স্মার্টফোন চার্জ হবে তাও আবার গাছের চারা থেকে? কি ভাই পাগল হয়ে গেলেন না কি? কি, শিরোনাম দেখে এটাই ভাবছেন তো! জি, আপনি একদম ঠিক জেনেছেন আর আমি আপনার সাথে মোটেও কোন মজা করছি না। এবার সত্যি সত্যি গাছের চারা দিয়ে চার্জ হবে আপনার স্মার্টফোন বা জ্বালিয়ে রাখতে পারবেন একটি সিএফএল বাল্ব। কিন্তু কীভাবে? দেখুন চিন্তা করার কিছু নাই, আমি আজ এই বিষয় নিয়েই আপনাদের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি। বন্ধুরা আমি পিছনের কয়েকদিন ধরে অনেক আর্টিকেল পড়েছি এবং মোটামুটি গবেষণা করার চেষ্টা করেছি যে, কীভাবে সামনের দিনে স্মার্টফোন ব্যাটারির পরিবর্তন ঘটবে বা কি প্রযুক্তি আমাদের সামনে আসতে পারে বা কীভাবে আপনার ফোনের ব্যাটারি অনেক দ্রুত চার্জ করা সম্ভব হবে (মনে করুন ১০ সেকেন্ডে ফুল চার্জ 😀) এবং কীভাবে আপনার ফোনের ব্যাটারি লাইফ অনেক দীর্ঘস্থায়ী হবে (৬ মাসের ব্যাটারি লাইফ 😀) তা নিয়ে। আর এভাবেই খুঁজতে খুঁজতে আমার সামনে একটি আর্টিকেল আসে, এবং সেখানে এটা বলা ছিল যে কীভাবে গাছের চারা থেকে আপনার ফোন চার্জ করা সম্ভব তা নিয়ে। যখন আমি প্রথমবারের এটি পড়েছিলাম তখন একদমই ভরসা করতে পারিনি, মনে করেছিলাম এটি হয়তো একটি ফেক আর্টিকেল বা কোন সায়েন্স ফিকশন হবে হয়তো। আর বিশ্বাসই কেমন করে করতাম বলুন? কেনোনা ছোট বেলা থেকে জেনে আসছি যে, গাছপালা থেকে বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ অক্সিজেন এবং অনেক সময় ফুল ফল পাওয়া যায়। কিন্তু গাছ থেকে যে বিদ্যুৎ ও পাওয়া যায় আর সেই বিদ্যুৎ থেকে আবার মোবাইল চার্জ হয় সেটা প্রথমবারের মতো জেনেছি।
কিন্তু বিষয়টির উপর যখন বিস্তারিত পড়াশুনা করলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে না তো এটি কোন ফেক আর্টিকেল আর নাই বা কোন সায়েন্স ফিকশন। বরং এটি একটি জীবন্ত প্রোডাক্ট যার সাথে একটি গামলা লাগানো আছে এবং গামলায় একটি গাছের চারা এবং একটি ইউএসবি পোর্ট লাগানো আছে যার মাধ্যমে আপনি আপনার স্মার্টফোন চার্জ করতে পারবেন। এখন এটি কি প্রোডাক্ট, কীভাবে কিনতে পাওয়া যাবে, কত দাম, এই প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে চলেছি। এমনিতেই ভূমিকা অনেক বড় হয়ে গেলো, তো চলুন আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।
এই প্রোডাক্ট টি http://www.indiegogo.com নামক একটি ক্রাউড ফান্ডিং ওয়েব সাইটে কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। এটি এমন একটি ওয়েব সাইট যেখানে নতুন নতুন আবিস্কারক রা আসে তাদের উদ্ভবনি চিন্তা ভাবনা নিয়ে ফান্ডিং পাবার জন্য। আর যদি তারা ফান্ডিং পেয়ে যায় তবে তাদের উদ্ভবনি চিন্তা ভাবনা গুলো বাস্তবে রুপ নিয়ে প্রোডাক্ট তৈরি হয়ে যায়। এবং বাজারে রিলিজ হওয়ার মাধ্যমে সেগুলো সাধারন জনগণের জন্য প্রাপ্য হয়ে যায়। এই প্রোডাক্ট টির বর্তমান দাম ১ পিস এর জন্য বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১০, ৫০০ এর মতো এবং ২ পিস এর জন্য পড়বে ১২,০০০ টাকার মতো। আর এভাবেই যতো বেশি কিনবেন সে অনুসারে আপনার দাম কমতে থাকবে।
এখন যদি বলেন এই প্রোডাক্ট কি, তবে আসলে এটি সাধারন ভাবে একটি গামলা বা একটি পট যেখানে আপনি আপনার মনের ইচ্ছা অনুসারে যেকোনো একটি গাছের চারা লাগাতে পারেন। আর গাছ লাগানোর পরে ওইটাতে পানি দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে, যেমনটা যেকোনো গাছ লাগানোর ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে। তারপর সেখানে একটি ইউএসবি পোর্ট লাগানো আছে যেখানে আপনি একটি ইউএসবি ক্যাবলের সাহায্যে কানেক্ট করে আপনার ফোনকে চার্জ করতে পারবেন। এখন চলুন জেনে নেওয়া যাক যে এটি কীভাবে কাজ করে?
