সকালে ঘুম থেকে উঠে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম লিকার বা সারা দিনের খাটুনির পর বাড়ী ফিরে হাল্কা দুধ ম’ম গন্ধে ভরপুর এক কাপ চা।
এই চা আবিষ্কার হল কিভাবে তা নিয়ে নানান কাহিনী আছে। খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩৭ সালে, মানে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে, চৈনিক সম্রাট শেনংগ তাঁর প্রাসাদে বসে একটা বাটিতে করে গরম পানি পান করছিলেন। এমন সময় কোথা থেকে উড়ে এসে কোনও গাছের গোটাকতক পাতা তাঁর পানির বাটিতে পড়েছিল। ভোজবাজির মতন পানির রঙ পাল্টাতে শুরু করে এবং সম্রাট সেই রঙিন পানির বাটিতে চুমুক দিয়ে তার স্বাদে এবং উত্তেজক ধর্মে অভিভুত হন। কাকতালীয়টার বাইরে দাঁড়িয়ে অন্য অভিমতটা হল- ভেষজ নিয়ে সম্রাট শেনংগের অপার অনুসন্ধিৎসা ছিল, সেই জায়গা থেকেই তিনি চা গাছের পাতা নিয়েও পরীক্ষা চালিয়েছিলেন এবং চা আবিষ্কার করেছিলেন। আবার বৌদ্ধধর্মের প্রচারকরা চা আবিস্কারের সব কীর্তি গৌতম বুদ্ধতে বর্তাতে চান। তাঁরা বলেন, বুদ্ধদেব যখন একদিন গরম পানি পান করছিলেন তখন চা গাছের ঝরাপাতা তাঁর বাটিতে উড়ে এসে পড়ে এবং এইভাবে তিনি পানীয় হিসাবে চায়ের আবিষ্কার ঘটান। আসলে এশিয় ভূখণ্ডে এক অতি প্রাচীন ও বহুপ্রচলিত পানীয়র নাম- চা। ফলে তার উৎসে যে Religious বা Royel গল্প থাকবে তা বলাই বাহুল্য।
দুটি পাতা একটি কুঁড়ি- এই তো চায়ের গল্প। কিন্তু গাছটার নাম কি? দার্জিলিংইয়ের, আসাম না সিলেট এর চা ভাল? আর Black tea, Green tea বা Milk tea কোন চা খাবেন?
চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Camellia sinester var. assamica বা camellia sinesis var. sinesis যার প্রথমটির উৎপত্তি চীনের হুনান(ইয়েনান) প্রদেশ থেকে আধুনা মায়ানমার হয়ে ভারতের আসাম পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়টির লীলাক্ষেত্র চীনের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল। কিন্তু আধুনিক জিনপ্রযুক্তিগত গবেষণা বলছে, বহুদিন ধরে এই বিভাজন সঠিক নয়। চা গাছ এক রকমই, মূলত camellia sinensis এবং তার আগে কোনও var. বা ভ্যারাইটি নেই। বৈচিত্র্য যা দেখা যায় তা আসলে হাইব্রিড বা সংকর।
গবেষকদের মতে চা গাছের আদিভূমি মায়ানমারের উত্তরাঞ্চল থেকে চীনের হুনান ও সিচুয়ান প্রদেশ পর্যন্ত। ভারতে চা আসে চীন থেকেই এবং সেটা আসে ব্রিটিশ জমানায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। এখন চীন ও ভারত চায়ের সবচেয়ে বড় উৎপাদক। বলা যায় এই মুহূর্তে এক নাম্বারে চীন, ভারত দু’নম্বরে। ২০০৪-২০০৫ সালে পৃথিবীর মোট উৎপাদন কিঞ্চিদধিক ৩৪ কোটি টনের ৯ টনের কিছু বেশী চা চীনে(মোট উৎপাদনের ২৭% ভাগ) এবং ৮ টনের কিছু বেশী চা ভারতে (মোট উৎপাদনের ২৪% ভাগ) উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীলংকা ও কেনিয়াতে পৃথিবীর মোট উৎপাদনের ৯% করে উৎপাদিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশেও প্রচুর চা চাষ হয়। ভারতে প্রথম চায়ের চাষ শুরু হয় আসাম ও দার্জিলিংয়ে। তারপর ইংরেজরা তা দক্ষিণ ভারতে এবং পরবর্তীকালে শ্রীলংকায়ে ছড়িয়ে দেয়। প্রথম দিকে দার্জিলিংয়ের সুগন্ধ লিকার এবং আসামের কড়া লিকারই ছিল ভারতীয় চা। কিন্তু পরবর্তী কালে এখানে খুব ভাল ‘গ্রীন টি’ উৎপাদিত হতে থাকে। ফলে চা রপ্তানি খুব বেড়ে যায়। ভারতীয় বা বাংলাদেশী চা বলতে মূলত দুধ চা বোঝায়। যদিও দার্জিলিংয়ের ও সিলেট এর লিকার এখনও পৃথিবীর সেরা এবং সবচেয়ে দামি।
ভারতে বর্ষার সময় উৎপাদিত চা পাতা বাজারে চালাবার জন্য CTC(crush, tear and curl) নামে এক ধরনের চা তৈরি হয়ে থাকে, যেটার আভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রচুর। চৈনিক সমাজ অবশ্য Oolong tea নামক ধরনের চা সেবন করে থাকে। Herbal tea নামের এক ধরনের চা এখন বেশ জনপ্রিয় সারা পৃথিবীজুড়ে। এতে অনেক প্রাকৃতিক পুষ্টিকর নির্জাস মিশানো হয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে চা চাষ করে তা সারা পৃথিবীতে ব্যাপ্ত করে। এক সময়ে আমেরিকা যখন ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল তৎকালীন সময়ের ঐতিহাসিক ‘বোস্টন টি পার্টি’ তে দার্জিলিং এর চা ব্যবহার হত।
চা বাগানের চা গাছের উচ্চতা আড়াই-তিন ফুটের হয়। নিয়ম করে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তোলা হয়ে সাপ্তাহে একবার। তোলার ঠিক ৭ দিন পড়ে আবার তোলার মত পাতা-কুঁড়ি গজিয়ে ওঠে। পাতা কুঁড়ি তোলার এই প্রক্রিয়াকে বলে Flushing।প্রতিটি চা গাছের প্রতিটি ডালে ৭ দিন অন্তর ঐ Flushing চালাতে হয়। না চালালে আড়াই-তিন ফুট উচ্চটার চা গাছের ঝোপ অনতিবিলম্বে ৬/৭ ফুট উচ্চটার বৃক্ষে পরিণত হয়। একটি চা বাগানকে জীবন্ত রাখার উপায় তিনটি :
১.নিয়মিত চা পাতা তোলা।
২.চা বাগানের ভিতরটা পরিস্কার রাখা। যেন কোনও আগাছা না থাকে।
৩.চা বাগানের ভিতর যেন কিছু দূর অন্তর ছায়া দিতে পারে এমন বড় বড় গাছ থাকে, যাকে বলা হয়ে shade tree।
বাজারে যে চা গুলো জনপ্রিয় তা হল :
১.Black tea/Red tea(শুকানো সম্পূর্ণ বিচূর্ণ এবং সম্পূর্ণ জারিত চা পাতা)
২.Green tea(না শুকানো এবং না জারিত চা পাতা)
সাধারণত সমতলের চা বাগানের তুলনায় ৪/৫ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ি ঢলের চা বাগানের চা পাতার গন্ধ হয় ভাল।
সবুজ পাতা থেকে ব্যবহারযোগ্য চা পাতা তৈরি হয় জারন এবং ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সন্ধান প্রক্রিয়ায়। এই প্রক্রিয়ায় ছত্রাকের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ। ছত্রাক শুধু যে চায়ের গন্ধ নষ্ট করে দেয় তাই নয়, ক্যান্সার উদ্রেগকারি যৌগের জম্ম দেয়।
