জুন ১৯৮৩ সাল। সারা অ্যামেরিকা জুড়ে চলছে সুপারহিট সিনেমা, ওয়ার গেইমস। সিনেমার কাহিনী হচ্ছে, এক স্কুলছাত্র ভুলক্রমে অ্যামেরিকান এয়ারফোর্সের মূল নিয়ন্ত্রন কম্পিউটারে ঢুকে যায়, এবং তার মনে হয়, এটা নতুন কোন ভিডিও গেম। সে গেম খেলে যাচ্ছে, আর তার দেয়া আদেশে আকাশে উড়ছে যুদ্ধবিমান—ছুটে যাচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। প্রায় তৃতীয় বিশ্বযুধ লেগে যাওয়ার মত অবস্থা। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সিনেমাটা দেখে অ্যামেরিকান মিলিটারি চিফকে জিজ্ঞেস করেন, “এরকম কি হতে পারে? আসলেই কি কেউ আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন কম্পিউটারে ঢুকে যেতে পারে?” জেনারেল এক সপ্তাহ সময় চান, এবং তারপর এসে রিপোর্ট দেন যে বাস্তবতা সিনেমার চাইতেও ভয়াবহ। সেই বিশ্লেষণের ফলশ্রুতি হিসাবে ১৫ মাস পরে আসে “জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন এবং স্বয়ংক্রিয় তথ্য ব্যাবস্থা নিরাপত্তা নীতি”। এত আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েও আমেরিকার সরকারি কম্পিউটার এখনও প্রচুর হ্যাক হচ্ছে।
তার ৩৩ বছর পর, ২০১৬র ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৯৫১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা সাইবার ডাকাতি করার চেষ্টা করেছিল হ্যাকাররা।
আট হাজার কোটি টাকা কতটুকু? বাংলাদেশের এবছরের বাজেটে ছেচল্লিশটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেট আট হাজার চারশো কোটি টাকা
পদ্মা ব্রিজের এক চতুর্থাংশ তৈরির খরচ আট হাজার কোটি টাকা
বাংলাদেশের কৃষি বা স্বাস্থ্য খাতের মোট বাজেটেরও এক চতুর্থাংশ আট হাজার কোটি টাকা
হ্যাকিং কী? কোথা থেকে এর উৎপত্তি?
কারা হ্যাক করে? কেন করে?
ভাইরাস আর ransomware কী?
সাইবারস্পেইসে নিরাপদ থাকার জন্য করনীয় কিছু টিপস আর বাংলাদেশ ব্যাংক সাইবারডাকাতির ঘটনা নিয়ে আমার স্ক্রিপ্টের ওপর ভিত্তি করে থিংক বাংলা চমৎকার একটা ভিডিও তৈরি করেছে। লেখাটা একটু লম্বা, তাই পুরোটা পড়ার ধৈর্য না থাকলে অন্তত ভিডিওটা দেখার অনুরোধ করব। (থিংকবাংলার প্রতিটা ভিডিও অত্যন্ত উচ্চমানের—সময় থাকলে সবকটা দেখা উচিত)
https://www.youtube.com/watch?v=l5JKCPIcEkE
হ্যাক শব্দটা বলতে বেশিরভাগ মানুষ ৭০ বছর আগে ভাবতো টুকরা টুকরা করে কাটা। ১৯৫৯ সালে অ্যামেরিকার বিখ্যাত বিশ্ববদ্যালয় MITর মডেল রেইলরোড ক্লাব “হ্যাক” শব্দটার অর্থ করল জোড়াতালি দিয়ে কোন কাজ শেষ করা, উদ্দেশ্যবিহীন কাজ, ইত্যাদি।
১৯৭৬ সালে প্রথম হ্যাকার আর কম্পিউটারকে একসাথে তুলে ধরা হলো, কিন্তু তখনো অর্থ আগের মতই জোড়াতালি কাজ ছিল।
তারপর কম্পিউটারের কাজে খুব দক্ষ মানুষদের নাম হলো হ্যাকার—যারা যে কোনভাবেই কাজ উদ্ধার করে আনতে পারে। এই ব্যবহারটা ইদানিং ফিরে এসেছে—বই মেলা আর ইউটিউব জুড়ে লাইফ-হ্যাকের সমারোহ।
১৯৭৫এ জার্গন ফাইল নামে একটা অনলাইন ডিকশনারি “হ্যাকার” শব্দটার সংজ্ঞা দিলে এইভাবেঃ খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে যে গোপনীয় তথ্য বের করার চেষ্টা করে, যেমন পাসওয়ার্ড হ্যাকার, নেটওয়ার্ক হ্যাকার, ইত্যাদি।
