ভূমিকা: সংবাদপত্র আধুনিক জীবনের অপরিহার্য সঙ্গী। গণতান্ত্রিক যে-কোনাে দেশে তা সুস্থ গণতান্ত্রিক সমাজের দর্পণ। সমাজজীবনের দৈনন্দিন পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পৃক্ততায় এবং নিরন্তর তার বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনায় সংবাদপত্র এখনাে শক্তিশালী গণমাধ্যম। জনমতের প্রতিফলনে ও জনমত গঠনে সংবাদপত্র পালন করে শক্তিশালী ভূমিকা। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বহু দল ও মতের ধারক-বাহক হিসেবে সংবাদপত্র সরকার ও জনগণের মধ্যে রচনা করে সেতুবন্ধন।
সংবাদপত্রে মানদণ্ড : একটি সংবাদ পত্রের চারটি গুণ থাকা আবশ্যক। যথা:
(১) সহজপ্রাপ্যতা: একটি সংবাদ পত্র সহজে জনসাধারণের কাছেই থাকবে। যেমন দোকান, লাইব্রেরি, হকার্স দ্বারা ঘরে ঘরে পাঠেয়ে ইত্যাদি। বর্তমানে এতই সহজপ্রাপ্য যে ইন্টারনেটে দেশের বা বিশ্বের জনপ্রিয় সংবাদপত্রগুলাে সহজেই দেখা যায় ও পড়া যায়।
(২) পর্যাবৃত্তি: যেসকল পত্রিকা দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, পাক্ষিক বা অন্য যেকোনাে ধারায় প্রকাশ করা হয় সেগুলাে তাদের নির্দিষ্ট সময় পর পর পুনঃ পুনঃ প্রকাশ করবে। এই ধারার পরিবর্তন হয় না। যেমন যে পত্রিকা সাপ্তাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় সেটি প্রতি সাত দিন পর পর অবশ্যই প্রকাশিত হবে এবং এই ধারা ভঙ্গ হবে না।
(৩) সাম্প্রতিকতম: সংবাদপত্র যে পর্যাবৃত্তিতেই প্রকাশিত হােকনা কেন তা অবশ্যই হতে হবে সর্বশেষ সত্য সংবাদে পূর্ণ।
(৪) সাবর্জনীনত্ব: সংবাদপত্র অবশ্যই হতে হবে সব মানুষের জন্য। কোনাে বিশেষ ধর্ম, বর্ণ বা বিশেষ গােষ্টিকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ হবে না বা অন্য গােষ্টিকে তাচ্ছিল্য করবে না। সংবাদপত্র হবে সকলের।
একটি ভালাে মানের পত্রিকার এই চারটি দিক অবশ্যই থাকে।
সংবাদপত্রের ইতিহাস : সংবাদপত্রের ইতিহাস অনেক পুরােনাে। প্রাচীন কালে রােমে সরকারের সংবাদ জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য সংবাদ পাথরে খােদাই করে তা নির্দিষ্ট দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হতাে। এরপর চীনে একটি রাজনৈতিক পত্রিকা প্রকাশিত হতাে বলে জানা যায়। ভারতবর্ষে মুসলমান রাজত্ব কালে সরকারের অভ্যন্তরিন কর্মচারীদের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদানের জন্য একটি হাতে লিখা সংবাদের কাগজ আদান প্রদান হতাে। ১৭৮০ সালে ইংরেজদের মধ্যে সংবাদ প্রেরণের জন্য কলকাতায় দুই পাতার ইন্ডিয়ান গেজেট' নামে একটি ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হতাে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৮ সালে 'সােমপ্রকাশ' নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করনে। ১৮৬১ সালে প্রথম বাংলা ছাপা অক্ষরে ঢাকা প্রকাশ নামে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সাল থেকে কাজগের সংবাদপত্রের পাশাপাশি হুবহু সংবাদপত্র ইন্টারনেটে থেকেও পড়ার সুযােগ তৈরি
হয়।
সংবাদপত্রের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা : দৈনন্দিন জীবনের নানা অপরিহার্য তথ্য প্রতিদিন আমাদের হাতে তুলে দেয় সংবাদপত্র। পৃথিবীর যে-কোনাে প্রান্তে ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যার মতাে খবরাখবর সংবাদপত্র আমাদের জানিয়ে দেয়। এভাবে দেশ ও বিশ্ববাসীকে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সংবাদপত্রে দুর্ঘটনার খবর পড়ে নিহত-আহতের সন্ধানে ছুটে যেতে পারে তাদের আত্মীয়-পরিজন। সাজ্যবাদী কিংবা আগ্রাসী তৎপরতা যখন সভ্যতাকে গ্রাস করে তখন সংবাদপত্র তার বিরুদ্ধে মানবতার জাগরণ ঘটায়। পারমাণবিক যুদ্ধ কিংবা স্নায়ুযুদ্ধের ভয়াবহতায় পৃথিবীর ধ্বংস-আশঙ্কা দেখে দিলে শান্তির সপক্ষে নেয় সচেতন দায়বদ্ধ ভূমিকা। দেশে সামরিকতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র জনগণের টুটি চেপে ধরলে সংবাদপত্র তার বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভের পটভূমি রচনা করে। গণআন্দোলনের পক্ষে নেয় কার্যকর অবস্থান। যেখানেই মানবতার লাঞ্ছনা, মূল্যবােধের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিবেকের কণ্ঠরােধ, সেখানেই সংবাদপত্রের কণ্ঠস্বর নেয় প্রতিবাদী ভূমিকা।
