মোবাইল ফোন আমাদের প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা দিনের বেশিরভাগ সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করে থাকেন। এমনকি, অনেকেই রয়েছেন যারা অনেক গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল ব্যবহার করেন।
আমরা যে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে স্মার্টফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি, এতে কিন্তু অনেক শারীরিক প্রভাব পড়ে। আর এই প্রভাব গুলোর মধ্যে অন্যতম আরো যে কারণটি আপনার জন্য বেশি ক্ষতির কারণ হয়, সেটি হলো, মোবাইল ফোনের স্ক্রিন থেকে নির্গত হওয়া Blue Light। আপনি হয়তোবা এর আগে অনেক জায়গায় ব্লু লাইট সম্পর্কে জেনেছেন কিংবা আপনার মোবাইলের স্ট্যাটাস বারে ও Blue Light প্রোটেকশন চালু করার অপশন দেখতে পাবেন।
যাইহোক, কিন্তু আপনি হয়তোবা এখনো পর্যন্ত জানেন না যে, স্মার্টফোনের ব্লু লাইট কী এবং এটি আমাদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
আমরা যখন স্মার্ট ফোন ব্যবহার করি, তখন ডিসপ্লে থেকে নির্গত হওয়া আলো গুলোর মধ্যে অনেক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলো থাকে। এগুলোর মধ্যে থেকে অন্যতম হলো, স্ক্রিন থেকে আসা নীল আলো। আর মোবাইল স্ক্রিন থেকে নির্গত হওয়া এই নীল আলোকেই ব্লু লাইট বলা হয়।
বিভিন্ন গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, Blue Light আমাদের স্বাস্থ্য কে প্রভাবিত করে। হার্ভার্ডের করা এক গবেষণায় বারবার সতর্ক করা হয়েছে যে, রাতে মোবাইল ডিভাইস এর মত গ্যাজেট ব্যবহার করলে, আপনার ঘুমের পরিমাণ এবং স্বাস্থ্য উভয় প্রভাবিত হয়। এর কারণ হলো, রাতে আলোর সংস্পর্শে আসা। আর বিশেষ করে, যদি স্বল্প তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হিসেবে Blue Light এর সংস্পর্শে আসা যায়। ব্লু লাইট মূলত ফোন, ট্যাবলেট এবং আলোকিত সকল ডিসপ্লে থেকে নির্গত হয়।
যদিও সূর্যের আলোতেও নীল আলো থাকে, যা দিনের বেলা অত্যাবশ্যক। এই আলো আমাদের দিনের বেলা জাগ্রত এবং সজাগ রাখতে সাহায্য করে। আর যার ফলে, আমাদের ঘুমের চক্রটি নিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করে। কিন্তু, আপনি যখন রাতের বেলাতেও নীল আলোর সংস্পর্শে আসেন, তখন এটি আপনার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর অন্যতম কারণ হলো, রাতে ব্লু লাইটের সংস্পর্শে আসার ফলে এটি আপনার মস্তিষ্ককে এটি চিন্তা করায় যে, এখনো দিনের বেলা রয়েছে।
আর, এর ফলে এটি মস্তিষ্কে মেলাটোনিনের হরমোনের নিঃসরণকে কমিয়ে দেয়। এটি হলো এমন একটি হরমোন, যা শুধুমাত্র রাতে উৎপাদিত হয় এবং যা আপনার শরীরকে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে।
Blue Light এর প্রভাব এমনটাই যে, Daily Mail এর একটি রিপোর্ট অনুসারে এবং অন্য আরও একটি গবেষণায় এরকম পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, গাড়ির ড্যাশবোর্ডে যদি নীল এলইডি লাইট জ্বালিয়ে রাখা যায়, তাহলে এটি গাড়ি চালকদের ঘুমিয়ে পড়া থেকে প্রতিরোধ করার অন্যতম একটি কার্যকর উপায় হবে। তাহলে আপনি বুঝতেই পারছেন যে, রাতে মোবাইল থেকে নির্গত হওয়া ব্লু লাইট আপনার স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।
এখন আপনার প্রশ্ন আসতে পারে যে, তাহলে আপনি ঘুমাতে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আপনার ফোন বন্ধ না করে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? এর সংক্ষিপ্ত সমাধান হল, আপনাকে Blue Light Filter ব্যবহার করতে হবে। আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোনে হয়তোবা ইতিমধ্যেই এই ফিচারটি দেওয়া রয়েছে। এছাড়াও, আরো বেশ কিছু সেরা থার্ড পার্টি অ্যাপ রয়েছে, যেগুলো দিয়েও আপনি Blue Light বন্ধ করতে পারেন।
