সেনাপতির নির্দেশ
অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।
চারপাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হয়ে উঠছে।
ঠিক এমনই সময়।
এমনই সময় হজরত হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান মুসলমান হন। মক্কায়, ইসলামের প্রথম পর্বে। পিতার সাথে মা-ও ইসলাম গ্রহণ করেন।
কী এক বিস্ময়কর ব্যাপার!
পুলকিত ও শিহরিত আকাশ-বাতাস।
ভাগ্যবান হুজাইফা! তিনি ক্রমশ বেড়ে ওঠেন মুসলিম পিতা-মাতার কোলে।
আরও মজার ব্যাপার যে রাসূলে কারীমকে (সা) দেখার সৌভাগ্য অর্জনের আগেই তিনি মুসলিম হন। ভাই-বোনের মধ্যে শুধু তিনি ও সাফওয়ান এ গৌরবের অধিকারী হন।
মুসলিম হওয়ার পর রাসূলকে (সা) একটু দেখার আগ্রহ জন্মে তার। দারুণ আগ্রহ! দিন দিন তার মধ্যে এ আগ্রহ তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হতে থাকে। তিনি সব সময় যারা রাসূলকে (সা) দেখেছেন, তাঁদের কাছে রাসূলের (সা) চেহারা-সুরত ও গুণ-বৈশিষ্ট্য কেমন তা জানার জন্য প্রশ্ন করতেন।
শেষে তিনি একদিন সত্যি সত্যি মক্কায় রাসূলুল্লাহর (সা) দরবারে হাজির হন এবং হিজরত ও নুসরাতের ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চান। রাসূল (সা) তাঁকে দুটোর যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দান করেন।
হুজাইফা বলেন : রাসূল (সা) হিজরাত ও নুসরাত (মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে অবস্থান)-এর যে কোন একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা আমাকে দান করেন। আমি পরম আনন্দের সাথে নুসরাতকে বেছে নিলাম।
মক্কার প্রথম সাক্ষাতে তিনি প্রশ্ন করেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি কি মুহাজির না আনসার?
রাসূল (সা) জবাব দিলেন : তুমি মুহাজির বা আনসার যে কোন একটি বেছে নিতে পার।
তিনি বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আনসারই হবো।
হযরত হুজাইফা উহুদ যুদ্ধে তাঁর পিতার সাথে যোগদান করেন।
পিতা ও পুত্র একই সাথে যুদ্ধ করছেন!
হুজাইফা দারুণ সাহসের সাথে যুদ্ধ করেন এবং নিরাপদে মদিনায় ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধ সাহসী পিতা যুদ্ধের ময়দানে শাহাদাত বরণ করেন! আর সে শাহাদাত ছিল স্বপক্ষীয় মুসলিম সৈনিকদের হাতে।
ঘটনাটি ছিল একটু অন্যরকম। যেমনÑ
উহুদ যুদ্ধের আগে নারী ও শিশুদের একটি নিরাপদ দুর্গে রাখা হয়। আর এ দুই বৃদ্ধকে রাখা হয় ঐ দুর্গের তত্ত্বাবধানে।
যুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করলো, তখন আল-ইয়াসান তার সাথী সাবিতকে বললেন : তোমার বাপ নিপাত যাক! আমরা কিসের অপেক্ষায় বসে আছি? পিপাসিত গাধার স্বল্পায়ুর মতো আমাদের সবার আয়ুও শেষ হয়ে এসেছে। আমরা খুব বেশি হলে আজ অথবা কাল পর্যন্ত বেঁচে আছি। আমাদের কি উচিত নয়, তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট চলে যাওয়া? হতে পারে, আল্লাহ তাঁর নবীর (সা) সাথে আমাদের শাহাদাত দান করবেন। তখন তাঁরা দু’জন তরবারি হাতে নিয়ে দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন।
এদিকে যুদ্ধের এক পর্যায়ে পৌত্তলিক বাহিনী পরাজয় বরণ করে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছিল। তখন এক দুরাচারী শয়তান চেঁচিয়ে বলে ওঠে, দেখ দেখ, মুসলমানরা এসে পড়েছে!
একথা শুনেই পৌত্তলিক বাহিনীর একটি দল ফিরে দাঁড়ায় এবং মুসলমানদের একটি দলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আল-ইয়ামান ও সাবিত দু’দলের তুমুল সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান।
পৌত্তলিক বাহিনীর হাতে সাবিত শাহাদাত বরণ করেন। কিন্তু হুজাইফার পিতা আল-ইয়ামান শহীদ হন মুসলমানদের হাতে। না চেনার কারণে এবং যুদ্ধের ঘোরে এমনটি ঘটে যায়।
হুজাইফা কিছু দূর থেকে পিতার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেন :
‘আমার আব্বা, আমার আব্বা’ বলে।
কিন্তু সে চিৎকার কারো কানে পৌঁছেনি। যুদ্ধের শোরগোলে তা অদৃশ্যে মিলিয়ে যায়। ইতোমধ্যে বৃদ্ধ নিজ সঙ্গীদের তরবারির আঘাতে ঢলে পড়ে গেছেন।
হুজাইফা পিতার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শুধু একটি কথা উচ্চারণ করেন: ‘আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন। তিনিই সর্বাধিক দয়ালু।’
কী অসাধারণ ধৈর্য ও সাহস! কী অসম্ভব মনের জোর! ঈমানী শিক্ষার কী অপূর্ব দৃষ্টান্ত!
