সুপারকম্পিউটারঃ পাওয়ার এন্ড পাওয়ারিং সিভিলাইজেশানঃ এবারের টপ ৫০০

ছবি-১: সানওয়ে ব্লুলাইট, চায়নিজ ডিজাইনের সুপার কম্পিউটার

এ লিখা যখন লিখছি তখন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের ডেনভার কনভেনশন সেন্টারে চলছে চারদিন ব্যাপী ৪২তম ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স ফর হাই পারফর্মেন্স কম্পিউটিং। বিগত দুই দশক ধরেই, জুন এবং নভেম্বর, বছরে দুইবার এই কনফারেন্স হয়ে আসছে, সাধারণত বছরের প্রথমটা হয় জার্মানীতে, নভেম্বরের টা যুক্তরাষ্ট্রে। সুপারকম্পিউটার এবং তার সাথে রিলেটেড বহুবিদ বিষয়ের বহু এক্সাইটিং এক্সপার্টিজ প্রেজেনটেশন এর বাইরেও এই কনফারেন্স আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বছরে দুইবার সারাবিশ্বের শক্তিশালী টপ ৫০০ সুপারকম্পিটার এর আপডেটেড একটা তালিকা প্রকাশ করা হয় কনফারেন্সের প্রথম দিনেই.... ১৯৯৩ সালের জুন থেকে শুরু হওয়া এই লিস্টে প্রতিবারই কম বেশী নূতন নূতন চমক থাকে.... চমক থাকুক বা না থাকুক, প্রশ্ন হচ্ছে কী লাভ এই তালিকা করে, কারা কিজন্য এবং কোন কোন কাজে এইসব উচ্চ ক্ষমতার সুপারকম্পিউটার ব্যবহার করে, এইসবের পেছনে আরো কোন রহস্য বা চমক আছে কি? কারা কারা আছে এবারের টপলিস্টে? মৌলিক বিষয় থেকে শুরু করে এইবিষয়ের রিলেটেড কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো এই আর্টিক্যালের মাধ্যমে...

ছবি-২: বিশ্বের সবচেয়ে পাওয়ারফুল সুপারকম্পিউটার, তিয়ানহে-২ অথবা মিল্কীওয়ে-২, যার অথরিটেটিভ বডি  হচ্ছে চায়নিজ ডিফেন্স ইউনিভার্সির আওতাধীন 'ন্যাশনাল সুপারকম্পিউটিং সেন্টার'

সুপারকম্পিউটার কীঃ
ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর সবকিছুই আজ নির্ভরশীল কম্পিউটারের উপর... কম্পিউটার ছাড়া আমাদের একটা দিনও হয়তো চলেনা... গান শোনা, নাটক সিনেমা দেখা, ব্রাউজ করা, গেমিং ইত্যাদির যতকিছুই করিনা কেন এসবের পেছনে যেই জিনিসটি সবকিছুকে কন্ট্রোল করছে তা হলো কম্পিউটিং, সহজ ভাষায় লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ক্যালকুলেশন... কম্পিউটারের কাজই হলো কম্পিউট করা... আপনি যাকিছুই করেন্না কেন তার মূল হচ্ছে কম্পিউটিং... এক দশক আগের ডেক্সটপ কম্পিউটারের মেগাহার্জ ক্ষমতার প্রসেসর থেকে আজকে আমাদের হাতে এসেছে 'কোর আই-৭' মডেলের মডার্ন ডেক্সটপ/ল্যাপটপ/নোটবুক ইত্যাদি.... এই যে প্রতি বছর বছর নিত্য নতুন মডেলের আপগ্রেডেশন, এইখানে যে জিনিসটা একেবারেই মৌলিক, যা আমাদের আমজনতার জানার দরকার হয়না তা হচ্ছে কম্পিউটারের 'পাওয়ার অব কম্পিউটিং' কতটা বাড়ছে... কম্পিউটিং পাওয়ার এর দৃষ্টিকোন থেকে উচ্চ ক্ষমতার যে মেইনফ্রেম কম্পিউটার বানানোই হয় শুধুমাত্র কম্পিউটিং এর জন্য, সাধারন কম্পিউটারের চেয়ে অনেক অনেকগুন বেশী ক্ষমতাসম্পন্ন যেইসব কম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ক্যালকুলেশন করতে পারে সেগুলোই হচ্ছে সুপারকম্পিউটার...

