বিজ্ঞানের খাতা [পর্ব-৪৫] :: শব্দ বিজ্ঞান

বিজ্ঞানের খাতা

আমি দক্ষিনবঙ্গের সন্তান। বর্তমান সরকার বাগেরহাটের যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাতে চাচ্ছে সেই রামপাল আমার বাড়ী থেকে খুব বেশী দূরে নয়। তাই রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে যেসকল ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে তার সবগুলোর শিকার হতে হবে আমাদের। ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দরবন।  শিক্ষিত সচেতন ব্যক্তি হিসেবে আমি কখনোই এটাকে সমর্থন করতে পারিনা। ফেসবুকে একটা পেজ খুললাম। “সুরক্ষিত সুন্দরবন চাই।” রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাইনা টাইপ নাম দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে জামায়াত বিএনপির দালাল ইত্যাদি টাইপের বিশেষন শোনার সম্ভাবনা থাকে। বাংলাদেশের দলীয় সমর্থকেরা অন্ধ সমর্থক হিসেবে নোবেল পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। দলের মতের সাথে সামান্যতম মতের অমিল হলে আপনাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে ডাস্টবিনে।  ব্যক্তিগত আক্রমন করে বসবে । দলীয় এই অন্ধ ভক্তি দূর না হলে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সম্ভব নয়। ভাবছেন প্রযুক্তি ব্লগে ফিলোসফি শুরু করে দিলাম কেন! নারে ভাই। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। বিজ্ঞান নিয়েই লিখব। আজ কানে শোনা নিয়ে লিখব। ফেসবুকে আমার পেজে এক বন্ধু  বলেছেন ভাই ফেসবুকে এত লেখালেখি করে কি হবে, একুশে আগস্টের বোমা হামলার পর থেকে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কানে কম শোনেন। যতই চিৎকার চেঁচামেচি করো কোন লাভ হবে না। লাভ হোক আর নাই হোক চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। মানুষ চেষ্টা করেছিলো বলে আজ আমরা টেকটিউনস ব্যবহার করতে পারছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যদি চেষ্টা না করত তাহলে আজ আমাদের গুহায় বসে পাতার বাঁশি বাজাতে হত। আজ কানে শোনা নিয়ে কিছু লিখতে চাই।

শব্দঃ শব্দ একধরনের তরঙ্গ বিশেষ, যা বস্তুর কম্পনের মাধ্যমে সৃষ্ট হয় এবং জড় মাধ্যমের সাহায্যে প্রবাহিত হয়ে আমাদের কানে পৌঁছায়।

শব্দ প্রতি সেকেন্ডে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে শব্দের বেগ বলে।  শুন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় এবং স্বাভাবিক বায়ুচাপে শব্দের বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৩৩২ মিটার। তাপমাত্রা বাড়লে শব্দের বেগ বৃদ্ধি পায়। প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য শব্দের বেগ ০.৬ মিটার/সেকেন্ড বৃদ্ধি পায়।  কঠিন মাধ্যমে শব্দের বেগ বাতাসের থেকে ১৫ গুন বেশী। বায়ুশুন্য মাধ্যমে শব্দের বেগ শূন্য। স্বাভাবিক অবস্থায় লোহাতে শব্দের বেগ ৫২২১ মিটার/ সেকেন্ড।

শ্রাব্যতার সীমাঃ প্রতি সেকেন্ডে ২০ থেকে ২০,০০০ এর মধ্যে হলে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তা আমরা শুনতে পাই। কম্পনের এই রেঞ্জকে বলা বয় শ্রাব্যতার সীমা। এই রেঞ্জের বাইরে উৎপন্ন শব্দ আমরা শুনতে পাই না।

প্রতিধ্বনিঃ কোন উৎস থেকে সৃষ্ট শব্দ দূরবর্তী কোন প্রতিবন্ধকে বাঁধা পেয়ে উৎসের কাছে ফিরে আসে তখন মূলধ্বনির যে পুনরাবৃত্তি ঘটে তাকে প্রতিধ্বনি বলে। পাহাড়ে চিৎকার করলে প্রতিধ্বনি শোনা যায়। প্রতিধ্বনি শোনার জন্য মুলধ্বনি এবং  প্রতিধ্বনির সময়ের পার্থক্য ০.১ সেকেন্ড হতে হবে। এর থেকে কম সময় হলে আমাদের মস্তিষ্ক মূলধ্বনি এবং প্রতিধ্বনির পার্থক্য বের করতে পারে না। তাই প্রতিধ্বনি শোনার জন্য শ্রোতা এবং প্রতিবন্ধকের মাঝে ন্যুনতম ১৬.৬ মিটার দূরত্ব থাকা আবশ্যক।