কিন্তু তারও কয়েক বছর আগে, ক্যালিফোর্নিয়া আর সারা অ্যামেরিকা জুড়ে বিনা খরচে ফোন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল একদল মানুষ, যাদেরকে বলা হতো ফ্রিকারস। তাদের মধ্যে একজনের নাম প্রায় সবাই জানে—অ্যাপল কম্পিউটারের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস। আরেকজন তারই বন্ধু ও অ্যাপল কম্পিউটারের আরেক প্রতিষ্ঠাতা, স্টিভ ওজনিয়াক। তখন ফোনের সংযোগ দেয়া নিয়ন্ত্রন করা হতো যে যন্ত্র বা সুইচ দিয়ে, সেগুলিকে ফোনের লাইনে শিষের মত শব্দ করে নির্দেশ দেয়া হতো। দুই স্টিভ একটা যন্ত্র বানালেন, যেটা দিয়ে নিজের ইচ্ছা মত নির্দেশ দেয়া যায় ফোন কোম্পানির সুইচকে, এবং বিনা খরচে বিদেশে বা অন্য কোথাও ইচ্ছামত ফোন করা যায়। এই ধরনের যন্ত্রকে বলা হয় ব্লু বক্স। তারপর তারা সেই বক্স বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে ১৫০ ডলারে বিক্রি করা শুরু করলেন।
অ্যাপল কম্পিউটার শুরু করার মূলধনের কিছুটা এসেছিল এই ফোন হ্যাকিং করার যন্ত্র বিক্রি থেকেই।
যেহেতু হ্যাকাররা বেআইনি কাজ করে, তাদের নিজেদের ঠিকানা লুকানোর জন্যও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের আগে, যখন ফোন লাইনের মাধ্যমে কম্পিউটারে সংযুক্ত হওয়া লাগতো, ব্লু বক্স সেই কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছিল। কিন্তু বিনা খরচে ফোন করেই সব হ্যাকার থেমে থাকলো না। তাদের কেউ কেউ ভাইরাস বা ওয়ার্ম বানানো শুরু করল।
ঠিক জৈবিক ভাইরাসের মতই, কম্পিউটার ভাইরাস কম্পিউটার বা সেটার তথ্যের ক্ষতি করতে পারে। এবং জৈবিক ভাইরাসের মতই, সেটা নিজে থেকে চলতে পারে না, তার বাহক লাগে। ১৯৪০ সালে জার্মান গণিতবিদ জন ফন নিউম্যান প্রথম কম্পিউটার ভাইরাসের ধারণা দেন। তার প্রায় ৩০ বছর পরে গবেষকরা ক্রিপার নামে প্রথম ভাইরাস তৈরি করেন সেটা কীভাবে কাজ করে দেখার জন্য। ১৯৭১ সালে বর্তমান ইন্টারনেটের উত্তরসুরি, অ্যামেরিকান মিলিটারির নেটওয়ার্ক আরপানেটে এই ভাইরাস পরীক্ষামূলকভাবে ছাড়া হয়। এটা কোন ক্ষতি করতো না, স্ক্রিনে শুধু একটা কথা দেখাতো। এই ক্রিপার নিজে থেকে এক কম্পিউটার থেকে সংযুক্ত অন্য কম্পিউটারে যেতে পারতো। চলনশক্তি ওয়ালা এই ধরনের ভাইরাসকে বলা হয় ওয়ার্ম বা কেঁচো।
এই ধরনের ওয়ার্ম কীভাবে হ্যাকিং এ সহায়তা করে, আমরা দেখব পরের অংশে
ইরানের আনবিক বোমা বানানো নিয়ে অ্যামেরিকা আর ইজরাইল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিন্তু ইরানের আনবিক বোমা গবেষণাকেন্দ্র মাটির ২০০ ফিট নিচে, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিয়ে তা ঢাকা। তাই অ্যামেরিকা আর ইজরাইল একটা ডিজিটাল অস্ত্র উদ্ভাবন করলো, যা কোন কম্পিউটারে চললে সেটা তার আশেপাশের সব কম্পিউটারকে পরীক্ষা করে দেখবে, সেটার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোন ছিদ্র আছে নাকি। যদি ছিদ্র পায়, তাহলে সেখানে সেই ওয়ার্মের মতই ঢুকে যাবে, নিজেকে চালু করবে, আবার আশেপাশের অন্য কম্পিউটারকে আক্রমণ করবে, যতক্ষন পর্যন্ত না সেটা আনবিক বোমার ইউরেনিয়াম পরিশোধন করার যন্ত্রের কম্পিউটার পর্যন্ত পৌছাতে না পেরেছে।
এই ওয়ার্ম বা ডিজিটাল অস্ত্রটাকে স্টাক্সনেট নামে ডাকা হয়। ডিজিটাল অস্ত্র সাধারণত একটা নিরাপত্তা ছিদ্র বা ভালরানারেবিলিটি ব্যবহার করে, এবং সেটার জন্য মাত্র একভাবেই আঘাত করতে পারে। যে নিরাপত্তা ছিদ্র সম্পর্কে কেউ এখনো জানে না, সেটাকে জিরো ডে বা নতুন আঘাত বলা হয়। স্টাক্সনেট একটা নয়, দুটো নয়, বিশটা নতুন আঘাত নিয়ে শুরু করেছিল।
