পাইরেসি বিশ্বব্যপী একটি সমস্যা। কিন্তু দারিদ্র তার চেয়েও আগে আসে। প্রথম আলোয় পল্লব মোহাইমেনের লেখাটি পড়ার পড়েই টিউনারদের সাথে শেয়ার করার ইচ্ছা হয়েছিল। আজ দিলাম, যারা পড়েছেন তারা জানেন যারা পড়েন নি বা মনে নেই তাদের জন্য এটি, দিলাম কারন সবার জানা দরকার।
বাংলাদেশে এখন নতুন একটি কম্পিউটার ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। কম্পিউটারে নানা কাজ করার জন্য যেসব সফটওয়্যার বা প্রোগ্রাম প্রয়োজন, সেসব ভরাই থাকে যন্ত্রটিতে। উইন্ডোজের মতো অপারেটিং সিস্টেম থেকে শুরু করে, লেখালেখি, হিসাবকিতাব করা−সব কাজের সফটওয়্যার চাইলেই পাওয়া যায় ওই কম্পিউটারের সঙ্গে। সস্তায় কম্পিউটার পাওয়ার কারণে এর ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে দারুণভাবে। এখন একজন মধ্যবিত্ত অভিভাবকও তাঁর সন্তানের জন্য একটা কম্পিউটার কেনার কথা ভাবতে পারেন।
সফটওয়্যারগুলোর লাইসেন্স যদি পয়সা দিয়ে কিনতে হতো তাহলে? শুধু উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম আর অতি জরুরি এমএস অফিস সফটওয়্যারসহ ১৬ হাজার টাকার কম্পিউটারের দাম দাঁড়াত ৫৫ হাজার টাকা। উইন্ডোজ ভিসতার দাম ১১ হাজার টাকা আর মাইক্রোসফট অফিসের দাম ৪০০ ডলার মানে ২৮ হাজার টাকার মতো। দেশের যেকোনো জায়গায় হলিউডের অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র, ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে বিনোদননির্ভর বলিউডি চলচ্চিত্র ডিভিডিতে পাওয়া যাচ্ছে ৬০ থেকে ১০০ টাকায়। আসল ডিভিডি কিনতে হলে ন্যূনতম ১৫ থেকে ২০ ডলার বেরিয়ে যেত পকেট থেকে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু বার্ষিক আয় এখন মাত্র ৪০০ ডলার। জনপ্রিয় এসব সফটওয়্যার যদি পয়সা দিয়ে কিনতে হতো তবে ফলাফলস্বরূপ দেশে কম্পিউটার ব্যবহারের হার কমে যেত আশঙ্কাজনকভাবে।
এবার একটা চিঠির কথায় আসি। ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর তারিখে সরকারি এই চিঠিটি লিখেছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কপিরাইট অফিস। চিঠি পাঠানো হয়েছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, ব্যাংকসহ বেসরকারি বড় বড় সংস্থা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানকে। পত্রের বিষয় হলো, ‘ব্যবহূত সফটওয়্যারসমূহের লাইসেন্স/অনুমতিপত্র সম্পর্কে তথ্য প্রেরণ।’ গোটা চিঠির মোদ্দা কথা এ রকম−বাংলাদেশ ওয়াল্র্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অরগানাইজেশন (উইপো) এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হিসেবে এর আন্তর্জাতিক চুক্তি/কনভেনশনের কপিরাইট-সংক্রান্ত সকল শর্তপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। ফলে এ দেশের সৃজনশীল কর্মসমূহ, একই সঙ্গে বহির্বিশ্ব থেকে আগত সৃজনশীল কর্ম ও ট্রেডনেম-সংবলিত সব কর্মের কপিরাইট লঙ্ঘন বা পাইরেসি প্রতিরোধের দায়দায়িত্ব কপিরাইট অফিসের।
এরপর বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি সাহিত্যকর্ম, শিল্পকর্ম, চলচ্চিত্র, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট-সংক্রান্ত কোনো কাজসহ যেকোনো সৃজনশীল কর্মের কপিরাইট লঙ্ঘন বা পাইরেসি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত)-এর বিধানমতে, কপিরাইট লঙ্ঘন বা পাইরেসির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি হলো পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ বছরের জরিমানা। কপিরাইট আইনের ৮৪ ধারায় কম্পিউটারে পাইরেটেড কপি ব্যবহারের জন্য ছয় মাস থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা এক থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
