বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের ইতিহাসের মৃত্যু

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল এক মহাসাগরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে জাহাজ, বিমান ইত্যাদি এক অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কারণে। আসলেই কি তাই? কি ঘটে আসলে সেখানে? তাই দেখে নেওয়া যাক।

পরিচিতিঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গল হলো আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত ত্রিভুজাকৃতির এক বিশেষ অঞ্চল। এর এক কোণে বারমুডা দ্বীপ আর অন্য দুই প্রান্তে মায়ামি বিচ ও পুয়ের্তে রিকোর সান জুয়ান অবস্থিত। কেও কেও মনে করেন এর আকার ট্রাপিজিয়ামের মতো, আবার কেও কেও মনে করেন এটি মেক্সিকো উপসাগরকেও যুক্ত করে। এ স্থান নিয়ে সর্বপ্রথম কথা উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে। অর্থ্যাৎ ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাঁচটি টিভিএম অ্যাভেঞ্জার উড়োজাহাজ এবং একটি উদ্ধারকারী উড়োজাহাজ রহস্যজনকভাবে এ স্থানে এসে উধাও হয়ে যায়।
এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ টি বিমান ও প্রায় ১০০ টির কাছাকাছি জাহাজ এ স্থান থেকে নিখোঁজ হয়েছে বলে জানা যায়।
এরপর থেকে শুরু হয় এ স্থানে বিভিন্ন যান হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। হারিয়ে যাওয়ার খাতায় একের পর এক যুক্ত হতে থাকে বিমান, নৌকা, জাহাজসহ আরও অনেক কিছুই।

বারমুডা আটলান্টিক মহাসাগরের উপর ৫ লক্ষ কিলোমিটার বর্গক্ষেত্রের একটি  বিশাল এলাকা যা ফ্লোরিডা, পুয়ের্তো রিকো এবং বারমুডার মধ্যে অবস্থিত। ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৪৯, ১৯৬২, ১৯৬৫, ২০০৫, ২০০৭ এবং ২০১৭ সালে ঘটে আরও বিমান দুর্ঘটনা। ১৮০০ সালে ঘটে প্রথম জাহাজ দুর্ঘটনায় যেখানে প্রাণ হারায় ৯০ জনের মতো যাত্রী। এছাড়া ১৮১৪, ১৮২৪, ১৮৪০, ১৯১৮, ১৯২১, ১৯২৫, ১৯৪১, ১৯৬৩ এবং ২০১৫ সালে অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে এই ট্রায়াঙ্গলে। ধারণা করা হয় এ পর্যন্ত ৫০টি বাণিজ্যিক জাহাজ ও ২০টি বিমান হারিয়ে গেছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, আজ অব্দি প্রায় ১০০০ জনের মতো বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এর মাঝে প্রাণ হারিয়েছেন, যা গড়ে প্রতি বছরে ১০ জনের সমান।
১৯৬৪ সালে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের দুর্ঘটনাগুলোর রহস্যময়তা বর্ণনা করে প্রথমবারের মত একটি বই লেখা হয়। যার নাম Invisible Horizones. বইটির লেখক ছিলেন Vincent Gaddis. এর পর থেকে বারমুডাকে নিয়ে একের পর এক বই লেখা হতে থাকে।

বিশেষ কয়েকটি ঘটনাঃ

১। ফ্লাইট নাইন্টিন - বারমুডার কথা আসবে অথচ ফ্লাইট নাইন্টিনের কথা আসবে না এটা তো ভাবাই যায় না। এই ৫টি বিমান ১৯৪৫ সালে ৫ ডিসেম্বর আটলান্টিক মহাসাগরে হারিয়ে যায়। এরপর এই ৫টি বিমান খুজতে আরও একটি বিমান গেলে সেটাও আর ফিরে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন নেভিগেশনে ভুলের কারণে জালানি শেষ হওয়ার ফলে বিমানগুলো হারিয়ে যায়।

২। ইউএসএস সাইক্লপসঃ বারমুডার ইতিহাসে সবথেকে বড় দূর্ঘটনা হলো এটি। ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ বার্বাডোস দ্বীপ থেকে উড্ডয়নের পর ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়ে এবং ৩০৯ জন স্ক্রুসহ বিকল হয়ে যায়। তবে বেশিরভাগ গবেষকদের ধারণা মূলত অতিরিক্ত ভার বহনের কারণেই এই বিমানটি সাগরে ডুবে যায়।

