আপনি কি জানেন আজকের যুগে একজন সাধারন মানুষ প্রতিদিন প্রায় গড়ে ২২১ বার তার মোবাইল ফোন হাতে নেন কোন কাজ করার জন্য ? এখন এটা আর কোন গোপন রাখার মত বিষয় না যে, আমরা প্রতিনিয়ত আরও বেশি করে আমাদের ফোনের ওপর আসক্ত এবং নিরভরশীল হয়ে পড়ছি।
কিন্তু আপনি কি ভেবেছেন যে এই স্মার্টফোন আপনার শরীর এবং মনের ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলে ? যদি অন্য অনেকের মত আপনিও মনে করে থাকেন যে, স্মার্টফোন শুধুমাত্র আপনার শরীরের এবং মনের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে, তাহলে আপনি অনেকটাই ভুল ভাবছেন। আজকের টিউনটিতে এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করব। তাহলে আর ভূমিকা না করে টিউনটি শুরু করা যাক।
Michigan State University এর একজন প্রখ্যাত প্রফেসর, রাসেল জনসন বলেন, " Smartphones are almost perfectly designed to disrupt sleep "। যার অর্থ হচ্ছে, আজকের স্মার্টফোনগুলো কে আপনার ঘুমকে বিপর্যস্ত করার জন্য ভালভাবে ডিজাইন করা হয়েছে। এর আর্থিক অর্থ করলে বোঝা যায়, স্মার্টফোন আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
আসলে আমাদের স্মার্টফোন আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় কিনা এটা বোঝার জন্য এতকিছুর দরকার হয়না। আমরা নিজেরাই জানি যে আমাদের স্মার্টফোন আমাদের ঘুমের ঠিক কতটা ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। আমার এবং পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের মত হয়ত আপনারও অভ্যাস আছে রাত জেগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার। রাত জেগে স্মার্টফোন ব্যবহার করার ফলে আমাদের ঘুম কম হয়। একদিন রাতে ঘুম কম হওয়ার ফলে আমাদের পরবর্তী দিনের জন্য শক্তির ঘাটতি পড়ে যায়। আর প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঘুমানো আমাদের শরীরের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমানোও আমাদের শরীরের জন্য অনেক ক্ষতিকর।
এছাড়া এখানে আরেকটি বিষয় হচ্ছে স্মার্টফোনের স্ক্রিনের ব্লু লাইট। স্মার্টফোনে তৈরি হওয়া এই ব্লু লাইট Melatonin নামের আমাদের শরীরের একটি প্রয়োজনীয় কেমিক্যালের কাজকে বাধা দেয়। উল্লেখ্য, এই কেমিক্যাল এর কাজ হচ্ছে আমাদের শরীরকে ঘুমানোর জন্য প্রভাবিত করা। তাই এই কেমিক্যাল এর কাজটি যদি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাহলে আমাদের ঘুমের যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটবে। আর মানুষ যদি প্রতিদিন প্রয়োজনের তুলনায় কম ঘুমায় তাহলে, মানুষের মনের ওপরও যথেষ্ট খারাপ প্রভাব পড়ে।
মানুষের মন খারাপ থাকা বা মেজাজ খিটখিটে হওয়ারও অনেক বড় একটি কারন এই কম ঘুমানো আর তার জন্য অনেকাংশে দায়ি আমাদের মোবাইল ফোন। তাই আমরা যদি ভালভাবে বাঁচতে চাই এবং একটি ভাল মন নিয়ে ভালভাবে নিয়মমাফিক জীবনযাপন করতে চাই, তাহলে আমাদের উচিত নিয়মিত প্রয়োজনীয় পরিমাণ ঘুমানো এবং রাত জেগে স্মার্টফোন ব্যবহার করার অভ্যাস বাদ দেয়া বা কমানো।
আপনি হয়ত খেয়াল করেছেন, অনেক্ষন ধরে কম্পিটার বা ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলে বা অনেক্ষন ধরে পিসি বা মোবাইল ফোন বিরামহীনভাবে ব্যবহার করতে থাকলে আপনার ঘাড়ে হালকা ব্যাথা অনুভূত হয়।