কিন্তু এই ডিজিটাল অস্ত্র কীভাবে ইরানিদের কম্পিউটারে ঢোকানো হবে? অ্যামেরিকান আর ইজরাইলি গুপ্তচররা ২০০৯ সালে কিছু ইরানি কোম্পানির পার্কিং লটে ইউএসবি বা থাম্ব ড্রাইভ ফেলে দিয়ে এসেছিল। কর্মচারিরা যখন সেগুলি পেয়ে অফিসের কম্পিউটারে লাগিয়েছে ড্রাইভে কি আছে দেখার জন্য, তখন ওয়ার্মটা জেগে ওঠে, এবং আক্রমণ চালিয়ে যায় যতক্ষন পর্যন্ত না সেই নিয়ন্ত্রন কম্পিউটারটাকে খুঁজে পায়।
ইউরেনিয়াম পরিশোধনের জন্য অতি দ্রুত গতিতে ইউরেনিয়ামকে সেন্ট্রিফিউজ নামে এক ধরনের যন্ত্রে ঘোরানো লাগে। সেটাকে নিয়ন্ত্রন করে জার্মানির সিমেন্স কোম্পানির তৈরি এক ধরনের বিশেষ চিপ। স্টাক্সনেট সেই চিপকে আক্রমণ করে, এবং সেন্ট্রিফিউজকে তার সর্বোচ্চ গতিতে ঘোরাতে থাকে। ফলে কিছুক্ষনের মধ্যেই সেন্ট্রিফিউজের মটোর জ্বলে যায়, বিয়ারিং নষ্ট হয়ে যায়। আর একই সাথে স্টাক্সনেট ভুল তথ্য সরবরাহ করে ফলে যাদের কাজ সেন্ট্রিফিউজের ওপর নজর রাখা, তারা ভাবে, সবকিছু ঠিক আছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, স্টাক্সনেট কোন নেটওয়ার্ক, কোন কম্পিউটারকে আক্রমণ করছে, সেটার ব্যাপারে নির্বিচার। আরো বড় সমস্যা, সিমেন্সের ঐ চিপ সারা পৃথিবীর বিভিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে, ট্রাফিক লাইটে, ফ্যাক্টরিতে, রেললাইন নিয়ন্ত্রনে ব্যবহার করা হয়। ফলে স্টাক্সনেট প্রায় করোনাভাইরাসের মত গতিতেই ছড়িয়ে গেল, এবং ২০১০ এবং ২০১১তে দেখা গেল, পৃথিবীর অন্তত ১১৫টা দেশের উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাকে স্টাক্সনেট আক্রমণ করে বসে আছে, যা নিয়ন্ত্রনে আনতে কয়েক বছর লেগেছে।
তবে গুপ্তচর সংস্থাগুলিই শুধু সাইবার আক্রমণ করে, তাই না। বিভিন্ন ধরনের হ্যাকাররা বিভিন্ন কারনে আক্রমণ করে থাকে।
যারা সাইবার আক্রমন করে সেই সাইবার ক্রিমিনাল বা তথ্যাপরাধীরা কয়েক গোত্রের হতে পারেঃ
- খুচরা তথ্যাপরাধী (স্ক্রিপ্টকিডি) - নিজেরা কোন ডিজিটাল আক্রমণ বা তথ্যাস্ত্র উদ্ভাবন করতে পারে না—এরা অন্যের তৈরি করা তথ্যাস্ত্র ব্যবহার করে। এদের মূল উদ্দেশ্য মাস্তানি বা বাজারে নাম কেনা। এরা সুযোগ পেলে বাহাদুরি করে, কিন্তু কোন বড় ক্ষতি করার ক্ষমতা এদের নেই।
- আদর্শিক তথ্যাপরাধী (হ্যাকটিভিস্ট)- যারা কোন আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আক্রমন করে। ২০১২তে বাংলাদেশী হ্যাকটিভিস্ট হ্যাকাররা প্রায় ২০, ০০০ ভারতীয় ওয়েবসাইট আক্রমণ করে বন্ধ করে দিয়েছিল। ভারতীয়রাও তার শোধ নিয়েছে বাংলাদেশী ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়ে।
- অন্তর্ঘাতক তথ্যাপরাধী –যারা কোন কারনে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের দফতরকে আক্রমন করে।
- সংগঠিত অপরাধী তথ্যাপরাধী (অরগানাইজড ক্রিমিনাল হ্যাকার) – অপরাধ যাদের পেশা, এবং যারা এখন তথ্যাপরাধীতার মাধ্যমে টাকা বানাচ্ছে। Ransomware এখন এদের বড় অস্ত্র
