ব্যস্ত জীবনে ঘুমের গুরুত্ব শুধু সে-ই বোঝে, যে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও রাতে দু'দণ্ড শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। আজকালকার প্রতিযোগী পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আপনাকে সবসময় সুস্থ, সবল ও প্রাণবন্ত থাকতেই হবে। এজন্য ঘুমের বিকল্প নেই।
আমরা সাধারণত দু'ধরনের ঘুমের মধ্য দিয়ে যাই-
১) নন- র্যাপিড আই মুভমেন্ট ও
২) র্যাপিড আই মুভমেন্ট।
এনআরইএম-এ আমরা গভীর ঘুমে থাকি, যা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। গভীর ঘুমের সময়ই আমাদের স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত হয়। তাছাড়া বাচ্চা থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও গভীর ঘুম তাদের উচ্চতা বাড়াতে সহায়ক এবং এই সময়ই আমাদের শরীরে নতুন কোষের জন্ম ও পুরনো কোষের মেরামত চলে।
এত প্রয়োজনীয় যখন ঘুম, তখন তার জন্য আমাদেরও কিছু কাজ করা উচিত। বর্তমানে খুব সহজেই আপনার অ্যান্ড্রয়েড বা আইফোনে আপনি এমন অনেক অ্যাপ্লিকেশন পাবেন, যেগুলো বিশেষভাবে আপনার মতো ঘুমবঞ্চিত মানুষের কথা মাথায় রেখেই বানানো হয়েছে। চলুন তাদের মধ্যে জনপ্রিয় ৫টি অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
স্লিপ সাইকেল
গুগল প্লে রেটিং- ৪.৫/৫.০
আমরা ঘুমের মধ্যে কিছু সাইকেল বা চক্র পার করি। যেকোনো ঘুমের প্রথম সাইকেলটি থাকে ‘হালকা ঘুমের’। যখন আমরা স্বপ্ন দেখি, তখন এটি র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা আরইএম-এ চলে যায়। অর্থাৎ আপনার চোখের পাতা ঘন ঘন নড়াচড়া করে। অস্বাভাবিক না হলে কেউই রাতের পুরোটা সময় গভীর ঘুমে কাটান না, ঘুম-জাগরণের মাঝামাঝি কয়েকটি ধাপ আমরা পার হই এবং এই প্রত্যেকটি ধাপ সাধারণত ৯০ মিনিটের হয়। ৯০ মিনিটের ধাপগুলো ঘুরে ফিরে আমাদের ৭-৮ ঘণ্টার ঘুম সম্পন্ন করে।
স্লিপ সাইকেল আপনার ঘুমের এই চক্রটি ধরার চেষ্টা করে শব্দ, ভাইব্রেশন ও রাতে বিছানায় আপনার শরীরের নড়াচড়া মনিটর করার মাধ্যমে। প্রতিটি ধাপে আমাদের শরীরের চলাচল পরিবর্তন হয়। এই অ্যাপ্লিকেশনটি আপনার কোন ধাপে কী ধরনের নড়াচড়া হয় তা খেয়াল রাখে।
আপনি যখন হালকা ঘুমের অবস্থায় থাকেন তখন এই অ্যাপটি আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত সময়ে জাগিয়ে দেয়, যাতে করে আপনি হঠাৎ গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠেন না। গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠলে সে ধাক্কা সামলাতে আপনার শরীরের অনেক সময় লাগে।
শব্দ ও নড়াচড়া ধরার জন্য মোবাইলের মাইক্রোফোনটি আপনার বিছানার দিকে মুখ করে রাখুন। এতে কিছু স্নুজ বা বিরতি দেয়ার অপশনও রয়েছে। এর ‘ইন্টেলিজেন্ট স্নুজ’ অপশনটি প্রতিবার স্নুজের সময় আপনাআপনি কমিয়ে আনে, যা আপনার ধীরে ধীরে জেগে ওঠার জন্য সহায়ক।
গুগল প্লে রেটিং- ৪.৩/৫.০