এই ব্যাথার কারন হচ্ছে ঘাড় নিচু করে আপনার স্মার্টফোনের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকা। এই প্রবলেমটিকে বলা হয় Text Neck। একজন পূর্ণবয়স্ক সাধারন মানুষের মাথার ওজন প্রায় ৫.৪ কেজির কাছাকাছি। কিন্তু যখন আপনি মাথা নিচু করে আপনার ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন তখন আপনার সারভিকাল মেরুদণ্ডের কাছে আপনার মাথার ওজন হয়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ২৭ কেজি পর্যন্ত (University of Utah Orthopaedic Centre এর এক্সপার্টদের মতে)।
এই কারনেই অনেক্ষন ধরে মাথা নিচু করে ফোন ব্যবহার করার ফলে আপনার ঘাড়ে ব্যাথা অনুভূত হয়। এভাবে অনেক্ষন ধরে মাথা নিচু করে স্মার্টফোন ব্যবহার করার অভ্যাসটি বাদ দিতে না পারলে আপনার ঘাড়ের কোন বড় ধরনের ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের উচিত এই অভ্যাসটি বাদ দেয়ার চেষ্টা করা। আর বাদ দিতে না পারলেও অন্তত একটু কমানোর চেষ্টা করা।
পৃথিবীর ৫০০ টি ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যে একটি জরিপ করে বোঝা গিয়েছে, মানুষের মোবাইল ফোন ব্যবহারের পরিমাণ সরাসরি তাদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। স্মার্টফোন ব্যবহারের ওপর মানুষের খুশি, দুঃখ, চিন্তা, ইত্যাদি অনেকাংশেই নির্ভর করে। Kent State University এর প্রফেসররা বলেন,
" high frequency cell phone users tended to have lower GPA, higher anxiety, and lower satisfaction with life (happiness) relative to their peers who used the cell phone less often. "
অর্থাৎ,
" হাই ফ্রিকুয়েন্সির সেল ফোন ব্যবহারকারী ছেলেমেয়েদের GPA কম থাকে। যারা কম সেলফোন ব্যবহার করে তাদের তুলনায় তারা অনেক বেশি চিন্তিত থাকে এবং তারা নিজেদের জীবন নিয়ে অনেক কম খুশি থাকে। "
অন্য একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, যেসব মানুষ অনেক বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন তারা প্রায় অধিকাংশ সময় ক্রুদ্ধ থাকেন সবকিছু নিয়ে এবং তাদের মেজাজ অনেক খিটখিটে থাকে এবং তারা প্রায় সবসময়ই এক ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন।
পৃথিবীর সব বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের একই অবস্থা না হলেও অধিকংশ মানুষ যারা অনেক বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে প্রায় অনেকেরই এই সমস্যাটি রয়েছে। আপনি যদি এই সমস্যার ভুক্তভোগী না হতে চান, তাহলে আপনার উচিৎ একবারে অনেক বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার না করে আপনার স্মার্টফোন ব্যবহার এর সময়ের মধ্যে যথেষ্ট পরিমান ফ্রি সময় রাখা যে সময়টিতে আপনি আপনার স্মার্টফোন থেকে দূরে থেকে আপনার নিজের ব্যবহারিক জীবনের সাথে সংযুক্ত হবেন।
অনেক্ষন স্মার্টফোনের খারাপ প্রভাব নিয়ে লিখলাম। এবার একটু স্মার্টফোনের ভাল দিকগুলো নিয়ে লেখা যাক। আপনি যদি অনেক ব্যাস্ত মানুষ হন এবং সারাদিন যদি আপনার কাজের ওপর থাকেন তাহলে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোট স্মার্টফোন ব্রেক নেয়া আপনার শরীর এবং মনের জন্য অনেক ভালো।
এই ছোট ছোট বিরতির সময়ে আপনি চাইলে স্মার্টফোনে কিছু ছোট ছোট গেমস খেলতে পারেন, চাইলে আপনার বন্ধুবান্ধবের সাথে কিছুক্ষন চ্যাট করে নিতে পারেন, অথবা চাইলে কিছু সময়ের জন্য ইন্টারনেট সার্ফিংও করতে পারেন।