ছবি-৩: টাইটান, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি এবং Oak Ridge রিসার্চ ল্যাবরেটরীর আওতাধীন সেকেন্ড ফাস্টেস্ট সুপার কম্পিউটার

বুঝলাম এইটা অনেক বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন, নাজানি এই কম্পিউটারের স্ক্রীন কত্ত বড়!!!!... দেখাতো যায় খালি আলমারির মত বড় বড় ক্যাবিনেট, বুঝলাম হাজার হাজার লাখ লাক কোর আছে এর ভিত্রে, কিন্তু এইগুলার মাজেজা কী, কিবোর্ড মাউজ কোথায় থাকে, বড়সড় কোন স্ক্রীন ওতো দেখিনা, স্ক্রীন-কীবোর্ড-মাউস ছাড়া এইডা আবার কেমন কম্পিউটার!!!... উত্তর হচ্ছে, এজাতীয় কম্পিউটার দিয়ে যেহেতু নাটকসিনেমা দেখা অথবা গান শোনা বা ব্রাউজিং করা হয়না তাই এর জন্য আলাদা কোন স্ক্রীন থাকার প্রয়োজনও নাই... যে কেউই যে কোন জায়গা থেকে যেকোন কম্পিউটার দিয়ে সুপারকম্পিউটারে লগইন করে কাজ করতে পারে, শুধুমাত্র এক্সেস এর জন্য অথরাইজড ইউজারনেম আর পাসওয়ার্ড লাগবে…..

ছবি-৪: তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সুপার কম্পিউটার Sequioa, যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি'র মালিকানাধীন

কিভাবে মাপা হয় কম্পিউটিং পাওয়ার:
যেকোন কম্পিউটারের কম্পিউটিং পাওয়ার পরিমাপ করা হয় FLOPS (Floating point operations per second) দিয়ে.... ধরুন ১.১+১.২=২.৩, এইটা একটা ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশন, এভাবে প্রতি সেকেন্ডে একটা কম্পিউটার যত বেশী সংখ্যক ক্যালকুলেশন (Floating point operations) করতে পারে তার ক্ষমতা তত বেশী। ১৯৬০ এর শুরুতে যখন প্রথম কম্পিউটার আবিষ্কৃত হল, তখনকার দিনে সুপারকম্পিউটারের ক্ষমতা ছিলো ০.৫ মেগাফ্লপস, মানে ৫ লাখ ফ্লপস... আর আজকের দিনের ফাস্টেস্ট সুপারকম্পিউটারের ক্ষমতা ৩৩৮৬২.৭ টেরা ফ্লপস, তার মানে প্রতি সেকেন্ডে এই কম্পিউটার ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশন করতে পারে ৩৩,৬৬২,৭০০,০০০,০০০,০০০ সংখ্যক....

ছবি-৫: চতুর্থ সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জাপানের 'রিকেন এডভান্সড ইনস্টিটিউট ফর কম্পিউটেশনাল সাইন্স'র মালিকানাধীন K-Computer

কারা কারা আছে এবারের টপ-৫০০ লিস্টেঃ
প্রেস্টিজিয়াস এই অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরুর প্রথম দশকে টপ টেনের ৭/৮ টা প্রায় সবসময়ই থাকতো যুক্তরাষ্ট্রের দখলে.... দ্বিতীয় দশকে যখন চায়না ঢুকতে শুরু করলো তার পর থেকেই টপটেন সহ পুরো চার্ট এলোমেলো হতে শুরু করে.... প্রথম দশ বছরের প্রায় প্রতি বছরই টপ ৫০০ এর ৪০০র বেশী দখলে থাকতো তিন সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং জার্মানীর.... ২০০১ সালে প্রথম চায়নিজ সুপারকম্পিউটার টপ চার্টে চলে আসে, ২০০৩ সালে ইন্ডিয়াও ঢুকে পড়ে.... টপ টেন এর দশটা প্রায় সবসময়ই থাকে জাপান, চায়না, জার্মানী বা যুক্তরাষ্টের দখলে, এর তেমন একটা হের ফের হচ্ছেনা বিগত ৩/৪ বছর ধরে...

