প্রথমে বলে নেই এই ব্লগ পড়ার পর আপনাদের পরম স্থিতি ও গতি নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারনা হতে পারে । তাই এই ব্লগ কম হলেও ২ বার পড়বেন ।
১. ধরা যাক কোন একটা জাড্য কাঠামোয় (inertial reference frame) দুটি ঘটনা একই স্থানে ঘটেছে, কিন্তু একই সময়ে নয়। অর্থাৎ তাদের মাঝে কালিক (বা কালের অর্থাৎ সময়ের) অন্তর আছে। যেমন প্রথম ঘটনাটা হতে পারে আমি হাত থেকে একটা বল ছেড়ে দিলাম, দ্বিতীয় ঘটনা হল বলটা মাটিতে আঘাত করল। ধরা যাক এই দুটো ঘটনার মধ্যে সময়ের পার্থক্য হচ্ছে t0। যদি বলটার মাটিতে পড়তে ১ সেকেন্ড সময় লাগে তবে t0 = ১ সেকেন্ড। যে কাঠামোয় আমি এই বল পড়ার ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করছি তার তুলনায় আমি স্থির আছি। সেটা আমার বাড়ির একটা ঘর হতে পারে। এই কাঠামোটাকে আমরা বলব আমার স্থিত বা প্রকৃত কাঠামো।
এখন ধরা যাক কাকতালীয় ভাবে ঐ বলটা মাটিতে পড়ার সময় আমার বন্ধু স্বাতী একটি দ্রুত গতির যানে বসে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল এবং ঘরের জানালা দিয়ে এই ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করল। (স্বাতী ভিনগ্রহের অধিবাসী, স্বাতী তারার কাছের এক সৌরমণ্ডল থেকে এসেছে বলে আমি তাকে স্বাতী নাম দিয়েছি।)
সেই হাই-টেক যানের গতি ছিল বেশ, ধরা যাক তা হল u। পরে স্বাতীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম সেই সময়ে তার আকাশযানের গতি ছিল আলোর গতির অর্ধেক। আলোর গতিকে যদি আমরা c দিয়ে চিহ্নিত করি, তবে u = 0.5c। আমার ঘরের প্রকৃত কাঠামোর তুলনায় স্বাতী সমবেগে চলছিল, অর্থাৎ তার কোন ত্বরণ ছিল না। সেই ক্ষেত্রে বলা যায় আমার জাড্য কাঠামোর মত স্বাতীর জন্যও তার আকাশযান একটা জাড্য কাঠামোর ভূমিকা পালন করেছে।
যাইহোক স্বাতীর সঙ্গে পরদিন দেখা। সে বলল, “কাল তোমার বাড়ির পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। দেখি তুমি একটা বল নিয়ে খেলছ।” আমি বললাম, “বলটা কতক্ষণে মাটিতে পড়ে তাই মাপছিলাম।” স্বাতী জিজ্ঞেস করল, “কেন?” আমি বললাম, “মাধ্যাকর্ষণ জনিত ত্বরণ, g-এর মান জানতে ঐ সময়টা লাগবে।”
স্বাতী বলল, “খুব ভাল। তা কত সময় নিল?”