সমস্যা সমাধানঃ এতক্ষণ আমরা দেখেছি বারমুডায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দূর্ঘটনা। এবার দেখে নেওয়া যার এর পিছনে আসল ঘটনা কি।

এর পিছনে অনেক বিষয়ই থাকতে পারে।
পাব্লিসিটিঃ এটি একটি ঘটনা রহস্যময় বানিয়ে তার উপর বিভিন্ন বই, আর্টিকেল, সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করে টাকা আয় করা অনেক পুরনো চিন্তা। এছাড়া এ বিষয় এর উপর শত শত কোটি টাকা খরচ করে বহু মুভি ও তৈরি করা হয়েছে।

উচ্চ ঢেউঃ ‘চ্যানেল ৫’ তাদের ‘দ্যা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল এনিগমা’ তথ্যচিত্রে দাবি করেছে সম্ভবত এই রহস্যজনকভাবে বিমান বা জাহাজ উধাও হয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে ১০০ ফুট উচ্চতার ‘রাফ ওয়েভ’ বা ‘ভয়ঙ্কর ঢেউ। ’ কিন্তু আসলেই কি এই ‘রাফ ওয়েভ’?

বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘অত্যন্ত ঝোড়ো ঢেউ। ’ এই ঢেউগুলি ১০০ ফুট উচ্চতা পর্যন্ত উপরে উঠতে পারে। ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম একটি স্যাটেলাইটের সাহায্যে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি সমুদ্র উপকুলে এই ভয়ঙ্কর ঢেউ লক্ষ্য করা যায়।

মেঘের গন্ডগোলঃ ২০১৬ সালে কলরাভো স্টেট ইউনিভার্সিটির, স্যাটেলাইট মিটিওরোলজিস্ট  ড. স্টিভ মিলার,  নাসার স্যাটেলাইট এর বিভিন্ন ছবি বিশ্লেষণ করে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য থিওরি দিয়েছিলেন। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলেরর অনেক অংশ জুড়ে থাকে ষড়ভুজ আকার মেঘ থাকে এবং এর কোন কোন মেঘের  বিস্তৃতি ২০ থেকে ৫৫ মাইল পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এখানকার বায়ুবেগ প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১৭০ মাইল!  আর এসবই হলো জাহাজ ও বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।

বিশেষজ্ঞদের মতামতঃ সমুদ্র বিজ্ঞানী সাইমন বক্সবল বলেন, আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর তিনটি ভিন্ন জায়গা থেকে তিনটি ভয়ঙ্কর ঝড় আশার ফলে ওইসময় ভয়ঙ্কর ঢেউের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি আরও বলেন এইরকম ঢেউ জাহাজটিকে টুকরো টুকরো করেও দিয়ে থাকতে পারে।

বিজ্ঞানী ডঃ ক্রসজেলনেইকি বলেন এমন নয় যে শুধুমাত্র বারমুডা ট্রায়াঙ্গলেই এইরকম ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীর বহু জায়গাতেই এইরকম ঘটনার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে উত্তর মিললেও বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের সমাধান হয়নি। দ্যা ন্যাশনাল ওসিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফোরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিজ্ঞানী ডঃ ক্রসজেলনেইকির সঙ্গে একমত হয়ে জানিয়েছেন, যে এই ট্রায়াঙ্গলের সঙ্গে অন্যান্য জায়গার কোনও তফাৎ নেই। একই ধরনের বাতাস ও সমুদ্রের অবস্থান রয়েছে সেখানে।

১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয় Larry kusche  এর “The Bermuda  Triangle Mystery : Solved “ বইটি। যুক্তিতে ভরপুর এই বইটিতে দেখানো হয়েছে যে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নিয়ে বেশিরভাগ গল্পই ভুয়া এবং অতিরঞ্জিত। প্রমাণ সহকারে ল্যারি দেখান যে, বারমুডার বেশিরভাগ প্রচলিত দুর্ঘটনাই  আসলে সেখানে নয় বরং অন্য কোথাও ঘটেছে। আর ট্রপিক্যাল সাইক্লোন প্রবণ অঞ্চলে জাহাজডুবি তো স্বাভাবিক ঘটনা।

