এটোমিক বোম্ব

অ্যাটমিক বোম্ব: ধ্বংসের মহাশক্তি

 

ভূমিকা

 

অ্যাটমিক বোম্ব বা পারমাণবিক বোম্ব হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্রগুলোর একটি, যা নিউক্লিয়ার ফিশন বা ফিউশন প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে প্রথমবারের মতো এটোমিক বোমা ব্যবহার করা হয়। এরপর থেকেই এটি মানব সভ্যতার জন্য এক চরম বিপদের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

-

 

অ্যাটমিক বোমার আবিষ্কার ও বিকাশ

 

অ্যাটমিক বোমার ধারণাটি ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীদের গবেষণার মাধ্যমে সামনে আসে। জার্মান বিজ্ঞানীরা ১৯৩৮ সালে প্রথম ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়ার ফিশন আবিষ্কার করেন, যা পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ভিত্তি তৈরি করে।

 

ম্যানহাটন প্রজেক্ট

 

১৯৪২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র "ম্যানহাটন প্রজেক্ট" নামে একটি গোপন গবেষণা কর্মসূচি চালু করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করা। বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ও এনরিকো ফার্মির মতো গবেষকরা এতে কাজ করেছিলেন। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোতে প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণের (ট্রিনিটি টেস্ট) সফল পরীক্ষা করা হয়।

 

 

-

 

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণ

 

৬ আগস্ট ১৯৪৫: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা শহরে "লিটল বয়" নামের একটি ইউরেনিয়াম ভিত্তিক এটোমিক বোমা নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় ১, ৪০, ০০০ মানুষ মারা যায়।

 

৯ আগস্ট ১৯৪৫: তিন দিন পর নাগাসাকি শহরে "ফ্যাট ম্যান" নামের প্লুটোনিয়াম ভিত্তিক একটি বোমা ফেলা হয়, যার ফলে প্রায় ৭৪, ০০০ মানুষ মারা যায়।

 

এই দুটি হামলার পর জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়।

 

 

-

 

অ্যাটমিক বোমার কার্যপ্রণালী

 

অ্যাটমিক বোমার শক্তি নিউক্লিয়ার ফিশন বা ফিউশন প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।

 

নিউক্লিয়ার ফিশন:

 

ভারী উপাদান যেমন ইউরেনিয়াম-২৩৫ বা প্লুটোনিয়াম-২৩৯ পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভাজিত হলে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়।

 

একে বলা হয় চেইন রিঅ্যাকশন, যা কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে সংঘটিত হয়।

 

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহৃত বোমাগুলো ফিশন ভিত্তিক ছিল।

 

 

নিউক্লিয়ার ফিউশন:

 

দুটি হালকা পরমাণু, সাধারণত হাইড্রোজেন আইসোটোপ, একত্রিত হয়ে আরও ভারী পরমাণু তৈরি করে।

 

এতে প্রচণ্ড তাপ ও শক্তি উৎপন্ন হয়।

 

হাইড্রোজেন বোম্ব বা থারমোনিউক্লিয়ার বোম্ব ফিউশন পদ্ধতিতে কাজ করে, যা ফিশন বোমার চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী।

 

 

 

-

 

অ্যাটমিক বোমার প্রভাব

 

পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে চারটি প্রধান ধ্বংসাত্মক প্রভাব দেখা যায়:

 

১. তাপীয় বিকিরণ:

 

বিস্ফোরণের কেন্দ্রস্থলে তাপমাত্রা কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যায়।

 

মুহূর্তের মধ্যে বিশাল এলাকা পুড়ে যায়।

 

মানুষ, ভবন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।

 

 

২. ধ্বংসাত্মক তরঙ্গ:

 

বিস্ফোরণের ফলে এক বিশাল শকওয়েভ সৃষ্টি হয়, যা কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ভবন ও অবকাঠামো ভেঙে ফেলে।

 

শকওয়েভের কারণে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয় ও আহত হয়।

 

 

৩. তেজস্ক্রিয়তা:

 

বিস্ফোরণের পর বাতাসে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে, যা ক্যান্সার, জন্মগত ত্রুটি ও দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হয়।

 

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণের পর বহু বছর ধরে মানুষ তেজস্ক্রিয়তার কারণে আক্রান্ত হয়েছে।

 

 

৪. পারমাণবিক শীত:

 

যদি বিশাল আকারের পারমাণবিক যুদ্ধ হয়, তবে বাতাসে প্রচুর ধূলিকণা ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়বে, যা সূর্যালোককে প্রতিরোধ করবে।

 

ফলে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা কমে গিয়ে খাদ্য সংকট ও পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেবে।

 

 

 

-

 

পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও ঠান্ডা যুদ্ধ

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়, যা "ঠান্ডা যুদ্ধ" নামে পরিচিত।

 

প্রধান ঘটনাবলী:

 

১৯৪৯: সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা করে।

 

১৯৫২: যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থারমোনিউক্লিয়ার বোমা পরীক্ষা করে।

 

১৯৬২: কিউবান মিসাইল সংকটের সময় বিশ্ব প্রায় পারমাণবিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বসেছিল।

 

১৯৬৮: পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT) স্বাক্ষরিত হয়।

 

 

আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে আছে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।

 

 

-

 

আন্তর্জাতিক চুক্তি ও পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ

 

পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা বুঝতে পেরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দেশগুলো এর বিস্তার রোধে চুক্তি করেছে।

 

১. পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT - ১৯৬৮):

 

পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা ও নিরস্ত্রীকরণ নিশ্চিত করা এর প্রধান লক্ষ্য।

 

 

২. পারমাণবিক পরীক্ষা নিষিদ্ধকরণ চুক্তি (CTBT - ১৯৯৬):

 

পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এটি করা হয়।

 

 

৩. পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টা:

 

বিশ্বের কিছু দেশ পারমাণবিক অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে (যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা)।

 

তবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া এখনো পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে আছে।

 

 

 

-

 

উপসংহার

 

অ্যাটমিক বোমা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী আবিষ্কারগুলোর একটি। এটি কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই ভয়াবহ নয়, বরং মানবজাতির অস্তিত্বকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে। তাই বিশ্বকে অবশ্যই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং শান্তির পথে এগিয়ে যেতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এই মারণাস্ত্র আর ব্যবহৃত না হয়।

 

"একটি পারমাণবিক যুদ্ধের ফলাফল হবে সভ্যতার চূড়ান্ত ধ্বংস, যা কোনো দেশই কামনা করে না। "

Level 1

আমি তাহমিদ হাসান। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস