বিচারকরা (জুরিরা) শুধু বিরলক্ষেত্রেই ক্রাইম সিন পরিদর্শনের অনুমতি পান। কিন্তু এটা বয়ে আনে অনেক রকম লজিস্টিক্যাল ও নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জ। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা পারবেন ক্রাইম সিন ‘রিমোটলি’ পর্যবেক্ষণ করতে। ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক সায়েন্স বিভাগের বাংলাদেশি গবেষক মেহযেব চৌধুরী বর্তমানে এমন একটি সিস্টেম উদ্ভাবন করছেন, যার মাধ্যমে এসবই সম্ভব হবে। মেহযেব চৌধুরী এই প্রতিবেদন দি কনভারসেশনের (বৃটিশ স্পেশালাইজড সাময়িকী) জন্য লিখেছেন। যা প্রকাশ হয়েছে ২৬শে আগস্ট। ইতিমধ্যে ডেইলি মেইল, বিজনেস ইনসাইডারসহ ২৭০০টি আন্তর্জাতিক সাইটে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়। গবেষণার বিষয়ে রাশিয়ান রেডিও স্পুটনিক মেহযেব চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও প্রচার করেছে।
ক্রাইম সিন সরজমিন পরিদর্শনের সুযোগ বিচারকদের জন্য কমই আসে। তবে ১৯৯৫ সালের ও. জে সিম্পসনের বিচার ছিল তেমনই একটি উদাহরণ। কতিপয় হাইপ্রোফাইল হত্যা মামলা এবং সাধারণত জটিল ধরনের মামলায় অবশ্য এমনই ব্যতিক্রম ঘটে।
এই উপায়ে জুরিদেরকে ফ্যাক্ট ফাইন্ডার হিসেবে ক্রাইম সিনে যেতে বললে তা অনেক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এতে সমস্যার ধরন হয় সম্ভাব্য পক্ষপাতিত্ব থেকে লজিস্টিক্যাল ও সিকিউরিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার।
কিন্তু ক্রমান্বয়ে উন্নত হতে থাকা ইমেজিং, রোবোটিক্স এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দ্বারা এসব সমস্যা এড়ানো যেতে পারে।
ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন্সিক সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন বিভাগের এই গবেষক বলছেন, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এর উত্তর হতে পারে। প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি বলেছেন, আদালত কক্ষের বাইরে না বেরিয়ে বিচারক ও জুরিদের সামনে কোনো একদিন ক্রাইম সিনটা ভেসে উঠতে পারে।
ক্রাইম সিন পরিদর্শন করা বিচারককে সাহায্য করে প্রসিকিউশন ও আসামি পক্ষের আনা যুক্তি-তর্ক যাচাই করতে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সংগীত প্রযোজক ফিল স্পেকটর ২০০৭ সালের (লানা ক্লার্কসন) হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। তার আইনজীবীরা দাবি করেন যে, ক্রাইম সিনে একটি বড় ঝরনা থাকায় সাক্ষী ভুল শুনেছেন যে, স্পেকটর অপরাধটা করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
ক্রাইম সিন পরিদর্শনের মাধ্যমে জুরি বিচার করতে পেরেছিলেন যে, এটা ঘটার সম্ভাবনা কতটা বাস্তব ছিল। একই সঙ্গে তারা আরো ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন যে, কিভাবে একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটেছিল।
যখন জুরি ক্রাইম সিন পরিদর্শন করেন, তখন তারা অপরাধ সংঘটনের সময়কার মূল দৃশ্য বা উপাদানগুলো নাও প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