শীর্ষস্থান চায়নার দখলে থাকলেও বরাবরের মত এবারেও অর্ধেকের বেশী সংখ্যক ২৬৪ টি সুপারকম্পিউটার নিয়ে পুরো লিষ্ট ডমিনেট করছে যুক্তরাস্ট্র, ৬৩ টি স্থান দখল করে দ্বিতীয়স্থানে চায়না, তৃতীয়স্থানে জাপান তাদের দখলে ২৮ টি,..... লিষ্টের পরের দেশগুলো হচ্ছে ইউকে (২৩টি), ফ্রান্স (২২টি), জার্মানি (২০টি), ভারত (১২টি), কানাডা (১০টি)... প্রত্যেকের ৫টি করে তার পরেই আছে ইটালি, সুইজারল্যান্ড, সাউথকোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও সুইডেন.... সৌদিআরব, নেদারল্যান্ড, ব্রাজিল ও নরওয়ের আছে তিনটি করে...লিস্টে আরো রয়েছে ইজরাইল, স্পেন,পোল্যান্ড, হংকং, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডের দুটি করে, তাছাড়া ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, তাইওয়ার ও অস্ট্রিয়াও একটি করে সুপারকম্পিউটার নিয়ে উঠে এসেছে টপ ৫০০ এর টেকনোলজিক্যাল মাসেল পাওয়ার প্রদর্শনীতে.... দুঃখের বিষয় হলো সারা বিশ্বে এতগুলো মুসলিম দেশ থাকলেও লিস্টের একমাত্র মুসলিম প্রধান দেশ হলো সৌদি আরাবিয়া!

ছবি-৬: পঞ্চম সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন যুক্তরাষ্ট্রের Argonne National Laboratory'র মালিকানাধীন 'মীরা'

যাদের দখলে টপ টেন:
৪১তম লিস্টের মতই এবারেও দ্বিতীয়বারের মত শীর্ষস্থানের মুকুট ধরে রেখেছে ৩৩৮৬২ টেরাফ্লপস ক্ষমতাসম্পন্ন চায়নিজ তিয়ানহে-২ (তিয়ানহে অর্থ মিল্কিওয়ে), এটির অথরিটি মূলত চায়নিজ আর্মি পরিচালিত ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি....অনেকের ধারনা ছিলো ২০১৫ সালের আগে তিয়ানহে-২ এর কাজ শেষ হবেনা, বাট এই বছরের শুরুর দিকে এর যাতবীয় কাজ শেষ হয়ে লিস্টের এক নাম্বারে চলে আসাটা অনেকের কাছেই ছিলো বিগ সারপ্রাইজ....পাওয়ারের দিক থেকে এটি দ্বিতীয়টার প্রায় দিগুন ক্ষমতাসম্পন্ন... ২ ও ৩ নাম্বারে থাকা 'টাইটান' এবং 'সেক্যুইয়া' যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি এবং দুটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আওতাধীন, যাদের ক্ষমতা যথাক্রমে ১৭৫৯০ ও ১৭১৭৩ টেরাফ্লপস..... চার নাম্বারে থাকা 'কে-কম্পিউটার' এর মালিক জাপানের রিকেন এডভান্স ইনস্টিটিউট ফর কম্পিউটেশনাল সায়েন্স, ক্ষমতা ১০৫১০ টেরাফ্লপস, বছরখানেক আগেও এটি ছিলো শীর্ষস্থানে.... ৫ নাম্বারের মিরা (৮৫৮৬ টেরাফ্লপস) আবারো ইউএস এর ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির.... এবারের লিস্টের সেরা চমক হচ্ছে ৬ নাম্বারে থাকা ৬২৭১ টেরাফ্লপস ক্ষমতার সুইজারল্যান্ডের 'পিজ ডেইন্ট', এটা শুধু কম্পিউটিং পাওয়ার এর দিক থেকেই অন্যতম সেরা নয়, বিদ্যুৎ খরচের দিক থেকেও সবচেয়ে সাশ্রয়ী, অর্থাৎ প্রতি টেরাফ্লপস এর জন্য পাওয়ার কসজাম্পশন এর দিক থেকে এটার অবস্থান এক নাম্বার....... তারপরে ৭ নং টা ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের... ৮ ও ১০ নাম্বারের দুটোই জার্মানীর দখলে.... একটু খেয়াল করলে নজরে আসবে টপ টেনের অধিকাংশ সুপারকম্পিউটারের মালিকই কোন না কোন রিসার্চ সেন্টার বা সরকারী প্রতিষ্ঠান...