- বিদেশি সরকারী তথ্যাপরাধী (নেশন স্টেট অ্যাক্টর)– যখন একটি বিদেশি সরকার এই কাজে লিপ্ত হয়। স্টাক্সনেট এটার একটা উদাহরণ। ২০১৬তে রাশিয়ান ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের ফলাফল বদলানোর চেস্টার ঘটনাও সুবিদিত।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্রিমিনাল আর সরকারী কর্মচারিরা একসাথে কাজ করে, এবং বাংলাদেশ ২০১৬ সালে তাতে বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছে কিন্তু তারপরেও কিছু টাকা হারিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একটা অংশ নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখে। সুইফট নামে আন্ত ব্যাংক সংযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়ে এই টাকার আদানপ্রদান করা হয়। ১৯৭০ সালে চালু হওয়া সুইফট ২০১৬ পর্যন্ত নিশ্ছিদ্র ও নিরাপদ বলে ধারণা করা হতো।
২০১৬-র ৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে কে বা কারা সুইফটের মাধ্যমে ফেডারেল রিজার্ভকে ৩৫টা নির্দেশ দেয়, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনে মোট ৯৫১ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় আট হাজার কোটি টাকা পাঠাতে। এর মধ্যে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনে চারটি নির্দেশের মাধ্যমে যায় ৮১ মিলিয়ন ডলার বা ছয়শ আশি কোটি টাকা। শ্রীলংকায় যাওয়ার কথা ছিল প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা, কিন্তু হ্যাকাররা নির্দেশে ফাউন্ডেশন শব্দের বানান ভুল করায় মধ্যবর্তী একটি প্রতিষ্ঠান, জার্মান ব্যাংক ডয়চে ব্যাংকের নিউ ইয়র্ক শাখা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে আবার নির্দেশ চায়। অবশেষে শ্রীলংকার প্যান এশিয়া ব্যাংক হয়ে টাকাটা ফেরত আসে নিউ ইয়র্কে। ফেডারেল রিজার্ভেরও ইতিমধ্যে টনক নড়েছে, তারা বাকি ৮৫০ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশী টাকায় ৭১৪০ কোটি টাকাও আটকে দেয়।
হ্যাকাররা প্রচুর গবেষণা করে এই কাজে হাত দিয়েছিল। ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহষ্পতিবার। পরের দিন শুক্রবার বাংলাদেশে ছুটি, কিন্তু বিশ্বের বাকি সব দেশে ব্যাংক খোলা। ঐদিন কিছু করলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারুর চোখে পড়বে না ব্যাংক আবার না খোলা পর্যন্ত, কিন্তু নিউ ইয়র্ক থেকে টাকা ঠিকই বের হয়ে যাবে।
ফিলিপাইনসে অপরাধীরা ২০১৫র মে মাসে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছে, তারপর তারা অপেক্ষা করেছে ২০১৬ পর্যন্ত সেখানে সাইবারডাকাতি করা টাকা জমা করতে।
হ্যাকাররা ২০১৫-র জানুয়ারীতে চাকরি চেয়ে ইমেইল পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। সেই ইমেইলে সিভি বা রেজুমের একটা লিংক ছিল, যা ক্লিক করলে একটা ওয়ার্ম ডাউনলোড হয়ে সাথে সাথে সেই কম্পিউটারকে আক্রমণ করে, এবং সেটার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়, তারপর নেটওয়ার্কের অন্য কম্পিউটারকে আক্রমন করে। এভাবে এই ওয়ার্ম মোট ৩২টা কম্পিউটারকে দখল করে। অবশেষে ২০১৬-র জানুয়ারিতে তারা সুইফট নেটওয়ার্কের কম্পিউটারে পৌছায়।
সেই কম্পিউটারগুলির নিয়ন্ত্রন নেয়ার পরে হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ দেয়ার পদ্ধতি, বিদেশী কোন ব্যাংককে কীভাবে নির্দেশ দেয়া হয়, সেটা পর্যবেক্ষন করে ও শিখে নেয়। তারপর তারা সুইফট সফটওয়্যারটার কার্যপদ্ধিতিতেও পরিবর্তন আনে, যাতে কোন কিছু প্রিন্ট না হয় এবং যাতে এই নির্দেশ পাঠানোর কোন চিহ্ন যেন কারুর চোখে না পড়ে।
অবশেষে তারা সেই ৩৫টি নির্দেশ পাঠায়। বাকি কাহিনী আমরা আগেই শুনেছি।