আমরা প্রত্যেকেই জানি যে, বড় গাছ বা ছোট গাছের চারা গুলো ফটোসিন্থেসিস (Photosynthesis) বা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের জন্য খাদ্য উৎপন্ন করে থাকে। কিন্তু সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার পরে গাছপালা অনেক ধরনের বায়োলজিক্যাল ইলিমেন্ট তাদের শিকড়ের সাহায্যে ছেড়ে দেয় সে সম্পর্কে আপনি হয়তো জানেন না বা পড়েন নি। এই ধারনাটি মূলত এই বিষয় বস্তুর উপর কাজ করে থাকে। পট টির নিচের দিকে একটি চেম্বার রয়েছে যেখানে এনোড আছে, ক্যাথোড আছে, অনেক মাইক্রো অরগানিজম আছে, অনেক একটিভ বায়ো মলিকিউলস আছে এবং বায়োলজিক্যাল ন্যানো ওয়্যারস আছে। তো এই অবস্থায় যখন গাছের চারা তার সাধারন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার পরে সেই বায়ো মলিকিউলস গুলো যখন বায়ো ইলিমেন্টস গুলোর উপরে ছড়িয়ে দেয় তখন এটি ঐ সিস্টেমকে আকর্ষণ করে। এবং আকর্ষণ করার পরে এমন একটি বিক্রিয়া সংঘতিত হয় যার ফলে ইলেকট্রনস উৎপন্ন হয়ে থাকে। এবং এই বিক্রিয়ার ফলে H2O অর্থাৎ পানি ও উৎপন্ন হয়ে থাকে। কেনোনা নিচে থেকে অক্সিজেন আসে এবং উপর থেকে হাইড্রোজেন পেয়ে যায় তাই পানি উৎপন্ন করে। এবং এর ফলে গাছের চারাটিতে তেমন পানির ঘাটতি ঘটবে না এবং আপনাকেও অনেক কম পানি ঢালার প্রয়োজন পড়বে। বিক্রিয়াটির ফলে যখনই ইলেকট্রনস উৎপন্ন হয়ে যায় তখন তা বায়োলজিক্যাল ন্যানো ওয়্যারস এর মাধ্যমে ডিভাইজটির ভেতর অবস্থিত এনোড এবং ক্যাথোড এর সাথে একটি ব্রীজ স্থাপন করে ফেলে। এবং এই ব্রীজের মাধ্যমে এবং নিচে অবস্থিত একটি ছোট সার্কিটের মাধ্যমে উপরে থাকা একটি ইউএসবি পোর্টে ৫ ভোল্ট ১ অ্যাম্পিয়ার আউটপুট বিদ্যুৎ দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি সাধারন ল্যাপটপ চার্জার থেকে সামান্য হাই পাওয়ার চার্জার তৈরি হয়। এখন আপনার কাজ হলো জাস্ট আপনার ফোনের সাথে এটি ইউএসবি ক্যাবলের সাহায্যে কানেক্ট করুন আর ফোনকে চার্জ হওয়ার জন্য সময় দিন।
এটির সবচাইতে ভালো দিক হলো এটি একটি ওয়ান টাইম ইনভেস্ট। বারবার এর পেছনে কোন টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই, এমনটা নয় যে কয়েকদিন চলার পরে এটি নষ্ট হয়ে যাবে। কারন এটি যে ধারনার উপর নির্ভর করে কাজ করে তা মোটামুটি আনলিমিটেড ব্যবহারের সুযোগ প্রদান করে থাকে। যতক্ষণ আপনার গাছের চারা জীবিত থাকবে বা আছে ততোক্ষণ এই প্রযুক্তি কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়ায় কাজ করে চলবে। এবং পটের নিচে অবস্থিত ডিভাইজটির জন্য আপনার গাছের চারাটিতে বিন্দু মাত্র কোন ক্ষতি হবে না। আপনি আপনার মনের ইচ্ছা অনুসারে যেকোনো গাছের চারা সেখানে লাগাতে পারবেন। তারপর যেখানে খুশি পট টিকে রাখুন এবং ইউএসবি ক্যাবল লাগিয়ে আপনার স্মার্টফোন চার্জ করতে থাকুন। এই প্রক্রিয়া সবসময় আপনার জন্য প্রাপ্য হবে এবং দিনের বেলায় আপনি কমপক্ষে ৩-৪ বার আপনার ফোন ফুল চার্জ করতে পারবেন।
আপনার স্মার্টফোন চার্জ হচ্ছে তাও আবার গাছের চারা থেকে। আসলেই এটি একটি নেক্সট লেভেল প্রযুক্তি ধারণা। একবার কি ভেবে দেখেছেন একটি ছোট গাছের চারা থেকে যদি এই পরিমানে এনার্জি পাওয়া যায় তবে একটি বড় গাছের গোঁড়ায় এই ডিভাইজটি স্থাপন করলে কত এনার্জি উৎপন্ন হবে? আপনার শহরে হয়তো অনেক বড় বড় পার্ক রয়েছে তো সেখানকার গাছের সাথে যদি এই ডিভাইজ লাগিয়ে রাখা হয় তবে আমরা কত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারবো, এবং আমাদের দেশের বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে পারবো। এমনকি আপনার বাড়িতে যদি একটি বড় বাগান থাকে তবে সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে আপনি আপনার ঘরের বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হতে পারেন। চিন্তা করে দেখুন আমরা আজ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার জন্য আমাদের পরিবেশের কত ক্ষতি করেছি। আমরা কয়লা জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেছি অনেক দেশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার করছে। আর এগুলোর ব্যবহারের ফলে আমাদের পৃথিবী ধিরেধিরে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা যখন বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার জন্য গাছ রোপণ করবো তখন তা পরিবেশের জন্য কতটা সুফল বৈয়ে নিয়ে আসবে তা কল্পনা করতে পারছেন কি?