সিম্পসনের বিচার চলাকালে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল যে, ক্রাইম সিনকে সাজানো হয়েছিল। ক্রাইম সিনের বিষয়গুলোকে অদলবদল করা হয়েছিল।
অপরাধ সংঘটনের পরে যত বেশি সময় অতিবাহিত হবে, ততোই ক্রাইম সিনের চেহারা বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকবে।
আলোকচিত্র একটি ক্রাইম সিনের সীমিত ধারণা দিতে পারে। সেখানে একজন আলোকচিত্রী কোন্ বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিলেন তার মাধ্যমেও বিষয়টি সীমিত হতে পারে। তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ক্রাইম সিনের উপকরণগুলোকে নানাভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারেন। এবং সাক্ষ্য প্রমাণের বিভিন্ন উপাদানকে তারা কিভাবে গুরুত্ব প্রদান করেন তাও বিবেচ্য হয়ে ওঠে।
ভিডিও একটি ক্রাইম সিন সম্পর্কে আরো বেশি ভালোভাবে ধারণা দিতে পারে। কিন্তু এরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
স্কেচ অবশ্য এমনভাবে ক্রাইম সিনের ধারণা তুলে ধরতে পারে যা আলোকচিত্র বা ভিডিও দিতে পারে না।
স্কেচ ক্রাইম সিন সম্পর্কে একটা সাধারণ ওভারভিউ বা ধারণা দিতে পারে। এভিডেন্সের যথার্থ কিংবা তার কাছাকাছি একটা অবস্থানও নির্দেশ করতে পারে।
কিন্তু স্কেচ ইনহেরেনটলি বা অন্তর্গতভাবে একটি ক্রাইম সিনের কম বাস্তবসম্মত চিত্র তুলে ধরে এবং সেখানেও স্কেচকারীর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রখর হতে পারে।
যাই হোক, নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে যেখানে থ্রি ডি ইমেজিং, প্যানোরোমিক ভিডিওগ্রাফি, রোবোটিক এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার করে ক্রাইম সিনের আরো নিখুঁত এবং প্রতিনিধিত্বশীল ছবি ধারণ এবং তা রিলে করতে ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেটর (সিএসআই)কে সক্ষম করে তুলবে।
উদাহরণ হিসেবে স্ট্যামফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ক্যারোলাইন স্টার্ডি কোলসের নেতৃত্বে গ্রিনস্ক্রিন, ভিডিও গেম সফটওয়্যার এবং সর্বশেষ ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট (যেমন অক্যুউলাস রিফট এবং এইচটিসি ভাইব) ব্যবহার করে ভার্চুয়াল ক্রাইম সিন ডিজিটালগতভাবে রিপ্রডিউস অর্থাৎ পুনরায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বিচরকরা (জুরিরা) সিস্টেম দ্বারা পুনঃনির্মিত থ্রি ডি ওয়ার্ল্ডে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারবেন এবং ক্রাইম সিনের গুরুত্বপূর্ণ খুঁটিনাটি (ভাইটাল ডিটেইলস) পরীক্ষা করতে পারবেন।
একটি সম্পাদিত ভিডিওর মাধ্যমে বিচারককে প্রভাবিত করার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু সেই আশংকা এখানে থাকবে না। বরং এ ধরনের এভিডেন্স একটি সিন ডকুমেন্টকরণকে আরো সহজতর করবে।
এটা অবশ্য নির্ভর করে তাদের উপরে যারা ক্রাইম সিনের কোনো বিকৃতি না ঘটিয়ে তথ্য সংগ্রহ করবেন।
থ্রি ডি রিক্রিয়েশন এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সিমুলিয়েশনের একটি সমস্যা হলো, সেখানে ব্যয়বহুল হেডসেট এবং উন্নতমানের কম্পিউটারের দরকার পড়ে।
