এক শতাব্দী বা তার আগের কথা ভাবুন, তখন হয়তো গোটা পৃথিবী জুড়ে হাজার খানেক গাড়ি (কার) ছিল। কিন্তু আজকের দিনে সেই সংখ্যা হাজারকে ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে প্রায় বিলিয়নে—মোটামুটিভাবে এই গ্রহের প্রত্যেক ৭ জনের ১ জনের কাছে রয়েছে একটি করে গাড়ি। এখন এই বিশাল সংখ্যার গাড়ি গুলোকে চালাতে গেলে প্রয়োজন প্রচুর পরিমানের জ্বালানী, আর দিনদিন জ্বালানীর সরবরাহ অর্থাৎ তেলের পরিমান কমে আসছে আমাদের কাছে। তাহলে ভবিষ্যতে আমাদের গাড়ি গুলো কোথা থেকে জ্বালানী পাবে? হুটকরে ভাবতে গেলে বলতে পারি, আমাদের বর্তমান কার গুলোকে আরো দক্ষ করে প্রস্তুত করতে হবে যাতে এরা অনেক কম জ্বালানী খরচ করে। আর একটু দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তা করতে চাইলে বলতে হয়, পেট্রোল আর ডিজেলের ইঞ্জিনের উপর নির্ভরশীল না থেকে ইলেকট্রিক ফুয়েল সেল এর দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। ফুয়েল সেল অনেক ব্যাটারির মতো, যা হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে চলে আর এই গাড়ি গুলো হবে নিঃশব্দের আর পরিবেশ বান্ধব—কিন্তু প্রশ্ন হলো এরা কীভাবে কাজ করবে? তো চলুন বন্ধুরা, উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
আজকের আধুনিক গাড়ি গুলোকে চালানোর জন্য আমরা দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি। রাস্তার বেশিরভাগ গাড়ি গুলো অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন ব্যবহার করে চলে। এই ইঞ্জিন গুলো পেট্রোলিয়াম জাতীয় জ্বালানী পুরিয়ে তাপ উৎপন্ন করে এবং একটি পিস্টনকে আগেপিছে ঠেলতে থাকে, ফলে চাকাতে ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়। কিন্তু ইলেকট্রিক কার গুলো সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে কাজ করে। ইলেকট্রিক কারে ইঞ্জিন থাকার বদলে থাকে ব্যাটারি, যা ইলেকট্রিক মোটরকে ঘুরতে সাহায্য করে—আর এই মোটর সরাসরি গাড়ীর চাকা ঘোরাতে সাহায্য করে। হাইব্রিড কার গুলোতে একসাথে অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন এবং ইলেকট্রিক মোটর দুইই থাকে, যখন যে পরিবেশে যা প্রয়োজন তা ব্যবহার করার জন্য।
ফুয়েল সেল অনেকটা অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন এবং ব্যাটারি পাওয়ার উভয়ের মতোই কাজ করে। অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিনের মতো এটির শক্তি উৎপন্ন করার জন্য একটি জ্বালানী ট্যাঙ্ক থাকে (এই জ্বালানী ট্যাঙ্কে কোন পেট্রোল বা ডিজেলের বদলে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হয়)। কিন্তু, ইঞ্জিনের মতো ফুয়েল সেল হাইড্রোজেন গ্যাসকে পোড়ায় না। এটি হাইড্রোজেন গ্যাসকে বাতাসের অক্সিজেন গ্যাসের সাথে কেমিক্যালি মিলিয়ে দিয়ে পানি উৎপন্ন করে (এটি সেই প্রসেস যা ব্যাটারির ক্ষেত্রে ঘটে থাকে) এবং এর ফলে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদিত হয় যা ইলেকট্রিক মোটর গুলোকে শক্তি যোগাতে সাহায্য করে। আর এই কার থেকে ধোঁয়ার বদলে বের হয় পানি, এই পানি এতোটাই বিশুদ্ধ যে আপনি তা পান করতে পারবেন।
ফুয়েল সেলের মধ্যে যে বিক্রিয়াটি ঘটে থাকে, তাকে ইলেক্ট্রো কেমিক্যাল প্রতিক্রিয়া বলা হয়। এটি একটি কেমিক্যাল বিক্রিয়া, কেনোনা এখানে দুটি কেমিক্যালকে একত্র করে কাজ করানো হয়, আবার এটি একটি ইলেকট্রিকাল প্রতিক্রিয়াও, কেনোনা দুটি কেমিক্যালের বিক্রিয়ার ফলে এখানে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদিত হয়। ফুয়েল সেলে প্রধানত তিনটি অংশ থাকে, যা একটি ব্যাটারির সাথে মিলে যায়। প্রথমত এতে একটি পজিটিভ চার্জ যুক্ত টার্মিনাল থাকে, দ্বিতীয়ত এতে একটি নেগেটিভ চার্জ যুক্ত টার্মিনাল থাকে এবং এই দুটি বিপরীত ধর্মী টার্মিনালকে একে অপরের থেকে আলাদা করে রাখার জন্য এক ধরনের কেমিক্যাল থাকে যাকে ইলেক্ট্রোলাইট বলা হয়।
তাহলে কীভাবে ফুয়েল সেল এগুলো থেকে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন করে?