প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনন্য একটি স্লিপ অ্যাপ্লিকেশন এই পিজিজ। হ্যারি পটার খ্যাত লেখিকা জে. কে. রোলিং নিজেও এই অ্যাপটি ব্যবহার করেন। এতে দু'ধরনের ফাংশন ব্যবহার করা হয়- একটি শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর ও কিছু বাইনরাল বিট বা শব্দ। বাইনরাল শব্দ হলো এমন শব্দ, যা বিভিন্ন কম্পাঙ্কের কিছু শব্দকে একত্র করে বানানো। আপনার দুই কানে এটি দুই রকমের বিট বাজাবে ও সাথে চলতে থাকবে ‘রিলাক্সিং ভয়েস-ওভার’।
এতে দু'ধরনের উপকার হয়-
১) এই অ্যাপে ১০০ বিলিয়নের মতো শব্দ তৈরি করা যায়; ফলে আপনার মস্তিষ্ক কখনো শুধু একটি-দুটি শব্দে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে না এবং
২) বিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুই কানে ভিন্ন দুই রকম শব্দ বাজানো হলে এতে আপনার মস্তিষ্কের তরঙ্গ বৃদ্ধি করে।
শুরুতে এই অ্যাপটি দুটি আলাদা সিস্টেমে চালানো হতো। এর মধ্যে একটি ছিল পিজিজ এনারজাইজার ও আরেকটি পিজিজ স্লিপ। এনারজাইজারে আপনি পাওয়ার ন্যাপ বা ছোট ঘুম দিতে পারেন এবং পিজিজ স্লিপে একটি সম্পূর্ণ ঘুম সম্পন্ন করতে পারেন। বর্তমানের পিজিজ অ্যাপে দুটি কাজ করার মডিউল রয়েছে। সেটিংসে গিয়ে শুধু ঠিক করুন আপনি পাওয়ার ন্যাপ নেবেন নাকি পুরো রাত ঘুমাবেন।
পাওয়ার ন্যাপের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে ঐ ‘রিলাক্সিং ভয়েস’-ই আপনাকে জাগিয়ে দিবে। অন্যদিকে স্লিপের ক্ষেত্রে আপনার মোবাইলের সাধারণ অ্যালার্ম ক্লকের সময় অনুযায়ীই অ্যাপটি অ্যালার্ম বাজাবে।
আপনি চাইলে এই শব্দগুলোর সময় ও তীব্রতা আপনার পছন্দমতো কমাতে-বাড়াতে পারেন। এটি চালানো অনেক সহজ এবং বহুসংখ্যক ব্যবহারকারী এই অ্যাপটিতে উপকৃত হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন।
গুগল প্লে রেটিং- ৩.৮/ ৫.০
ঘুমের ক্ষেত্রে অন্যান্য যেকোনো অ্যাপের চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক ধরা হয় স্লিপ জিনিয়াসকে। বলা হয়, নাসার নভোচারীদের ঘুমের জন্যই বিশেষভাবে বানানো হয়েছে এই অ্যাপটি। অন্যান্য অ্যাপে যেখানে আপনার শরীরের নড়াচড়া ও বিভিন্ন বাহ্যিক অনুষঙ্গ দিয়ে আপনার ঘুমের প্যাটার্ন ধরা হয়, স্লিপ জিনিয়াসে ব্যাপারটি আরও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়। শব্দ ও ভাইব্রেশন অনেক সময়ই মোবাইল ধরতে পারে না। সেক্ষেত্রে ঘুমের প্যাটার্নে ভুল তথ্য চলে আসা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
সেজন্য স্লিপ জিনিয়াস আপনাকে প্রতি সপ্তাহে একটি প্রশ্নোত্তর পর্ব ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠাবে। এতে আপনার ঘুমের পরিমাণ, ঘুমের কোয়ালিটি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কিত প্রশ্ন থাকবে, যার সাহায্যে অ্যাপটি বুঝতে পারবে আপনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সিস্টেম ব্যবহার করা উচিত।