রাসূলে কারীম (সা) হুজাইফাকে তাঁর পিতার দিয়াত বা রক্তমূল্য দিতে চাইলে তিনি বললেন : আমার আব্বা তো শাহাদাতেরই প্রত্যাশী ছিলেন। তিনি সেটা লাভ করেছেন। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাক, আমি তাঁর দিয়াত বা রক্তমূল্য মুসলমানদের জন্য দান করে দিলাম।
হুজাইফার এই সাহসী উচ্চারণে রাসূল (সা) দারুণ খুশি হলেন।
হজরত হুজাইফা খন্দক যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধের ময়দানে কুরাইশরা এমন তোড়জোড় করে ধেয়ে আসে যে, মদিনায় ভীতি ও ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে।
মদিনার চতুর্দিকে বহুদূর পর্যন্ত কুরাইশ বাহিনীর লোকেরা ছড়িয়ে গেছে।
রাসূল (সা) আল্লাহর কাছে দু’য়া করেন, আর সেই সাথে মদিনার প্রতিরক্ষার জন্য খন্দক খনন করেন।
এক রাতে এক অভিনব ঘটনা ঘটে গেল! সেটা ছিল মুসলমানদের জন্য এক অদৃশ্য সাহায্য আল্লাহর পক্ষ থেকে। কুরাইশরা মদিনার আশপাশের বাগানগুলোতে শিবির স্থাপন করে আছে। হঠাৎ প্রচণ্ড এমন এক বাতাস বইতে শুরু করলো যে, কুরাইশদের তাঁবু রশি ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। হাঁড়ি-পাতিল উল্টে-পাল্টে গেল। এবং হাড় কাঁপানো শীত শুরু হলো।
কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বললো, আর উপায় নেই! এখনই এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। জলদি পালাতে হবে। আর দেরি নয়। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়!
হজরত রাসূলে কারীম (সা) কুরাইশ বাহিনী নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন। তিনি সেই ভয়াল দুর্যোগময় রাতে হুজাইফার শক্তি ও অভিজ্ঞতার সাহায্য গ্রহণ করতে চাইলেন। তিনি কোন রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইচ্ছা করলেন।
আর এ দুঃসাহসী অভিযানের জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত হুজাইফাকে নির্বাচন করলেন। রাসূল (সা) সঙ্গীদের বললেন : ‘যদি কেউ মুশরিকদের খবর নিয়ে আসতে পারে, তাকে আমি কিয়ামতের দিন আমার সাহচর্যের খোশখবর দিচ্ছি।’
একে তো দারুণ শীত, তার ওপর প্রবল বাতাস! কেউ সাহস পেল না।
রাসূল (সা) তিনবার হুজাইফার নাম ধরে ডেকে বললেন : তুমি যাও, খবর নিয়ে এসো।
যেহেতু নাম ধরে ডেকেছেন, সুতরাং আদেশ পালন ছাড়া হুজাইফার আর কোনো উপায় ছিল না। এ সম্পর্কে হুজাইফা নিজেই বলেন : আমরা সে রাতে কাতারবন্দী হয়ে বসেছিলাম।
আবু সুফিয়ান ও মক্কার মুশরিক বাহিনী ছিল আমাদের ওপরের দিকে, আর নিচে ছিল বনি কুরাইজার ইহুদি গোত্র। আমাদের নারী ও শিশুদের নিয়ে আমরা ছিলাম শঙ্কিত। আর সেই সাথে ছিল প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘোর অন্ধকার। এমন দুর্যোগপূর্ণ রাত আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। বাতাসের শব্দ ছিল বাজ পড়ার শব্দের মত তীব্র। আর এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল যে, আমরা আমাদের নিজের আঙুল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না।
এদিকে মুনাফিক শ্রেণীর লোকেরা একজন একজন করে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট এসে বলতে লাগলো : আমাদের ঘরদোর শত্র“র সামনে একেবারেই খোলা। তাই একটু ঘরে ফেরার অনুমিত চাই।
মূলত অবস্থা সে রকম ছিল না। কেউ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেই রাসূল (সা) অনুমতি দিচ্ছিলেন। এভাবে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত আমরা তিন শো বা তার কাছাকাছি সংখ্যক লোক থাকলাম।
এমন এক সময় রাসূল (সা) এক এক করে আমাদের সবার কাছে আসতে লাগলেন।
এক সময় আমার কাছেও এলেন।
শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার গায়ে একটি চাদর ছাড়া আর কিছু ছিল না। চারদটি ছিল আমার স্ত্রীর, আর তা খুব টেনেটুনে হাঁটু পর্যন্ত পড়ছিল।
রাসূল (সা) আমার একেবারে কাছে এলেন।
আমি মাটিতে বসেছিলাম। রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করলেন : এই তুমি কে?