এই ধরনের ফুয়েল সেলকে পিইএম (পলিমার এক্সচেঞ্জ মেমব্রেন) বলা হয়। এই সেলটি ঠিক ততোক্ষণ চলতে থাকবে যতক্ষণ এতে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন সরবরাহ করা অব্যাহত রাখা হবে। যাইহোক, বাতাসে তো অক্সিজেনের অভাব নেই কিন্তু প্রশ্ন আসবে যে কতটা হাইড্রোজেন ট্যাঙ্কে আছে।
হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে গাড়ি চালানো সত্যিই এক চমৎকার আইডিয়া। কিন্তু সমস্যা হলো যখন প্রত্যেকে এই আইডিয়া ব্যবহার করে গাড়ি চালাতে আরম্ভ করবে তখনই ঘটবে আসল সমস্যা—কেনোনা আমাদের চারপাশে যে বাতাস রয়েছে আর মধ্যে অত্যন্ত কিঞ্চিৎ পরিমানে হাইড্রোজেন মজুদ রয়েছে। আপনি মিলিয়ন লিটার বাতাস থেকে কেবল ১ লিটার হাইড্রোজেন পেতে পারবেন। আর এই প্রাপ্তির অংকটা সত্যিই অনেক কম। তাহলে উপায় কি? কীভাবে এতো পরিমানে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা সম্ভব হবে যা দ্বারা এই গ্রহের সকল গাড়ি চলতে পারবে? এর সহজ উত্তরটি হলো পানি থেকে, হ্যাঁ, আমাদের পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করতে হবে। আর সবচাইতে মজার ব্যাপার হলো এই গ্রহের পৃষ্ঠে প্রায় ৭০ শতাংশ পানি রয়েছে। তাই পানি ফুরিয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নয় আসেনা। শুধু H2O (পানি) থেকে H2 (হাইড্রোজেন) এবং O2 (অক্সিজেন) কে আলাদা করতে পারলেই কাজ শেষ, আর এই সম্পূর্ণ ম্যাজিকটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করবে ইলেক্ট্রোলাইজার।
চলুন এখানে দেখে নেওয়া যাক, কীভাবে অতি সহজে ইলেক্ট্রোলাইজার থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা সম্ভব।
এতক্ষণ পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাকই আছে, আপনি নিশ্চয় বেশ মজা নিয়েই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি জানছিলেন। কিন্তু আপনি কি কোন সমস্যা ধরতে পারলেন? হ্যাঁ আরেকটি সমস্যা রয়েছে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করার সময়। ইলেক্ট্রোলাইজার দিয়ে পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করার জন্য আমাদের প্রয়োজন পড়ছে ইলেক্ট্রিসিটি—আর অধিক পরিমানে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা মানে অধিক ইলেক্ট্রিসিটি ব্যয় করা। যদি আমরা সোলার সেল ব্যবহার করে ইলেক্ট্রিসিটি উৎপন্ন করে সরবরাহ করি তবে সেটি মাত্র ১০ শতাংশ ক্রিয়াশীল হবে। কিন্তু সফল ভাবে ইলেক্ট্রোলাইজার চালাতে প্রয়োজন পড়বে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ ক্রিয়াশীল ইলেক্ট্রিসিটি। তাহলে আমাদের কাছে বর্তমানে ক্রিয়াশীলতার হার রয়েছে ৭.৫ শতাংশ মাত্র। যদিও এটি খুব বড় কোন সূচনা নয়—কিন্তু তারপরেও এটি কেবল মাত্র একটি সূচনা, ভবিষ্যতে অবশ্যই আরো ক্রিয়াশীল ইলেক্ট্রিসিটি উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
