এক সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান শাওমি কর্পোরেশনের শুরুটা খুব বেশি দিন আগের নয়। ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে এই প্রতিষ্ঠানটি। শুরু থেকেই ব্যবহারকারীদের জন্য আধুনিক সব ফিচারের বাজেটবান্ধব স্মার্টফোন তৈরি করে লাখো স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর মনে জায়গা করে নিয়েছে তারা।
চীনের পাশাপাশি ভারতেও স্যামসাংকে পেছনে ফেলে শাওমি এখন 'সবচেয়ে বেশি বিক্রিত স্মার্টফোন ব্র্যান্ড' হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। সরাসরি আইফোন অনুপ্রাণিত শাওমির মিইউআই এখন অনেক ব্যবহারকারীর প্রথম পছন্দ। শাওমিকে এখন বলা হচ্ছে ‘প্রাচ্যের অ্যাপল’ (Apple of the East)। বর্তমানে আমাদের দেশেও বিক্রির দিক থেকে শাওমির স্মার্টফোনগুলো যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। তাদের স্মার্টফোনগুলো সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের অনেকের জানা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বেশ কিছু মজার অজানা তথ্য। শাওমির অজানা ভুবন নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
শাওমির একটি গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড রয়েছে। রেকর্ডটি হচ্ছে, একদিনে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক স্মার্টফোন বিক্রির রেকর্ড! ২০১৫ সালের বার্ষিক ফ্যান ফেস্টিভ্যালে শাওমি ২৪ ঘণ্টায় ঠিক ২১, ১২, ০১০ ইউনিট স্মার্টফোন অনলাইনে বিক্রি করে এই রেকর্ডটি গড়ে। ফ্যান ফেস্টিভ্যালে আকর্ষণীয় মূল্যহ্রাসের কারণেই তারা একদিনে এই রেকর্ড পরিমাণ ফোন বিক্রি করে গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে।
শুধু স্মার্টফোন বিক্রি নয়, এই দিনে শাওমি ৭, ৭০, ০০০ ইউনিট স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্স ২, ৪৭, ০০০ ইউনিট পাওয়ার ব্যাংক ২, ০৮, ০০০ ইউনিট এমআই ব্যান্ড এবং ৩৮, ০০০ ইউনিট স্মার্ট টিভি বিক্রি করেছিল। এই সংখ্যাগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে রেকর্ড না হলেও স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালের বার্ষিক ফ্যান ফেস্টিভ্যালের বিক্রির পরিসংখ্যানটি একটি নির্দিষ্ট দিনে অনলাইনে স্মার্টফোন বিক্রির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
একটি নির্দিষ্ট দিনে এর আগে সর্বোচ্চ স্মার্টফোন বিক্রির রেকর্ডটি ছিল চীনের আলিবাবা কোম্পানির টি’মল নামের অনলাইন শপের। চীনের অভ্যন্তরীণ এই অনলাইন স্টোরটি ২০১৪ সালে ২৪ ঘণ্টায় ১৮, ৯৪, ৮৬৭ ইউনিট ফোন বিক্রি করে রেকর্ড গড়েছিল।
চলতি বছরের এপ্রিলে শাওমির সিইও লেই জুন শাওমির উৎপাদিত পণ্যের মুনাফার বিষয়ে একটি যুগান্তকারী ঘোষণা দেন। তিনি বলেন,
এখন থেকে আমরা হার্ডওয়্যার সম্পর্কিত যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট ব্যতীত ঠিক ৫ শতাংশ মুনাফা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে আমাদের স্মার্টফোন বিভাগও থাকছে।
শাওমি কর্তৃপক্ষ মূলত তাদের ভোক্তা বা ব্যবহারকারীদের ক্রয়সীমার কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের কৌশল হচ্ছে'অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে বেশি সংখ্যক পণ্য বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়া'।
শুধু স্মার্টফোন নয়, প্রতিদিন ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের লাইফস্টাইল পণ্যের জন্য চীনের বাজারে শাওমি এখন বেশ সুবিদিত একটি নাম। স্মার্টফোন বিক্রির পাশাপাশি শাওমি ইকোসিস্টেমে এখন নানা ধরনের পণ্যের সমাহার রয়েছে। বিপুল সংখ্যক স্মার্টফোন বিক্রির কারণে শাওমির ইকোসিস্টেমে ভোক্তারপরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ফলে স্মার্টফোন বিভাগে যদি তাদের মুনাফার পরিমাণ অন্যান্য ফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় একটু কমও হয়, অন্যান্য পণ্যসম্ভার এবং সেবার সার্বিক মুনাফার হিসেবে শাওমি কিন্তু আদৌ পিছিয়ে থাকছে না।
২০১৪ সালে শাওমি কর্পোরেশন তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট mi.com কিনতে ঠিক ৩.৬ মিলিয়ন ডলার খরচ করে। বিশ্বব্যাপী ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যেই শাওমি কর্তৃপক্ষ তাদের আগের ওয়েবসাইট xiaomi.com'এর পরিবর্তে নতুন এই ওয়েবসাইট কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
চীনের বাইরের জনগণের জন্য কিন্তু Xiaomi নামটি উচ্চারণ করা একটু অসুবিধারই বটে। ঠিক এই কারণেই অনলাইন বিক্রয়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি সহজে উচ্চারণযোগ্য একটি ওয়েবসাইট চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই বিষয়টি সামনে রেখেই ২০১০ সালের xiaomi.com এর পরিবর্তে ২০১৪ সালে সহজে উচ্চারণযোগ্য mi.comপ্রতিষ্ঠিত হয়।
শাওমি কর্পোরেশনের ব্যবহৃত লোগোটি আপনার চোখে খুব সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু এই লোগোর বিশেষ একটি অর্থ রয়েছে। লোগোটিকে ঠিক উল্টো করে দেখলে আমরা একটি চীনা শব্দ পাই, যার অর্থ হচ্ছে 'হার্ট বা হৃদয়'। বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক কিনা এই বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া না গেলেও বিষয়টি কিন্তু বেশ মজারই।
শাওমি কোম্পানির Mi লোগোটি মূলত মোবাইল ইন্টারনেটকে নির্দেশ করে। এই লোগোর কিন্তু আরও একটি অর্থ আছে। সেই অর্থটি হচ্ছে 'মিশন ইম্পসিবল'!
