প্রোগ্রামিং প্রতিযগিতা নিয়ে সাক্ষাতকার :: মোঃ মাহবুবুল হাসান – বাংলাদেশের কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং কমিউনিটিতে এক সুপরিচিত নাম

মোঃ মাহবুবুল হাসান বাংলাদেশের কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং কমিউনিটিতে এক সুপরিচিত নাম। সেই কলেজ লেভেল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রোগ্রামিং কনটেস্টের সাথে জড়িত আছেন। দুবারের আইসিপিসি ওয়ার্ল্ড ফাইনালিস্ট। কোডশেফের প্রোগ্রামার অফ দ্যা মান্থ। কোডফোর্সেস এ আগের রেটিংব্যবস্থায় প্রথম বাংলাদেশি রেড কোডার।  বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক।আমরা তার সাথে কথা বলেছি বাংলাদেশে প্রোগ্রামিং কনটেস্টের বর্তমান অবস্থা, এর বিভিন্ন সমস্যা এবং তার সমাধানের উপায় নিয়ে।

সাক্ষাতকার গ্রহণেঃ মীর ওয়াসি আহমেদ

মীর ওয়াসি আহমেদঃ প্রোগ্রামিং এবং প্রোগ্রামিং কনটেস্ট সাথে কিভাবে পরিচিত হলেন?

মোঃ মাহবুবুল হাসানঃ ক্লাস সিক্স এর শেষের দিকে আমি একটা কারিগরী শাখার কম্পিউটার শিক্ষা বই পাই। সেখানে কিউবেসিক এ বেশ কিছু ছোটখাটো প্রবলেম এবং তার সমাধান ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে আমার পিসিতেও কিউবেসিক ছিলো। আমি সেসব প্রোগ্রাম করে বেশ মজা পেয়েছিলাম। ক্লাস এইট এ আমি ভিজুয়াল বেসিক নামে যে আরো একটি ল্যাঙ্গুয়েজ আছে তা জানতে পারলাম, এবং বই কিনে এনে বেশ কিছু ছোট খাটো প্রোগ্রাম লিখেছিলাম। ক্লাস টেন এ সম্ভবত, আমি কোনো ভাবে জানতে পারি প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট নামে কিছু একটা আছে এবং ইউভিএ (ইউনিভার্সিটি অফ ভ্যালাদোলিদ এর অনলাইন জাজ) সাইট এর ঠিকানা পাই। যতদূর মনে পড়ে কায়কোবাদ স্যার এর কোনো একট লেখা থেকেই জানতে পেরেছিলাম। আমি ওখানকার এর ১০০ নাম্বার প্রবলেমটা চেষ্টা করেছিলাম, এবং তা কম্পাইল এরর দিয়েছিলো, কারণ আমি তখন conio.h, goto, clrscr, getch এরকম নানা কিছু ব্যবহার করেছিলাম। এর পরে ঠিক মনে নেই, কোথা থেকে যেন সেই প্রবলেম এর সমাধান পেয়েছিলাম। আমি প্রথমে ওই প্রোগ্রামটা সাবমিট করে দেখেছিলাম যে ওটা ঠিক আছে (অ্যাক্সেপ্টেড) কিনা, এর পর আমি আমার প্রোগ্রামটার একটা একটা লাইন মুছে মুছে বুঝার চেষ্টা করেছিলাম কেন আমার নিজের প্রোগ্রামটা কাজ করে নি, এভাবেই আমার প্রোগ্রামিং এর সাথে পরিচয়।

