নামকরণ: لهب শব্দের অর্থ : অগ্নিশিখা, আগুনের শিষ, স্ফুলিঙ্গ ইত্যাদি। তৃতীয় আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরাকে সূরা মাসাদও বলা হয়। শানে নুযূল: (রা)ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন (وَأَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ) “আর তুমি তোমর নিকটতম আন্তীয়-স্বজনদের ভীতি প্রদর্শন কর” (সূরা শুআরা ২৬: ২১৪) আয়াতটি অবতীর্ণ হয় অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন ও একনিষ্ঠ দলভুক্ত লোকদেরকে ভয় দেখানো ও তাদের মাঝে তাবলীগ করার নির্দেশ প্রদান করা হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাফা পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেন এবং ইয়া সাবাহা বলে উঁচু আওয়াজ করলেন। (এটা বিপদসংকেতমূলক শব্দ, তৎতালে কেউ বিপদে পড়লে এ শব্দ ব্যবহার করত) সবাই বলল: এটা কে? সবাই তাঁর কাছে একত্রিত হলো। এমনকি কোন লোক আসতে না পারলে অন্য একজন দূত প্রেরণ করেছিল। তখন নাবী (সাঃ) বললেন : তোমরা কি লক্ষ্য করেছো? আমি যদি তোমাদেরকে বলি এক দল অশ্বারোহী সৈন্য এ পাহাড়ের পশ্চাতে তোমাদের ওপর হামলা করার জন্য অপেক্ষা করছে তাহলে তোমরা কি বিশ্বাস করবে? সবাই বলল : কেন বিশ্বাস করব না? আমরা তো তোমাকে কখনও মিথ্যারূপে পাইনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : তাহলে শোন, আমি তোমাদেরকে আসন্ন এক ভয়াবহ কঠিন শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করছি। আবূ লাহাব বলল : তোমার ধ্বংস হোক! এজন্য তুমি আমাদেরকে একত্রিত করেছো। তখন এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৭১, সহীহ মুসলিম হা. ২০৮) أبو لَهَبٍ - আবূ লাহাব এর প্রকৃত নাম আব্দুল উয্যা। তার রূপ সৌন্দর্য ও মুখমন্ডলের উজ্জ্বলতার (লাল আভার) কারণে আবূ লাহাব বলা হয়। তা ছাড়া পরিণামের দিক দিয়েও সে জাহান্নামের ইন্ধন। আবূ লাহাব কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের দশজন পুত্রের অন্যতম একজন। আবূ লাহাব রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর চাচা, তার নিকট রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এত প্রিয় ছিল যে, তাঁর জন্মের খবর শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সর্বত্র দৌড়ে গিয়ে লোকদের জানিয়ে দিয়েছিল যে, তার মৃত ছোট ভাই আব্দুল্লাহর বংশ রক্ষা হয়েছে। এ সুসংবাদটি প্রথম তাকে শোনানোর জন্য সে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দাসী সুওয়াইবাকে আযাদ করে দেয়। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/২৭৩; আলবানী, সহীহ সীরাতুন নববিয়্যাহ পৃ : ১৫) নবুওয়াতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর দুকন্যা রুকাইয়া ও উম্মে কুলসুমকে আবূ লাহাবের দুপুত্র উৎবা ও উতাইবার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন। (আর রাহীকুল মাখতূম পৃ : ৮৬) এত আন্তরিকতা ও সুসম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নবুওয়াত লাভের পর আবূ লাহাব চরম শত্রুতে পরিণত হয় এবং রাসূল (সাঃ)-কে খুব কষ্ট দেয়। তার ছেলেদ্বয়কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দু কন্যাকে তালাক দিতে বাধ্য করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দ্বিতীয় পুত্র আব্দুল্লাহ মারা গেলে আবূ লাহাব খুশীতে বেশামাল হয়ে সবার কাছে গিয়ে বলে, মুহাম্মাদ আবতার অর্থাৎ নির্বংশ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয় হাজ্জের মওসুমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আগত হাজীদের তাঁবুতে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত দিতেন কিন্তু আবূ লাহাব তাঁর পেছন থেকে লোকদের তাড়িয়ে দিত এবং বলত ‘তোমরা এর কথা শুননা, সে ধর্মত্যাগী ও মহা মিথ্যুক। এভাবে সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে ও কষ্ট দিতে থাকে। (মুসনাদে আহমাদ হা. ১৬০৬৬, সহীহ ইবনু হিব্বান হা. ৬৫৬২, ইবুন কাসীর) উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের লোক ছিল। ১. যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিল যেমন হামযাহ ও আব্বাস (রাঃ)। ২. যারা তাঁকে সাহায্য সহযোগিতা করেছে কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করেনি যেমন আবূ তালেব। ৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শত্রুতা করেছিল যেমন আবূ লাহাব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্মের খুশীতে আবূ লাহাবের দাসী আযাদ করাকে কেন্দ্র করে বিদআতীরা জাল হাদীস বর্ণনা করে বলে থাকে : রাসূলের জন্মের খুশীতে আবূ লাহাব দাসী আযাদ করার কারণে যদি প্রতি সোমবার জাহান্নামের শাস্তি লাঘব করা হয় তাহলে অবশ্যই ঈদে মীলাদুনাবী উদ্যাপন ফযীলতের কাজ। এ বিষয়ে কুফরী অবস্থায় চাচা আব্বাস-এর একটি স্বপ্নের কথা বলা হয়, যার কোন ভিত্তি নেই। সুতরাং এসব বিদআতী কর্মকান্ড অবশ্যই পরিত্যাজ্য, কোনক্রমেই রাসূলুলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্ম বার্ষিকী পালন করা বা ঈদে মীলাদুন্নাবী উদ্যাপন করা ইবাদত হতে পারে না। যদি তা ইবাদত হত তাহলে অবশ্যই সাহাবীগণ তা করতেন, কিন্তু কোন সাহাবী করেছেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। বরং এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হল : ইসলাম গ্রহণ করার কারণে বেলালের মত একজন হাবশী গোলাম সম্মানের পাত্রে পরিণত হল আর কুরাইশদের সম্মানিত নেতা আবূ লাহাব ইসলাম বর্জন করার কারণে অসম্মানিত ও জাহান্নামী হল। একজন মুসলিম যত বার এ সূরা পাঠ করবে ততবার একটি অক্ষরের বিনিময়ে দশটি নেকী পাবে, অপরপক্ষে আবূ লাহাব ও তার স্ত্রী অভিশাপ ও ধ্বংসের বদদু‘আ পাবে। تَبَّ শব্দের অর্থ : বরবাদ হওয়া, ধ্বংস হওয়া ইত্যাদি। শব্দটি অতীতকাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থ : আবূ লাহাবের দু হাত ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ তখনও সে ধ্বংস হয়নি। অর্থাৎ অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই পূর্বেই এর নিশ্চয়তা দিয়ে দেয়া হয়েছে। সত্যিই তাই হলো, আবূ লাহাব বদরের যুদ্ধের কয়েকদিন পর এক চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। সে রোগের কারণে দেহে প্লেগের মত গুটলি প্রকাশ পায়। ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যু মুখেমুখে পতিত হয়। তিন দিন পর্যন্ত তার লাশ এভাবেই পড়েছিল। পরিশেষে তা খুবই দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে। অতঃপর ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় এবং মান সম্মানের ভয়ে তার ছেলেরা তাকে দূর থেকে পাথর ফেলে ও মাটি ঢেলে দিয়ে দাফন করে। (আইসারুত তাফাসীর) দ্বিতীয় تَبَّ ক্রিয়া দ্বারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যে বদ্দুআ দেওয়া হয়েছিল তার জবাবস্বরূপ পুনরায় বদ্দুআ করা হয়েছে। يَدَآ শব্দটি দ্বিবচন, অর্থ : হাতদ্বয়। এখানে শুধু হাত উদ্দেশ্য নয় বরং সম্পূর্ণ শরীর উদ্দেশ্য। (مَآ أَغْنٰي عَنْهُ مَالُه۫ وَمَا كَسَبَ) অর্থাৎ সে যেসব সম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে এবং যা উপার্জন করেছে ও তার স্ত্রী সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারেনি। ইবনু আব্বাস (রাঃ)-সহ অনেক মুফাসসির