বাদুর কিভাবে পথ চলেঃ আমরা অনেকেই জানি বাদুর চোখে দেখেনা। কিন্তু তারা দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে এগাছ থেকে ওই গাছে। বাদুরের চোখ খারাপ হলে কি হবে কান কিন্তু অনেক শার্প।  শব্দত্তোর তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে বাঁদুর পথ চলে। বাদুর চলার পথে ক্রমাগত বিভিন্ন কম্পাংকের শব্দোত্তর তরঙ্গ সৃষ্টি করে।  এই তরঙ্গ কোন প্রতিবন্ধকে বাঁধা পেয়ে প্রতিফলনে বাঁধা পেয়ে বাদুরের কানে ফিরে আসে। শব্দ ও প্রতিধ্বনির মধ্যবর্তী সময়ের পার্থক্য থেকে বাদুর প্রতিবন্ধকের অবস্থান এবং আকৃতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারে এবং চলার সময় সেই প্রতিবন্ধক পথ পরিহার করে চলে।

জিয়োডাইমিটারঃ শব্দ নিরূপণের মাধ্যমে দুটি স্থানের দূরত্ব নির্ণয় করার যন্ত্রের নাম জিয়োডাইমিটার।

সমুদ্রের গভীরতা নির্ণয়ঃ  ফ্যাদোমিটারের সাহায্যে সমুদ্রের গভীরতা নির্ণয় করা হয়। এই যন্ত্র বাদুরের মত আল্ট্রাসনিক শব্দ তৈরী করে এবং সমুদ্রের তলদেশে বাঁধা পেয়ে ফিরে আসা প্রতিধ্বনির মাধ্যমে গভীরতা পরিমাপ করা হয়।

কূপের গভীরতা নির্ণয়ঃ একই পদ্ধতিতে প্রতিধ্বনির সাহায্যে কূপের গভীরতা নির্নয় করা সম্ভব।

টকিং টিউবঃ স্টিমার, মোটর লঞ্চের সারেং ইঞ্জিন ঘরের কর্মীদের সাথে কথোপকথনের জন্য একধরনের নল ব্যবহার করে একে টকিং টিউব বলে। নলের একপ্রান্তে কথা বললে অন্য প্রান্তে স্পষ্ট শোনা যায়। কারণ নলের ভিতর যে শব্দ তৈরী হয় তা বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। নলের গায়ে বারবার প্রতিফলিত হয়ে অন্য প্রান্তে গিয়ে পৌঁছায়।

স্টেথোস্কোপঃ আমাদের হৃদপিন্ডের বিট আমরা যাকে হার্টবিট বলি ডাক্তার তা শোনার জন্য কানে যে যন্ত্র ব্যবহার করেন তাকে স্টেথোস্কোপ বলে। ডাক্তাররা মূলত নলের সাহায্যে হৃদপিন্ডের কম্পনের প্রতিধ্বনি শোনেন।

বর্ষাকালে শব্দ জোরে শোনা যায় কেনঃ বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমান বেশী থাকলে বায়ুর ঘনত্ব কমে ফলে শব্দের বেগ বাড়ে। অন্যান্য সময়ের তুলনায় বর্ষাকালে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমান বেশী থাকে। তাই বর্ষাকালে শব্দের বেগ বেশী থাকে। লক্ষ্য করলে দেখবেন এক পশলা বৃষ্টির পর বায়ুতে শব্দের বেগ বৃদ্ধি পায়।

ফনোগ্রাফ ও গ্রামোফোনঃ শব্দকে যান্ত্রিকভাবে ধারনকরে তা পূনরুৎপাদনের যন্ত্রকে ফনোগ্রাফ বলে। ১৮৭৮ সালে আমার প্রিয় বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ফনোগ্রাফ আবিষ্কার করেন। ফনোগ্রাফের উন্নত এবং নির্ভরযোগ্য সংস্করনের নাম গ্রামোফোন। বলেন তো গ্রামোফোন এবং গ্রামীনফোনের মধ্যে পার্থক্য কি?

