আসসালামু আলাইকুম। আপনারা সকলে কেমন আছেন? আশা করছি আপনারা সকলেই আল্লাহর রহমতে অনেক বেশি ভালো আছেন। প্রতিদিনের মত আপনাদের জন্যও নতুন নতুন টিউন নিয়ে আসার ধারাবাহিকতায় আজও নিয়ে এসেছি আপনাদের জন্য নতুন একটি টিউন।
বর্তমানে আমরা সকলেই স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি। যেখানে আমরা অনেকেই মনে করি যে, আমাদের হাতে থাকায় স্মার্টফোনটি আমাদের জন্য ক্যান্সার সৃষ্টি করার জন্য দায়ী হতে পারে। আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোনটি আমাদের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করার জন্য দায়ী কিনা, এটির দাবি করা মোটেও অমূলক নয়। আমরা এমন একটি ডিভাইস ব্যবহার করছি, যেটি অনবরত রেডিয়েশন নির্গত করে যাচ্ছে। যেখানে এই রেডিয়েশন থেকে কি সত্যিই আমাদের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে?
আমাদের ব্যবহার করা এই স্মার্টফোন থেকে আমাদের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হতে পারে ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন। ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন আমাদের জন্য ক্যান্সার সৃষ্টি করার জন্য দায়ী হলে প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে এই রেডিয়েশন টি আসলে কি। রেডিয়েশন হচ্ছে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ; যা একই স্থান থেকে অন্য স্থানে আলোর গতিতে শক্তি পরিবহন করে। খুব সহজভাবে বলতে গেলে রেডিয়েশন হচ্ছে একটি আলো, যার নির্দিষ্ট একটি পরিসর আমরা দেখতে পাই। রেডিয়েশন কতটা শক্তিশালী, এটির উপর ভিত্তি করে রেডিয়েশন কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
দুই ধরনের রেডিয়েশন এর মধ্যে যথাঃ Non-ionizing radiation এবং Ionizing radiation। Non-ionizing radiation এরমধ্যে Radio waves এবং Microwave। অন্য Ionizing radiation এর মধ্যে যেমনঃ Gamma rays, X-ray ইত্যাদি। যে সকল রেডিয়েশনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশি অর্থাৎ, ফ্রিকুয়েন্সি কম; তারা কম শক্তি সম্পন্ন। এই ধরনের রেডিয়েশন যখন পরমাণু কে আঘাত করে, তখন কম শক্তি সম্পন্ন হওয়ায় পরমাণুর ইলেকট্রন কে স্থানচ্যুত করতে পারেনা এবং এই জন্য এদেরকে Non-ionizing radiation রেডিয়েশন বলে।
Non-ionizing radiation মানুষ কিংবা অন্য কোন প্রাণীর কোষের রাসায়নিক বন্ধন ভাঙতে পারে না। যার কারণে এই রেডিয়েশন মানব শরীর এবং অন্যান্য প্রাণীর ডিএনএ ও ভাঙতে পারে না। সুতরাং এই ধরনের রেডিয়েশন থেকে মানুষের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এছাড়া এই ধরনের রেডিয়েশন মানুষ ব্যতীত অন্যান্য সকল প্রাণীর ওপর প্রভাব না থাকায় এটি তাদের ওপরও কার্যকর নয়। যে কারণে এই Non-ionizing radiation কে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
অন্যদিকে যেসব রেডিয়েশনের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম, অর্থাৎ, ফ্রিকুয়েন্সি বেশি; তারা বেশি পরিমাণে শক্তি বহন করে। এই ধরনের রেডিয়েশন যখন পরমাণুতে আঘাত করে তখন শক্তি বেশি থাকায়, এই রেডিয়েশন পরমাণুর ইলেকট্রন কে স্থানচ্যুত করে ফেলতে পারে। আর এজন্য এই ধরনের রেডিয়েশন কে Ionizing radiation বলে। এই ধরনের High-energy সম্পূর্ণ রেডিয়েশন কোন কোষের রাসায়নিক বন্ধন কে ভেঙে ফেলতে পারে এবং সেই সঙ্গে এটি কোষের ডিএনএ কে ভেঙে ফেলতে পারে।
এই উচ্চশক্তিসম্পন্ন রেডিয়েশন কোষের ডিএনএ কে ভেঙে ফেলার কারণে এটি ক্যান্সার সৃষ্টি করার জন্য অন্যতম কারণ। সুতরাং যত তীব্র রেডিয়েশন হোক না কেন, যদি তা কোষের ডিএনএ কে নষ্ট করতে না পারে তবে এটি ক্যান্সার সৃষ্টি করার জন্য দায়ী হবে না। এর মধ্যে যেমন মাইক্রোওভেন। মাইক্রোওভেনের মধ্যে খুব বেশি পরিমাণে রেডিয়েশন নির্গত হয়; কিন্তু এখানে ফ্রিকুয়েন্সি অনেক কম বলে, এর শক্তি কম। এর ফলে মাইক্রোওভেনের মাইক্রোওয়েভ পরমাণুকে বিচ্যুত করতে পারে না। এতে করে বোঝা যায়, যে রেডিয়েশন এর ফ্রিকোয়েন্সি যত বেশি, সেই রেডিয়েশনের শক্তি ততবেশি।