 প্রোগ্রামিং কনটেস্ট এর বিষয়ে বলতে হলে বলতে হয়, তখন ইউভিএ তে অনেক কনটেস্ট হত।অনেক মানে, দেখা যেত মাসে একটা। সেই কনটেস্ট গুলোতে আমি নিয়মিত অংশ নিতাম। সর্ব প্রথম আমি যে অনসাইট কনটেস্ট করেছিলাম তা ছিলো রুয়েটে এ আয়োজিত ইন্টারনাল প্র্যাকটিস কনটেস্ট। যদি আমার ঠিকঠাক মনে থাকে, সেখানে সবগুলো সমস্যার মধ্যে একটি সমস্যা সমাধান আমি করতে পারি নি। সব কয়টি সমস্যা সমাধান করে ছিলো রুয়েটেরই একটি দল। যেটা সমধান করতে পারিনি তা ছিলো এরকম: অনেক গুলো Resistance দেয়া আছে। এখন দুইটি বিন্দুর মাঝেResistance বের করতে হবে। তোমরা যারা এই এই ইন্টারভিউটা পড়বে তারা চিন্তা করে দেখতে পারো। আমি তখন কলেজ এ ফার্স্ট কি সেকেন্ড ইয়ার এর ছাত্র ছিলাম। এর পরে জাতীয় পর্যায়ের প্রথম প্রতিযোগিতা ছিল এসিএম আইসিপিসি ঢাকা রিজিওনাল ২০০৫ এ (আনঅফিসিয়ালি -প্রতিযোগিতাটা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছিল, আমরা তখনো কলেজে)। আমাদের দল সেখানে আমরা ৫ টি সমস্যার সমাধান করেছিলাম। চীনের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে ৬ টি সমস্যার সমাধান করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ সমাধান ছিল ৪টি। ঐ দলে ছিলাম শাহরিয়ার রউফ নাফি, খোবাইব চৌধুরী এবং আমি।

 ওয়াসিঃ এত কিছু থাকতে কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং কেন?

 মাহবুবঃ জানি না। তবে আমি এধরনের প্রবলেম সল্ভিং এ সবসময়ই খুব মজা পেয়ে এসেছি। আমি এটিকে সবসময়ই মজা বা আনন্দ বা মোট কথা ফান হিসেবে দেখে এসেছি, কিন্তু সিরিয়াস ফান। তবে ফান কিভাবে সিরিয়াস হয় তা অবশ্য বলতে পারবো না (হা হা)।

 ওয়াসিঃ আমরা জানি বাইরের দেশগুলোতে স্কুলের বাচ্চারা অনেক আগ থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর সাথে পরিচিত হয়। বিভিন্ন অলিম্পিয়াড হয়। আমাদের দেশে ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াড হয়, কিন্তু খুবই সীমিত পরিসরে। আমাদের দেশে গণিত অলিম্পিয়াড কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াড সে ভাবে জনপ্রিয় হয় নি। প্রতিবন্ধকতাগুলো কোন জায়গায় বলে মনে করেন?

 মাহবুবঃ আমাদের দেশে গণিত অলিম্পিয়াড এর প্রশ্ন কিন্তু বাইরের দেশের অলিম্পিয়াড এর প্রশ্নের তুলনায় কিছুই না। এখানে যে ক্যাম্প হয়ে থাকে সেখানেও কিন্তু খুব ভালো রকম প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাও আমি বিশ্বাস করি না । কিন্তু তাও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (IMO) গিয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা ভালো করছে বলে আমি মনে করি। এর কারণ হলো, গণিত অলিম্পিয়াড এর জনপ্রিয়তা। আমি একটু খোলাসা করে বলি, আমাদের দেশে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হয়, এর প্রধান উদ্দেশ্য IMO তে ভালো করা না, এর প্রধান উদ্দেশ্য সকলের মাঝে গণিতের জাগরণ ঘটানো। স্কুল-কলেজের বহু শিক্ষক আজে বাজে কারণে নম্বর কেটে থাকেন, ছেলে মেয়েরা এখন এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যে গণিতও মুখস্ত করে। অবশ্যই এটার জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী। এই গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য গণিত অলিম্পিয়াড অসাধারণ ভুমিকা পালন করেছে । এবং এরই ফলশ্রুতিতে বহু ছেলে মেয়ে গণিত অলিম্পিয়াডের আওতায় এসেছে এবং অনেক জনের মাঝে অবশ্যই এক জন বা দুই জন ব্যতিক্রম মেধাধর্মী থাকবেই থাকবে। আর যারা এক্সেপশনাল না, তারা একে অপরের সাথে যখন প্রতিযোগিতা করে তখন অবশ্যই তাদের উন্নতি হয়। ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াডের (হাইস্কুল লেভেলের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা)ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় অন্তরায়। আমরা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌছাতে পারছিনা। যদি পারতাম তাহলে আমি নিশ্চিত অনেক আগেই আন্তর্জাতিক ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াডের (IOI) এ স্বর্ণপদক আনা সম্ভব ছিলো। আর এজন্য প্রয়োজন ডাচ বাংলা ব্যাঙ্ক বা এই রকম একটি বড় স্পন্সর এবং প্রথম আলো এর মতো বড় কোনো প্রচার মিডিয়া।