চন্দ্রপৃষ্ঠে কথা বলা যায় না কেনঃ চাঁদে কোন বায়ুমন্ডল নাই। আমি আগেই বলেছি বায়ুশূন্য মাধ্যমে শব্দের বেগ শুন্য। তাই চাঁদে দুজন ব্যক্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বললেও শোনা যাবে না। এজন্য চাঁদে নভোচারীদের যন্ত্রের ব্যবহার করতে হয়।

মশার উড়ার শব্দ আমরা শুনতে পাই কিন্তু পাখি উড়ার শব্দ শুনতে পাই না কেনঃ

যারা জানেন না তারা নিশ্চয় অবাক হয়ে ভাবছেন মশার ডানার শব্দ আবার কবে শুনলাম! ভেবে পাচ্ছেন না তাই তো। আসলে আমাদের কানের কাছে মশা পোঁ পোঁ শব্দ করে অস্থির করে ফেলে সেই শব্দ কিন্তু মশার মুখ থেকে নয় ডানা থেকে আসে। মশা যখন উড়ে তখন মশার পাখার কম্পন ২০ থেকে ২০০০০ বারের মত হয়। তাই আমরা মশার ডানার শব্দ শুনতে পাই। কিন্তু পাখির উড়ার সময় ডানার কম্পন প্রতি সেকেন্ডে ২০ বারের কম হয়। তাই পাখির উড়ার শব্দ আমরা শুনতে পাই না।  তবে পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ আমরা শুনতে পাই।

মশার গুঞ্জনের তীক্ষ্ণতা বাঘের গর্জনের চেয়ে বেশীঃ বাঘের গর্জন শুনলে হৃদকম্প শুরু হয় কিন্তু মশার গুঞ্জন কানে বিরক্তি উৎপাদন করে। অথচ মশার গুঞ্জনের তীক্ষ্ণতা বাঘের গর্জনের চেয়ে বেশী। তীক্ষ্ণতা কম্পাংকের সমানুপাতিক। আর মশার ডানার কম্পাংক বাঘের গর্জনের কম্পাঙ্কের চেয়ে বেশী।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর পরে মেঘের গর্জন শোনা যায় কেনঃ মেঘে মেঘে সংঘর্ষের ফলে আকাশে বিদ্যুতের ঝলক এবং শব্দ একই সাথে উৎপন্ন হয়। বিদ্যুৎ ঝলকের গতিবেগ আলোর সমান, সেকেন্ডে ৩×১০মিটার। অন্যদিকে শব্দের বেগ সেকেন্ডে ৩৩২ মিটার। তাই শব্দ পৌঁছানোর অনেক আগেই আলোর ঝলকানি আমাদের নিকট পৌঁছে যায়। আর বিদ্যুৎ চমকানো সাথে সাথেই কিন্তু বজ্রপাত হয়, মেঘের গর্জনের সাথে নয়।

আমাদের ঘরে প্রতিধ্বনি শুনতে পাই না কেনঃ সাধারনত আমাদের ঘরের দুই দেয়ালের দূরত্ব ১৬.৬ মিটারের কম থাকে। তাই আমরা ঘরে প্রতিধ্বনি শুনতে পাই না।

কি! পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলেন নাকি? এগুলো আপনাদের সবারই জানা। ছোট বেলায় পাঠ্যপুস্তকে আমাদের পরীক্ষা পাশের জন্য পড়তে হয়েছে।  সময়ের ব্যবধানে আমরা অনেক কিছুই ভূলে যাই। আমি আপনাদের মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র।

শুরুতেই বলছিলাম সুন্দরবনের কথা। সুন্দরবন ধ্বংস হলে আক্রান্ত হবে পুরো বাংলাদেশ।  সুন্দরবন নিয়ে আমার ফেসবুক পেজ  http://www.facebook.com/protectsundarban    । আশা করি বিজ্ঞানের খাতার পাঠকেরা এই পেজটি লাইক দিবেন এবং অন্যদের সাথে শেয়ার করবেন।  আর মন্তব্য করবেন। মন্তব্য পেলে লিখতে ভালো লাগে। যদিও আমি ভালো করেই জানি বিজ্ঞানের খাতায় মন্তব্য করার মত খুব বেশী কথা থাকেনা। ভালো থাকবেন এবং দোয়া করবেন।

ঈদ এবং পূজার অগ্রিম শুভেচ্ছা।

Level 2

আমি সরদার ফেরদৌস। Asst Manager, Samuda chemical complex Ltd, Munshiganj। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 94 টি টিউন ও 463 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।

আমি ফেরদৌস। জন্ম সুন্দরবনের কাছাকাছি এক জনপদে। ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ থেকে লেখাপড়া করেছি এপ্লাইড কেমিস্ট্রি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। এরপরে চাকরি করছি সামুদা কেমিকেল কমপ্লেক্স লিমিটেডের উৎপাদন বিভাগে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে। এছাড়া আমি বাংলা উইকিপিডিয়ার একজন প্রশাসক।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

Level 0

খুব ভালো হয়েছে ! তবে, আমার মনে হয় একটা প্রশ্ন করা যেতে পারে -শব্দের বেগ বেশি হলে কি শব্দ জোরে শুনা যায় ? ধন্যবাদ !

    @voltrome: শব্দের কম্পাঙ্ক যত বেশী থাকবে শব্দ তত বেশী জোরে শোনা যাবে।