আমি বললাম, “এক সেকেন্ড।”
স্বাতী বলল, “আমার আকাশযানের যান্ত্রিক চোখ থেকে কিছু এড়ায় না। সেটার হিসেবে তোমার বল পড়তে সময় লেগেছে ১.১৫৪৭ সেকেন্ড।”
আমি বললাম, “তা বটে। তোমার গতি ছিল আলোর গতির অর্ধেক। স্বাভাবিক ভাবেই তোমার কাঠামোতে সময়ের প্রসারণ হয়েছে। আমার t0 = ১ সেকেন্ড হচ্ছে যথার্থ বা প্রকৃত সময়, কারণ বল ছাড়া ও বলের মাটিতে আঘাত করা এই দুটো ঘটনাই আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মেপেছি। কিন্তু তুমি এই দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন জায়গা থেকে মেপেছ। তাই তোমার কালিক অন্তর যথার্থ নয়। তোমার কালিক অন্তর যদি tহয়, তবে আপাক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী
সেকেন্ড
অর্থাৎ তোমার বেগসম্পন্ন কাঠামোতে সময়ের প্রসারণ হয়েছে। এক অর্থে তোমার কাঠামোতে সময় শ্লথ হয়ে গিয়েছে। তুমি বলটাকে আমার থেকে আস্তে পড়তে দেখেছ।”
“আমি যদি আরো জোরে যেতাম তাহলে বলটাকে তো আরো আস্তে পড়তে দেখতাম,” স্বাতী বলে।
“তা বটে,” আমি বলি, “আর দেখ তোমার জন্য এই গ্রাফগুলো আমি আগেই বানিয়ে রেখেছিলাম।” এই বলে আমি নিচের ছবিগুলো স্বাতীকে দেখাই।
এখানে x-অক্ষে আলোর ভগ্নাংশে স্বাতীর গতিবেগ দেখানো হয়েছে। 0.2 মানে আকাশযানের গতি হচ্ছে 0.2c বা আলোর গতিবেগের ২০%, 0.8 হচ্ছে 0.8c বা আলোর গতিবেগের ৮০%। y-অক্ষে দেখানো হয়েছে কালিক অন্তর। y-অক্ষের একক হচ্ছে সেকেন্ড। দেখাই যাচ্ছে বল পড়ার কালিক অন্তর স্বাতীর কাঠামোর গতিবেগের ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ সেটা হল গতিবেগের ফাংশান। আকাশযানের গতিবেগ যত বেশী হবে সময়ের অন্তর তত বাড়বে, স্বাতী দেখবে বলটা পড়তে বেশী সময় নিচ্ছে। আলোর গতিবেগের ৮০%-এ বলটা পড়তে সময় নেবে প্রায় ২.৮ সেকেন্ড।
“আর তুমি আলোর গতিবেগের যত কাছাকাছি যাবে কালিক অন্তর তত বেড়ে যাবে,” আমি বলি। “নিচের গ্রাফটা দেখ।”
“তুমি যদি আলোর গতিবেগের ৯৯.৯৯৯৯৯% বা 0.9999999c-তে ভ্রমণ করতে তবে তোমার কাছে ঐ কালিক অন্তরটা হত ৫x১০৬ বা ৫,০০০,০০০ সেকেন্ড। অর্থাৎ পাঁচ মিলিয়ন বা পঞ্চাশ লক্ষ সেকেন্ড। যা কিনা প্রায় ৫৮ দিন বা দু’মাসের সমান।
“আর আলোর গতিবেগে ভ্রমণ করলে সময় তোমার জন্য স্তব্ধ হয়ে যেত। বলটা ওপরেই আটকে যেত, আমার হাত থেকে আর পড়ত না।”
যে কালিক অন্তর একই জায়গায় নির্ণীত হচ্ছে তাকে বলা হচ্ছে যথার্থ সময়। শুধুমাত্র আমার ঘড়িই আমার কাঠামোর তুলনায় স্থির আছে। কিন্তু স্বাতীর কাঠামো আমার তুলনায় গতিশীল ছিল বলে তার ঘড়ি আমার কাঠামোর তুলনায় স্থির ছিল না। কাজেই তার সময় যথার্থ সময় নয়। তাই তার সময়কে আমার তুলনায় মাপতে হবে, সেই সময় শ্লথ হবে।
সত্যিই কি তাই? আমার সময় যথার্থ আর স্বাতীর সময় যথার্থ নয়? বিষয়টিকে একটু পরিষ্কার করতে হলে আর একটু ভাবনা চিন্তার দরকার আছে।
স্বাতীর সঙ্গে বলটার ব্যাপারে আমার মতের মিল হল, কিন্তু এর পরেই একটা ব্যাপারে আমাদের দুজনের তর্ক লেগে গেল। আমি বললাম, “তুমি তো আমার জানালার পাশ দিয়ে আলোর গতিবেগের অর্ধেক গতিতে (u = 0.5c) বেড়িয়ে গেলে। আমি দুরবিন দিয়ে দেখলাম তুমি ৩,০০,০০০ (তিন লক্ষ) কিলোমিটার দূরত্ব ২ সেকেন্ডে পার হয়ে গেলে। আলো যেহেতু সেকেন্ডে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার যায়, তাই তোমার যান ঐ দূরত্ব পার হতে আমার ঘড়িতে ২ সেকেন্ড সময় নিয়েছে। তোমার ঘড়িতে তখন ক’টা বাজে?”