 আর যদি এসব সম্ভব না হয়, তাহলে আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসা উচিত। BUET, DU, RUET, KUET, CUET, MBSTU এরকম বহু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ আছে। সেখানের যারা প্রোগ্রামিং কনটেস্ট এ অংশ নেয় তারা যদি নিজ উদ্যোগে সেই শহরের কিছু (এই ধরা যাক ২০/৩০ জন) আগ্রহী এবং মেধাবী স্কুল/কলেজ এর ছেলেমেয়েদের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ এবং প্রব্লেম সলভিং এর তালিম দিতো তাহলে আমার মনে হয় আমাদের ছেলে মেয়েরা অনেক উপকৃত হত। আমরা ইনফরম্যাটিক্স অলিম্পিয়াডে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। আমরা কিন্তু IOI এর জন্য ট্রেনিং এর আয়োজন করে থাকি, কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত বেসিক কভার করা ছেলে মেয়ে আমরা খুব কম পাই। যদি প্রোগ্রামিং কনটেস্টেন্টরা এগিয়ে আসে তাহলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি।

 ওয়াসিঃ আশা করি আপনার পরামর্শ মেনে বিভিন্ন জায়গায় প্রোগ্রামিং কন্টেস্টেন্টরা এইরকম উদ্যোগ নেবে। এই যে একটু আগে স্পন্সরশীপের কথা বললেন আমাদের দেশের একটি কোম্পানির জন্যে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার স্পন্সর হওয়াটা কেন একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার হবে?

 মাহবুবঃ প্রোগ্রামিং স্কিল দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই কোম্পানিগুলোকে দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। ভারতীয় কোম্পানি Directi অনেক অনেক টাকা ব্যয় করছে সেদেশের এসিএম আইসিপিসির জন্যে এর জন্য। এবং তার ফলস্বরূপ, ৩ বছরের মাথায়, তারা ২০ তম স্থান দখল করেছে। এতে আমি জানি না সেই কোম্পানি এর কোনো লাভ হচ্ছে কিনা, তবে এটুকু বলতে পারি, বহু বহু ছেলেমেয়ে এখন কোডিং করছে, দেশে বহু রত্ন জন্ম নিচ্ছে। হ্যা রত্ন, কারণ আমাদের দেশের কারা Google, Microsoft এ গিয়েছে? কমপক্ষে ৯০% ই প্রোগ্রামিং কনটেস্ট করা। সবাই হয়তো সেসব বিদেশি কোম্পানিতে যাবে না। না গেলেও আমাদের দেশে ভালো প্রোগ্রামার এর সংখ্যা বাড়বে। দেশের আইটি খাত শক্তিশালী হবে। এখানেই বড় সফটওয়্যার কোম্পানি জন্ম নেবে।

 ওয়াসিঃ এ বিষয়ে আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আশা করব Directiএর মত আমাদের দেশের কোন কোম্পানী এগিয়ে আসবে। আচ্ছা, এদেশের পাঠ্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন করি। উচ্চ-মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রমে ডিসক্রিট ম্যাথম্যাটিক্স (বিচ্ছিন্ন গণিত) বলে যে অংশটি আছে, সেটি অত্যন্ত দায়সারা ভাবে লেখা। আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটি খুবই নিম্নমানের। আপনি কি মনে করেন এই অংশটি আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থাপন করা গেলে আরো বেশি ছেলেমেয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে আগ্রহী হতো?

 মাহবুবঃ আসলে শুধু বিচ্ছিন্ন গণিত না, আমার মনে হয় প্রথম শ্রেণী হতে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সকল শ্রেনীর গণিত সিলেবাস বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ঢেলে সাজানো দরকার। এবং সেই সাথে গণিত বইয়েও বিস্তর পরিবর্তন আনা জরুরী, এবং এ জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়ে এই কাজটি করানো।

 ওয়াসিঃ আপনার কি কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়টি মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে ছিল? থাকলে সেটি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?