ছবি-৭: ষষ্ঠ সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন Swiss National Supercomputing Center এর মালিকানাধীন Piz Daint

আপনি নিজেও একটা সুপারকম্পিউটারের গর্বিত মালিক:
আপনি একটু খেয়াল করলে দেখবেন আপনি নিজেও একটা সুপারকম্পিউটারের মালিক! বিশ্বাস হচ্ছেনা? চলুন দেখা যাক কিভাবে!... ১৯৯৩ সালে যখন প্রথম অফিসিয়াল টপ ৫০০ লিস্ট প্রকাশ করা হয়, তখন ফাস্টেস্ট সুপারকম্পিউটারের ক্ষমতা ছিলো ১২৪ গিগাফ্লপস, ৫০০তম টার ক্ষমতা ছিল মাত্র ০.৫ গিগাফ্লপস..... অথচ আজকের দিনে প্রায় সকল ল্যাপটপ ডেক্সটপ এর ক্ষমতাই কয়েক গিগাফ্লপস থেকে শুরু করে ১০০ গিগাফ্লপস এর উপরেও, তার মানে বিশ বছর আগে যেটা সুপার কম্পিউটার লিস্টে ছিলো আজকে তা সবার হাতে হাতে..... যদি আপনি আপনার কম্পিউটারের ক্ষমতা মাপতে চান, তাহলে IntelBurnTest নামে একটা ফ্রি সফওয়ার কিট পাওয়া যায়, খুজে ডাউনলোড করে চেকে করে নিন আপনারটা কোন লেভেলের সুপারকম্পিউটার... আমার ল্যাপটপ সুপারকম্পিউটার টা অনেক স্লো, মাত্র ৮ গিগাফ্লপসের!.... আপনারটার পাওয়ার কত?

ছবি-৮: অষ্টম সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জার্মান সুপারকম্পিউটার JUQUEEN

কাদের প্রয়োজন সুপারকম্পিউটার:
আজকাল যারা ইন্টারনেট ঘাটেন নিয়মিত তারা কমবেশী প্রায় সকলেই অবহিত যে সায়েন্স এন্ড টেকনোলোজির ভিত্তি হচ্ছে গাণিতিক মডেল এবং এক্সপেরিমেন্টাল রেজাল্ট.....যেকোন লেভেলের সফিস্টিকেটেড এবং জটিল সমস্যার গাণিতিক মডেল গবেষণা করেই বিভিন্ন অনুসিদ্ধান্তে পৌছান গবেষকরা, আর তার জন্যই প্রয়োজন উচ্চ ক্ষমতার এইসব সুপারকম্পিউটার.... যার সমস্যা যত বড়, যত বেশী জটিল, তার কম্পিউটিং পাওয়ার প্রয়োজন তত বেশী.... এজাতীয় প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা নিয়ে কাজ করে সাধারণত রিসার্চ ইউনিভার্সিটি, রিসার্চ সেন্টার, বড় বড় কোম্পানী এবং বিভিন্ন সরকারী ইনস্টিটিউট যেমন আর্মডফোর্সেস ইত্যাদি... অর্থাৎ যার রিসার্চ লেভেল যত সফিস্টিকেটেড তার তত বেশী ক্ষমতার সুপারকম্পিউটার লাগবেই.... অন্যভাবে বললে বলা যায় যার সুপারকম্পিউটার লাগেনা, আসলে তার গবেষণা লেভেল এখনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালভাবে পৌছেনি, অথবা তারা সীমিত পর্যায়ের ছোট ছোট প্রবলেম নিয়ে কাজ করেন, অথবা মান্দাত আমলে জিনিসপাতি নিয়ে পড়ে আছেন এখনো.... যদি তাই হয়, তাহলে এবারে বাংলাদেশের সেরা মেধাবীদের প্রতিষ্ঠান, টেকনোলজিক্যাল পাওয়ারহাউজ বুয়েটের কথা চিন্তা করেন, বুয়েটের কয়টা সুপারকম্পিউটার আছে!! কোন জায়গায় আছি আমরা!!!....

ছবি-৯: কয়েকবছর আগেও শীর্ষস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের জাগুয়ার

কী কী করা যায় সুপারকম্পিউটার দিয়ে:
কী করা যায়না সুপারকম্পিউটার দিয়ে!!! পৃথিবীর গভীরে কী হচ্ছে, সাগরের তলদেশে কী কী আছে, মহাশূন্যে কী কী হচ্ছে বা ভবিষ্যতে কী কী হবে ইত্যাদি কতযে বৈচিত্রধর্মী বৈজ্ঞানিক প্রবলেম সলভ করে এই জিনিস,আসুন তার কয়েকটা দেখে নেই সংক্ষেপে...

১. ভূপৃষ্ঠের তলদেশে কোন জায়গায় কী কী আছে, কোন স্তর কত গভীর, টেকটনিক প্লেট কী অবস্থায় আছে, তেল-গ্যাস কুপ আছে কোন কোন জায়গায়, থাকলে তা কত বড় ইত্যাদি বহুবিদ বিষয়াদি (সাইসমিক ইমেজিং), অথবা তেল-গ্যাস উত্তোলনের সময়ে রিজার্ভয়ার এর অবস্থা কেমন ইত্যাদি যা আগে জানা যেতো ছয়মাস বা বছরে তা এখন একমাসের কম সময়েই জানা যায় উচ্চ ক্ষমতার এইসব কম্পিউটারের মাধ্যমে...

২. নিউক্লিয়ার ফিউশন রিয়েক্টরের উপরে একটা বিমান বিধ্বস্ত হলে কী কী ঘটতে পারে, রিয়েক্টরের ভিতরে ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর কী অবস্থা... বড় একটা বাঁধ ভেঙ্গে পড়লে পাশের এলাকা কোন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে.. অথবা সুনামি আসলে সম্ভাব্য দূর্গত এলাকায় কী কী ঘটতে পারে.... ভূমিকম্পের পূর্বাভাস, অথবা লাভা উদগীরণ করলে তার কতটুকু পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে ইত্যাদি জটিল সমস্যার সবই কমবেশী সমাধান করা যায় জটিল ম্যাথমেটিক্যাল মডেল এবং তার সুপারকম্পিউটার দিয়ে সিম্যূলেশন করার মাধ্যমে

৩. ধরুন একটা বিশাল লম্বা ব্রিজ তৈরী করতে হবে, অথবা একশ তলার একটা স্কাইক্রেপার বানাতে হবে, ভূমিকম্প বা সুনামি হলে এইসব জিনিস টিকবে কিনা, এজাতীয় বিষয়গুলোতো আর সবসময় ল্যাবরেটরীতে টেস্ট করে দেখা যাবেনা, এইসব জিনিসের পর্যাপ্ত তথ্য জানার জন্যই সুপারকম্পিউটিং....

৪. আসুন এবার দেখি মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও লাইফ সাইন্সের দুএকটা বিষয়.... আপনি একটা ড্রাগ ডিসকাভারি নিয়ে কাজ করছেন, কোন উপাদান কী পরিমানে দিলে রোগীর শরীরে কী মাত্রায় কোন কোন পরিবর্তন আসতে পারে, ড্রাগের একশনই বা কী হতে পারে, প্রোপাগেশন কোন মাত্রায় হবে, অথবা প্রোটিন বা নিউক্লীক এসিডের মলিক্যূলার লেভেলে কী দশা হতে পারে ইত্যাদি বহুবিদ বিষয় যদি রোগীর উপর এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে প্রয়োগ করতে চান, তাইলেতো শত শত মানুষ মারা পড়তে পারে... তাই এগুলো আগে উচ্চক্ষমতার কম্পিউটার দিয়ে সিম্যুলেশন করে তারপর গবেষকরা নূতন নূতন সিদ্ধান্তে আসে মেডিসিন নিয়ে....