ফার্স্ট জেনারেশন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) সিস্টেম যেমন এইচটিসি ভাইব (৭৫৯ পাউন্ড অথবা ৭৯৯ ডলার) এবং অকুলাস রিফট (৫৪৯ পাউন্ড অথবা ৬শ’ ডলার) এসব এতটা ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও এর সঙ্গে অতিরিক্ত ভিআর কম্পলায়েন্ট কম্পিউটার অথবা কনসোল লাগে। এসব ছাড়া কাজ করে না।
এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি এবং আমার ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা একটি রোবট সিস্টেম তৈরি করছি। এটা করতে আমরা নাসা’র ‘কিউয়িরসিটি’ নামের একটি রোবট দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। এই রোবট সিস্টেমটি ক্রাইম সিনের ইমারসিভ বা অত্যন্ত মুগ্ধকর ভিডিও ফুটেজ ধারণ করবে।
এম.এ.বি.এম.এ.টি. ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও এবং ছবি ধারণ করবে, যা যে কোনো কম্পিউটার অথবা স্মার্ট ফোনের একটি উপযুক্ত অ্যাপ দ্বারা চালানো সম্ভব।
একটি বেসিক অ্যাডাপ্টার হেডসেট যেমন ১০ পাউন্ডের (১৫ ডলার) গুগল কার্ডবোর্ডের মাধ্যমে পুনরায় সৃষ্টি করতে পারবে একটি অভিন্ন ভিআর অভিজ্ঞতা, যা হবে উপরে উল্লিখিত সরঞ্জামের মতো। কিন্তু তা ব্যয়বহুল হবে না। খরচ পড়বে নামমাত্র।
এতে থ্রি ডি গ্রাফিক্স রেন্ডার করার প্রয়োজন নেই, না প্রয়োজন পড়বে কোনো শক্তিশালী কম্পিউটার। কিন্তু ধারণ করবে কোনো একটি ক্রাইম সিনের সব দিক থেকে তোলা যথার্থ আলোকচিত্র।
ব্যবহারকারীরা তাকাতে পারবেন, ডানে বামে উপরে নিচে এবং পারবেন জুম ইন বা জুম আউট করতে।
আদালত কক্ষের জুরিদেরকে যেমন সাহায্য করবে তেমনি এই সিস্টেম ইনভেস্টিগেটরদেরকে অপরাধের দৃশ্যপটের প্রাথমিক ফরেনসিক পর্যবেক্ষণে সাহায্য করবে। তথ্য তিনটি ভিন্ন উপায়ে ধারণ করা যাবে।
একজন সিএসআই একটি ‘‘প্রিডিফাইন্ড পাথ’’ বা পূর্ব নির্ধারিত পথ নির্দিষ্ট করতে পারবে। যা রোবটটি ব্যবহার করে উন্নত মানের ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও চিত্র ধারণ করবে।
ওই রোবটটিকে একটি ব্লু টুথ রিমোট অথবা স্মার্ট ফোন বা ট্যাবলেট দ্বারাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
এর অতিরিক্ত, রোবটটি আলট্রাসনিক, মোশন এবং ইনফ্রা রেড সেন্সর ব্যবহার করে নিজকে একটি ক্রাইম সিনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবে আর এসময় সবকিছুই চিত্রায়িত হবে।
পুরো সিস্টেমটির খরচ পড়বে শুধু ২৯৯ পাউন্ড (৩৯৫ ডলার) এবং এই দাম ভবিষ্যতে আরো কমবে। কারণ ‘র্যাস্পবেরি পাই’’ এবং ‘আরডুইনো’’-এর মতো সস্তা কম্পিউটার সিস্টেম দ্বারা গঠিত ওপেন সোর্স রোবোটিক কিটস সহজলভ্য হবে।
আরেকটি অগ্রগতি ঘটতে পারে গুগলের ট্যাঙ্গো প্রকল্পের মাধ্যমে। যা তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যপট এবং ভূখণ্ডের (টেরেইন) থ্রি ডি ইমেজ তৈরি করতে পারে। এর মাধ্যমে ক্রাইম সিন স্কেচিংয়ের অবসান ঘটবে।
এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে এমন একটি মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা যাতে ক্রাইম সিনের উপাদানগুলোর নিখুঁত ও খুঁটিনাটির জীবন্ত বিবরণ দেখা যাবে।
আরো কিছু টিউন
আমি মুসা বিন মোস্তফা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 13 টি টিউন ও 23 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।