মাহবুবঃ এক কথায়, জঘন্য ।

ওয়াসিঃ ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। একটু আগে আপনি প্রোগ্রামিং এবং তার Fun aspect এর কথা বললেন। আপনার কি মনে হয় এখনকার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক বিনোদনের মাধ্যমগুলো আর টানছে না? নতুন কিছু শেখার ইচ্ছাটা তাদের মধ্যে কমে যাচ্ছে?

 মাহবুবঃ আমরা যখন ঐ বয়সে ছিলাম তখন ইন্টারনেট বেশ দুস্প্রাপ্য ছিলো, কিন্তু এখন প্রায় প্রত্যেক ছেলেমেয়ের হাতে মোবাইল আছে, এবং সেই মোবাইল এ ইন্টারনেট আছে। ইন্টারনেটের শক্তিকে কাজে লাগানো উচিত। ইদানিং ছেলেমেয়েরা সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকে। আমি বলছি না যে, ফেসবুক খারাপ জিনিস, কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত কোন কিছুই ঠিক নয়। ফেসবুকের বাইরেও অনেক ইন্টারেস্টিং জিনিস করার আছে। এটা ঠিক যে হয়তো গ্রামের ছেলে মেয়েরা এখনো ইন্টারনেট সেভাবে পায় না, কিন্তু শহরের ছেলে মেয়েদের কাছে ইন্টারনেট এখন খুবই সহজলভ্য জিনিস। আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কাছে তো বটেই।  আমাদের শিক্ষার্থীরা একটা খুব ভালো যুক্তি দেয় তা হলো, টিচারদের কথা বুঝি না, তারা বাজে পড়ান, কিন্তু এখন যেভাবে ইন্টারনেট এ সব কিছুই সহজে পাওয়া যায়, তারা যদি খোঁজে, তাহলেই হাজারো ডকুমেন্ট, ভিডিও পাওয়া যাবে। এখন শেখা অনেক সহজ, প্রয়োজন শিখতে চাইবার আগ্রহ।

 ওয়াসিঃ হুমম, আপনি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আপনার কাছে একটা ব্যাপার জানতে চাই। ছাত্রছাত্রীরা যারা কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে আসে, সাধারনভাবে তাদের প্রত্যাশা কি? তারা কি বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তারপর পড়তে আসছে? নাকি অন্যদের কাছ থেকে প্রভাবিত হচ্ছে? এর পিছনে বিষয়টির প্রতি আগ্রহ কতটুকু কাজ করছে? ভালো চাকরীপ্রাপ্তির আশা কতটুকু কাজ করছে?

 মাহবুবঃ আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের বড় করা হয় মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা শুনিয়ে। তোমাকে মেডিক্যাল এ চান্স পেতে হবে, তোমাকে বুয়েটের এ ইলেক্ট্রিক্যালে চান্স পেতে হবে। কিন্তু কখনো ঐ ছেলে বা মেয়ের ইচ্ছা অনুসারে পড়তে দেয়া হয় না। আমি এ জন্য বাবা-মার দোষ দেবো না। কারণ বাবা-মা খুব ভালো করেই জানে, তার ছেলে মেয়ে যদি আর্টসে ভর্তি হয় তাহলে তার পেট ভরবে না। যদি ফিজিক্সে এ পড়ে তাহলে তো মানসম্মান থাকবে না, চাকরিও জুটবে না। তাহলে আমরা ঐ সকল ছাত্র ছাত্রী কই থেকে পাবো যারা কম্পিউটার সায়েন্স এর প্রতি সত্যিই প্যাশনেট?

 ওয়াসিঃ আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই কোন কোন পেশাকে সম্মানজনক আবার কোন কোনটিকে মূল্যহীন করে রেখেছে।ছেলেমেয়েরা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সামাজিকভাবে বেশি মর্যাদাপূর্ণ/অর্থকরী কোন পেশাকেই বেছে নিচ্ছে। যাই হোক। আমরা আবার প্রোগ্রামিং কনটেস্ট প্রসংগে ফিরে আসি। আপনার ক্লাসের যেসব ছাত্র প্রোগ্রামিং কন্টেস্টে ভালো করছে, ক্লাসের বিষয়গুলোতে তারা কেমন করছে?