এখানে আপনাকে যে ধরনের মিউজিক শোনানো হয়, তা স্নায়ুবিদরা গবেষণা করে তৈরি করেছেন। নিউরোসেন্সরি অ্যালগোরিদম, পিংক নয়েজ, মাল্টিব্যান্ড বাইনরাল বিট ও সাইকোএকুসটিক মিউজিক- এই ৪ ধরনের শব্দের কম্বিনেশনের মাধ্যমে আপনার মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ২-৩ মাস অনবরত শোনার ফলে আপনার মস্তিষ্ক একটি বিশেষ শব্দে ঘুমিয়ে পড়বে, আবার একটি বিশেষ শব্দে জেগে উঠবে।
জেগে ওঠার ক্ষেত্রে এই অ্যাপটি ‘রিভাইভ সাইকেল অ্যালার্ম’ নামে একটি ফিচার ব্যবহার করে। এখানেও অন্যান্য অ্যাপের মতোই একবারে না জাগিয়ে কয়েকটি বিরতির মধ্য দিয়ে জাগানো হবে; তবে স্লিপ জিনিয়াস প্রতি ৫ মিনিট পর পর অ্যালার্ম দেবে এবং প্রতিবার অ্যালার্মের শব্দের তীব্রতা পরিবর্তন হবে নিজে নিজেই।
তাদের ওয়েবসাইটে স্লিপ জিনিয়াস দাবি করে, তাদের বানানো এই অ্যাপটি শতভাগ বৈজ্ঞানিক ও তারা নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান ব্যবহার করে তাদের অ্যাপটি ডিজাইন করেছে। ২০১৫ সালে নাসার প্রযুক্তি ও পণ্যের বার্ষিক প্রকাশনা ‘স্পিনঅফ’-এ স্লিপ জিনিয়াস অ্যাপটিকে একটি উদীয়মান প্রযুক্তি বলে আখ্যা দিয়েছে।
গুগল প্লে রেটিং- ৪.৩/৫.০
যদি আপনার শুধু কিছু শব্দে কাজ না হয় এবং মনে করেন আপনার মেডিটেশন বা ধ্যানের প্রয়োজন আছে, তাহলে রিলাক্স অ্যান্ড স্লিপ ওয়েল অ্যাপ্লিকেশনটি আপনার উপকারে আসবে। এটি ইতিমধ্যে প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষকে সেবা দিচ্ছে এবং ৫০টি দেশে ১ নম্বর অবস্থানে আছে।
বিখ্যাত ব্রিটিশ হিপনোটিস্ট বা সম্মোহক গ্লেন হ্যারল্ড এই অ্যাপটি ডিজাইন করেন এবং যে ব্যক্তির কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে সম্মোহন করা হয়, সেটি তারই।
এখানে আপনি বিনামূল্যে দু'ধরনের সম্মোহন ফিচার পাবেন-
১) ২৯ মিনিটের একটি সম্পূর্ণ সম্মোহন সেশন, যেখানে একটি শান্ত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে গ্লেনের সম্মোহনী আওয়াজ শোনা যাবে; এবং
২) ৩০ মিনিটের সলফেগিও স্কেলের মিউজিক। সলফেগিও হলো একটি গ্রিক ‘হিলিং স্কেল’; অর্থাৎ এই শব্দগুলো শোনার মাধ্যমে আমাদের মানসিক শান্তি অর্জিত হয়। সলফেগিওয়ের বাকি ভাগগুলো পেতে হলে আপনাকে অর্থের মাধ্যমে আপনার অ্যাপটি আপগ্রেড করতে হবে।
এখানের প্রতিটি শব্দ স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়েছে বিধায় সাউন্ড কোয়ালিটি খুবই ভালো। তাছাড়া প্রতিটি ধাপের জন্য বিশেষভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন সমস্যার জন্য বিভিন্ন মেডিটেশন প্যাকেজ ব্যবহার করতে পারবেন- ঘুম, হতাশা, অস্বস্তি, ইনসোমনিয়া, অতিরিক্ত ওজন, দুর্বল আত্মবিশ্বাস, মাদকাসক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার জন্য আলাদা আলাদা ধ্যানের প্যাকেজ আছে, কিন্তু এর সবই বিনামূল্যে নয়। এসব ফিচার পেতে হলে আপনাকে সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হবে।
গুগল প্লে রেটিং- ৪.৫/৫.০