তার গবেষণা ছিলো অত্যন্ত সরল প্রকৃতির এবং তিনি পত্রপত্রিকা ঘেটেই বারমুডা রহস্য উদঘাটন করেন। পরিশেষে তিনি এই উপসংহারে আসেন যে,

১. দুঘটনা কবলিত জাহাজ এবং উড়োজাহাজের সংখ্যা অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করা হয়েছিল।

২. এটা এমন একটি এলাকা যেখানে প্রতিনিয়ত মৌসুমী ঝড় বহমান। এবং ঝড়ের সাথে দুর্ঘটনার সংখ্যা তুলনা করলে সেটা যথেষ্ট বাস্তব-সম্মত মনে হয়।

৩. বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকাটি অত্যন্ত ব্যস্ত নৌ-পথ। ব্যস্ততা তুলনা করলে এখানে ঘটা দুর্ঘটনার সংখ্যা সমুদ্রের অন্যান্য এলাকায় ঘটা দুর্ঘটনার সাথে সমতুল্য।

৪. ব্যস্ত নৌপথ হওয়ায় এখানে প্রচুর জলদস্যুর আনাগোনা ছিল। এরা সাধারণত ছোটখাটো জাহাজে লুটপাট চালিয়ে সেগুলোকে ডুবিয়ে দিত।

৫. অনেকসময় খবর আংশিকভাবে প্রকাশ করা হত। কোন জাহাজ বা প্লেনের নিখোঁজ হওযার খবর প্রচার হত। কিন্তু ফিরে আসার খবর প্রচার হত না।

কুশের বইটি প্রকাশের পর সবার টনক নড়ে এবং আরো যা পাওয়া যায়:

৬. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই এলাকায় প্রচুর সাবমেরিন মোতায়েন হয়। এদের আক্রমনে যেসব জাহাজ ও প্লেন ডুবি হত সেগুলো সামরিক কর্তৃপক্ষ গোপন রাখত।

৭. এই এলাকার নীচ থেকে প্রচুর মিথেন গ্যাস নির্গত হয় যা পানির সাথে মিশে হাইড্রেটেড মিথেন তৈরি করে। এই হাইড্রেটেড মিথেন বেশ হালকা। একারনে কিছু কিছু ভারী জাহাজ পানিতে ডুবে যায়।

৮. মেক্সিকান উপসাগরীয় প্রবল স্রোতে(এই স্রোতটি অনেকটা নদীর মত) অনেক দুর্ঘটনা কবলিত যান দুরে ভেসে যায়।

৯. কম্পাসের ব্যপারে তথ্য হল পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই কম্পাসের বিক্ষেপের ভিন্নতা দেখা যায় যেহেতু পৃথিবীর ভৌগলিক মেরু এবং চৌম্বকীয় মেরু এক নয়। খুব অল্প কিছু যায়গায় অবস্থানকালে একই দুই মেরু একই দিকে থাকে এবং কম্পাস সঠিক দিক নির্দেশ করে। অন্যত্র কম্পাস চৌম্বকমেরুর দিক নির্দেশ করে।

১০. মানুষের ভুলেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ইউএস নেভীর তথ্য থেকে জানা যায়।

মার্কিন সরকার বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে স্বীকৃতি দেয় না এবং এলাকাটি কোনো অফিসিয়াল মানচিত্রে প্রদর্শিত হয় না।  এবং কোস্ট গার্ড এবং ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স বারবার এলাকাটি বা এর কিংবদন্তিগুলিকে কোনো অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে।  তদুপরি, এমন কোন প্রমাণ নেই যে এই অঞ্চলে যে পরিমাণ ট্র্যাফিক অতিক্রম করে তার হিসাব করার পরে, বিশ্বের অন্য যেকোন স্থানের তুলনায় সামুদ্রিক বা বিমান চলাচলের বিপর্যয়ের উচ্চ হার দেখে।

এছাড়া আরও ছোট বড় প্রায় ১২-১৫ টি কারণ আছে এই স্থান থেকে বিভিন্ন যার হারিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পরিশেষে এটা বলাই যায় যে এ স্থানে কোনো সমস্যা থাকুক আর না থাকুক, যারা এ বিষয় পুজি করে চলছে, তাদের লাভের খাতা হিসেব বিহীনভাবে বেড়েই চলেছে।
<!-/data/user/0/com.samsung.android.app.notes/files/clipdata/clipdata_bodytext_221022_231224_173.sdocx->

Level 1

আমি Sk Shakib। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 2 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 8 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস