সাল ২০১৮, প্রায় শেষই হয়ে এসেছে। আর কয়েকদিন পরেই আমরা হিসাব করতে বসব ২০১৮ আমাদের কি দিলো আর কি নিয়ে গেল। প্রতি ক্ষেত্রের প্রতিটা মানুষই একটা বছর থেকে কি পেল সেটা হিসাব করে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রও এখানে ব্যতিক্রম নয় বরং অন্যান্য ক্ষেত্রের চেয়ে নতুন বছরের পাওয়া, না-পাওয়ার হিসেবের উন্মাদনাটা এখানে অনেকটাই বেশি। প্রযুক্তিপ্রেমী আর প্রযুক্তিপাগলদের মাতামাতির মাঝেই প্রতিটা বছর আসে আর চলে যায়। এই আসা আর চলে যাওয়ার মাঝখানে কোন ক্ষেত্রের কথা যদি বলতে হয় যার সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আর উন্নতি হয় তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা হবে প্রযুক্তি। প্রতিটা নতুন আসা বছর সবচেয়ে বেশি চমক নিয়ে আসে প্রযুক্তি দুনিয়ায়। প্রতি বছর আগের বছরের চেয়ে আরো উন্নত, ব্যবহারযোগ্য এবং নতুন সব প্রযুক্তি পণ্য উদ্ভাবন করে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলি। নতুন বছরে এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তিতে অনেক পরিবর্তন আসে, আসে অনেক নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন। শত শত এইসব প্রযুক্তির মধ্যে থেকে কয়েকটি থাকে ইতিহাস সৃষ্টি করার মত উদ্ভাবন।
আজকে আমরা ২০১৭-২০১৮ সালের ইতিহাস সৃষ্টি করার মত ১০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্পর্কে জানব। তো চলুন শুরু করা যাক।
মস্তিষ্কের স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে মস্তিষ্কের কোন অংশের কার্যক্ষমতা হারানো কেই মূলত প্যারালাইসিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত কোন মানুষ সারাজীবনের জন্য তার দেহের কোন একটি বা অসংখ্য অংশের নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা হারান। মস্তিষ্ক সেখানে নিউরন দ্বারা সংকেত পৌছাতে পারে না। ফলে দেহের সেই অংশটি বিকল হয়ে যায়। সেটা আর নাড়াচড়া করা সম্ভব হয় না। পক্ষাঘাত আক্রান্ত কাউকে পরবর্তীতে আর পুরোপুরি সুস্থ্য করা কখনই সম্ভব হয় না। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রেঞ্চ নিউরোসায়েন্টিস্ট Grégoire Courtine ও তার দলের করা গবেষণা বলছে অন্য কথা। তাদের করা গবেষণার ফলাফল বলছে, প্রযুক্তির সহায়তায় একজন প্যারালাইজড মানুষকে আবার সুস্থ্য করা সম্ভব এবং পুরোপুরি ভাবেই। এর জন্য মস্তিষ্কে কিছু তারযুক্ত যন্ত্র বসাতে হবে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে স্টিমুলেশন দেয়া যাবে। ফলে মস্তিষ্ক উদ্দীপিত হবে এবং নিউরন মস্তিষ্কের সংকেত বহন করে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যেই একটি প্যারালাইজড বানর এবং অনুমতিক্রমে একজন প্যারালাইজড মানুষের উপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া গেছে। কিন্তু এই পদ্ধতির একটি সমস্যা হল এক্ষত্রে মস্তিষ্কে তারপূর্ণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে Grégoire Courtine এবং তার দল ওয়াইরলেস বা তারহীন পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশা করা যায় আগামী ১০-১৫ বছরের মাঝেই এই পদ্ধতি সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসবে।