স্বাতী বলল, “আশা করছি তুমি যে ২ সেকেন্ড সময় নির্ধারণ করেছ সেটা আমার আকাশযান যে তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হয়েছে সেই খবরটা আবার তোমার কাছে আসতে যতটুকু সময় নিয়েছে সেটা বাদ দিয়েই মেপেছ।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তা তো বটেই। তাছাড়া আমি এমন একটা জাড্য কাঠামো ব্যবহার করছি যেখানে কিছু পথ অন্তর একটা করে ঘড়ি রয়েছে, সবগুলো ঘড়ি আবার একই সময়ে সমলয় (synchronize) করা আছে। তুমি যখন আমার জানালার পাশ দিয়ে গেলে আমার ঘড়ি যদি শূন্য সেকেন্ড দেখায় তাহলে তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরে আমি যে ঘড়ি রেখে দিয়েছি “সেই মুহূর্তে” সেটাও শূন্য সেকেন্ড দেখাবে। তুমি যখন সেই তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরের ঘড়ির পাশ দিয়ে গেলে তখন সেই ঘড়ি দু সেকেন্ড সময় দেখিয়েছে।”
চিত্রঃ আমার জাড্য ফ্রেমে এক গাদা ঘড়ি সমলয় (synchronize) করা আছে। নিচের বাঁ কোণার ঘড়িটা আমার হলে, তিন লক্ষ দূরে আর একটি ঘড়ি আছে। ২ সেকেন্ড পরে স্বাতী সেই ঘড়ির পাশ দিয়ে যাবে।
“তাহলে আমি বলি আমার দিকটা,” স্বাতী বলে, “দুটি ঘটনা ঘটেছে। এক, আমি তোমার জানালার পাশ দিয়ে উড়ে গেছি। দুই, আমি তোমার তিন লক্ষ মিটার পার হয়েছি।”
“আমার তিন লক্ষ মিটার বলছ কেন?” আমি জিজ্ঞেস করি, “সেটা কি তোমারও নয়?”
“দাঁড়াও,” বলে স্বাতী, “ভাবনাগুলি একটু গুছিয়ে নিই। প্রথমতঃ এই দুটি ঘটনা তোমার কাঠামোয় দুটি ভিন্ন জায়গায় ঘটেছে। কিন্তু আমার আকাশযানের কাঠামোয় তারা একই জায়গায় ঘটেছে। তাই এক্ষেত্রে আমার কালিক অন্তর হচ্ছে যথার্থ বা প্রকৃত সময়, কারণ তোমার জানালার পাশ দিয়ে যাওয়া ও তোমার তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হওয়া এই দুটো ঘটনাই আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মেপেছি। কিন্তু তুমি এই দুটো ঘটনা দুটো ভিন্ন জায়গা থেকে মেপেছ। তাই তোমার কালিক অন্তর যথার্থ নয়। তোমার কালিক অন্তর যদি t= 2 সেকেন্ড হয়, তবে আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী আমার কালিক অন্তর হবে,
তাই তুমি যখন তোমার দুটো ঘড়ির মাধ্যমে ২ সেকেন্ড সময় দেখছ, আমি ১.৭৩ সেকেন্ড সময় দেখছি।”
“তাহলে তুমি যখন তোমার ঘড়িতে ১.৭৩ সেকেন্ড সময় দেখছ, আমি আমার ঘড়িতে ২ সেকেন্ড দেখব।” আমি স্বাতীকে বলি।
“এখানেই যত ঝামেলা। উত্তরটা হচ্ছে না।” স্বাতী উত্তর দেয়।
“কি বলছ তুমি?” আমি একটু রেগেই যাই স্বাতীর ওপর।“একটু আগেই না বললে আমি যখন ২ সেকেন্ড মাপবো, তুমি ১.৭৩ সেকেন্ড মাপবে। তাহলে তুমি যখন ১.৭৩ সেকেন্ড মাপবে, আমি কেন ২ সেকেন্ড মাপবো না।”
