একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে আরম্ভ করি। আমার এক মামা ১৯৮০ এর দশকে ঢাকা কলেজ থেকে বিকম পাস করে MBA করতে সুইডেন গেলেন। এসএসসি থেকে বিকম পর্যন্ত মামার রেজাল্ট মাঝারি মানের ছিল। সুইডেনে MBA করতে গিয়ে পড়াশুনা ও জীবনযাত্রার খরচ ম্যানেজ করতে, মামা সুইডেনে পার্ট টাইম জব হিসেবে মাংস কাটা, খবরের কাগজ বিক্রয়ের হকারি থেকে শুরু করে দোকানের সেলস ম্যান সহ হরেক রকমের কাজ করেছেন। মামা সুইডেনে MBA পাস করে এক সুইডিশ ব্যাংকের অফিসার হিসেবে যোগদান করলেন। ২০১০ সালে মামা দিল্লিতে উক্ত সুইডিশ ব্যাংকে ম্যানেজার হিসেবে আসলেন। তিন বছর দিল্লিতে কাজ করে মামা পুনরায় উক্ত ব্যাংকের AGM হিসেবে সুইডেনে ফিরে গেলেন। পরবর্তীতে মামা আরোও প্রমোশন পেয়েছেন। বর্তমানে মামা Sweden-Bangladesh Business Council এর চেয়ারম্যান। মামার সমসাময়িক বা আগে-পরে মামার চেয়ে অনেক ভালো রেজাল্টধারীরা মামার মত সাফল্য পায়নি। জীবনে সফল হওয়ার চাবিকাঠি কি?
মানুষের মস্তিষ্কের কোষ (নিউরোন) ১০ হাজার কোটির (১০০ বিলিয়ন) অধিক। মানুষ মস্তিস্কের কোষ অর্থাৎ নিউরোনেগুলো যত বেশি ব্যবহার করবেন, ততই মানুষের সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও সাফল্য বাড়বে। যদিও অধিকাংশ মানুষ ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত হয়ে হতাশা, আলস্য ও বিভিন্ন নিজ সৃষ্ট (Self-Created) অজুহাতের কারণে তাঁর নিজের মস্তিস্কের নিউরোনের অল্প সংখ্যক কাজে লাগায়, ফলে জীবনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায় না। মানুষের সাফল্যের পেছনে নেপথ্যে থেকে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি। মস্তিষ্কের এই অফুরন্ত ক্ষমতা ও শক্তি কতটা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে তা তোমার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল।
সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি কি? ‘তোমার কি নাই বা কি আপনি পার না বা কি তুমি হারিয়েছ — তা নিয়ে হতাশায় ও আত্মবিশ্বাসহীনতায় না ভুগে যা তুমি পার তা দিয়ে শুরু করাটাই’ হচ্ছে — সঠিক (ইতিবাচক/পজিটিভ) দৃষ্টিভঙ্গি। আসলে ভুল দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাকে 'সংকটে' পরিণত করে; আর ইতিবাচক/পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাকে পরিণত করে 'সম্ভাবনায়'।
প্রয়াত ব্রিটিশ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংয়ের বিখ্যাত উক্তি, “প্রথমত, মাটির দিকে নয়, বরং আকাশের ওই তারাগুলোর দিকে চোখ রাখতে কখনো ভুলো না। দ্বিতীয়ত, তুমি যা-ই করো না কেন, হাল ছেড়ো না। তোমার কাজই তোমাকে জীবনের অর্থ আর উদ্দেশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। ”
জীবনে ব্যর্থ হওয়ার মুখ্য কারণগুলো হচ্ছে — নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের ও সুন্দর পরিকল্পনার অভাব এবং কয়েকবার ব্যর্থতার পর হাল ছেড়ে দেওয়া। খ্যাতিমান Mentor Myron Sta. Ana উক্তি করেছেন, "একটি সুন্দর পরিকল্পনা সাফল্য সুসম্পন্নের অর্ধেক; পক্ষান্তরে খারাপ পরিকল্পনা সাফল্যের পথে ব্যর্থতার কারণ হয়ে দাঁঁড়ায়। ”
ভারতের খ্যাতিমান রাজেশ মুরথি এর বিখ্যাত উক্তি, “জীবনের ৫০% ঠিক হয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা, এবং বাকিটাও দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা। জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিসটা হলো দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করা, এটা হয় আপনার ভিতর ছাইচাপা আগুনকে আরো বাড়িয়ে দিয়ে আপনাকে উজ্জ্বল করবে নতুবা আপনার সকল স্বপ্নকে মাটি চাপা দিতে পারে। ”
