পরের দিন সকাল ১০টায় আমরা বের হই বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে, যেটি ছিল আমাদের দেখা সিলেটের সব থেকে আকর্ষণীয় একটি জায়গা। বিশ্বনাথ থেকে বিছানাকান্দির দূরত্ব প্রায় ৯০ কি:মি:। কিন্তু রাস্তা এতটাই খারাপ যে আমাদের যাওয়া আসা করতে বেশ সময় লেগে গিয়েছিলো। আমি গুগল ম্যাপ ঘেটে সব থেকে শর্ট-কার্ট রাস্তা (এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে) খুঁজে নেই আর সেটাই ছিলো আমাদের জন্য সব থেকে চরম অভিজ্ঞতা। এর থেকে জঘন্য রাস্তা আমার জীবনে কোনো দিন দেখি নাই। প্রায় ৩০ কি:মি: রাস্তায় ভাঙ্গা, কোথাও কাদা, কোথাও ধুলোবালির রাজ্য। ভুল পথে এসে সত্যি যেন ফেঁসে গেছি বলে মনে হলো। ছাইড়া দে মা, কাইন্দা বাঁচি এমন একটা অবস্থা। যদিও আমার এতটুকু বিশ্বাস ছিলো যে, যেহেতু ম্যাপে একটা পথ দেখাচ্ছে সেহেতু একটু দেরি হলেও আমরা ঠিক পৌঁছে যাবো। তাই কাদা, পানি, ভাঙা রাস্তার মধ্যে দিয়ে রাইড করতে থাকলাম এবং কোথাও কোনো সময় নষ্ট করলাম না। একটা সময় এসে সবাই যেই রাস্তা দিয়ে বিছানাকান্দি যাওয়া-আসা করে সেটা খুঁজে পেলাম।
রাতারগুল যেহেতু একধরণের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, এতে বাইক নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাই আমরা এই যাত্রায় ধরে নিয়েছিলাম রাতারগুল দেখা হবেনা। কিন্তু ভুল রাস্তার কল্যানে আমরা রাতারগুলের খুব পাশ দিয়ে আসি আর বেশ খানিকটা জায়গা পানিতে ভেসে থাকা একটি বন দেখতে পাই। বুঝতে পারি রাতারগুল না গিয়ে আমরা সত্যি মিস করলাম।
বিছানাকান্দি স্পটের প্রায় ৮ - ১০ কিঃমিঃ আগে থেকে আবার শুরু হয় কাঁচা, ভাঙ্গা, কাদাময় রাস্তা। আমরা ২ - ১ জনকে জিজ্ঞেস করে এগুতে থাকি কিন্তু এক সময় সামনে গিয়ে দেখি একটা খাল ! যেখানে নৌকা দিয়ে সবাই পাড় হচ্ছে। দেখে মাথায় যেন বাজ পড়ার উপক্রম। কারন আমাদের সাথে মটরসাইকেল, এখানে কোনো গারেজ নেই আর এটাকে এখানে রেখেও স্পটে যাওয়া সম্ভব নয়। এত দূর এসে যদি স্পটেই না যেতে পারি তাহলে কেমন হবে ! তবে শেষ মেশ একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল। নৌকার মাঝি আমাদের বাইকসহ পাড় করে দিতে চাইলেন, ভাড়াও (৩০ টাকা) একদম কম। রাজি হয়ে গেলাম। আমি, রুম্মান কেউ সাতার জানিনা। নৌকার একদম শেষ মাথায়, নৌকা চলন্ত অবস্থায় বাইকের উপর বসে থাকা সত্যি সাহসের ব্যাপার। এই সাহসটা অবশ্যও রুম্মানই নিল। নৌকার মাঝি সিলেটি ভাষায় পরামর্শ দিলেন যে, সোজা রাস্তা দিয়ে চলে যাবেন, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। এখানে নানা ধরনের মানুষ, সবাই শুধু টাকার ধান্দায় থাকে। একটু মুচকি হেসে, কথাটা শুনেও যেনো উড়িয়ে দেয়ার ভান করলাম।