“না, আমি তা বলি নি,” শান্ত স্বরে উত্তর দেয় স্বাতী, “প্রথম ক্ষেত্রে তুমি যখন দেখছ আমার আকাশযান দ্রুত বেগে আকাশে ছুটে যাচ্ছে, তুমি এক জায়গায় বসে আমার সময় ও দূরত্ত্ব নির্ধারণ করতে পারবে না, তোমাকে সেই এক গাদা সিনখ্রোনাইজড (সমলিত) ঘড়ির সাহায্য নিতে হবে। আমি যখন তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হব সেই দূরত্ত্বে বসানো একটা ঘড়ি তখন দেখাবে ২ সেকেন্ড, কিন্তু আমার আকাশযানের ঘড়ি বলবে মাত্র ১.৭৩ সেকেন্ড পার হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে তুমি নিজে ২ সেকেন্ড সময় মাপো নি, বরং তোমার কাঠামোতে এক গাদা ঘড়ি ব্যবহার করে নির্ধারণ করেছ যে আমার দু সেকেন্ড সময় লেগেছে তিন লক্ষ কিলোমিটার পার হতে। যেহেতু দুটো ঘটনা তুমি দুই জায়গা থেকে মেপেছ তোমার মাপাটা “যথার্থ” বা proper নয়, সেটা হবে t। এখানে আমার সময়টা হচ্ছে যথার্থ সময় - t০।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রশ্নটা হচ্ছ উলটো। এখন আমি ১.৭৩ সেকেন্ড মাপছি এক জায়গায় বসে নয়, বরং দু-জায়গায়। তুমি কিন্তু একই জায়গায় বসে সময় দেখছ। এখন তোমার সময় হবে যথার্থ।”
“দাঁড়াও,” আমি বলে উঠি, “আমি এটা বুঝতে পারছি তুমি যখন ভীষণ গতিতে ভ্রমণ করছ তোমার সময়ের প্রসারণ হচ্ছে যার ফলে আমার ২ সেকেন্ড তোমার ১.৭৩ সেকেন্ড হচ্ছে। এবং যেহেতু তুমি একই জায়গায় বসে তোমার সময় নির্ধারণ করছ তাই তোমার সময়কে যথার্থ সময় বলা হচ্ছে।”
“ঠিক, স্বাতী বলে। এখন আমাদের দেখতে হবে প্রশ্নটা কাকে করা হচ্ছে। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় – স্বাতী, তুমি যখন তোমার ঘড়িতে ১.৭৩ সেকেন্ড দেখবে তখন দ.র ঘড়িতে কত সময় দেখাবে, তাহলে আমি বলব আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক কার সময় এখানে যথার্থ। যেহেতু এই ক্ষেত্রে আমাকে আমার কাঠামোতে ১.৭৩ সেকেন্ড মাপতে হবে সেহেতু আমাকে আমার কাঠামোতে এক গাদা সিনক্রোনাইজড ঘড়ির সাহায্য নিতে হবে, এবং সেই ক্ষেত্রে তোমার সময় হবে যথার্থ। আমি দেখব তুমি আমার থেকে দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছ এবং তুমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমার সময় মাপছ। এই ক্ষেত্রে আমার কালিক অন্তর হবে t= ১.৭৩ সেকেন্ড, এবং তোমার অন্তর হবে,
“এই ক্ষেত্রে প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি আমি,” স্বাতী বলে, “এবং আপেক্ষিকতার বোধ অনুযায়ী এবার তুমি আমার কাছ খুব দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছ। এবং ১.৭৩ সেকেন্ড পরে আমি তোমাকে ১.৭৩২০৫ সেকেন্ড পূরণ ১,৫০,০০০ কিলোমিটার/সেকেন্ড = ২,৫৯,৮০৮ কিলোমিটার পেছনে দেখব। আমি বলব যে তোমার ঘড়ি শ্লথ চলছে এবং সেই ঘড়িতে মাত্র ১.৫ সেকেন্ড পার হয়েছে।”
আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
স্বাতী বলতে থাকল, “ঠিক আছে, আমি বরং একটা চার্ট বানাই। আমার আকাশযানের গতিবিধি দেখে তুমি (দ.) বলব, স্বাতী ৩,০০,০০০ কিলোমিটার দূরত্ত্ব পারি দিয়েছে ২ সেকেন্ডে। এদিকে আমি (স্বাতী) বলব, তুমি যাকে ৩,০০,০০০ কিলোমিটার বলছ সেটা পারি দিতে আমার (স্বাতীর) সময় লেগেছে ১.৭৩ সেকেন্ড, কিন্তু আমি (স্বাতী) ৩,০০,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করি নি, বরং দ. আমাকে ছেড়ে ২,৫৯,৮০৮ কিলোমিটার পেছনে চলে গেছে। আর দ.র ঘড়িতে তখন বাজবে ১.৫ সেকেন্ড।
আমি----------------------স্বাতী (যথার্থ সময়)----------------------অতিক্রান্ত স্থান
২ সেকেন্ড----------------------১.৭৩ সেকেন্ড----------------------৩,০০,০০০ কি.মি.
আমি (যথার্থ সময়)----------------------স্বাতী----------------------অতিক্রান্ত স্থান
১.৫ সেকেন্ড----------------------১.৭৩ সেকেন্ড----------------------২,৫৯,৮০৮ কি.মি.
“এই জনেই কি এর নাম আপেক্ষিকতা?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“সে তোমরা ভাল জানো। আমি তো আর পৃথিবীর লোক নই,” স্বাতী হেসে বলে, “তবে আপেক্ষিকতায় তোমার জন্য যা সত্যি আমার জন্য তা নয়, তোমার আর আমার ঘটনা যুগপৎ বা simultaneous নয়।”
স্বাতীর সঙ্গে যখন ওপরের প্রপঞ্চ নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই সময় মৃত্তিকা রাণী এসে উপস্থিত। স্বাতীকে নিয়ে তার আবার কিছু ঈর্ষাপরায়ণতা আছে। মৃত্তিকা উদ্ভিদবিদ, আপেক্ষিকতা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। সেবলল, ‘তোমরা কি নিয়ে কথা বলছ?’ আমি বললাম, ‘আপেক্ষিকতা নিয়ে।’ মৃত্তিকা বলল, ‘তারপর?’
আমি বললাম, ‘স্বাতীর সঙ্গে একটা বিষয়ে তর্ক হচ্ছে।’
তর্কের বিষয়বস্তুটা তাকে বলার পর মৃত্তিকা বলল, ‘হুঁ।’ হুঁ-টা যেনএকটু তাচ্ছিল্য মেশানো ছিল। আমি বললাম, ‘হুঁ মানে?’
‘হুঁ মানে তোমরা পদার্থবিদরা সরল জিনিসকে জটিল করে দাও।’
‘তার মানে?’
‘মানে খুব সহজ,’ বলে মৃত্তিকা, ‘তোমরাই তো বললে এটা আপেক্ষিকতা। তুমি আর স্বাতী দুটো জাড্য কাঠামোতে বসে এক অপরের কার্যাবলী দেখছ। দুটো কাঠামোর কোনটাই বিশেষ নয়। তোমার মনে হবে স্বাতী সেকেন্ডে ১৫০,০০০ কিলোমিটার বেগে সামনে চলে গেল, স্বাতী ভাবল তুমি সেকেন্ডে ১৫০,০০০ কিলোমিটার বেগে পেছনে চলে গেলে। তোমার ফ্রেমে স্বাতীর ঘড়ি শ্লথ চলবে, আর স্বাতীর ফ্রেমে তোমার ঘড়ি শ্লথ চলবে, এটা না বোঝার কি হল?’