সিমিলারলি, গ্র্যাভিটেশনাল কলাপ্স অব দি ইউনিভার্স... মার্জিং অব গ্যালাক্সিস....মলেকুলার ডাইনামিক্স ইন ড্রাগ ডিসকাভারি..... রেডিওথেরাপি ডোজ ক্যালকুলেশন ফর ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট..... স্প্ল্যাশডাউন অব এ স্পেস ক্যাপসুল...... গ্লোবাল ক্লাইমেট রিসার্চ ফর বেটার আন্ডাস্টেন্ডিং অব আর্থ, সী, এনড ফিউচার.... হিউম্যান ব্রেইন সিমুলেশন..... এক্সসিডেন্ট হইলে গাড়ির ভিতরের যাত্রীদের অবস্থা কেমন হবে (ক্র্যাশ সিমেুলেশন) ইত্যাদি বিষয়ও কমবেশী সুপারকম্পিউটারের উপর নির্ভরশীল ..... যেখানে বাস্তব টেস্ট করা সম্ভন না, বা সম্ভব হলেও ব্যয়বহুল এবং ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ, এইসব বহুবিদ বিষয়াদিই আজকের হাই পারফর্মেন্স কম্পিউটার ছাড়া সম্ভব না....

কারা করেন সুপারকম্পিউটিং:
যেকোন সায়েন্স অথবা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকই সুপারকম্পিউটার প্রোগ্রামিং করতে পারে যদি তার প্রোগ্রামিং টেকনিকস ফর সুপারকম্পিউটার বা প্যারালাল প্রোগ্রামিং টেকনিস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকে.... বলে রাখা প্রয়োজন, যারা কনভেশানাল প্রোগ্রামিং যেমন সি/সি++/ফোট্রান ইত্যাদিতে দক্ষ কেবলমাত্র তারাই এজাতীয় জটিল প্রোগ্রামিং কনসেপ্ট এ নিজেদের অভ্যস্ত করাতে পারেন... এভারেজ প্রোগ্রামার যদি এবিষয় নিয়ে ঘাটাঘাটি করে তাইলে প্রথমদিকে মাথা আউলাঝাউলা হওয়ার সম্ভাবনা আছে.. এই বিষয়ের জন্য হাইলি চ্যালেঞ্জিং একটা একাডেমিক ডিসিপ্লিনও আছে যাকে বলে কম্পিউটেশনাল সায়েন্স... কেউ যদি এইসব বিষয়ের এক্সপার্ট হতে চায়, তাহলে তাকে একাধারে অনেক বিষয়ে দক্ষ হতে হয়... জার্মানীর এরলাঙ্গেন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটিং সেন্টারের হেড প্রফেসর গারহার্ড ওয়েলেইন বছর খানেক আগে ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স গ্রিড নামে এক সায়েন্স ম্যাগাজিনের সাথে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বলেছিলেন তরুন সায়েন্টিস্টদের এব্যাপারে সম্যক ধারনা থাকা উচিৎ যে সুপারকম্পিউটিং এর কাজ করতে গেলে তাদেরকে একাধারে হার্ডওয়ার স্ট্রাকচার, সফওয়ার লেয়ারস, এপ্লিকেশান কোডস, নিউমেরিক্যাল মেথডস এবং 'ম্যাথমেটিক্যাল এন্ড ফিজিক্যাল আন্ডাস্টেন্ডিং অব দি প্রবলেম ইটসেলফ' সহ রিলেটেড সকল বিষয়ের সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে.....