আমরা প্রতিনিয়ত যে কাজ করছি, তা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত। ভারতের প্রয়াত বিজ্ঞানী ও সর্বকালের জনপ্রিয় (একাদশ) রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের একটি উক্তি, "মানুষ তার ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করতে পারে না, কিন্তু অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারে। অভ্যাসই মানুষের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন করে দেয়। " আর এই অভ্যাস পরিবর্তনের চাবিকাঠি হচ্ছে — দৃষ্টিভঙ্গি।
জাপানের টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির প্রফেসর ও গবেষক ইয়োশিনোরি ওহশোমি ৩০ বছরের অধিক সময় গবেষণার হাল না ছেড়ে অটোফেজি প্রক্রিয়ার (জীবদেহ কেমন করে ত্রুটিপূর্ণ কোষ ধ্বংস করে নিজের সুরক্ষা করে, সেই রহস্য) নিয়ন্ত্রণকারী জিনটি আবিষ্কার করার কারণে ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
মানুষের শরীরের চেয়ে মন অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। মানুষের মস্তিষ্কের ক্ষমতা একটা সুপার কম্পিউটারের চেয়েও অনেকগুণ বেশি। জীবনের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট হলেই আত্মবিশ্বাস আসবে। প্রশান্ত মনের স্থির পর্দায় সফলতার ব্লু প্রিন্ট (প্রতিচিত্র) অর্থাৎ ‘মনছবি’ আঁকতে হবে। ‘মনছবি’ হচ্ছে — মনের পর্দায় গভীর বিশ্বাস, একাগ্র চিত্তে ও গভীর মনোযোগে আঁকা লালিত সাফল্যের ছবি যা যে কোন সাফল্যের 'ভ্রুণ'।
মনছবির এ প্রক্রিয়ার ফলপ্রসূতার জন্য নিম্নোক্ত ০৪টি শর্ত আছে —
১) স্থির লক্ষ্য; ২) লক্ষ্যে আস্থা ও একাত্মতা; ৩) লক্ষ্যে আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ; ৪) লক্ষ্য পূরণে নীরবে কাজ।
স্থির ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যের ছবি (মনছবি) যখন মনে গেঁথে যায় তখন মানুষের মস্তিষ্কের কর্মগঠন বদলে যায় এবং তখন তোমার মস্তিষ্ক স্বয়ংক্রিয়ভাবে তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্য বাস্তবায়নের কাজে লেগে যায়। এটি বিজ্ঞানসম্মত। মনে রাখবে, বারবার লক্ষ্য পরিবর্তন করলে তোমার মস্তিষ্ক কর্মপন্থা ঠিক করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সেকারণে লক্ষ্যে সংকল্পবদ্ধ থেকে লক্ষ্য পূরণে নীরবে নিরলসভাবে কাজ কর। দ্রুত রেজাল্ট পাওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করা উচিৎ।
আমরা যখন একাগ্র কল্পনায় আমাদের লক্ষ্যের ছবি মনে গেঁথে ফেলি, তখন তা ব্রেন ও স্নায়ুতন্ত্রকে (নার্ভাস সিস্টেম) স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য অর্জনের পথে পরিচালিত করে। ‘মনছবিকে’ আমরা তুলনা করি মিসাইলের সাথে। মিসাইলের যেমন টার্গেট নির্ধারণ করে দিলে আর কোনো দিক-নির্দেশনার প্রয়োজন হয় না। মিসাইল নিজের পথে এগিয়ে চলে, মনছবিও ঠিক তেমনি। ‘মনছবির’ মাধ্যমে লক্ষ্যের ছবি অবচেতন মনে বসিয়ে দিলে মন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে তার সকল শক্তিকে নিয়োগ করে অবিরাম কাজ করে যায়। দুর্দমনীয় আগ্রহ ও উদ্যম সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছার জন্যে যা যা করা দরকার তা করার জন্যে মনের গভীরে একটা তাড়না সৃষ্টি করে।
All the best,
— প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর
ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ও
সাবেক প্রাধ্যক্ষ, মতিহার হল,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Website: https://www.drmdaliasgar.com/
Facebook Page: https://www.facebook.com/ProfDrMdAliAsgarShanto
আমি সুমাইয়া মৌ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 3 বছর 5 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 10 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।