এতক্ষণ ধরে যে প্রোডাক্ট টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছিলাম তার নাম হচ্ছে বায়ো লাইট (bioo lite)। এই কোম্পানিটি আরো একটি নতুন প্রোডাক্ট সামনে আনতে চলেছে যার নাম হলো বায়ো প্যানেল (The bioo panel)। এটি সাধারনত ১ মিটার বাই ১ মিটার চৌরা একটি প্লেট। এখানে আপনি সাধারনত গাছের চারা বা ঘাস জাতীয় গাছ লাগাতে পারবেন। এর উচ্চতাও বেশি না মাত্র ২৫ সেন্টিমিটার। বায়ো লাইটে ব্যবহার করা ধারণাই এখানেও কাজে নেওয়া হয়েছে একটি বড় প্লেটের সাথে। এবং এর এনার্জি আউটপুট ২৮ থেকে ২৮০ কিলোওয়াট প্রতি ঘণ্টায় হতে পারে। এর মানে ২৫০ থেকে ২৮০ ইউনিটস। চিন্তা করতে পারছেন কি ঐ গাছের প্লেটের মাধ্যমে ২৮০ ইউনিটস উৎপন্ন করা সম্ভব!
২৮০ ইউনিটস কিন্তু অনেক বেশি এনার্জি হয়। একটি ১০ ওয়াট সিএফএল বাল্ব যদি ১০০ ঘণ্টা ধরে জ্বলে তবে ১ ইউনিট সম্পূর্ণ হয়। সেখানে ২৮০ ইউনিটস মানে ভাবতে পারছেন? এই এনার্জিতে বাল্বটি প্রায় ২৫,০০০ ঘণ্টা জ্বলতে পারবে। চিন্তা করে দেখুন বন্ধুরা, কোন প্রকার বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই শুধু একটি গাছের গামলা থেকে কি করা সম্ভব! ব্যাস গাছের চারা গুলোকে জীবিত রাখতে হবে আপনার, আর আপনার বাকী কাজ এমনি হয়ে যাবে।
আমার মতে এটি অবশ্যই একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তি ধারণা। এর মাধ্যমে ব্যাস একবার খরচ করে আনলিমিটেড এনার্জি পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া এই প্রযুক্তি আমাদের গাছ লাগাতে উদ্বুদ্ধ করবে, এতে অবশ্যই আমাদের পরিবেশের কল্যাণ ঘটবে। তো ব্যাস গাছ লাগান আর আপনার স্মার্টফোন চার্জ করুন বা বাতিয়ে জ্বালিয়ে রাখুন বা যা ইচ্ছা তাই করুন। আশা করছি এই প্রযুক্তিটি অবশ্যই আপনার অনেক পছন্দ হবে, আর যদি টাকা থাকে তবে কিনেই ফেলুন একটি ডিভাইজ। আপনার মতামত অবশ্যই আমাকে টিউমেন্ট করে জানান।
এই রকম এবং আরো হার্ডকোর টেকনলজি ও সায়েন্স টিউন পড়তে আমার বাংলা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সাইট টি ঘুরে আসতে ভুলবেন না। আশা করি চরম লাগবে। যাই হোক, ভালো থাকুন।
পূর্বে প্রকাশিতঃ Techubs
আমি তাহমিদ বোরহান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 10 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 177 টি টিউন ও 680 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 43 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি তাহমিদ বোরহান। টেক নিয়ে সারাদিন পড়ে থাকতে ভালোবাসি। টেকটিউন্স সহ নিজের কিছু টেক ব্লগ লিখি। TecHubs ব্লগ এবং TecHubs TV ইউটিউব চ্যানেল হলো আমার প্যাশন, তাই এখানে কিছু অসাধারণ করারই চেষ্টা করি!