বাংলা বর্ণগুলোকে দেখলেই আপণ আপণ লাগে।এত শান্তি লাগে বাংলা পড়তে! এই বর্ণগুলোর বিবর্তণ ও ইতিহাস কি আমরা জানি?
চলুন পাঁচ মিনিচে জেনে নেই বাংলা বর্ণ মালার ইতিহাস।
সময়টা খ্রিষ্টপূর্ব 3300-1200 সাল, মধ্য ব্রোঞ্জ যুগ! মানুষ তামার ব্যবহার শিখেছে, তৈরী করতে পেরেছে হাতিয়ার।ব্রোন্জ হাতের নাগালে, দৃশ্যপট অনেকটা নিচের মত।
চিত্রঃ ব্রোঞ্জ যুগের নিদর্শন
প্রয়োজন দেখা দিল চিহ্নের মাধ্যমে ভাব প্রকাশের, আর জন্ম নিল প্রোতো-সিনাইটিক স্ক্রিপ্ট (Proto-Sinaitic script) নামের নতুন লিপি। শিলা বা পাথরের উপরেই অঙ্কিত হত এই লিপি।
ব্রোন্জযুগের Proto-Sinaitic লিপির নমুনা।
এর বহুদিন পর খ্রিস্টপূর্ব 1050 সালের দিকে প্রাচীন ফিনিশীয় (Phoenicia) সভ্যতায় জন্ম নেয় ফিনিশিয়ান লিপি (Phoenician alphabet)। এই লিপি ফিনিশিয়া ভাষার জন্য নির্মিত হয়েছিল এবং এ দ্বারা শুধু ব্যঞ্জনবর্ণ প্রকাশ করা যেত। তাদের লিপিতে মোট বাইশটি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ফনিশিয়ান লিপি বেশ জনপ্রিয় হয়ে যায় এবং সমগ্র ভূ-মধ্যসাগরীয় অন্ঞলে তা ছড়িয়ে পড়ে। গ্রিক ও ইহুদীরা ফিনিশীয়দের কাছ থেকে বর্ণমালার ধারণা ধার করে। গ্রিক বর্ণমালায় বর্ণের সংখ্যা ২৪। তারা ব্যঞ্জনবর্ণের পাশাপাশি স্বরবর্ণেরও প্রচলন করেছিল। পরে গ্রিকদের কাছ থেকে রোমানরা লিপির ধারণা নেয়। রোমান বর্ণমালা থেকেই পরে প্রায় সমস্ত ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার বর্ণমালা তৈরি হয়।
ছবিঃ প্রাচীন ফিনিশিয়ান বর্ণমালা।
খ্রিস্টপূর্বঃ ৮০০ সালের দিকে ফিনিশিয়ান লিপি অভিযোজিত হয়ে জন্ম দেয় আরামিক লিপির (Aramaic alphabet) এই লিপি থেকেই পরবর্তীতে আধুনিক আরবী ও হিব্রু লিপি জন্ম নেয়।
চিত্রঃ আরামিক লিপি (৮০০ খ্রিপুর্ব থেকে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ)
কোন কোন ভাষা বিশেষজ্ঞ মনে করেন ফিনিশিয়ান লিপি থেকে আরামিক লিপির সাখে অন্য একটি লিপির জন্ম হয়েছিল খিস্ট্রপূর্ব ৬০০ শতকের দিকে যার নাম ব্রাহ্মি লিপি (Brāhmī Script).। অর্থাৎ আরামিক ও ব্রাহ্মি লিপি একই মাতার সন্তান। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন ব্রাহ্মি লিপির জন্ম হয়েছে আরামিক লিপি থেকে। কেউ কেউ বলেন, প্রাচীন ভারতীয়রা স্বাধীন ভাবেই এই লিপিটি আবিষ্কার করেন, এটি কারো কাছ থেকে জন্ম নেয়নি। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ শতকে উত্তর-মধ্য ভারতের শিলালিপিতে ব্রাহ্মি লিপি নিদর্শন পাওয়া গেছে।
চিত্রঃ ব্রাহ্মি শিলা লিপি
চিত্রঃ ব্রাহ্মি বর্ণমালা
খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ব্রাহ্মি লিপি প্রচলিত ছিল। এরপর অশোক লিপি বা মৌর্য লিপিতে এর বিবর্তন শুরু হয়
চিত্র: অশোকের ব্রাহ্মি লিপি
আশোকান ব্রাহ্মি লিপি থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে জন্মনেয় গুপ্তলিপি (Gupta script) নামের নতুন লিপি। গুপ্ত রাজাদের আমলে এই লিপিতে সংস্কৃত চর্চা করা হোত।এটি চতুর্থ ও ৫ম শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল
চিত্রঃ গুপ্তলিপি
গুপ্ত শাসনকালে অশোকের ব্রাহ্মিলিপি ভারতের পূর্বাঞ্চলে 600 খ্রিম্টাব্দের দিকে যে রূপ ধারন করেছিলো তাকে সিদ্ধাম (Siddhaṃ) লিপি বলা হয়। এতে মূলত সংস্কৃতচর্চা করা হোত। বৌদ্ধ ধর্মের অসংখ্য গাথা লিখিত হয়েছে সিদ্ধাম লিপিতে।
চিত্রঃ সিদ্ধাম লিপিতে লেখা Heart Sūtra
চিত্রঃ কুটিল লিপি
সিদ্ধাম লিপির বর্ণমালাসমূহ-
এই সিদ্ধামলিপি থেকেই একাদশ শতকের দিকে জন্মনেয় আমাদের প্রিয় বাংলা লিপি।