আধুনিক সংবাদপত্রের বিষয়-বিস্তার: আধুনিক সংবাদপত্র কেবল সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম নয়। দেশ-বিদেশের রানীতি ও সামাজিকঅর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংবাদ পরিবেশন ছাড়াও এতে থাকে বিচিত্র তথ্য প্রতিবেদন। শিল্প-সাহিত্যের আলােচনা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও বিনােদন জগতের বিচিত্র কর্মধারা এখন সংবাদপত্রের আকর্ষণীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। অর্থনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, ভূগােল, দর্শন- যেকোনাে বিষয়ের খবরাখবর, প্রবন্ধ এখন সংবাদপত্রের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। শিশু-কিশাের ও ছাত্রছাত্রীদের জন্যে থাকে আলাদা বিভাগ, আলাদা পাতা। মেয়েদের জন্যে তাে আলাদা পাতা থাকেই। এখন আমাদের দেশে পত্রিকার পাতায় আলাদাভাবে যােগ হয়েছে কোনাে বিশেষ এলাকার জন্যে সাপ্তাহিক আলাদা পাতা। দীর্ঘকাল ধরে জনমত ও জনজীবনের সমস্যা ভিত্তিক চিঠিপত্রের কলাম ছিল পত্রিকার বিশেষ অঙ্গ। এখন কোনাে কোনাে পত্রিকা আবার পঠকদের নিয়ে আলাদা মঞ্চ বা ফোরাম গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছে। কোনাে কোনাে পত্রিকা বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে পাঠকদের মতামত জরিপ করে তার প্রতিবেদন প্রকাশ করছে এবং ঐসব ইস্যুতে সরকার ও জাতির করণীয় সম্পর্কে আলােকপাতের চেষ্টা করছে। আশাকরির সন্ধান, অবসর নিবােদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, হরতাল-ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ, আলােচনা-সেমিনার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির নির্দেশিকা, পরীক্ষার তারিখ ও ফলাফল, বার্ষিকী কিংবা দিবস পালন, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে, পুরস্কার ও সম্মাননা- কী থাকছে না সংবাদপত্রে? দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সংবাদপত্র এখন আমাদের চলমান নির্দেশিকা।
সংবাদপত্র ও জনমত গঠন : গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রকৃত ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। ফলে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও ভূমিকা জাতীয় অগ্রগতির পক্ষে কতটা সহায়ক এবং কতটা জনস্বার্থের পরিপূরক তা নিয়ে জনগণের মধ্যে অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ক্ষমতাসীনরা সবসময় তাদের পদক্ষেপকে জোর গলায় ইতিবাচক বলে প্রচার করে এবং বিরােধীরা তাকে একেবারেই প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু সংবাদপত্র উভয় পক্ষের মতামত, যুক্তি ও তথ্যনির্ভর আলােচনা প্রকাশ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নিজেদের অভিমত গঠন করতে পারে। সংবাদপত্রের পাতায় জ্ঞানীগুণী ও বিশেষজ্ঞদের লেখা প্রবন্ধ ও অভিমত, কলাম লেখকদের তর্কবিতর্ক, যুক্তি প্রদান ও যুক্তিখণ্ডন, পত্রিকার নিজস্ব সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় মতামত জনমত গঠনে সাহায্য করে। আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তি ইত্যাদি ইস্যুতে জনমত গঠনে সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অবশ্য কখনাে কখনাে কোনাে কোনাে সংবাদপত্র বিশেষ গােষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে জনমতকে তাদের পক্ষে টানার জন্যে সংকীর্ণ উদ্দেশ্যপূর্ণ নানারকম প্রচারণার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু পাঠক সমাজ সচেতন হলে শেষ পর্যন্ত এসব সংবাদপত্রের অপপ্রচারের চেষ্টা ও হীন উদ্দেশ্য সফল হতে পারে না।