মার্ক টোয়েনের সেই বিখ্যাত উক্তিটি দিয়ে শুরু করি?
“সিগারেট ছেড়ে দেয়া একদম সহজ। আমি তো হাজারবার ছেড়েছি”।
.
.
সিগারেট হল সেই মারাত্মক ব্যাধি যা অমিত সম্ভাবনাকে আমাদের অজান্তে আমাদের পঙ্গু করে দিচ্ছে চিরতরে। শেষ করে দিচ্ছে একটি সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যতের দৃপ্ত পথচলার।
ধূমপানঃ যেভাবে শুরু হয়-
শারীরিক ও মানসিক কারনঃ
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্ট্রেস থেকে মুক্তির জন্য মানুষ সিগারেট ট্রাই করে দেখে, কিন্তু পরে আর ছাড়তে চায় না । বলা যায় ছাড়তে পারে না।
- “আমার সব দুশ্চিন্তাকে একদম বাতাসে উড়িয়ে দিলাম”- ভাবনাটা যুগে যুগে সিগারেট খাওয়ার প্রসারে একটি বড় কারন।
- অনেকের কাছে সিগারেট খেলে ‘রিলাক্সড’ মুড আসে। আমার এক খালুকে দেখতাম অফিস থেকে ফিরে কম্পিউটার নিয়ে ইমেইল-এ বসার সময় সিগারেট না খেলে তার হতোই না।
- তীব্র শোক, যা মানুষকে একদম ভেতর থেকে আঘাত করে, এই শোক ভুলতে আমরা নিজেকে কষ্ট দিয়ে হালকা হতে চেয়ে সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ি।
- শুধুমাত্র মজা হিসেবে মানুষ সিগারেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। অনেকে দেখা যায় দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার পর একটা সিগারেট খেলে ‘ভাল’ বোধ করতে থাকে। এটা যতটা না শারীরিক তার চেয়ে বেশি মানসিক।
- নিজেকে উৎসাহিত করার জন্য স্মোকাররা সিগারেট নিয়ে থাকে। যেমন, আমরা অনেকে সিগারেটকে একটা পুরষ্কার হিসেবে দেখে থাকি। “হ্যা, এই কাজটা করে নেই, এর পরেই একটা সিগারেট খাব, সব ঝামেলার চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়ে যাবে”- এই ভাবনাই বলে দেয় পুরষ্কার হিসেবে সিগারেট স্মোকারদের কতটা প্রিয়।
- সময় কাটানোর জন্য একাকীত্বের সঙ্গী হিসেবে সিগারেট একটা বিরাট ভূমিকা পালন করে স্মোকারদের কাছে। কারো জন্য কিছু না করে আধ-ঘন্টা অপেক্ষা করা বোরিং মনে হতে পারে, কিন্তু সিগারেট ধরিয়ে নিলেই যেন মনে হয় সময় একদম দ্রুত কেটে যাচ্ছে। এমনকি, সিগারেট এখন এতটাই সময়ের করেস্পন্ডেন্ট যে অনেকে বলেন, “এই রাস্তা দিয়ে হেটে যাও, তিনটা সিগারেট শেষ হতে হতেই তুমি পোস্ট অফিসে পৌছে যাবে!”
- অনেকে আবার সিগারেট সাথে থাকলে নিজেকে একা মনে করেন না, সিগারেটকে সাথীর মত মনে করেন।
- অনেকে ধোঁয়ার খেলা দেখতে পছন্দ করেন, সিগারেটের ধোঁয়া দিয়ে রিং বানিয়ে অন্যদের মজা দিতে চান। এতে করে যে নিজের ও দর্শক দুজনেরই বিরাট ক্ষতি হচ্ছে সেসময় সেই জ্ঞান থাকে না।
- “দিনে কয়টা?”- সম্ভবত স্মোকারদের মধ্যে সবচাইতে জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন। যার যত বেশি, সে তত বেশি অন্যদের চেয়ে ‘বেশি আসক্ত’ বোঝাতে ব্যবহার হয়। এবং এখানে ‘বেশি আসক্ত’ ব্যাপারটি বেশ কেউকেটা কিছু একটা বোঝাতে ব্যবহার হয়।
- ব্র্যান্ডিং একটা বিরাট ব্যাপার। যার বেশি টাকা, সে বেশি দামী সিগারেট খাচ্ছে এতে তার বিত্ত ও ক্ষমতার একটা প্রকাশ হচ্ছে পরোক্ষভাবে। একারনে অনেকে শুধুমাত্র অন্যদের সামনেই সিগারেট খায় ‘আলাদা ভাব’ প্রকাশ করার জন্য।
সামাজিক কারনঃ
- টিনেজারদের মধ্যে সিগারেট আসে নিজেকে ‘বড় হয়ে গিয়েছি’ নামক পর্দায় আড়াল করার ইচ্ছায়।
- ‘নতুন এক্সপেরিয়েন্স’ কিংবা ‘আমার প্রথম সিগারেট’ এই এডভেঞ্চারের স্বাদ নিতে।
- টিভিতে মুভি, ড্রামা, ভিডিও সং ইত্যাদিতে নায়ক নায়িকাকে স্মোক করতে দেখে নিজে উৎসাহিত হয়ে।