দূর থেকে জাফলং আর বিছানাকান্দির সৌন্দর্য প্রায় একই রকম কারণ এখানেও বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে সুউচ্চ পাহাড়। কিন্তু ঝর্ণাটি ঠিক কোন জায়গায় বুঝতে পারছিলাম না। কাঁচা রাস্তা ধরে ৭-৮ মিনিট আসার পর দেখলাম কিছু বিজিবি একটি চায়ের দোকানে বসে গল্প-গুজব করছে। তাদেরকে দেখে আমরা মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে স্পটটা কোন দিকে। তারা আমাদের জিজ্ঞেস করলো যে, আমরা কোথা থেকে এসেছি ? বললাম যে রংপুর থেকে, তারা বেশ বিস্মিত হলো। বললো মোটরসাইকেল নিয়ে একদম রংপুর থেকে ? আমার আবার হ্যা সূচক উত্তর দিলাম। উনাদের মধ্যে একজন একটা ছোট ছেলেকে আমাদের সাথে দিল এবং বলল আপনারা এখানে বুজতে পারবেন না কোনটা বাংলাদেশের সীমানায় আর কোনটা ভারতের ভিতর। আর বললো সামনে একটা বিজিবি ক্যাম্প আছে, গিয়ে ওনার পরিচয় দিয়ে বাইকটা ক্যাম্পের কাছে রেখে স্পটে যেতে। ছোট ছেলেটি আমাদেরকে স্পটের কাছাকাছি বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে গেলো। সেখানে ২ জন বিজিবিকে আমরা আমাদের বৃত্তান্ত বললাম। আমাদের রংপুর থেকে আসা শুনে তারাও বেশ অবাক হলো। আমাদের বললেন মোটরসাইকেল নিয়েই স্পটে চলে যেতে। আমরা বেশ খুশিই হলাম। ছোট বাচ্চাকে চকলেট খাওয়ার জন্য ২০ টাকা দিল রুম্মান।
এখানেও পাহাড় যেখান থেকে শুরু তার সবটাই ভারতের, তবে পাহাড় থেকে নেমে আসা অসাধারণ একটি ঝর্ণা আমাদের ভাগে পড়েছে। ঝর্ণাটি বেশ প্রশস্ত এবং পানির স্রোত মোটামুটি বেশ। শুনলাম বর্ষার সময়ে পানি আরও অনেক বেশি থাকে আর দেখতেও বেশি আকর্ষণীয় লাগে। তখন প্রায় দুপুর দেড়টা, ৩০-৪০ জন পর্যটক ঝর্ণার পানিতে গোসল করছে, কেউ আবার ছবি তোলায় ব্যস্ত। পাথর ভর্তি ঝর্ণার পাশে একটি দুইটি খাবার হোটেল এবং ৮ - ১০টি উপহার সামগ্রীর দোকান রয়েছে। আমাদের সাথে ব্যাগ থাকলেও, গামছা ছিলনা তাই একটু ঝামেলার মধ্যে পরে গেলাম। দোকানগুলোতে খুজলাম কোথাও গামছা পাওয়া যায় কিনা। রুম্মান কোথায় থেকে যেন গামছা ভাড়া করে আনলো। কোথায় পেলো, কিভাবে পেলো এখনো আমি জানিনা। কারণ গামছা পেয়েই আমি খুশি ছিলাম। এত শত শুনে কাজ কি, যদিও ১ বার ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু উত্তরে কি বলেছিল মনে পরেনা।
ড্রেস চেঞ্জ করে ঝর্ণার পানিতে নামতেই মনটা প্রশান্ত হয়ে গেল। প্রচন্ড গরমে এমন হিম শীতল পানি পেয়ে মনে হচ্ছিল আর উঠবো এখান না। যেমন শীতল, স্বচ্ছ পানি, তার উপর পাশেই বিশাল পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য।যা দেখে, যে কোনো কেউ কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্থবির হয়ে যাবে। অন্তত: একবার হলেও মনে হবে, স্রষ্টার সৃষ্টি কত সুন্দর। আসলে আমাদের সকলেরই উচিত সময়, সুযোগ, আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো দেখতে বের হওয়া। এত মন যেমন তৃপ্ত হয়, তেমনি জীবনের রহস্যও খানিকটা উপলব্ধি করা যায়। প্রায় এক থেকে দেড় ঘন্টা ঝর্ণার পানিতে গোসল করে একদম সতেজ লাগছিল আর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিলো। হোটেলের খাবারের মান ভালো না কিন্তু তাতে কোনো যায় আসে না। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