চিঠির শেষাংশে আছে কপিরাইট লঙ্ঘন/পাইরেসি প্রতিরোধে এসবের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবকে আহ্বায়ক করে র্যাবের সম্পৃক্ততায় ১১ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স কাজ শুরু করেছে। সবশেষে প্রাপকের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ৩১ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিষ্ঠানে ব্যবহূত সফটওয়্যার সম্পর্কে কপিরাইট অফিসে তথ্য জানাতে হবে। চিঠি পাওয়ার পর অনেকে তথ্য দিয়েছেন, অনেকে দেননি।
কোনো প্রতিষ্ঠানে কপি করা সফটওয়্যার ব্যবহারের তথ্য জানালেই চলবে নাকি জানালে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা চিঠিতে পরিষ্কার নয়। এই চিঠিতে বাংলাদেশ ডব্লিউটিওর সদস্য তা বলা হলেও অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশও যে ডব্লিউটিওর ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টিং রাইটস (ট্রিপস) চুক্তিতে সই করেছে তা বলা হয়নি। ট্রিপসের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে চিঠিতে। এই চিঠির পেছন পেছন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাইক্রোসফট বাংলাদেশের একটি চিঠি যাওয়ার কথাও জানা গেছে। সেসব চিঠিতে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হয়েছে, আপনার প্রতিষ্ঠানে মাইক্রোসফটের যেসব কপি করা সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে তা বেআইনি। বেআইনি কাজ না করে ব্যবহূত সফটওয়্যারগুলোর বৈধতা নিতে বলা হচ্ছে মাইক্রোসফটের কাছ থেকে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যায় সহজেই।
বিশ্বের সব চুক্তি অনুযায়ী মেধাসম্পদ অধিকার (আইপিআর), কপিরাইট ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় আইন প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের কপিরাইট আইন অনুযায়ী শুধু সৃজনশীল কর্ম সৃষ্টি করলেই হবে না, সেটি কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে দেশি কর্মের নিবন্ধনই শুধু করা যাবে। কম্পিউটার সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে দুটি সিডি ও এক হাজার টাকা জমা দিতে হবে নিবন্ধনের জন্য।
ট্রিপস চুক্তিতে পৃথিবীর সব দেশের মেধাসম্পদের সর্বজনীন সংরক্ষণের কথা বলা আছে। কিন্তু বাণিজ্যে সমতা সৃষ্টির জন্য উন্নত বিশ্ব আর স্বল্পোন্নত বিশ্বকে একই কাতারে ফেলা যায় না। তাই কপিরাইট বিষয়ে ডব্লিউটিওতে দরিদ্র−ভদ্র ভাষায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো ছাড় পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে। শুরুতেই ট্রিপসে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ছাড় দেওয়া হয়। পরে ২০০৫ সালে হংকংয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সেই ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়। ট্রিপসে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলো সাড়ে সাত বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত বিদেশি কপিরাইট, পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক ও অন্যান্য মেধাসম্পদের ক্ষেত্রে এবং ১১ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ওষুধ শিল্প ছাড় পাবে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে এই ছাড় দেওয়ার কারণ হচ্ছে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সব দেশ যাতে সমান সুযোগ পায়। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো অনেক এগিয়ে। এখন তথ্যপ্রযুক্তি তথা মেধানির্ভর বিশ্ব বাণিজ্যে টিকে থাকতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সক্ষম হতে হবে। প্রযুক্তি বা জ্ঞান স্থানান্তরই এই ছাড়ের মূল উদ্দ্যেশ। ২০১৩ বা ২০১৬ সালের মধ্যে প্রযুক্তিগতভাবে একটা মানে পৌঁছানো হয়তো সম্ভব স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে।