চলুন একটি অন্যরকম অ্যাপের কথা বলি। আওকেন আপনাকে ঘুমাতে সাহায্য করবে না। তবে যদি আপনি আপনার ঘুমে দেখা স্বপ্নগুলো নিয়ে বিচলিত থাকেন, তাহলে আওকেন আপনাকে সাহায্য করতে পারবে।
এটি এক ধরনের ‘লুসিড ড্রিমিং অ্যাপ’। লুসিড ড্রিমিং হলো স্বপ্নের এমন একটি পর্যায়, যখন আপনি নিজেই জানেন আপনি ঘুমাচ্ছেন ও স্বপ্ন দেখছেন! এমনটি সচরাচর না হলেও একেবারে হয় না তা বলা যাবে না। ধরুন, আপনার খারাপ স্বপ্ন দেখার প্রবণতা বেড়ে গেছে, বা স্বপ্নে কী দেখছেন তার কিছুই মনে থাকছে না বা আপনি আপনার দেখা স্বপ্নগুলোকে মনে রাখতে চাচ্ছেন তাহলে আপনি লুসিড ড্রিমিং অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। স্টোরে অনেক রকমের লুসিড ড্রিমিং অ্যাপ থাকলেও আওকেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
কেন? কারণ এই অ্যাপটি অনেক বেশি ইউজার-ফ্রেন্ডলি। এটি শুধু কিছু ফিচারের সমন্বয়ই নয়, বরং কী করে আপনি আরও সতর্কভাবে স্বপ্ন দেখতে পারবেন সে বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য ও পরামর্শ দেবে আওকেন। এই অ্যাপটি আপনাকে দিনের যেকোনো সময় হুটহাট কিছু নোটিফিকেশন পাঠাবে, যেগুলোকে বলা হয় ‘রিয়েলিটি চেক’। সেসব নোটিফিকেশনে প্রশ্ন থাকবে আপনি ঘুমাচ্ছেন কি না।
রাতে যখন সত্যিই ঘুমাবেন, তখন আবারো সেই একই নোটিফিকেশনের শব্দ বেজে উঠবে। সে শব্দের মাধ্যমেই অভ্যাসবশত আপনি ঘুম থেকে স্বপ্নের দেশে চলে যাবেন। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে? ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য নয়, তবে এতে অভ্যস্ত হতে অনেক সময় লাগে- এটি এই অ্যাপের প্রস্তুতকারকরাও স্বীকার করেছেন।
তাছাড়া এতে একটি ড্রিম ডায়েরি ফিচার আছে, যা আপনার জেগে ওঠার সাথে সাথে আপনাকে স্বপ্নটি লিখে রাখতে নির্দেশ দিবে। এই ফিচারটি গুগল ক্লাউডের সাথে সামঞ্জস্য করা, যাতে আপনার ফোন হারিয়ে গেলেও আপনার স্বপ্নের রেকর্ডগুলো যেন থাকে। তাছাড়া অ্যাচিভমেন্ট ফিচার নামের অংশটি আপনার উন্নতি সম্পর্কে আপনাকে জানাতে থাকবে।
যদি কখনো এতে বিরক্তি চলে আসে তাহলে আপনি যেকোনো সময় এই প্রক্রিয়াটি থামাতে পারেন, পরবর্তীতে আবার সেখান থেকে শুরু করতে পারেন।
যদিও এটি ঘুমের সহায়ক কোনো অ্যাপ্লিকেশন না, তবু প্রচুর সংখ্যক মানুষ এটি ব্যবহার করছে। যদি আপনার না ঘুম হওয়ার কারণ হয় দুঃস্বপ্ন, তাহলে এই অ্যাপটি আপনাকে অনেক সাহায্য করবে বলা যায়।
আমি বিপ্লব হুসাইন। CEO, YouthEye Foundation, Dhaka। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 6 বছর 10 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 69 টি টিউন ও 4 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 7 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 15 টিউনারকে ফলো করি।
A computer science & engineering student along with a youth social activist in Bangladesh, Love to teach, learning new things and writing articles for the betterment of peoples.