 মাহবুবঃ দুই ধরনেরই আছে, কেউ ভালো করে কেউ খারাপ করে। তবে যে প্রোগ্রামিং কনটেস্ট করে তারা কখনো কোডিং এর ল্যাব এ খারাপ করে না এটুকু বলতে পারি। এবং শুধু তাই না,প্রোগ্রামিং কনটেস্ট করে এবং করে না এদের পার্থক্য খুব ভালো করে করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের শিক্ষার সিস্টেম এত বাজে যে তারা আসলে এসবে মজা পায় না, সেজন্য সবাই আসলে ভালো করে না। একটা উদাহরণ দেই, বুয়েট এ বহু প্রোগ্রামিং কনটেস্টেন্ট আছে যাদের অ্যালগোরিদম কোর্সগুলোর থিওরিতে A+ তো দূরে থাক হয়তো A- ও জুটে না, কিন্তু যারা A+ পেয়েছে তাদের তুলনায় হাজারগুনে বেশি জানে।

 ওয়াসিঃ ক্লাসের সেরা ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন আপনি। কনটেস্ট এ ভালো করার জন্যে প্র্যাকটিসে অনেক সময় দিতে হয়। পড়াশোনা ঠিক রেখে কনটেস্টে ভালো করার রহস্য কি?

 মাহবুবঃ সত্যি বলতে আমি তেমন পড়াশুনা করি নাই। বহুজন ছিল যারা পরীক্ষায় ভালো করার জন্য ঘড়ি ধরে অঙ্ক করতো, এই অঙ্ক আমাকে ৫ মিনিট করতে হবে, এরকম ভাবে। কিন্তু আমি এরকম কাজ কখনো করতে পারি নাই। এ জন্য বহু কোর্সে খারাপ রেজাল্ট হয়েছে। এছাড়াও গতানুগতিক চোথা থেকে কঠিন অঙ্ক দেয়া তো আছেই। আমি সবসময়ই যা করেছি, তা হলো ক্লাস লেকচার ভালো মতো পড়ে গিয়েছি। এমনকি আগের বছরের প্রশ্ন সলভ করে গিয়েছি খুবই কম সময়। বহু জন আছে যারা ক্লাস চলাকালীন সময়েই আগের বছরের প্রশ্ন সলভ করতো। তারাই ভালো রেজাল্ট করেছে। আমার কাছে ভালো রেজাল্ট করতে হবে এটা কখনই লক্ষ্য ছিলো না। আমি চেষ্টা করতাম সম্পূর্ণ লেকচার বুঝে পড়ে যেতে, এর বাইরে কিছুই করি নাই। তবে হা, ক্লাস এ আমি ভীষণ রেগুলার ছিলাম। কোনো ক্লাস মিস দিতাম না। যদি স্যার ভালো পড়াতেন তাহলে অবশ্যই ক্লাস মনোযোগ দিয়ে করতাম, আর যদি স্যারের পড়ানো ভালো না হলে মন দিতাম না (হাহা)।

 ওয়াসিঃ হাহা, OK।

 প্রোগ্রামিং কনটেস্ট এ সাফল্যের জন্যে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার পাশাপাশি প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা। এটি অনেকেরই জানা, আমাদের দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধরণের প্রতিযোগিতার জন্যে অনেক সময় ডিপার্টমেন্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা পাওয়া যায় না। প্রোগ্রামিং কন্টেস্টকে অনেক যায়গায় নিছক সময় নষ্ট বলে মনে করা হয়। অথচ অনেক অনুৎপাদনশীল কাজে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ দিতে তাদের আপত্তি থাকে না। এ ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?

 মাহবুবঃ কায়কোবাদ স্যার একটা কথা বলেন, এমআইটি/হার্ভার্ড/স্ট্যানফোর্ড এর মতো বিশ্ববিদ্যালয় যদি এসিএম আইসিপিসিতে অংশ নেয়, তাহলে আমাদের চোখ বন্ধ করে ওখানে অংশগ্রহন করা উচিত। তারা হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তারা যদি কোনো কিছু করে তাতে ‘কিছু একটা‘ আছে বলেই করে। এবং যারা মনে করে এটা শুধু অর্থের অপচয় তারা গর্ধভ ছাড়া আর কিছুই না।

 ওয়াসিঃ আইসিপিসির মূল পর্বে বাংলাদেশের দলগুলো ভালো করছেনা। আমার দল এই বছর আইসিপিসির মূল পর্বে কোয়ালিফাই করে এবং সেখানে আমরা বেশ খারাপ করি। এখন প্রশ্ন হলো ,বিদ্যমান পরিকাঠামোর মধ্যেই উল্লেখ করার মতো ভালো করা সম্ভব, নাকি নতুন করে ভাবার সময় এসেছে? কি কি পরিবর্তন আনা উচিত বলে মনে করেন?