কপিরাইট নিয়ে ১৮৮৬ সালে সুইজারল্যান্ডের বার্নে যে বার্ন কনভেনশন গৃহীত হয়, সেটির বাস্তবায়ন ১০০ বছরেও সম্ভব হয়নি। বার্ন কনভেনশন অনুযায়ী স্থানীয় সৃজনশীল কর্মের পাশাপাশি বিদেশি কর্মের কপিরাইটের সংরক্ষণও নিশ্চিত করা হেেয়ছ। এখন যেহেতু বেশির ভাগ দেশই ডব্লিউটিওর সদস্য হিসেবে ট্রিপসকে মেনে নিয়েছে, তাই বার্ন কনভেনশন সেসব দেশেই প্রযোজ্য যেসব ডব্লিউটিওর সদস্য নয়। ট্রিপসে সব বিদেশি সফটওয়্যার বা অন্যান্য সৃজনশীল কর্মের কপিরাইট সংরক্ষণ করার কথা থাকলেও শুধু স্বল্পোন্নত দেশগুলো ২০১৩ ও ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছাড় পাবে। এর আগেই যদি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়, তবে এ ছাড় আমরা আর পাব না।
এখন দেখা যাচ্ছে, ট্রিপসের আওতায় ছাড় পেলেও মাইক্রোসফটের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যার কপি করে ব্যবহারের বিষয়টিকে চৌর্যবৃত্তির পর্যায়ে ফেলার চেষ্টা করছে। বিষয়টি আদৌ চৌর্যবৃত্তি নয়। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিদেশি সফটওয়্যার বা ডিভিডি কপি করা মানে চুরি নয়। ট্রিপসের কারণেই এটা আমাদের অধিকার।
অনেকে আবার মনে করেন, এতে দেশি সফটওয়্যারের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে না। এটাও একটা ভুল ধারণা। দেশি সফটওয়্যারের স্বার্থ সংরক্ষণ হবে স্থানীয় আইনে। আর তার প্রয়োগ আরও বেশি বাড়াতে হবে। দেশি সফটওয়্যারের কপিরাইট সংরক্ষণ পুরোপুরি সম্ভব হলে, সেই চর্চা থাকলে তবেই তো ভবিষ্যতে বিদেশি পণ্যগুলোর কপিরাইট সংরক্ষণের বিষয়টি ভালোভাবে দেখা সম্ভব।
অনেক কম্পিউটার সফটওয়্যার কপি করা যায় না বা নির্দিষ্ট কিছু দিনের পর আর ব্যবহার করা যায় না। মাইক্রোসফটের সফটওয়্যারগুলো কেন কপি করা যায়? বিষয়টি অনেকটা এমন−বিনামূল্যে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে এসবে অভ্যস্ত করে পরে লাইসেন্সের মূল্য আদায় অর্থাৎ বাণিজ্য-স্বার্থ হাসিল করা। অপর দিকে বিশ্বে প্রতিবছর ভাইরাস বা ওয়ার্মের কারণে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। এসব ভাইরাস বা ওয়ার্মের শতভাগই উইন্ডোজচালিত কম্পিউটারকে আক্রান্ত করে। এর মধ্যে বহু কম্পিউটার আছে, যেগুলোতে লাইসেন্স করা উইন্ডোজ ব্যবহার করে। এর জন্য মাইক্রোসফট কি কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে?
এ কথা ঠিক মেধাস্বত্ব-সংক্রান্ত ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিদেশি সফটওয়্যারের লাইসেন্স আমাদের কিনতে হবে। এরই মধ্যে মুক্ত সফটওয়্যার ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। বাংলাদেশে কাজের উপযোগী অনেক মুক্ত সফটওয়্যারও বের হয়েছে। যেগুলোর প্রোগ্রামিং সংকেত উন্নুক্ত (ওপেন সোর্স)। আমি আমার প্রয়োজন অনুযায়ী মুক্ত সফটওয়্যার সাজিয়ে নিতে পারব। ফলে লাইসেন্স করা সফটওয়্যারের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে গড়ে উঠছে মুক্ত সফটওয়্যার। ট্রিপসে দেওয়া কপিরাইট সংক্রান্ত ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যেটা ভালো হয়, সেটাই করতে হবে। কিন্তু তার আগে ফলাও করে বলা যাবে না যে আমরা চুরি করছি। কপি করার এ কাজটা চুরি নয়, ট্রিপসের কারণে এটা আমাদের অধিকার।
পল্লব মোহাইমেন: সাংবাদিক।সবাইকে ধন্যবাদ
আমি অলোক মিস্ত্রী। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 15 বছর 8 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 15 টি টিউন ও 95 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 0 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
পল্লব দার কথার সঙ্গে আমি সম্পূর্ন একমত।