শাওমি নামটির আভিধানিক অর্থ 'সামান্য শস্যবিশেষ' (little rice)। আভিধানিক অর্থে যা-ই হোক না কেন, 'মোবাইল ইন্টারনেট' বা 'মিশন ইম্পসিবল' শব্দগুলো দ্বারা কিন্তু মূলত শাওমি কর্পোরেশনের উদ্দেশ্যের দিকেই ইঙ্গিত দেয়া হয়।
অধিকাংশ মানুষের কাছে শাওমি মূলত তাদের স্মার্টফোনের জন্য পরিচিত হলেও তাদের উৎপাদিত পণ্য কিন্তু শুধু স্মার্টফোন নয়। কোম্পানিটি তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় স্মার্টফোনগুলোর পাশাপাশি আরও বেশ কিছু পণ্য উৎপাদনের জন্য সুবিদিত। পণ্যসম্ভারের এই নামগুলো অনেককে বেশ অবাক করে।
স্মার্টফোনের পাশাপাশি শাওমি ফিটনেস ব্যান্ড, ড্রোন, স্মার্ট লাইট বাল্ব, রোবট ভ্যাকুয়াম ক্লিনার এবং পাওয়ার ব্যাঙ্কের জন্যও বেশ পরিচিত। এছাড়া সিকিউরিটি ক্যামেরা, মিডিয়া স্ট্রিমিং ডিভাইস, এমনকি স্মার্ট জুতাও প্রস্তুত করে থাকে এই কোম্পানিটি। সম্প্রতি শাওমি ইলেকট্রিক স্কুটারের জগতেও পা ফেলেছে। চীনের বাজারে আনা তাদের স্মার্ট স্কুটারটি একবার চার্জে কমপক্ষে ১৮ মাইল পাড়ি দিতে সক্ষম।
শাওমির পণ্যসম্ভার শুধুমাত্র এগুলোই ভাবলে আপনি হয়তো একটু ভুলই করছেন! বর্তমানে শাওমির উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে রাইস কুকার, ইলেকট্রিক টুথব্রাশ, ট্রাভেল পিলো, স্যুটকেস, ম্যাট্রেস, এমনকি কলমও। ‘প্রাচ্যের অ্যাপল’ নামে খ্যাত এমন একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে এমন সব পণ্যের সমারোহের বিষয়টি বেশ বিচিত্র হলেও চীনের অভ্যন্তরীণ বাজারে এই পণ্যগুলোর কিন্তু বেশ সুনাম রয়েছে। চীনের বাইরে শাওমি মূলত স্মার্টফোনের জন্যই সুপরিচিত হলেও চীনে শাওমি কর্পোরেশন শুধুমাত্র স্মার্টফোন নয়, বরং নিত্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের জন্যও জনগণের কাছে সুপরিচিত।
শাওমির বিক্রয় অন্তর্ভূক্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র চীন এবং সিংগাপুরের বাইরে অধিকাংশ দেশগুলোতে তাদের তেমন কোনো অফলাইন বিক্রয়কেন্দ্র নেই। প্রতিষ্ঠানটি মূলত অনলাইন বিক্রয়ের প্রতিই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অফলাইন বিক্রয়ের পরিবর্তে অনলাইন বিক্রয়ের কারণেই অপেক্ষাকৃত কম খরচ, কম কর্মী এবং কম মুনাফায় শাওমি তাদের পণ্য তাদের ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দিতে পারে। এই বিষয়টি শাওমি স্মার্টফোনের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের অন্যতম প্রধান একটি কারণ।
ঠিক রিটেইল বিক্রয়কেন্দ্রের মতোই শাওমি তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপণের বিষয়েও বেশ কৌশলী। বিজ্ঞাপণ ব্যয়ের কারণে পণ্যের অহেতুক মূল্যবৃদ্ধির বিপক্ষে শাওমির অবস্থান। ঠিক এই কারণেই সনাতনী টেলিভিশন বিজ্ঞাপণের বদলে অনলাইন বিজ্ঞাপনকেই তারা তাদের পণ্য প্রচারণার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। এছাড়া কোনো চলচ্চিত্র প্রযোজনা কোম্পানির সাথেও শাওমির কোনো প্রচারণা চুক্তি নেই। সীমিত বিজ্ঞাপণ কৌশলের পরেও চীন, ভারত এবং বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারে শাওমি আজ এক আকাশচুম্বী জনপ্রিয় নাম।
ফিচার ইমেজ - Wikimedia Commons
আমি বিপ্লব হুসাইন। CEO, YouthEye Foundation, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 69 টি টিউন ও 4 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 7 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 15 টিউনারকে ফলো করি।
A computer science & engineering student along with a youth social activist in Bangladesh, Love to teach, learning new things and writing articles for the betterment of peoples.