সমস্যার কিন্তু এখানেই শেষ নয় বন্ধুরা, আমাদের এই হাইড্রোজেন গ্যাসকে কম্প্রেস করে তরলে পরিণত করতে হবে—যাতে গাড়ীর ট্যাঙ্কে সেটি বহন করা সম্ভব হয়। আর এখানেই এসে দাঁড়ায় আরেক সমস্যা, কেনোনা গ্যাসোলিনের তুলনায় হাইড্রোজেনের এনার্জি ঘনত্ব ৫ গুন কম। অর্থাৎ আপনি গ্যাসোলিন ব্যবহার করে যে দূরত্ব অতিক্রম করতে পারবেন ঠিক সেই দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য ৫ গুন বেশি হাইড্রোজেনের প্রয়োজন পড়বে।
আরেকটি সমস্যা হলো, হাইড্রোজেন গ্যাস অধিক সময়ের জন্য জমা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। যদি ভুল করেও এক অণু পরিনামের ছেঁদ ট্যাঙ্কে সৃষ্টি হয় তবে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের সম্ভবনা ঘটতে পারে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না পেট্রোল আর ডিজেলের দাম আকাশ ছুঁয়ে যাবে ততোক্ষণ পর্যন্ত হয়তো হাইড্রোজেন গাড়ি জনপ্রিয়তা পাবে না। আবার এমন প্রযুক্তি চলে আসতে পারে, হয়তো ফুয়েল সেল গাড়ি উন্নতি করার প্রয়োজনই পড়বে না। আমরা হয়তো ভবিষ্যতেও অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন গাড়ীর সাথে চিপকে লেগে থাকবে, কিন্তু সেগুলো চালাতে জৈবজ্বালানি ব্যবহার করতে পারি। অথবা ব্যাটারি ওয়ালা ইলেকট্রিক কার তৈরি করতে পারবো যা সহজেই বাড়িতে চার্জ করতে পারবো। অথবা একসাথে গ্যাসোলিন ইঞ্জিন এবং ইলেকট্রিক মোটরের হাইব্রিড কার ব্যবহার করে এই গ্রহের বাকি মজুদ থাকা তেল গুলোকে বাচিয়ে রাখতে পারি আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য। আবার এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে নিউক্লিয়ার শক্তি ব্যবহার করে গাড়ি চালাতে পারি। কেউই জানেনা, ভবিষ্যতে ঠিক কি হতে চলেছে, কিন্তু একটি বিষয় নিশ্চিত যে পেট্রোলিয়ামের ভূমিকা খুব শীঘ্রই শেষ হতে চলেছে। সামনে হয়তো আসছে—ইলেকট্রিক কার, জৈবজ্বালানি, ফুয়েল সেল, বা যেকোনো কিছু—তবে সর্বউত্তমটিই আমারা হয়তো ব্যবহার করতে সক্ষম হবো।
তো কেমন লাগলো আজকের আর্টিকেলটি? আশা করছি অনেক জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন, এবং জানলেন কীভাবে ভবিষ্যতে হয়তো পানি দিয়ে গাড়ি চালানো সম্ভব হতে পারে। আপনার মতে ভবিষ্যৎ গাড়ি গুলো আরো কীভাবে চালানো যেতে পারে তা মতামত প্রকাশ করে নিচে আমাদের জানান। আর এই চমৎকার আর্টিকেলটি আপনার বন্ধুর সাথে শেয়ার করতে একদমই ভুলবেন না।
পূর্বে প্রকাশিত- Techubs.net
আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!
অনেক সুন্দর