সত্যিই তো! এটা তো বোঝারই কথা। আমার ঘড়িতে যখন ২ সেকেন্ড বাজবে, আমার কাঠামোতে স্বাতীর ঘড়িতে তখন ১.৭৩ সেকেন্ড বাজবে, তেমনই স্বাতী যখন তার ঘড়িতে ২ সেকেন্ড দেখবে তার কাছে মনে হবে আমার ঘড়িতে ১.৭৩ সেকেন্ড বেজেছে। আমাদের দুজনের কাঠামোর মধ্যে একটা প্রতিসাম্য তো বজায় থাকবে। তাই স্বাতী তার ঘড়িতে ১.৭৩ সেকেন্ড দেখবে, সে ভাববে আমি ১.৫ সেকেন্ড দেখছি।
একজন উদ্ভিদবিদের কাছে সহজ ব্যাখ্যা শুনে আমি ও স্বাতী দুজনেই একটু দমে গেলাম। মৃত্তিকা মুখ বাঁকিয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘তোমরা পদার্থবিদরা সহজ জিনিসকে জটিল করে ফেল। যেমন তোমরা বলছ দুটি ঘটনা যদি একজনের ফ্রেমে যুগপৎ অর্থাৎ একই সঙ্গে ঘটে থাকে, সেটা আর একজনের কাঠামোতে যুগপৎ হবে না। কিন্তু তোমরা ট্রেনের উদাহরণটা কেন দিচ্ছ না? স্বয়ং আইনস্টাইন তো যুগপৎ ঘটনার একটা ব্যাখ্যা দিতে রেলগাড়িকে ব্যবহার করেছেন। জান না যে পৃথিবীর তাবৎ পাঠ্যপুস্তক সেই উদাহরণটাই ব্যবহার করে?’
চিত্র ১: মৃত্তিকার কাঠামোতে, ট্রেনের বাইরে প্ল্যাটফর্মের দু’পাশে, মৃত্তিকা ও স্বাতীর থেকে সম দূরত্বে, একই সময়ে দুটি বজ্রপাত হল।
সত্যিই তো, ভাবলাম আমি। বললাম, ‘দাঁড়াও, দেখি আমি এই ঘটনাটা বর্ণনা করতে পারি কিনা। মনে কর একটা রেলগাড়ি বেশ জোরে পশ্চিম থেকে পূব দিকে যাচ্ছে সমবেগে। ট্রেনের একদম মাঝখানে স্বাতী বসে আছে। ধর কোন একটা নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনটা একটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মটার দৈর্ঘ্য ট্রেনের সমান। আরো ধরা যাক প্ল্যাটফর্মের ঠিক মাঝখানে তুমি মৃত্তিকা দাঁড়িয়ে আছ। আর ট্রেনটার সামনের দিকটা ঠিক প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকের সমান। ঠিক সেই সময়ই মৃত্তিকার ঘড়ি অনুযায়ী দুটো বজ্রপাত হল যেটা কিনা ট্রেনের ঠিক সামনে ও ঠিক পেছনে প্ল্যাটফর্মটাকে ঝলসে দিল কালো দাগে। পেছনের দাগটা হল A আর সামনের দাগটা হল B। মৃত্তিকার কাছে এই বজ্রপাতদুটো একই সময়ে দেখা যাবে। কারণ A ও B বিন্দু দুটি তার থেকে সম দূরত্বের। কাজেই বজ্রপাতের ঝলকানি তার কাছে আলোর গতিবেগে যতটুকু সময় লাগে সেই সময়ের পরে যুগপৎ ভাবে এসে পৌঁছাবে। যদিও এই ঘটনাদুটো মৃত্তিকার কাছে যুগপৎ, কিন্তু স্বাতীর কাছে সে দুটি যুগপৎ নয়।’
আমি একটু দম নেই। স্বাতী আর মৃত্তিকাদুজনেই চুপ করে থাকে। এগুলো তাদের কাছে অজানা জিনিস না।