বলেন : এর অর্থ তার সন্তানাদি। যেমন আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : إِنَّ أَطْيَبَ مَا أَكَلْتُمْ مِنْ كَسْبِكُمْ، وَإِنَّ أَوْلَادَكُمْ مِنْ كَسْبِكُم মানুষ যা উপার্জন করে সেটাই তার সর্বাধিক পবিত্র খাদ্য। আর তার সন্তান তার উপার্জনের অংশ। (আবূ দাঊদ হা. ৩৫৩০, মিশকাত হা. ২৭৭০, সহীহ) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় জাতিকে ঈমানের দাওয়াত ও আখেরাতের আযাবের ভয় দেখান, তখন আবূ লাহাব তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল : আমার ভাতিজার কথা যদি সঠিক হয় তাহলে আমি কিয়ামতের দিন আমার ধন-সম্পদ ও সন্তানাদির বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করে নেব। অত্র আয়াতে তার জবাব এসেছে। (ইবনু কাসীর) وامراته অর্থাৎ আবূ লাহাব জাহান্নামে যাবে, সাথে তার স্ত্রীও জাহান্নামে যাবে। তার স্ত্রীর নাম উম্মে জামীলা আরওয়া বিনতে হারব। সে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে দুশমনীর দিক দিয়ে স্বামীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। (حَمَّالَةَ الْـحَطَبِ) অর্থাৎ জাহান্নামে সে স্বামীর আগুনে কাঠ এনে নিক্ষেপ করবে। ফলে আগুন আরো বৃদ্ধি পাবে। এটা হবে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। অর্থাৎ দুনিয়াতে যেমন স্বামীকে কুফর ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কষ্ট দানে সহযোগিতা করছিল আখিরাতেও জাহান্নামে সে ভাবে সাহায্য করবে। (فِيْ جِيْدِهَا حَبْلٌ مِّنْ مَّسَدٍ) - جيد শব্দের অর্থ গর্দান, ঘাড়। مَّسَد অর্থ ليف বা আঁশ, ছিলকা ইত্যাদি। অর্থাৎ জাহান্নামে তার গলায় লোহার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হবে যা খেজুরের আঁশের মত পাকানো হবে। অথবা তার গলায় লোহার বেড়ি পরিহিত অবস্থায় জাহান্নামে স্বামীর জন্য কাঠ বহন করবে। যহহাক ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ বলেন: ঐ রশিই কিয়ামতের দিন তার জন্য আগুনের রশি হবে। আর সাঈদ বিন মুসাইয়িব (রহঃ) বলেন: আবূ লাহাবের স্ত্রীর মণিমুক্তাখচিত বহু মূল্যবান একটি কণ্ঠহার ছিল। যেটা দেখিয়ে সে লোকদের বলত: লাত ও ওযযার কসম! এটা আমি অবশ্যই ব্যয় করব মুহাম্মাদের শত্রুতার পেছনে। এ কণ্ঠহারই তার জন্য কিয়ামতের দিন আযাবের কণ্ঠহার হবে। (তাফসীর কুরতুবী) ইসলামের প্রচার ও প্রসারে যুগোপযোগি মাধ্যম কাজে লাগাতে হবে যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তৎকালীন নিয়মানুযায়ী সাফা পাহাড়ে উঠে জাতির কাছে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আর দাওয়াত দিলে পক্ষ বিপক্ষ দুশ্রেণির লোকই পাওয়া যাবে। তাই বলে পশ্চাদপদ হওয়া যাবে না। আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে শত্রুতা করে তারা সবাই ধ্বংস হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে এবং আখিরাতে তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নাম।
২. ঈমান-আমল না থাকলে ধন-সম্পদ, জ্ঞান-গরিমা ও ক্ষমতা কোন কাজে আসবে না।
৩. সফলকাম তারাই যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আদর্শে গড়ে তুলেছে, অতঃপর তাতে অবিচল থেকেছে।
৪. ইসলাম প্রচারে যুগোপযোগি মাধ্যম গ্রহণ করা যেতে পারে।
৫. ঈদে মীলাদুন্নাবী উদ্যাপন বিদ‘আত। কোন সাহাবী, তাবেয়ী এমনকি চার ইমামের কেউ তা করেননি।
আমি লিখন সরকার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 7 বছর 1 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 0 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 1 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।