এ বিষয়ে আপনারা হয়তোবা একটি কথা শুনতে পেয়েছেন। অনেকে বলে থাকে যে ফাইভ-জি প্রযুক্তি মানুষের শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে বা ফাইভ-জি প্রযুক্তি মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এখানে ফাইভ-জি প্রযুক্তিকে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলার কারণ আসলে কি? ফাইভ-জি প্রযুক্তিকে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর বলার একমাত্র কারণ হচ্ছে এর ফ্রিকোয়েন্সি। ফাইভ-জি প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে অবশ্যই সেই টাওয়ার থেকে অধিক পরিমাণে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রাম ব্যবহার করা হয় এবং যে কারণে ততই স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে।
Non-ionizing radiation এবং Ionizing radiation এর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে দৃশ্যমান আলো এবং অদৃশ্যমান আলো। এখানে Ionizing radiation রেডিয়েশন হচ্ছে দৃশ্যমান আলো এবং Non-ionizing radiation হচ্ছে অদৃশ্যমান আলো। দৃশ্যমান তরঙ্গের ফ্রিকুয়েন্সি থেকে অদৃশ্যমান বা Radio তরঙ্গের ফ্রিকুয়েন্সি অনেক কম। আমাদের মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন হচ্ছে Radio waves। সকালবেলা আমরা যে সূর্যের আলো মিষ্টি অনুভব করি এবং দুপুরবেলা আমরা যে সূর্যের আলোকে বিরক্তিকর অনুভব করি, তার চাইতেও মোবাইলে ব্যবহৃত রেডিও ওয়েভ এর শক্তি কম।
সুতরাং মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশনের কারণে ক্যান্সার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তারপরেও মোবাইল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ডাক্তার এবং বিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেছে। মোবাইল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ক্যান্সার সৃষ্টি নিয়ে এ বিষয়ে তারা অনেক গবেষণা করেছে। প্রথমদিকের গবেষণা দেখলে এমনটা মনে হতে পারে যে, মোবাইল ব্যবহার করার জন্য ক্যান্সার সৃষ্টিতে একটি হাত রয়েছে। যেমন হবে ইউকে তে একটি গবেষণা হয়েছিল ১০ লক্ষ মানুষের উপর।
যেসব মানুষেরা এক ধরনের টিউমার, যেটিকে Acoustic Neuroma বলে; এটি সৃষ্টির জন্য মোবাইল ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেছিল। যেটি মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি করে। এর ফলে পরবর্তীতে এই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সাত বছর পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল; এটি জানার জন্য যে, মোবাইল ব্যবহার করার সাথে টিউমার সৃষ্টির কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা। যদি মোবাইল ব্যবহার করার ফলে টিউমারের সংখ্যা বেড়ে যেত, তবে অবশ্যই Acoustic Neuroma রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যেত। কিন্তু দেখা গেল যে Acoustic Neuroma রোগীর সংখ্যা বাড়েনি।
এই একই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আরো বড় পরিসরে গবেষণা করা হয় এবং তারা মোবাইল ব্যবহার করার জন্য Acoustic Neuroma এর সূত্র পায়নি। এর পরবর্তীতে গবেষণা করেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তারা গবেষণার পর এটা বলেছিল যে, নিয়মিত মোবাইল ব্যবহার করলে এই টিউমার হবার সম্ভাবনা ১০ শতাংশ বেড়ে যায়। এই Glioma হলো এক ধরনের স্নায়ু কোষ, যার ফলে Malignant brain cancer হয়। কিন্তু এই গবেষণার ও একটি দুর্বল দিক বা ত্রুটি রয়েছে।
তারা এই গবেষণা করার ক্ষেত্রে মানুষের থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে। সে কারণে প্রকৃত তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। এক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষ যদি কতগুলো ব্যক্তির উপর লক্ষ্য করতো, যে কোন ব্যক্তি কতক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করছে এবং সর্বশেষ কতজন আর মধ্যে Glioma সৃষ্টি হয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে সেই গবেষণার ফলাফল করার যোগ্য হতে পারত। অন্য আরেকটি কারণ হচ্ছে Glioma খুবই দুর্লভ একটি ব্রেইন ক্যান্সার। যেটি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে তিনজনার হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