আমি আবার বলতে শুরু করি, ‘ধরা যাক স্বাতীর ট্রেনটা বেশ জোরে যাচ্ছে। তাহলে স্বাতী B’র ঘটনাটা আগে দেখবে, কারণ B’র ঘটনাটা বহন করে যে আলোক তরঙ্গ স্বাতীর দিকে আসছে তার ট্রেনও সেদিকে ছুটে যাচ্ছে। আর A থেকে যে আলোক তরঙ্গ আসছে সেটাকে আর একটু বেশী দূরত্ব পার হতে হচ্ছে। স্বাতী ভাববে B’র ঘটনাটা আগে ঘটেছে, অর্থাৎ বজ্রপাতটা সেখানে A’র আগেই ঘটেছে। এখন যেহেতু স্বাতীর ট্রেন সমবেগে যাচ্ছে, আপেক্ষিকতার একটা পস্টুলেট বা স্বীকার্য অনুযায়ী স্বাতীর কাঠামোটা হল একটা জাড্য কাঠামো, স্বাতীর পক্ষে কোন ধরনের পরীক্ষা করা সম্ভব নয় যা দিয়ে কিনা সে বুঝতে পারে সে দ্রুতগতিতে ভ্রমণ করছে এবং প্ল্যাটফর্মের কাঠামোয় A ও B’র ঘটনা যুগপৎ।’
চিত্র ২: স্বাতীর কাছে A ও B থেকে আলো ভিন্ন সময়ে এসে পৌঁছাবে। স্বাতী ভাববে B’র ঘটনা A’র আগে ঘটেছে। এই ধারনাটা স্বাতীর কাঠামোতে ঠিক, মৃত্তিকার কাঠামোতে নয়। মৃত্তিকা ভাববে স্বাতীর ট্রেনের গতিমুখের জন্য স্বাতী ভিন্ন ভিন্ন সময়ে A ও B’র ঘটনা দেখছে। দুটো ধারনাই সঠিক তাদের নিজের কাঠামোতে।
স্বাতী বলল, ‘কিন্তু আমার ফ্রেম যদি জাড্যই হয় আমার কি ঐ দুটো ঘটনা, অর্থাৎ A ও B’র ঘটনা একসাথে দেখার কথা নয়?
আমি বললাম, ‘তুমি দুটো ঘটনা একসাথে দেখতে যদি ঐ আলো তোমার ট্রেনের দুপাশ থেকে নির্গত হত। অর্থাৎ মনে করে ট্রেনের দুপাশে দুটো টর্চ বাতি বা লেজার আছে। সে দুটো বাতি ট্রেনের সাথেই ভ্রমণ করছে। সেই দুটো যদি একই সময়ে জ্বলে উঠত তাহলে তুমি একই সময়ে ঐ দুটো ঘটনা দেখতে। সেইক্ষেত্রে সে দুটো যুগপৎ হত। কিন্তু বজ্রপাত দুটো তোমার ট্রেনের সাথে ভ্রমণ করছিল না, তাদের উৎস ট্রেনের বাইরে, তাই জন্য তুমি তাদের একসাথে দেখবে না।’
মৃত্তিকা বলল, ‘কিন্তু বজ্রপাতের ক্ষেত্রে, আমি প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দেখব যে স্বাতীর কাছে A ও B থেকে আলো বিভিন্ন সময়ে পৌঁছেছে। B’র আলো আগে পৌঁছাবে, A’র আলো পরে। কিন্তু এই ঘটনাটার ব্যাপারে আমাদের উপসংহার ভিন্ন হবে। আমি যেখানে বলব, A’র থেকে আগত আলোকে বেশী পরিমাণ পথ যেতে হয়েছে বলে স্বাতী A’র ঘটনাটা পরে দেখছে, স্বাতী বলবে আসলে A’র ঘটনাটা পরে ঘটেছে বলে সে সেটা পরে দেখছে। এখানে কারুর ধারনাই বেঠিক নয়। দুটো ধারনাই দুজনের কাঠামোতে আলাদা আলাদা ভাবে ঠিক। কারণ প্রতিটি জাড্য ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়ম একই ভাবে সংঘঠিত হবার কথা। আইনস্টাইন যখন তার বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব রচনা করেন তিনি দুটি মৌলিক স্বীকার্য, যার ইংরেজি হচ্ছে postulate, তার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেন। এর প্রথমটি হচ্ছে, সমস্ত জাড্য কাঠামোতে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী একই থাকবে।’