অনেকের মতে,সিদ্ধামলিপির বোন হিসাবে বিবেচনা করা হয় নগরীলিপিকে যারা প্রত্যেকেই কুটিল লিপির অন্তর্গত। অনেকে মনে করেন, প্রাচীন নাগরী লিপির পূর্ব শাখা থেকে ১০ম শতকের শেষভাগে এসে উৎপত্তি হয়েছে বাংলা লিপির।
মোট কথা, মূলত কুটিল লিপি থেকেই জন্ম হয় বাংলা লিপির।
চিত্রঃ সিলেটের বিখ্যাত নগরী লিপি।
১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল ব্রাসি হালেদের লেখা A Grammar of the Bengal Language প্রকাশনার মাধ্যমে বাংলা মুদ্রণশিল্পের জন্ম হয়। বইটি ইংরেজি ভাষাতে লেখা হলেও এতে বাংলা বর্ণপরিচয় ও বাংলা লেখার নিদর্শন সবই বাংলা মুদ্রাক্ষরে ছাপা হয়। এই মুদ্রণে প্রথমবারের মত "বিচল হরফ" (movable type) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
চিত্রঃ হ্যালহেডের ব্যাকরণে বাংলা
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য একটি ছাপাখানাখোলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের জন্য অনেকগুলি প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
চিত্রঃ ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণপরিচয়।
ইউরোপে ১৯শ শতকের শেষ দিকে লাইনোটাইপ মেশিনে ছাপানোর চল হয়। ১৯৩০-এর দশকে বাংলা হরফও লাইনো মেশিনে ছাপানোর চিন্তাভাবনা শুরু হয়। লাইনোটাইপ মেশিনে ছাপানোর অনেক সুবিধা থাকলেও এর একটি অসুবিধা ছিল এতে আড়াইশো-র মত চিহ্ন রাখার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতিতে হরফের সংখ্যা ছিল বিশাল। "করণ টাইপ" নামের এক পদ্ধতিতে এর সংখ্যা কমলেও তার পরেও সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০-র মত হরফের ব্লক প্রয়োজন হত। আনন্দবাজার প্রকাশনা সংস্থার সুরেশচন্দ্র মজুমদার রাজশেখর বসুর পরামর্শে বাংলা হরফের বিরাট আকারের সংস্কার সাধন করেন। তিনি স্বরবর্ণের কার-চিহ্নগুলি সকল ক্ষেত্রে একই আকারের রাখার ব্যবস্থা করলেন এবং এগুলি ব্যঞ্জন বা যুক্তব্যঞ্জনের নিচে বা উপরে না বসিয়ে সামান্য ডানে বা বামে সরিয়ে আলাদা অক্ষর হিসেবে ছাপার ব্যবস্থা করলেন। এছাড়াও তিনি অনেক যুক্তব্যঞ্জনের একই উপাদান ব্যঞ্জনাক্ষরের সাধারণ আদল আলাদা করে সেটির হরফ বানালেন, ফলে যুক্তব্যঞ্জন ছাপানোতেও হরফের সংখ্যার অনেক সাশ্রয় হল। শেষ পর্যন্ত সুরেশচন্দ্র বাংলা হরফের সংখ্যাকে চাবির ডালায় ১২৪টি এবং বিবিধ আরও ৫০টিতে নামিয়ে আনতে পেরেছিলেন।
চিত্রঃ আনন্দ বাজার পত্রিকা
বর্তমানে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ছাপা অক্ষরের সুদর্শন যে রূপটি সংবাদপত্র, বইপত্র, বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড, গণমাধ্যম, মাল্টিমিডিয়াসহ সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়, তা আসলে ৭০-এর দশকে সৃষ্ট এই লাইনোটাইপ বেঙ্গলিরই কোনও না কোন রূপ।
এতধাপ পেরিয়েই এসছে এই আমাদের বাংলা বর্ণমালা!
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
--- নেট মাস্টার।
(বাংলা বর্ণমালার ক্রমবিকাশের উপর ইন্টারনেটে বাংলায় ধারাবাহিক ও গোছানো কোন লেখা না থাকায়, বহুদিন ধরে বহুকিছু পড়ে পড়ে গুছিয়ে এই লেখা লিখলাম যাতে সহজে সবাই পড়ে নিতে পারে। কারো কাজে লাগলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।)
Author: Dr. Tanzil
আমি নেট মাস্টার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 14 বছর 3 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 64 টি টিউন ও 1834 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 9 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
বিশেষজ্ঞ! হতে পরিনি?আগে জানা ছিল।তবে আরো কিছু জানতে পারলাম।