যে কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা একটি শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৮০ সাল থেকে মোবাইল ফোন উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় এবং সে সময় থেকেই মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে। বর্তমানে প্রায় ৫০০ কোটি মানুষ মোবাইল ব্যবহার করে। যদি মোবাইল ফোন ব্যবহারে মানুষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা থাকতো, তবে ১৯৮০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মত বেড়ে যেত। কিন্তু বাস্তবে এটি হয়নি। বরং, মোবাইল ব্যবহার করার পর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় স্বাভাবিক এর মতই রয়েছে।
তবে এই বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে দিলে চলবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার করার ফলে মানুষের ক্যান্সার সৃষ্টি হয় কিনা বা মানুষের মস্তিষ্কের ব্রেইন টিউমার হবার সম্ভাবনা আছে কিনা এটি নিয়ে গবেষণার ফলাফল যদি এলোমেলো ও প্রকাশ পায় তবে এটিকে আমাদের উড়িয়ে দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ, এই বিষয়টি আমাদেরকে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। মোবাইল থেকে নির্গত রেডিয়েশন আমাদের শরীরের জন্য যদি ক্ষতি না হতো, তবে এটি নিয়ে তবে এত মাতামাতি হয়তোবা হতো না। আমাদের মোবাইল থেকে নির্গত রেডিয়েশনের আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ না হলেও, এটি আমাদের শরীরের জন্য কিছুটা হলেও ক্ষতিকর।
যদি এই রেডিয়েশন আমাদের শরীরের জন্য কোন ক্ষতির কারণ না হতো, তবে এটি নিয়ে বারবার এতটা গবেষণা করার দরকার পড়তো না। যদিও কিছু গবেষণার ফলাফল বলে, মোবাইল কানের কাছে নিয়ে অতিরিক্ত কারো সঙ্গে কথা বলবে সেই ব্যক্তির ব্রেন টিউমার হয়ে যাবার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এছাড়া মোবাইলের চার্জ যখন কমে যায়, তখন মোবাইল থেকে অনেক বেশি পরিমাণে রেডিয়েশন নির্গত হয় যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ১০০০ গুন বেশী। তাই, মোবাইলে যখন চার্জ কমে যায় তখন মোবাইলে কল না রিসিভ করায় অনেক ভালো। মোবাইল থেকে নির্গত রেডিয়েশনের আমাদের মানব শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ কিনা এটির ব্যাপারে আমি নিশ্চিত করে কোন কিছু বলতে পারব না।
মোবাইল থেকে নির্গত রেডিয়েশনের ব্যাপারে বলতে হলে আমাকে অবশ্যই বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দিকে লক্ষ্য করতে হবে। আর প্রত্যেকটি গবেষণার ফলাফল একেক সময়ে ভিন্নও হতে পারে। যখন পর্যন্ত না এটি চূড়ান্ত গবেষণা ফলাফল দাঁড় করানো যাচ্ছে মোবাইল থেকে নির্গত রেডিয়েশনের ব্যাপারে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই বিষয়টি ধোঁয়াশা ই থেকে যাবে। এখানে উপরে আমি আমার কিছু কথা বলেছি। যদি টিউনটির মাঝে কোথাও ভুল হয়ে থাকে তবে অবশ্যই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন এবং সেইসঙ্গে আমাকেও বিষয়টি জানিয়ে দিবেন।
আশা করছি মোবাইল রেডিয়েশন সম্পর্কিত আজকের এই টিউনটি আপনার কাছে অনেক বেশি ভালো লেগেছে। আপনি আপনার বন্ধুদেরকে এই বিষয়ে সতর্ক করার জন্য তাদের কাছে এই টিউনটি শেয়ার করতে পারেন। এছাড়া আপনার কোন মতামত থাকলে নিচের টিউনমেন্ট বক্সে টিউনমেন্ট করতে পারেন। আগামীর কোন নতুন টিউন দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম।
আমি মো আতিকুর ইসলাম। কন্টেন্ট রাইটার, টেল টেক আইটি, গাইবান্ধা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 4 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 421 টি টিউন ও 93 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 62 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 3 টিউনারকে ফলো করি।
“আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ছেড়ে দিবে, আল্লাহ্ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু অবশ্যই দান করবেন।” —হযরত মোহাম্মদ (সঃ)