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিপূরক ভূমিকা : সংবাদপত্র বর্তমানে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রমভিত্তিক এবং পরীক্ষা-নির্ভর সার্টিফিকেট প্রদানের শিক্ষা শিক্ষার্থীর জ্ঞানের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা নােট ও গাইড-বই নির্ভর মুখস্থ বিদ্যায় পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্র এখন যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রকেই তার আওতায় এনেছে তার ফলে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠে বহুমুখী জ্ঞান অর্জনের সুযােগ পায়। এত তাদের জ্ঞানের ক্ষেত্র যেমন সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়। তেমনি বিষয়জ্ঞানের পাশাপাশি ভাষাজ্ঞানও বাড়ে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটে। তাদের শিক্ষা হয় সর্বতােমুখী।
সংবাদপত্রের অপকারিতা: সংবাদপত্রের অনেক উপকারিতা থাকলেও কিছু কিছু অপকারিতাও আছে। কখনাে কখনাে মিথ্যা, উদ্ভট খবর প্রচার করে পাঠককে বিভ্রান্ত করে থাকে। এতে মানুষ এবং দেশের ক্ষতি হয়। সংবাদপত্রের মালিকানা ব্যক্তিগত বলে মালিকের খেয়ালখুশিমত তা পরিচালিত হয়। কোনাে কোনাে পত্রিকা রাজনৈতিক দলের মুখপত্র হিসেবে বানােয়াট খবর প্রচার করে, এতে দেশ ও জনগণের উপকারের চেয়ে অপকার হয় বেশি।
উপসংহার : বর্তমানে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মানব উন্নয়ন এবং মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে সংবাদপত্রগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যেও সংবাদপত্র ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। উন্নততর জীবন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আগ্রহ সৃষ্টিতেও সংবাদপত্রের দায়িত্ব কম নয়। বর্তমানে স্যাটেলাইট যােগাযােগ প্রযুক্তির ফলে গণমাধ্যমে উন্নত দেশের একচেটিয়া আধিপত্য সম্প্রসারিত হচ্ছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের সংবাদপত্রকে হতে হবে ঐতিহ্য-সচেতন, জাতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক। আমাদের দেশে ব্যাপক নিরক্ষরতা, সমাজজীবনে পশ্চাৎপদতা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে সমাজজীবনে আদুনিক ধ্যান-ধারণা ও বিজ্ঞানমুখী চেতনার বিকাশে সংবাদপত্রের ভূমিকা হতে হবে কল্যাণমুখী। লুটেরা পুঁজি ও ক্ষমতার অপব্যবহার সমাজজীবনে যে সন্ত্রাস, ও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিভেদ ও জবরদস্তিমূলক মানসিকতার বিস্তার ঘটেছে, তার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে এবং দেশে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন সুশীল সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সংবাদপত্র সততা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দেবে- এটাই সবার কাম্য। জনস্বার্থে ও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানই সংবাদপত্রকে সত্যিকার অর্থে জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
একটি অ্যাপসে সকল পত্রিকা পড়তে নিচের ভিডিওটি দেখুন :
আমি জুয়েল আহমদ লিটন। Mid Level, Pro Bangla, Moulvibazar। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 7 বছর 2 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 63 টি টিউন ও 16 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 5 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 1 টিউনারকে ফলো করি।
আমি জুয়েল আপনাদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা পেলে টেকনোলজি সম্পর্কে নতুন কিছু শেয়ার করার চেষ্টা করব।
এই ওয়েবসাইটিও দেখতে পারেন
https://probangla.com/en