বললাম : আমি হুজাইফা।
তুমি হুজাইফা? এই বলে রাসূল (সা) মাটির দিকে একটু ঝুঁকলেন, যাতে আমি তীব্র ক্ষুধা ও শীতের মধ্যে উঠে না দাঁড়াই।
আমি বললাম : হাঁ , ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি হুজাইফা।
তিনি বললেন : তুমি কুরাইশদের শিবিরে গিয়ে আমাকে তাদের খবর এনে দেবে।
আমি বের হলাম। সেনাপতির নির্দেশ বলে কথা! অথচ আমি ছিলাম সবার চেয়ে ভীতু ও শীতকাতর। রাসূল (সা) দু’আ করলেন : হে আল্লাহ! সামনে-পেছনে, ডানে-বামে, ওপর-নিচে, সব দিক থেকে তুমি তাকে হিফাজত কর। রাসূলাল্লাহর (সা) এ দু’আ শেষ না হতেই আমার মনের সকল ভয়-ভীতি দূর হয়ে গেল এবং কী আশ্চর্য! শীতের জড়তাও কেটে গেল। আমি যখন পেছন ফিরে চলতে শুরু করেছি তখন রাসূল (সা) আমাকে আবার ডেকে বললেন : হুজাইফা! আমার কাছে ফিরে না এসে আক্রমণ করবে না।
বললাম : ঠিক আছে। আমি রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে চলতে লাগলাম। এক সময় চুপিসারে কুরাইশদের শিবিরে প্রবেশ করে তাদের সাথে এমনভাবে মিশে গেলাম যেন আমি তাদেরই একজন। আমার পৌঁছার কিছুক্ষণ পর আবু সুফিয়ান কুরাইশ বাহিনীর সামনে ভাষণ দিতে দাঁড়ালেন। বললেন : হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে একটি কথা বলতে চাই। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে তা মুহাম্মাদের কাছে পৌঁছে যায় কি না। তোমরা প্রত্যেকেই নিজের পাশের লোকটির প্রতি লক্ষ্য রাখ। এ কথা শোনার সাথে সাথে আমার পাশের লোকটির হাত মুঠ করে ধরে জিজ্ঞেস করলাম : কে তুমি?
সে জবাব দিল, আমি অমুকের ছেলে অমুক।
আবু সুফিয়ান বললেন : হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! তোমরা কোন নিরাপদ গৃহে নও। আমাদের ঘোড়াগুলো মরে গেছে, উটগুলো কমে গেছে এবং মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজাও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। তাদের যে খবর আমাদের কাছে এসেছে তা সুখকর নয়। আর কেমন প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে পড়েছি, তাও তোমরা দেখছো। আমাদের হাঁড়িও আর নিরাপদ নয়। আগুনও জ্বলছে না। সুতরাং ফিরে চলো। আমি চলছি।
এ কথা বলে তিনি উটের রশি খুললেন এবং তার পিঠে চড়ে বসে উটের গায়ে আঘাত করলেন। উট চলতে শুরু করলো। কোন কিছু ঘটাতে রাসূল (সা) যদি নিষেধ না করতেন তাহলে একটি মাত্র তীর মেরে তাকে হত্যা করতে পারতাম।
আমি ফিরে এলাম। এসে দেখলাম রাসূল (সা) তাঁর এক স্ত্রীর চাদর গায়ে জড়িয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে আছেন। নামাজ শেষ করে তিনি আমাকে তাঁর দু’পায়ের কাছে টেনে নিয়ে চাদরের এক কোনা আমার গায়ে জড়িয়ে দিলেন। আমি সব খবর তাঁকে জানালাম।
তিনি দারুণ খুশি হলেন এবং আল্লাহর হামদ ও ছানা পেশ করলেন।
হজরত হুজাইফা সে দিন বাকি রাতটুকু রাসূলুল্লাহর (সা) সেই চাদর গায়ে জড়িয়ে সেখানেই রাত কাটিয়ে দেন। প্রত্যুষে রাসূল (সা) তাঁকে ডাকেন : ইয়া নাওমান-হে ঘুমন্ত ব্যক্তি! কী সৌভাগ্যবান হজরত হুজাইফা!
এখানেই শেষ নয়। আরো আছে তাঁর সাহসের কথা। আছে এমনতর অনেক প্রসঙ্গ। সেখানেও রয়ে গেছে হুজাইফার ঈমান ও সাহসের অজস্র সাম্পান। সে সম্পর্কেও আমরা জানবো আগামীতে। জানতে হবে আমাদের বড় হওয়ার জন্য। সাহসী হওয়ার জন্য।
নিজেদের গড়ে ওঠার জন্য।
আমি সাবিহা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 4 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 98 টি টিউন ও 753 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
খুব সাধারন একটি মানুষ।সারাদিন কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকি।মুভি দেখি,ব্লগ এ ব্লগ এ ঘুরাঘুরি করি।পড়ালেখা করতে বরাবরই ভয় লাগে। আর ফেসবুক এ একটা পেজ খুলেছি।যারা সময় পাবেন একটু ঢু মেরে আসবেন।
ভাল। ধন্যবাদ আপনাকে।