এবার ফেরার পালা, প্রায় ৪টা বেজে গেছে। যাদের সাথে একটু খাতির হয়ে গিয়েছিলো, তাদের বিদায় দিয়ে আবার নৌকাতে বাইক পাড় করে রওনা দিলাম বিশ্বনাথের উদ্যেশ্যে। বিছানাকান্দি স্পট থেকে আসার সময় ওর আসে পাশে আমাদের চোখে যেই মোটরসাইকেলগুলো পড়েছিল তার ৯০% এর কোনো লাইসেন্স ছিলোনা। ২ - ১টা ১৮০ - ২২০সি,সি'র বাইকও চোখে পড়েছে। অনেককেই দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, তারা বাংলাদেশী নয়। যদিও বিছানাকান্দি দিন দিন বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠছে তবুও স্থানীয় লোকজনদের তাকানোর চাহনি দেখে মাঝে মাঝে মনে হলো, তাদের চোখে ট্যুরিস্ট কমই পরে। অনেকের চোখে খানিকটা কৌতহলই লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের কাছেও অনেকের আচরণ কেমন ভিন্ন ধাঁচের মনে হয়েছে। তো যাই হোক, ফেরার সময় আর আগের মতো ভুল করবো না বলে সিদ্ধান্ত নেই এবং যেই পথে সবাই সিলেট থেকে যাওয়া-আসা করে সেই পথটিই বেছে নেই। কিন্তু যার নাম লাউ, উহার নামই কদু। ভাঙা রাস্তার কোনো শেষ নেই, তার উপর রাস্তায় ইটের টুকরা (খোয়া) বিছানো, রাস্তা মেরামতের কাজ চলছিল। বাইকের রেয়ার টায়ার মোটা হওয়াতে আমরা বেশ সুবিধা পেয়েছি, নয়তো এই রাস্তায় ড্রাইভ করাটা আরো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠতো। আমাদের টার্গেট ছিল সন্ধ্যার আগেই মেইন রাস্তায় ওঠা, নয়তো গ্রামের রাস্তায় সন্ধ্যার পর কোনো বিপদেও পরে যেতে পারি। সন্ধ্যার আগেই আমরা মেইন রোডে উঠে যাই এবং একটা বিরতি নেই। যদিও সন্ধ্যা হয়ে গেছে তারপরও রাস্তায় অনেক গাড়িঘোড়া। বুঝতে পারলাম এই রাস্তায় রাত ৯টা পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না হয়ত। আমরা নিজেদের মাঝে কথা বলছিলাম যে, কোথাও কোনো সমস্যায় পড়লে, আমাদের কি করনীয়। আসলে বিপদ বলে আসে না, আর আসলেও কিছু করার থাকেনা। তবে অস্থির না হয়ে ঠান্ডা মাথায় সবার আগে নিজের সেফটির কথাটা চিন্তা করাই শ্রেয়। আল্লাহর রহমতে এই ট্যুর থেকে বাড়ি ফেরা অবদি আমরা তেমন কোনো সমস্যাতেই পড়িনি। আস্তে ধীরে সিলেট সদর হয়ে, আমরা বিশ্বনাথে পৌঁছে যাই। পরের দিনের পরিকল্পনা, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখে শ্রীমঙ্গল ফেরা এবং শ্রীমঙ্গলের আশেপাশের জায়গা গুলো ঘুরে দেখা.
3rd Part - coming soon ...
প্রথম প্রকাশিত: http://deshibiker.com/ বাংলা ভার্শনে
আমি দেশি বাইকার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 7 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 5 টি টিউন ও 1 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 2 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।