চা একটি অতি উপকারী পানীয়। চা পান করলে নেশা হয় বা চায়ের নেশা বলে যে কথাটা চালু আসে তা সম্পূর্ণ ভুল। চায়ে কোনও নেশা হয় না। কারণ চায়ে কোনও নেশার উপাদান নেই। চায়ে প্রায় ২৫% এর বেশি পলিফেনলস(Polyphenols) থাকে যা ক্যান্সার প্রতিরোধী। এই পানীয়তে ০.৭% Theophyllin ও Theobromin থাকে যা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের জন্য উপকারী। স্বাস্থ্যরক্ষার উপায় হিসাবেই চীনে চায়ের চাষ শুরু হয়। ৮০০ খ্রিঃ জাপানে চা চালু হয় মূলত সুস্বাস্থ্যের কারণে। প্রথম দিকে ইংরাজ ও ডাচরা চা বিক্রি করত ওষুধের দোকান থেকে।একসময় ইংল্যান্ডে নামকরা চায়ের ব্র্যান্ড ছিল ‘টাইফু’। এটি একটি চাইনিজ শব্দ যার মানে ‘চিকিৎসক’।
ইংরেজিতে ‘Tea’ আর বাংলায় ‘চা’ নাম দুটি পৃথিবীময় ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। ইংরেজ ও হাঙ্গেরিয়ান ‘চা’কে বলে Tea; আবার আফ্রিকান,জার্মান ও ফিনিশিয়রা এবং ফরাসিরা বলে tee; ওয়েলস,স্কতিস,সুইডিশ,ডেনিশ,নরয়েজিয়ান,আইল্যান্ডের মানুষ ও স্প্যানিশরা চা কে বলে te; জাপান,কোরিয়া, থাইল্যান্ডের লোকজন ও পর্তুগীজরা ‘চা’-কে বলে cha; বুলগেরিয়ান,জর্জিয়ান,রাশিয়ান ও উক্রেনিয়ানরা বলে chai। এটার সহজ ব্যাখ্যা হল, ইংরেজরাই মূলত বিশ্বময় চায়ের সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে আর এই সম্প্রসারণের মদদ জুগিয়েছে এই চীন ও ভারত। কারণ চা তৈরি হয়েছে চীন ও ভারতে এবং তা রপ্তানি হয়েছে এখান থেকে। তাই প্রভুদের tea আর প্রজাদের ‘চা’ বিশ্বময় ছড়িয়ে গেছে।
ইংরেজ রাজপ্রাসাদে চায়ের নেশা ধরায় পর্তুগালের যুবরানী Catherine of Braganza ১৬৬০ সালে ২য় চার্লসের সঙ্গে তার বিয়ের পর। এই চা সম্ভবত আমস্টারডাম থেকে আসত। কিন্তু আসল কাজটা করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাঁরা অনেক পণ্যসামগ্রীই দেশে এনেছিল। কিন্তু কেউ ভাবতেই পারেনি ১৭৫০ সালের মধ্যে ব্রিটিশদের কাছে চা একটা জনপ্রিয় পানীয় হয়ে উঠবে। এই সময়ের মধ্যে শুধু চা নয়, আখের আমদানিও বেড়ে যায় ইংল্যান্ডে। কারণ ইংরেজরা চিনি দিয়ে চা পান করতে ভালবাসত। চা পানের এই অভ্যাস দুটি বাণিজ্যিক ত্রিভুজের জম্ম দেয়। একটি চিনির জন্য ব্রিটেন-আফ্রিকা-ওয়েস্ট ইন্ডিজ অন্যটি চায়ের জন্য ব্রিটেন-চীন-ভারত। ইংরেজরা চীনের সঙ্গে চায়ের বিনিময় অন্য পণ্যের বাণিজ্য করতে চেয়েছিল কিন্তু চীন রাজী হয় নি। ফলে ইংল্যান্ডের রাজাকে সোনার বিনিময় চীন থেকে চা আমদানি করতে হত। যার কারণে ইংল্যান্ডের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। এটা রোধ করতে ব্রিটিশ সরকার ভারতে আফিম চাষ আরম্ভ করে এবং চীনকে বাধ্য করে আফিমের বিনিময় চা রপ্তানি করতে। এর ফলে একদিন শুরু হয় Opium war।
সময়ের নানা পথ অতিক্রম করে আজও চা একটি জনপ্রিয় পানীয় পুরো পৃথিবীময়।
আমি রাশেদুল আলম অয়ন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 12 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 23 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।