সিগারেটের বিস্তারঃ
সিগারেট কাউকে একদিনে ধবংস করে দেয় না। বয়স হবার সাথে সাথে ধীরে ধীরে এর কুফল দেখা দিতে থাকে। আমার দাদীর ছোট ভাই, অর্থাৎ আমার দাদা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি প্রচুর ধুমপান করতেন। শেষ বয়সে তিনি অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২ বছর আগে। উনি অতিরিক্ত ধূমপানে এমন অবস্থা করেছিলেন নিজের, যে, প্রায় প্রতিদিন তাকে একঘন্টা অক্ষিজেন দিতে হত। তা না হলে তিনি শ্বাস নিতে পারতেন না ও প্রচন্ড কাশতেন। তিনি শীতের সময় ঘরের বাইরে বের হতে পারতেন না। আমার বাবা ডাক্তার, প্রায়ই তাঁকে দেখতে যেতেন আর একটা কথা দাদা বলতেন নিজেই- “সিগারেট খেয়ে নিজের চরম সর্বনাশ করছি, বাবা”। কিন্তু কারো কিছু করার ছিল না। সিগারেটের প্রতি আমার সে-সময় প্রচন্ড ঘৃনা ছিল। তিনি মাত্র ৬৫ বছর বয়সে মারা গেলেও আমার দাদী উনার চেয়ে ৪ বছরের বড় হয়েও দিব্যি সুস্থ আছেন।
প্রতিবছর প্রায় প্রায় ৫.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট তৈরি করা হয় (1), আর প্রায় ১.১ বিলিয়ন মানুষ সিগারেট খায়। এর মধ্যে প্রতি ১০০ জনেঃ
1. এশিয়ায় প্রায় শতকরা ৪৪ভাগ পুরুষ ও ৪ ভাগ মহিলা সিগারেট খান।
2. ইউরোপে নারীদের স্মোকিং-এর হার বেশি, প্রায় শতকরা ৪৬ভাগ পুরুষ ও ২৬ ভাগ মহিলা,
3. আমেরিকায় এটি প্রায় ৩৫ ও ২২ ভাগ।
4. কিন্তু পশ্চিম মহাসাগরীয় অঞ্চলে সিগারেট মহামারির মত প্রায় ৬০ ভাগ পুরুষ ও ৮ ভাগ নারীর হাতে চলে গিয়েছে।
কিছু নামকরা ব্রান্ডের সিগারেট হলঃ
পরিবেশের উপর প্রভাবঃ
উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, সিগারেটের ফিল্টার যা আমরা ফেলে দেই, তা হল সেলুলোজ এসিটেট যা পঁচে যায়, কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ যা একমাস থেকে তিন বছর এমনকি ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। (2)
সিগারেট এমন একটি Dynamic Environment Pollutant, যা শুধু কনসিউমারকেই নয়, আশেপাশে অবস্থিত সকল নন-স্মোকারকেও আক্রান্ত করে। তবে ভয়াবহ ব্যাপারটি হল, এই আক্রমনের মাত্রা স্মোকারদের চেয়েও নন স্মোকারদের উপর বেশি।
২০০৬ সালে International Coastal Cleanup সংগঠনটি জানায় তাদের পরিষ্কার করা আবর্জনার প্রায় ২৪.৭% হল সিগারেটের ‘বাট’ যা আমরা ফেলে দেই এবং এটি অন্য যেকোন ক্যাটাগরির আবর্জনার চেয়ে একক ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি। (3)
সিগারেটের ফেলে দেয়া ‘বাটের’ আগুন অনেকেই পা দিয়ে মাড়িয়ে নিভিয়ে ফেলে না। এই আগুন যদি কোন দাহ্য পদার্থের কাছে আসে, তা মূহুর্তের মধ্যে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। (4) (5)
সিগারেটের বাটে যেটুকু কেমিক্যাল লেগে থাকে,তা নিশ্চয়ই বেশি নয়। কিন্তু এমন মিলিয়ন মিলিয়ন সিগারেটের ক্যামিকেল বৃষ্টির পানির সাথে সুয়ারেজের লাইনে প্রবেশ করে তা পানিকে আরো দূষিত করে যা পানি সরবরাহকারী সংস্থার পানি শোধনে বাধা সৃষ্টি করে।
সিগারেটে কি কি থাকে?
জানতে চান? দেখেন এবার বিশ্বাস হয় কি না। বিশ্বাস না হলেও, এগুলো সত্যি।
- Nicotine- সিগারেটের মূল আসক্তি সৃষ্টক উদাপান। মস্তিষ্কে ডোপামিন তৈরি করায়। দেহে রিলাক্সেশন ও উত্তেজনা দেয়।
· Acetone - নেইল পালিশ তোলার কাজে ব্যবহৃত হয় !!!!
· Ammonia - নিকোটিনের কাজে প্রভাবক।
· Tar - আলকাতরা !!!
· Benzene - তেল, রাবার, রঙ এর দ্রাবক !!!