শেষ কথা:

এতক্ষনে বোধয় ক্লিয়ার হয়েছে যে যার রিসার্চ স্ট্যান্ডার্ড যত হাই, যত সফিস্টিকেটেড, যত জটিল তার দরকার তত বেশী ক্ষমতার সুপারকম্পিউটার... অবস্থা এমন হয়েছে, ৫ বছর আগেও যে প্রবলেম সলভ করতে সুপারকম্পিউটার সময় নিতো ছয়মাস বা তারও বেশী সময়, এখন সেই প্রবলেম সলভ করা যাচ্চে হয়তো এক সপ্তাহেই, আর একমাসের প্রবলেম একদিনেই .... এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি পয়েন্ট হলো প্রবলেম সাইজ.... সাইজ যত বড় তত উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার প্রয়োজন... সাইজ হিসেব করা হয় 'গ্রিড পয়েন্ট' বা 'ডিগ্রি আব ফ্রিডম' (DOF) দিয়ে... একটি ইঞ্জিনের স্পেসিফিক কোন পার্টস নিয়ে কোন কিছু এনালাইসিস করার ক্ষেত্রে প্রবলেম সাইজ আর পুরো গাড়ি নিয়ে এনালাইসিস করার ক্ষেত্রে সাইজ এর ডিফারেন্স অনেক বেশী, তাই যত বড় জিনিস নিয়ে এনালাইসিস হবে তত বড় ও বেশী ক্ষমতার সুপারকম্পিউটার লাগবে... নাম্বার অব গ্রিড পয়েন্টও তত বেশী হবে....

আরো ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে ষাটের দশকে যেখানে এক গিগাফ্লপস কম্পিউটেশনস এর পেছনে খরচ হতো ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার, এখন সেখানে খরচ মাত্র ০.১৬ ডলার.... চিন্তা করে দেখতে পারেন, সভ্যতার স্পিড বিগত ৫০/৬০ বছরে কী দ্রুত গতিতে বেড়েছে!!!....কয়েক বছর আগেও যেখানে লারজেস্ট প্রবলেম সাইজ ছিলো কয়েক কোটি DOF, এখন সেখানে কয়েকশ বিলিয়ন DOF এর সায়েন্টিফিক প্রবলেমও সলভ করা যাচ্ছে... কত বড় বিপ্লব হয়ে গেছে বিগত ৫০-৬০ বছরে, এই বিপ্লব শুধু কম্পিউটারের স্পিড এর বিপ্লব নয়, শুধু পাওয়ার অব কম্পিউটিং এর বিপ্লব নয়, শুধুমাত্র কম্পিউটার সাইন্সের বিপ্লবই নয়, এ বিপ্লব ছড়িয়ে গেছে সভ্যতা বিনির্মানের সকল দিক ও বিভাগে, ভুমিকা রেখে চলছে সভ্যতার উৎকর্ষতা সাধনে, আর এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতা, হচ্ছে 'পাওয়ারিং অব সিভিলাইজেশন এন্ড পাওয়ারিং দি ফিউচার'!!!... ইন্টারের কেমিস্ট্রি বইতে পড়েছিলাম যে দেশে সালফিউরিক এসিডের উৎপাদন যত বেশী সেদেশের ইন্ড্রাষ্ট্রিয়াল হেলথ তত ভালো, সেই দিন এখন অনেক পাল্টে গিয়েছে, এখন বোধয় বলার সময় এসেছে সেদেশের পাওয়ার অব কম্পিউটিং যত বেশী সেদেশের রিসার্চ, এডুকেশন, টেকনোলজি এবং ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল হেলথ তত গভীর.....

বিস্তারিত: http://www.top500.org/

Level 0

আমি helalce। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 2 টি টিউন ও 14 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

সুন্দর হয়েছে…… বিবরণের ধরণটা সুন্দর লেগেছে……। 🙂

Level 0

পড়ার ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা!‍

wonderful,awasome tune. Thank you brother helalce.

    Level 0

    @গাজী: many thanks for good words brother!

আমারটা ২০ গিগাফ্লপস !! ছোটখাটো একটা (প্রাগৈতিহাসিক) সুপার কম্পিউটার 😉

    Level 0

    @rabiul islam: আপনারটা প্রাগৈতিহাসিক হলে আমারটাতো ডাইনোসর যুগের;)

Super computer e ki operating system use hoy ??

    Level 0

    @Tech follower: different versions of Linux in more than 95% case……

চমৎকার আর্টিক্যাল, টিউনটি নির্বাচিত করা হউক

    Level 0

    @মোহাম্মদ খালিদ হোসাইন: অনেক ধন্যবাদ মোহাম্মদ খালিদ হোসাইন পড়ার ও সমর্থনের জন্য! ভালো থাকুন!