‘তাহলে জাড্য কাঠামোর সংজ্ঞাটাও দিয়ে দাও,’ আমি বলি।
‘আমি যেরকম বুঝি সেভাবেই বলছি,’ মৃত্তিকা বলে, ‘জাড্য বা জড়ত্বীয় কাঠামোতে দেশ (স্থান) ও কাল (সময়) সমসত্ত্ব হবে, অর্থাৎ দেশ ও কাল একই ভাবে বইবে ও দিক-নির্ভর হবে না। আর প্রতিটি জাড্য কাঠামো অন্য একটি জাড্য কাঠামোর অনুপাতে ত্বরণশীল হবে না, অর্থাৎ একটি কাঠামো অন্য কাঠামোর তুলনায় একই গতিবেগে চলবে। আর যেই কাঠামোতে ত্বরণ নেই, সেই কাঠামোর মধ্যে বসে সেই কাঠামো যে গতিশীল সেটা কোনভাবেই বোঝা যাবে না।’
‘তুমি বলছ আমি যদি একটা বদ্ধ ঘরে থাকি আর ঘরটা যদি সম গতিতে ভ্রমণ করে আমি কোন ধরণের পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারব না যে আমার ঘরটা ভ্রমণ করছে।’
‘না, কারণ স্থির থাকা আর সমগতিতে ভ্রমণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। দুটো কাঠামোতেই পদার্থবিদ্যার নিয়মগুলো একই ভাবে খাটবে। যদি না খাটে তাহলে তো সমূহ বিপদ।’
‘তা বটে,’ আমি স্বীকার করলাম।
কিন্তু পাঠক জাড্য কাঠামো অনুযায়ী আমি যদি একটা বদ্ধ ঘরে থাকি আর ঘরটা যদি সম গতিতে ভ্রমণ করে আমি কোন ধরণের পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে পারব না যে আমার ঘরটা ভ্রমণ করছে। কিন্তু সকল বস্তু অন্য বস্তুর সাপেক্ষে স্থির বা গতিশীল । পরম গতি বা পরম স্তিথি বলে কিছু নেই । তাহলে এর যৌক্তিকতা কতটুকু !!
উপসংহার
এটিকে অদ্ভুতভাবে নেবেন না । এটি পদার্থবিজ্ঞানের খুব সহজ বিষয় । টিউন সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও আমার প্রস্নের উত্তর নিয়ে আপনাদের কথাও জানতে চাই ।
আমি আছি > http://www.facebook.com/techfreak.unknown
প্রযুক্তি পাতা > http://www.facebook.com/cy133r
আল্লাহ হাফেয
প্রাপ্তি স্বীকার > বিজ্ঞান ব্লগ , দিপেন ভট্টাচার্য , আপেক্ষিকতা তত্ত্ব বই, অধ্যাপক রঞ্জন
আমি রাশেদ রাহুল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 53 টি টিউন ও 50 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
এটা জানতাম আগেই। প্রথম যখন এটা জানি তখন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল, আসলে একটু চিন্তা করলেই বিষয়টা বুঝে ফেলা যায়।
যাই হোক, টিউনার রাশেদ ভাইকে ধন্যবাদ। এইরকম বিজ্ঞানসম্মত টিউন আরো আশা করি! 🙂