঃ ভুল করে রেফারি যাতে পেনাল্টি না দিয়ে বসেন সেই বিষয়টিও দেখভাল করে এই ভিএআর। পেনাল্টি সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়কে ডি-বক্সে সত্যিই ফাউল করা হলো কিনা তা সুক্ষ্ণভাবে বিশ্লেষণ করতে রেফারি 'ভিএআর' এর সাহায্য নেন। তৃতীয়টিঃ কোনো খেলোয়াড় ফাউল না করেও যাতে রেফারির ভুল সিদ্ধান্তের কারণে মাঠ ত্যাগ না করেন তার জন্য ব্যবহার করা হয় 'ভিএআর'। এবং চতুর্থটিঃ রেফারির চোখ এড়িয়ে কোনো খেলোয়াড় ভুল কিছু করে থাকলে যাতে রেফারি সেই খেলোয়াড়কে সতর্ক করে দিতে পারেন সে বিষয়েও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া এক্সায় 'ভিএআর' থেকে।
২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে ব্যবহার করা হয় 'ভিএআর' প্রযুক্তি। এরপর থেকে ব্যাপকভাবে প্রসার ঘটে এই প্রযুক্তির। 'ভিএআর' পদ্ধতিতে কোনো সিদ্ধান্ত নির্ভুলভাবে নেওয়ার জন্য তিনটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়৷ প্রথমত, রেফারির নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত ঠিক-ভুল যাচাই করার জন্য 'ভিএআর' রেফারিদের কাছে আবেদন জানানো হয়। 'ভিএআর' রেফারি প্যানেল তা পর্যালোচনা করে মূল রেফারিকে জানিয়ে দেন। দ্বিতীয়ত, এই পদ্ধতিতে ভিডিও বিশ্লেষণ করে 'ভিএআর' রেফারি প্যানেল যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তা হেডফোনের মাধ্যমে মাঠের রেফারিকে জানিয়ে দেয়া হয়। এবং তৃতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হলে মূল রেফারি 'ভিএআর' রেফারি প্যানেলের সাথে পরামর্শ করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
একইসাথে কোনো বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে মাঠের পাশে থাকা মনিটরে ভিডিও ক্লিপ দেখেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে খেলোয়াড়দের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় অনেকাংশে। চলুন যেনে নেয়া যাক 'ভিএআর' প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখা-প্রশাখাগুলো সম্পর্কে। ভিএআর যদি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখা যায় যে, এখানে কিছু নতুন শব্দ পাওয়া যায়। যেমন, "অ্যাসিস্ট্যান্ট ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি" বা "এভিএআর" যা কিনা বর্তমান কিংবা সাবেক কোনো রেফারি প্যানেল। তারা মূলত যে কাজগুলো করে থাকেন তা হচ্ছে, সরাসরি ভিএআর দিয়ে খেলা দেখা, খেলা যারা সম্প্রচার করছেন তাদের সাথে যোগাযোগ রাখা, গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ বিবেচনা করে দেখা। মুল রেফারি যে ধরনের পোশাক পড়েন, এই রেফারি প্যানেলও ওই একই পোশাক পড়ে খেলা পরিচালনা করতে সহায়তা করেন।
'ভিএআর' প্রযুক্তির আরও কিছু শাখা রয়েছে, যেমনঃ "এপিপি" বা "অ্যাটাকিং পজিশন ফেজ" বলে একটি বিষয় রয়েছে। এট হলো, পেনাল্টি, গোল কিংবা ফাউল করার ঠিক পূর্ব মূহুর্তে খেলার অবস্থা কেমন ছিলো তা দেখা এবং সিদ্ধান্ত নেয়া। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে "ওএফআর" বা "অন ফিল্ড রিভিউ"। এটির মাধ্যমে রেফারি কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে মাঠের পাশে থাকা স্ক্রিনে ভিডিও ফুটেজ দেখেন। এবং "আরআরএ" অর্থাৎ "রেফারি রিভিউ এরিয়া"-এর মাধ্যমে রেফারি একটি বিশেষ স্থান থেকে ভিডিও ফুটেজ রিপ্লে দেখেন।
"আরও" বা "রিপ্লে অপারেটর" হচ্ছে ভিএআর এর আরেকটি শাখা, যেখানে একজন দক্ষ লোক থাকেন। তার কাজ হচ্ছে ভিডিও অপারেশন রুম থেকে ভিএআর কে সহায্য করা। এবং "আরএ" বা "রিভিউ অ্যাসিস্ট্যান্ট" এর দায়িত্বে থাকেন সেই ব্যক্তি যিনি "আরআরএ" -এর দায়িত্বে থাকা রেফারিকে সহায়তা করেন এবং নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। "এসসি" বা "সাইলেন্ট চেক" বলে একটা অপশন রয়েছে যার মাধ্যমে রেফারির সাথে আলোচনা না করেই ভিএআর ভুল নেই এমন সিদ্ধান্ত মিমাংসা করে থাকে। "ভিওআর" বা "ভিডিও অপারেশন রুম" হলো এমন একটি কক্ষ যেখান থেকে "এভিএআর", "ভিএআর" এবং সংশ্লিস্ট অন্যান্যরা ম্যাচ চলাকালীন ভিডিও ফুটেজ, বিশ্লেষণ, যাচাই-বাছাই কিংবা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। যেটি স্টেডিয়ামের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে।
ভিএআর প্রযুক্তি সংযোজন করার চিন্তাভাবনা আসে ২০১৭ সালে পর্তুগাল ও মেক্সিকোর মধ্যকার ম্যাচটি থেকে। সেই বছরই সিরিএ লিগ, কনফেডারেশন কাপ, বুন্দেসলিগাসহ বেশ কিছু খেলায় এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়। ফুটবলে প্রযুক্তির এই ব্যবহার সত্যিই সুফল বয়ে এনেছে। বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার ফুটবল খেলাকে আরও বেশি স্বচ্ছ ও গতিময় করে তুলেছে
আমি মেহেদী হাসান শাওন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 3 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 7 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।