ফিলিপাইনসে যাওয়া ছয়শো আশি কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ১৪৩ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া গিয়েছে। বাকি ৫৩৮ কোটি টাকার কোন হদিস নেই। বাংলাদেশের মত দেশের জন্য এটা বড় একটা আঘাত। আর যদি সাইবারঅপরাধীদের চেষ্টা করা আট হাজার কোটি টাকাই বের হয়ে যেত, সেটা বিশাল বড় আঘাত হতো বাংলাদেশের জন্য।
বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার বা পুলিশ এই হ্যাকিং এর পেছনে কারা জড়িত, তা নিয়ে কিছু বলে নাই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আমন্ত্রণে অ্যামেরিকান একটি কোম্পানি এটার সাইবার ময়নাতদন্ত করেছিল, এবং অ্যামেরিকা ও ব্রিটিশ সরকারী ও বেসরকারী কিছু সংস্থা এই ওয়ার্মটাকে খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছে। এই রকম অন্য আক্রমণ ও প্রোগ্রামিং স্টাইল দেখে ধারণা করা হয়, ল্যাজারাস ও বিগল বয়েজ নামে উত্তর কোরিয়ার দুটি সরকারী হ্যাকারের দল এর পেছনে আছে। বাংলাদেশের আরো অনেক ব্যাংক কিছুদিন আগে এটিএম হ্যাকিং এর শিকার হয়ে রাতের বেলা এটিএম বন্ধ করে রাখতো। প্রশ্ন আসতে পারে, নর্থ কোরিয়া কেন হ্যাকিং করছে। নর্থ কোরিয়ার তেমন কোন রফতানী নেই, এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারনে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়ার পথ খুব সীমিত। তাই হ্যাকিঙয়ের মাধ্যমে তারা বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ খুঁজে নিয়েছে
সরকারী হ্যাকিং দল ছাড়াও মাফিয়াদের মত সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। এদের প্রিয় একটা পদ্ধতি হচ্ছে ransomware বা ভাইরাস আক্রমণ করে মুক্তিপণ দাবী করা। এই ধরনের কিছু দল, যাদের মধ্যে উত্তর কোরিয়ার সরকারী হ্যাকাররাও আছে। এই মুক্তিপণ কাজ করে ভিক্টমের কম্পিউটারের জরুরী ফাইল বা তথ্য এনক্রিপ্ট বা গুপ্তায়ন করে। তারপর তারা বিটকয়েন বা এই জাতীয় ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে মুক্তিপণ দাবী করে। ইদানিং এরা সাধারণ মানুষ বাদ দিয়ে হাসপাতাল ও ব্যাবসায়ের পেছনে মনোযোগ দিয়েছে, কারন হাসপাতালের মেডিক্যাল রেকর্ড না পেলে রোগী মারা যেতে পারে, ফলে অনেক হাসপাতাল মুক্তিপন দিতে বাধ্য হয়েছে। ধারণা করা হয়, বিশ্বব্যাপি ransomware এর ফলে বিশ বিলিয়ন ডলার, বা বাংলাদেশের মোট বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষতি হয়।
হ্যাকার বা সাইবার অপরাধীরা শুধু ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করে, এমন না। যে সাধারণ মানুষের ফেইসবুক বা ইমেইল অ্যাকাউন্ট আক্রান্ত হতে পারে, বিকাশ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা বের হয়ে যেতে পারে, ransomware এ জরুরী ফাইল আটক হয়ে যেতে পারে। সেগুলি থেকে মুক্ত থাকার জন্য কয়েকটা কাজ করা জরুরী। সেই কাজগুলি কী, জানার জন্য ভিডিওটা দেখতে হবে।
সবাই ভালো থাকুন, সাইবার আক্রমণ থেকে নিজে নিরাপদ থাকুন ও অন্যকে নিরাপদ থাকতে সাহায্য করুন
আমি মোঃ বিপ্লব হোসেন। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 মাস 3 সপ্তাহ যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 3 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
I play with computers.