বাংলাদেশের অনেক জায়গায় বিশেষ করে চাদপুর ,দিনাজপুর ও চট্টগ্রামের অনেক জায়গায় সাউদী আরবের সাথে মিলিয়ে রমজান মাস শুরু এবং ঈদ পালন করে থাকে।এতে কিছুটা ভুল-বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।আসুন দেখি কুরআন ও হাদীস এ এই সম্পর্কে কি ব্যাখ্যা আছে।সহীহ মুসলিমে বলা আছে,
প্রত্যেক দেশের জন্য চাঁদ দেখা জরুরী, আর যখন মুসলিমগণ এক দেশে চাঁদ দেখবে তা হতে দূর দেশের জন্য সে হুকুম সাব্যস্ত হবে না।
উক্ত অধ্যায়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) হাদীস বর্ণনা করেছেনঃ
কুরাইব তাবেঈ বলেছেন, যে হারিসের কন্যা (লুবা-বা) তাকে শাম প্রদেশে সম্রাট মুআবিয়ার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর আমি শামে এসে তাঁর প্রয়োজন সমাপন করলাম এবং আমার শামে থাকা অবস্থায় রামাযানের নতুন চাঁদ উদয় হল এবং আমি বৃহস্পতিবারের দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখলাম, তারপর মদীনা আসলাম; অতঃপর আমাকে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) জিজ্ঞেসা করলেন যে, তোমরা (রামাযানের) চাঁদ কবে দেখেছ? আমি বললাম, জুমুআ রাত্রিতে; পুনরায় বললেন যে, তুমি নিজে দেখেছ? আমি বললাম, জি হ্যাঁ এবং অন্যান্য লোকেও দেখেছে এবং মুআবিয়া ও শামবাসীরা রোযা রেখেছেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, আমরা কিন্তু শুক্রবারের দিবাগত সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছি, অতএব আমরা রোযা রাখতেই থাকব। ৩০-এ পর্যন্ত কিংবা ৩০শের পূর্বে ২৯শে চাঁদ দেখা পর্যন্ত। আমি বললাম, আপনি কি মুআবিয়ার চাঁদ দেখা ও তাঁর রোযা রাখার উপর নির্ভর করতঃ রোযা ও ঈদ করবেন না? ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেন, না; এটাই আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আদেশ দিয়েছেন যে আমরা আপন দেশের লোকের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর করব; অন্যান্য দূর দেশবাসীদের চাঁদ দেখাকে আমরা যথেষ্ট মান্য করব না।"
যেমন শাইখ আবুল হাসান সিন্ধি হানাফী নাসায়ীর টীকায় বলেনঃ
"আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে দেশবাসীদের চাঁদ দেখার উপন নির্ভর করতে এবং অন্যান্য দেশবাসীদের চাঁদ দেখার উপর নির্ভর না করা। "(নাসায়ী ১ম খন্ডঃ ৩০১ পৃঃ)
খতীব হিন্দ শাইখ মুহাম্মাদ মুহাম্মাদী উক্ত হাদীসের সারমর্মে এ বিষয়ে বলেনঃ
"অর্থাঃ শামবাসীদের চাঁদ দেখা হিজাযবাসীদের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এটাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর আদেশ এবং শরী'আতের বিধান।"
জগদ্বিখ্যাত হাদীসের কিতাব জামে আত্-তিরমিযীর লেখক ইমাম আবূ ঈসা (রহ.) বলেনঃ
প্রত্যেক দেশবাসীদের জন্য চাঁদ দেখা বিষয়টি উক্ত অধ্যায়ে উপরোল্লিখিত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হাদীস বর্ণনা করার পর বলেছেনঃ
এই হাদীসের প্রতি বিদ্বানগণের 'আমল আছে যে, আপন আপন দেশে চাঁদ দেখার পর রোযা ও ঈদ করা উচিত। (তিরমিযী ১ম খন্ডঃ ৯১ পৃষ্ঠা)
পঞ্চম শতকের স্বনামখ্যাত ইমাম মুজতাহিদ হাফিয ইবনে আবদুল বার (রহঃ) বলেনঃ
(পঞ্চম শতকের পূর্বের) মুসলিম মনীষীগণ ঐকমত্য পোষণ করেন যে, এক দেশের চাঁদে উদয় তা হতে দূর দেশেরও জন্য সর্বব্যাপী হবে না যেমন খোরাসান ও স্পেন।
এখানে কতগুলি লোক যাদের হাদীসের প্রতে আমাল করতে ইচ্ছা নয় তারা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে, তোমরা চাঁদ দেখে রোযা কর। যে কোন স্থানে একজন চাঁদ দেখলেই সকল মুসলিমকে মান্য করতঃ 'আমল করতে হবে।
আর ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর শামবাসীদের চাঁদ দেখা অমান্য করা এজন্য ছিল যে, সংবাদ দাতা কুরাইব একাকী বলে তার স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেননি তা নয় বরং এজন্য যে, এক দেশের চাঁদ আর এক দেশের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রথম কথা (যে কোন স্থানে কোন মুসলিম চাঁদ দেখলে সকলকে সেই অনুযায়ী 'আমল করতে হবে) যদি মান্য করা যায় তবে যাবতীয় হাদীস ও সাহাবা তাবেঈনও মুসলিমদের ঐকমত্যকে ছিন্ন করে এক নতুন ধর্ম গঠন করতে হয়।
প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ডাঃ জাকির নায়েক একটি সাক্ষাতকার নিচে দেয়া হল যাতে উনি এই সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন।
প্রশ্নঃ ইসলামি মাস কিভাবে শুরু হয়?
উত্তরঃ ডাঃ জাকির নায়েকঃ ইসলামি মাস শুরু হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনে পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন,
“তোমার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও যে এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম”
[সূরা বাকারা আয়াত ১৮৯]
মুহাম্মাদ (সাঃ) একাধিক সহীহ হাদীসে এ ব্যাপারে বলেছেন, যেমন- “আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, "যখন তোমরা নতুন চাঁদ দেখ তখন রোযা রাখ এবং যখন শাওয়াল চাঁদ দেখ তখন রোযা ভেঙ্গে ফেল আর যদি আকাশ মেঘাছন্ন থাকার কারণে চাঁদ দেখা না যায় তবে রমযানের ত্রিশ দিন পূর্ণ করো একইভাবে শাবানেরও”"
[বুখারী, অধ্যায় রোযা, হাদীস নং ১৯০৯]
আয়েশা (রা) বলেন, "মুহাম্মাদ (সা) শাবানের মাসের দিন গণনার ক্ষেত্রে অতিশয় সাবধানতা অবলম্বন করতেন এবং তিনি যখনই নতুন চাঁদ দেখতে পেতেন তখন রোযা শুরু করতেন। আর যদি নতুন চাঁদ না দেখতে পেতেন তাহলে শাবান মাসের ত্রিশ দিন পূর্ণ করে রোযা রাখতেন"
[আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩১৮]
সুতরাং তিনি নির্দিষ্টভাবে বলেন নি যে, কখন রমজান শুরু হয়। চাঁদের প্রত্যক্ষদর্শী সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে যে, "যখন দুইজন মুসলিম চাঁদ দেখবে তখন রোযা ভেঙ্গে ফেল অথবা রাখ"
[নাসাঈ, হাদীস নং ২১১৮]
অর্থাৎ চাঁদ উঠেছে কিনা তা জানার জন্য দুইজন মুসলিম প্রত্যক্ষদর্শী প্রয়োজন।
কিছু আলেম বলেন যে, রোযা শুরু করার জন্য একজন প্রত্যক্ষদর্শীই যথেষ্ট।
কারণ হাদীসে আছে, "“আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) বলেন, যখন লোকজান রমজানের নতুন চাঁদ দেখার চেষ্টা করেছিলো তখন আমি মুহাম্মাদ (সা) বললাম, আমি নতুন চাঁদ দেখেছি, তখন তিনি রোযা আরম্ভ করলেন এবং সকলকে রোযার জন্য নির্দেশ দিলেন”"
[আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৩৫]
সুতরাং অধিকাংশ আলেম বলেন যে রোযা রাখার জন্য একজন দর্শক হলেই চলবে তবে রোযা ভঙ্গ করার জন্য দুইজন দর্শক প্রয়োজন।
প্রশ্নঃ পৃথিবীতে মুসলমানরা সকলে একই দিনে রোযা রাখা, ইদুল ফিতর এবং ইদুল আযহা পালন করার ব্যাপারে একতাবদ্ধ নয় কেন?