স্বচালিত কিংবা মানুষ চালক বিহীন গাড়ি সম্পর্কে ইতিমধ্যেই সবাই জেনে গেছে। কিন্তু স্বচালিত গাড়ি আর স্বচালিত ট্রাকের মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। একটি গাড়ি হল ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী। গাড়িতে মানুষ বেশি হলে হালকা কিছু মালপত্র বহন করা হয়। কিন্তু আমরা যখন কথা বলছি ট্রাকের তখন আমাদের মনে রাখতে হবে একটি ট্রাক কয়েক টন পর্যন্ত মালামাল বহন করে থাকে। আর তাই স্বচালিত গাড়ি তৈরীর থেকে স্বচালিত ট্রাক তৈরী করা অনেক কঠিন। তবে ভাল খবর হল ইতিমধ্যেই এই ধরনের স্বচালিত ট্রাক তৈরী হয়েছে বং চীনে এগুলোর টেস্ট ড্রাইভও হয়েছে। ২০১৭ সালের এই প্রযুক্তিটি আশা করা যায় আগামী ৪-৫ বছরের মাঝেই পরপূর্ণতা পাবে।
এখন আর সরাসরি ক্যাশের লেনদেন খুব একটা চলে না। স্মার্ট পেমেন্ট সম্পর্কে আমরা জানি এবং আমরা ব্যবহারও করছি। বাংলাদেশেরও হাজার হাজার ক্ষেত্রে স্মার্ট পেমেন্ট চালু হয়েছে। এই স্মার্ট পেমেন্ট চালু করার পেছনে উদ্দেশ্য হল মূলত মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করে তোলা। কিন্তু এই স্মার্ট পেমেন্ট নিয়েও অনেকে সন্তুষ্ট না। কার্ড নিয়ে ঘুরাঘুরি এবং পিন প্রবেশ করিয়ে টাকা তোলা এইসব অনেকের কাছে ঝামেলার মনে হয়। তাদের জন্য আছে অন্য পদ্ধতি।
শুধুমাত্র নিজের মুখ বা ফেস দিয়েই করতে পারবেন পেমেন্ট। অনেকের মনের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য বলছি, প্রযুক্তি দিন দিন উন্নত হচ্ছে। বর্তমানে নিখুঁতভাবে আলাদা আলাদা মানুষের ফেস বা মুখ শনাক্ত করার জন্য অ্যান্ড্রয়েড ফোনই যথেষ্ট। আর ফোন ছাড়া ফেস শনাক্ত করার আলাদা যন্ত্র তো আছেই।
সেই যন্ত্র বা এপটি আপনার ফেসের সাথে কানেক্ট করা ব্যাংক একাউন্ট থেকে নিজেই টাকা কেটে রেখে দিবে। অনেকটা ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ করার মত। অনেকের কাছে এই ধরনের কিছু অসম্ভব মনে হতে পারে। তাদের বলছি ইতিমধ্যেই চীনের ১২ কোটি মানুষ Alipay নামের একটি এপের মাধ্যমে এই ফেস পে সেবাটি উপভোগ করছে এবং এখন পর্যন্ত এই পদ্ধতির কোন সমস্যা ধরা পড়েনি।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার সম্পর্কে মানুষের জল্পনা কল্পনার কোন শেষ নেই। সাধারণ ০, ১ ভিত্তিক ডিজিটাল কিংবা এনালগ সিস্টেম এর বাইরে গিয়ে কোয়ান্টাম বিটস ব্যবহার করে তৈরী করা অসম্ভব ক্ষমতাধর এই কম্পিউটার ধারণাটি এখনই ধারণাই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে গুগল এবং ইন্টেলের আলাদা কোয়ান্টাম কম্পিউটার রিসার্সের খবর থেকে জানা গেছে বিজ্ঞানীরা একটি প্র্যাক্টিক্যাল কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরীর খুব কাছাকাছি পৌছে গিয়েছেন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার সফলভাবে তৈরী করা হবে মানবজাতির আরেক বিরাট অর্জন গুরুত্ব বিবেচনায় যেটা চন্দ্রজয়ের চেয়ে কম নয় কোন অংশেই। আর ২০১৭ তে এসে বিজ্ঞানীরা যখন গোষণা দিলেন কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরীর মূলনীতি এবং কাঠামো তারা পেয়ে গেছেন তখন সেটাকে ঐতিহাসিক একটি প্রযুক্তি অর্জন বলাই যায়। আশা করা যায় ৪-৫ বছরের মাঝেই তৈরী হবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার।
সেলফি সম্পর্কে বলার কিছুই নেই। ৩৬০-ডিগ্রি সেলফি বলতে বোঝায় উপর-নিচ, সামনে-পিছনে চারিদিক নিয়ে তোলা সেলফি। এমনিতেই ৩৬০-ডিগ্রি কোন ছবি তুলতে গেলে বেশ কয়েকবার একটি ছবি বেশ অনেক রকম কায়দা করে তুলতে হয়।
একবারে এক ক্লিকে ৩৬০-ডিগ্রি ছবি তলা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু, হার্ভাড ইউনিভার্সিটির তৈরী নতুন ক্যামেরা দেবে এমনই এক সুযোগ। শুধু তাই নয় দিবে ৩৬০-ডিগ্রি সেলফি তোলার সুযোগ। ২০১৭ এর ঐতিহাসিক আবিষ্কার বলাই যায় এটাকে।
সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন হয় মুটামুটি বিশাল মাপের একটি সোলার প্যানেল এবং এই পদ্ধতি বেশ ব্যয়বহুলও। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কোন সুযোগ নেই, থাকলেও সেটা অবশ্যই প্রত্যাশা পুরণ করে না। নতুন উদ্ভাবিত ছোট আকারের হট সোলার সেল আগের সোলার প্যানেলের মতই তাপশক্তিকে আলোকরশ্মিতে রূপান্তরিত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে।
কিন্তু সোলার প্যানেল থেকে আকারে অনেক ছোট এবং সোলার প্যানেলের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এই প্রযুক্তিটি নিঃসন্দেহে ২০১৭ এর অন্যতম সেরা আবিষ্কার। তাছাড়া এ ধরনের সোলার সেল বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারোপযোগী এবং স্বল্প ব্যয়ী।
ইতিমধ্যেই পরিচয় করিয়ে দেয়া জিন থেরাপির আরো উন্নত পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছে জিন থেরাপি ২.০। মূলত জিন থেরাপির দ্বিতীয় প্রজন্ম বোঝাতে এই নামকরণ। বিভিন্ন ধরনের বংশানুক্রমিক রোগ প্রতিরোধ এবং জিনগত বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার পদ্ধতি হিসেবে এটি ব্যবহৃত হব। এর সাহায্যে হার্টের সমস্যা এমনকি ক্যান্সারের মত রোগও নিরাময় করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
এটি আসলে কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন নয়। মূলত এটি একটি বায়োলজিক্যাল প্রজেক্ট। তবে গুরুত্বের বিবেচনায় এটি এই তালিকায় স্থান পাবার মতই। এই প্রজেক্টে মানুষ কি দিয়ে তৈরী সেটা নিয়ে গবেষণা করা হবে। খুঁজে বের করা হবে মানুষের শুন্য অস্তিত্ব।
এটা মূলত ইন্টারনেট অফ থিংসের অফলাইন রূপ। ইন্টারনেট অফ থিংস সম্পর্কে সবাই জ্ঞাত। ইন্টারনেট অফ থিংস চালু হবার পর দেখা গেছে অনেক সময় নেটওয়ার্কের উপর হামলা হয়েছে। হ্যাকারদের কারণের যন্ত্রপাতি ঠিকঠাকভাবে কাজ করে নি বা নষ্ট হয়ে গেছে। আর তাই বটনেট তৈরী হয়েছে। যেটা সরাসরি নেটওয়ার্কে যুক্ত না থেকে আগে থেকেই দিয়ে রাখা বা ডাউনলোড করে রাখা তথ্যানুযায়ী কাজ করবে। ফলে ইন্টারনেট হামলার ঝুঁকি থাকবে না।
বলা যায় এটি হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্সের একটি আবিষ্কার। কেননা এই পদ্ধতিতে কম্পিউটার নিজেই বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে অনেক কিছু নিজে থেকেই শিখে নিচ্ছে যেটা কোন প্রোগ্রামাররা প্রোগ্রাম করে শিখাতে পারত না। এই পদ্ধতি এখন মূলত কম্পিউটার ব্যবহার করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার হচ্ছে।
প্রযুক্তি বিশ্বে ঘটে যাচ্ছে পরিবর্তন এবং সেটা ঘটছে প্রতিনিয়ত। আর তাই প্রযুক্তি সম্পর্কে কখনই একদম পারফেক্ট রিপোর্ট করা যায় না। এই টিউনে যদি কোন ভুল কিংবা কমতি থাকে তাহলে দয়া করে টিউমেন্ট করে জানাবেন। এছাড়া জানাতে পারেন টিউনটি কেমন লাগল এবং যে কোন মতামত। টিউনটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আমি হাসিবুর ইসলাম নাসিফ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 43 টি টিউন ও 76 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
বিষাদময় পৃথিবীতে আমি আনন্দ খুঁজে নিই সবকিছু থেকে। আর স্বপ্ন দেখি মহাকাশ ভেদ করে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার। স্বপ্নচারী আমার স্বপ্নগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। হাত ধরে চলো স্বপ্ন দেখি একসাথে।
খুব সুন্দর একটা টিউন, তথ্যসমৃদ্ধ।