এইসব ছোট ছোট বিরতির মধ্যে এসব কাজ করলে আপনার মনও রিফ্রেশ হবে এবং আপনি কাজ করতে করতে বিরক্তও অনুভব করবেন না। এছাড়া এর ফলে আপনি আরো বেশি করে কাজ করার আগ্রহ ফিরে পাবেন। অনেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানিদের মতেই আপনার ব্যাস্ত জীবনের কাজের ফাঁকে ছোট ছোট স্মার্টফোন বিরতি নেয়া একটি ভাল সিদ্ধান্ত।
আরো অনেক মানুষের মত হয়ত আপনারও ধারনা আছে যে স্মার্টফোনের ব্যবহার আপনাকে ক্যান্সার এর দিকে ঠেলে দেয়ার মত ক্ষমতা রাখে। যদি আপনার ধারনা এটাই হয়ে থাকে তাহলে আপনি সম্পূর্ণ সঠিক নন। আপনার ধারনাটি অনেকাংশে ভুল।
আপনি হয়ত অনেক জায়গায় শুনে থাকবেন যে স্মার্টফোনে তৈরি হওয়া রেডিয়েশন আপনার অনেক বড় ক্ষতি করতে পারে এবং আপনার ক্যান্সারের কারনও হতে পারে। কিন্তু এই ধারনাটি ঠিক নয়। এটি শুধুমাত্র একটি Myth। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে মানুষের স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং ক্যান্সার রোগীদের কান্সারের কারন ইত্যাদি বিষয় গবেষণা করে বিজ্ঞানিরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, স্মার্টফোনের ব্যবহার মানুষের দেহে ক্যান্সারের মত রোগের সৃষ্টি করতে পারেনা। আর যদি রেডিয়েশনের কথা বলেন তাহলে জেনে রাখা ভালো যে, রেডিয়েশন দুই ধরনের হয়ে থাকে, আয়োনাইজিং রেডিয়েশন এবং নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন।
আয়োনাইজিং রেডিয়েশন হচ্ছে অনেক বেশি ফ্রিকুয়েন্সির রেডিয়েশন আর নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন হচ্ছে কম ফ্রিকুয়েন্সির রেডিয়েশন। আপনার বা আমার স্মার্টফোন থেকে যে রেডিয়েশন বের হয় তা নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন। কম ফ্রিকুয়েন্সির রেডিয়েশন হওয়ায় এটি আমাদের শরীরের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারেনা এবং ক্যান্সারও ঘটাতে পারেনা।
এই বিষয়টি নিয়ে যদি ইন্টারনেটে আরেকটু খোঁজাখুঁজি করেন তাহলে এটি নিয়ে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন। আপনি যদি স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করেন তাহলে আপনার ক্যান্সার বা এই ধরনের মারাত্মক কোন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
আশা করি আপনি এই টিউনটি থেকে একটু হলেও উপকৃত হয়েছেন বা কিছু জানতে পেরেছেন। আজকের টিউন এখানেই শেষ করছি। আশা করি আগামীতে এমন আরো টিউন করতে পারব। টিউন সম্পর্কে আপনার কোন ধরনের কোন প্রশ্ন থাকলে বা মতামত থাকলে অবশ্যই টিউনমেন্ট করে জানাবেন। ভালো থাকবেন। 🙂
You can contact me on : Facebook
আমি সিয়াম একান্ত। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 40 টি টিউন ও 82 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 12 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
আমার নাম সিয়াম রউফ একান্ত। অনেকে সিয়াম নামে চেনে আবার অনেক একান্ত নামে। যাইহোক, পড়াশুনা একেবারেই ভাল লাগেনা আমার। ভাল লাগার মধ্যে দুইটা জিনিস , ফটোগ্রাফি আর প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির প্রতি ভাললাগা থেকেই টেকটিউন্স চেনা এবং টেকটিউন্সে আইডি খোলা। দেখা যাক কতদূর কি করা যায়......
অনেক ভুল ধারনা ভাঙ্গল। ধন্যবাদ