উত্তরঃ ডাঃ জাকির নায়েকঃ এই ব্যাপারে আলিমদের মধ্যে মতভেদ আছে। একদল বলেন, সারা বিশ্বের মুসলমানদের মক্কার সময় অনুসরণ করা উচিত। অন্য দলের আলেমগণ বলেন, এই সময়টি বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় সময়ে হওয়া উচিৎ।
আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেছেন,
“রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর”"
[বাকারা আয়াত ১৮৫]
মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, "“তোমরা যখন নতুন চাঁদ দেখ তখন রোযা রাখ এবং নতুন চাঁদ দেখলে রোযা ভেঙ্গে ফেল"
[বুখারী, হাদীস নং ১৯০৭ ও ১৯০৯]
সুতরাং এই হাদীসটির উপর ভিত্তি করে ইবনে তাইমিয়াহ (রহ) বলেন যে, সারা বিশ্বের সব জায়গা থেকে একই দিনে রমজানের চাঁদ দেখা অসম্ভব। সুতুরাং মক্কার সময়টি সারা বিশ্বে একযোগে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
"মুহাম্মাদ (সাঃ) আরো বলেছেন, “ঐ দিন রোযা আরম্ভ হবে যেদিন সকলে রোযা রাখবে, রোযা ভাঙ্গতে হবে ঐ দিন যেদিন সবাই রোযা ভাঙ্গে আর কুরবানি করতে হবে ঐ দিন যে দিন সকলে কুরবানী করে"
[তিরমিযী, হাদীস নং ৬৯৭]
কুরআনে বলা হয়েছে যে,
"আর পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোযা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত"
[বাকারাঃ ১৮৭]
কিন্তু সূর্যদয় সারা বিশ্বে একই সময়ে হয় না বরং একেক দেশে একেক সময়ে হয়। সুতরাং রোযা পালনে স্থানীয় সময় অনুসরণ করতে হবে।
প্রশ্নঃ যে শহরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে রমযান এবং ঈদ পালন করা হয় সেই শহরের লোকদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী ?
উত্তরঃ ডাঃ জাকির নায়েকঃ এই ব্যাপারে হাদীসে পরিস্কার বলা হয়েছে।
যেমন,
"ঐ দিন রোযা আরম্ভ হবে যেদিন সকলে রোযা রাখবে, রোযা ভাঙ্গতে হবে ঐ দিন যেদিন সবাই রোযা ভাঙ্গে আর কুরবানি করতে হবে ঐ দিন যে দিন সকলে কুরবানী করে”"
[তিরমিযী, হাদীস নং ৬৯৭]
সুতরাং একই শহরের লোকদের একই সাথে রোযা এবং ঈদ পালন করা উচিৎ।
কারণ এমন কোন বড় শহর নেই যেখানে একই দিনে চাঁদ দেখতে পাওয়া যায়না। সুতরাং তাদের এক সাথে রোযা পালন করা উচিৎ।
অতএব হাদীস অনুসারে চাদ দেখে রোজা এবং ঈদ পালন সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।
[লেখাগুলো বিভিন্ন বাংলা ব্লগ এর বিভিন্ন পোস্টথেকে সংকলিত করা হয়েছে]
আমি নিশাচর নাইম। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 8 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 47 টি টিউন ও 1182 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
তেমন কিছু জানি না, কিছু জানলে তা অন্যদের শিখানোর চেষ্টা করি যতটুকু সম্ভব।জ্ঞান নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়াই প্রকৃত সার্থকতা।
ভালো হয়েছে ।