· Cadmium - ব্যাটারি তৈরি করতে ব্যবহার হয় !! কিডনি ক্যান্সার ও লাং ক্যান্সারের আহবায়ক !
· Hydrogen cyanide - ইঁদুর মারতে ব্যবহৃত হয় !! একেবারে যদি বেশি পরিমাণে ভেতরে যায়, সাথে সাথে মৃত্যু হয়।
· Ammonia
· Carbon monoxide (CO) - শরীরের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমায়।
· Nitrogen oxide
মানব শরীরে সিগারেটের ধবংসাত্বক পরিণতিঃ
- সিগারেটের কারনে ফুসফুসে ক্যান্সার হয়।
এখানে ২ নাম্বার ছবিতে দেখুন লাং-এর মাঝ বরাবর ক্যান্সার কোষ জন্ম নিচ্ছে!
- স্মোকিং হার্ট এটাক ও স্ট্রোক ঘটায়।
- ধমনীতে(করনারি আর্টারি) ব্লকেজ তৈরি করে। তখন এনজিওপ্লাস্টি করে আর্টারিতে রিং পরাতে হয়, এই রিং ১০ বছরের মতন থাকে। এরপর অবস্থার উন্নতি না হলে বাইপাস সার্জারি (ওপেন হার্ট) করানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
- দিনে ২০ টা সিগারেট খাওয়া স্মোকার প্রতি বছর প্রায় ১ কাপ পরিমান টার(আলকাতরা) ধোঁয়ার সাথে ভেতরে নেয়। এই টার লাংস-এ ঝুল সৃষ্টি করে আবৃত করে রাখে !!
- কার্বন মনোক্সাইড আমদের পেশি, টিস্যু ও ব্রেনের অক্সিজেনকে নিঃশেষ করে দেয়। ফলে হার্টকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এসব টিস্যুকে অক্সিজেনেটেড রাখতে। ফলে একসময় দেহের বায়ু প্রবেশপথ ফুলে ওঠে ও শেষে দেখা যায় ফুসফুসে(Lungs) কম বাতাস প্রবেশ করে।
- সিগারেট ফুসফুসে ‘এমফাইসেমা’ সৃষ্টি করে। ‘এমফাইসেমা’ হলে ধীরে ধীরে ফুসফুস পঁচে যায়। ‘এমফাইসেমা’ রোগীর যখন তখন ব্রংকাইটিস হয়ে থাকে। যেকোনো সময় হার্ট কিংবা লাংস ফেইল করতে পারে।
- প্রাপ্ত বয়স্কে প্রতি ৫ টি হার্টের অসুখে মৃত্যুর মধ্যে স্মোকিং-এর কারনে হয় ১ টি!
- অপ্রাপ্ত বয়স্কে প্রতি ৩ টি হার্টের অসুখে মৃত্যুর মধ্যে স্মোকিং-এর কারনে হয় ১ টি!
- গর্ভাবস্থায় স্মোকিং করলে ঘনঘন গর্ভপাত, জন্মের আগেই বাচ্চার মৃত্যু হতে পারে, আর বাচ্চার যদি জন্ম হয়ও দেখা যায় সেই বাচ্চা কম ওজন নিয়ে বা অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহন করে।
- সিগারেট মুখে বাজে গন্ধ সৃষ্টি করে। দাঁতের ও মাঢ়ির ক্ষয় ঘটায়।
- সিগারেটের কারনে স্কিনে অক্সিজেন কম আসে, ফলে অল্প বয়সে বৃদ্ধদের মত রুক্ষ স্কিনের সৃষ্টি হয়। এমনকি কম অক্সিজেনের কারনে অঙ্গে পঁচন দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত তা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না।
- হাড়ের ক্ষয় ঘটায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি আরো মারাত্মক। কেননা মেয়েরা এম্নিতেই অস্টিওপরেসিসে ভুগে বেশি, তার উপর ধুমপায়ী মেয়েরা ১০-১৫% বেশি এ রোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে পড়ে।
- পাকস্থলির ক্যান্সার বা আলসার, কিডনি, অগ্নাশয়, ব্লাডারের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
সুতরাং দেখা যায়, স্মোকিং হল নিজেই নিজেকে ধীরে ধীরে অপমৃত্যুর দিকে এগিয়ে নেবার অপর নাম।
তাই সচেতন হয়ে এখনি আমাদের সিগারেট ছেড়ে দিতে উদ্যোগী হতে হবে।
আবার ঝোকের বশে হাজারবার হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরে নিজের কল্যানেই সিগারেট ছেড়ে বিশুদ্ধ খাবারের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে পারলেই সুস্থ জাতি হিসেবে আগামীর যাত্রায় নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা আমাদের হবে।
ধন্যবাদ।
--এই লেখায় ব্যবহৃত প্রতিটি ছবি যথাযথ owner এর কপিরাইট।
[বিঃদ্রঃ আমি নিজেও কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত মানসিক চাপে পড়ে ধুমপান শুরু করি, ইচ্ছাশক্তির বলে এখন আমি প্রায় সিগারেটের হাত থেকে মুক্ত]
নির্বাচিত করা হোক।