 মাহবুবঃ আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে শুরু করাটা একটু দেরীই হয়ে যায়। ভালো করা শুরু করতে করতেই তার সময় শেষ হয়ে যায়। এজন্য আমাদের স্কুল/কলেজ এর দিকে তাকাতে হবে। আর তবে ভালো করা যে অসম্ভব তা নয়, যেহেতু দেরী হয়েই গেছে, তাই আরো অনেক বেশি বেশি পরিশ্রম করতে হবে। এখন ইন্টারনেটে শেখার অনেক জায়গা আছে। এছাড়াও আমরা ক্যাম্প আয়োজন করে থাকি, সেখান থেকেও অনেক কিছু শেখা সম্ভব। আমরা দেখি বছরে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রোগ্রামিং কনটেস্ট আয়োজন করে, কিন্তু আমার মনে হয় এক্ষেত্রে একটু পরিবর্তন আনতে পারলে ভালো হয়। এত কনটেস্ট আয়োজন না করে যদি কিছু কর্মশালা/ক্যাম্প যদি আয়োজন করা যেত আমার মনে হয় ছেলেমেয়েরা আরো বেশি উপকৃত হত।

 ওয়াসিঃ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রোগ্রামিং কন্টেস্টকে বেশ গুরুত্বের সংগে নিচ্ছে। এখনকার সময়ের সিংহভাগ কন্টেস্টের আয়োজক তারাই। তারা ট্রেনার নিয়োগ করছে, এমনকি বিদেশেও দল পাঠাচ্ছে। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?

 মাহবুবঃ এটা সত্যিই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, এখানে ছেলেমেয়েদের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এর আগ্রহ বেশি। একজন ট্রেইনার কিছু শিখাতে পারেন, কিছু রাস্তা ধরিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু শেষে কাজ কিন্তু করতে হবে ওই ছেলে/মেয়ে কেই। তাকে অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগই দেখা যায়, এই পরিশ্রম করতে চায় না, এবং মাঝপথেই ছেড়ে দেয়,এটা দুঃখজনক।

 ওয়াসিঃ নবীন কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামারদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

 মাহবুবঃ দেখো, যেকোনো কিছু অর্জন করতে হলে অনেক অনেক কষ্ট করতে হয়। যদি এমনি এমনি কিছু পাওয়া যেত তাহলে তো কাউকেই কিছু করতে হত না। যদি তুমি সত্যিই প্রোগ্রামিং এবং প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট এ মজা পাও তাহলে কষ্ট করো, বেশি বেশি করে সলভ করো, অন্য দেশে কি হয় তার খোঁজ রাখো। বিদেশিদের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের লেভেল কে উন্নত করো। মনে রেখো, যতদিন ছাত্র আছো, ততদিনই তোমার সুযোগ, এরপর আর চাইলেও এই মজা আর পাবে না।

 ওয়াসিঃ আপনাকে ধন্যবাদ, PROGক্রিয়াকে সময় দেওয়ার জন্যে।

প্রথম প্রকাশ
http://progkriya.com/2012/05/29/interview-with-md-mahbubul-hasan/

Level 0

আমি nzml। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 13 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 6 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস

দারুন টিউন। সোজা প্রিয়তে। যতবার পড়ব প্রোগ্রমিংএ উৎসাহ বাড়বে।

Level 0

versity life er programming contest, iiucpc, ncpc, icpc koto contest korlam, Raw programming er mojay alada, professional life e baje programming kora hoy. insert, update, delete, exception handling chara ar kichui korte hoy na… joghonno professional life.

টিউনটি পড়ে খুব ভালো লাগলো । টিউনারকে অনেক ধন্যবাদ । প্রোগ্রামিং সম্পর্কে অনেক মূল্যবান কথা বলার জন্য মাহবুব স্যারকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।