ব্লু লাইট ফিল্টার গুলো আপনার মোবাইল থেকে নির্গত হওয়া নীল আলোর পরিমাণ কমিয়ে দিতে কাজ করে। Blue Light ফিল্টার ফিচার আপনার মোবাইলের ব্লু লাইটের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে, স্ক্রিনে লাল ফিল্টার রাখে। আপনার মোবাইলে পূর্ব থেকেই Blue Light Filter ফিচারটি থাকতে পারে। আর যদি না থাকে, তাহলে আপনি বিভিন্ন থার্ড পার্টি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে Blue Light Filter করতে পারবেন।
দুইটি পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্লু লাইট ফিল্টার করার প্রভাব প্রায় একই। তবে, আপনি যদি মোবাইলে থাকা Built-in ব্লু লাইট ফিল্টার ফিচারটি বাদ দিয়ে থার্ড পার্টি অ্যাপ ব্যবহার করেন, তাহলে আপনি অতিরিক্ত কাস্টমাইজ করে ব্লু লাইট ফিল্টার করার সুবিধা পাবেন।
যাইহোক, Blue Light Filter সুবিধার মাধ্যমে আপনার মোবাইলের স্ক্রিন থেকে নির্গত হওয়া নীল আলোর প্রভাবগুলো হ্রাস পায়। আপনি যদি আপনার ঘুমের উন্নতির ব্যাপারে সন্দিহান হন অথবা একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে আপনার ফোন ব্যবহার করেন, তখন এটি আপনার চোখের স্ট্রেন হ্রাস লক্ষ্য করবেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে আপনি দেখবেন যে, এটি চালু করার পর মোবাইল ব্যবহারের সময় আপনার চোখ পূর্বের চাইতে কম ক্লান্ত হচ্ছে।
আপনি থার্ড পার্টি অপশন গুলো ব্যবহার করে ব্লু লাইট ফিল্টার চালু করার আগে, আপনার অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা ট্যাবলেটে থাকা Blue Light Filter একবার চালু করে দেখুন। আপনি মোবাইল ফোনের ব্র্যান্ড এবং অ্যান্ড্রয়েড ভার্সন অনুযায়ী এই সেটিংসটি ভিন্ন ভিন্ন নামে দেখতে পাবেন। এক্ষেত্রে আপনি Night Light, Blue Light, Eye Comfort অথবা অন্য কিছু নামে একই সেটিংস টি দেখতে পাবেন।
উদাহরণস্বরূপ, Samsung ফোনে এটি “Eye Comfort Shield” বলা হয়। যাইহোক, বেশিরভাগ অ্যান্ড্রয়েড ফোনেই আপনাকে শুধুমাত্র Settings থেকে Display অপশনে যেতে হবে।
এরপর, এখানে Blue Light বা Night Light চালু করার অপশনটি পেয়ে যাবেন। যেমন আমার ডিভাইসের এখানে দেখুন, “Blue-ray eye protection” নামে সেটিংসটি রয়েছে।
আর কিছু কিছু অ্যান্ড্রয়েড ভার্সনের মোবাইলে আপনি Blue Light চালু কিংবা বন্ধ রাখার জন্য সময় সেট করে দিতে পারবেন। এক্ষেত্রে সেই সময়ে Automatically Blue Light Filter চালু বা বন্ধ হবে। আর আপনি যদি এই সেটিংসটির আরও সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণ করতে চান, তাহলে আপনাকে একটি থার্ড পার্টি অ্যাপ ইন্সটল করতে হবে।
আর, একবার সেটিংস অপশন থেকে Blue Light চালু করলে কিংবা আগে থেকেই আপনার মোবাইলের স্ট্যাটাস বারে “Blue Light” বা “Eye Protection” মোড চালু বা বন্ধ করার অপশন পাবেন।
যাইহোক, আপনি মোবাইলের Built-In অপশন ব্যবহার করে তেমনভাবে মোবাইলের ব্লু লাইট নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবেন না। এক্ষেত্রে, আপনার একটি সেরা ব্লু লাইট ফিল্টার অ্যাপ ব্যবহার করা উচিত।
Twilight হলো অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জন্য একটি সেরা ব্লু লাইট ফিল্টার অ্যাপ। এই অ্যাপসটি ব্যবহার করে খুব সহজেই ডিসপ্লের Color Temperature নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি ক্রমান্বয়ে ডিসপ্লের রঙের সামঞ্জস্য করে থাকে। তার মানে হল, আপনি যখন এমন কোন স্ক্রিনে থাকেন, যেখানে নীল আলোর পরিমাণ কম, তখন এটি সে অনুযায়ী আপনার ডিসপ্লেতে নীল আলোর পরিমাণ কমায় এবং যখন আপনি বেশি নীল আলোতে থাকেন, তখন সেই আলো অনুযায়ী অধিক ব্লু লাইট কমিয়ে দেয়।
এই কাজ করার সময় অ্যাপসটি আপনার ফোনের লাইট সেন্সর ব্যবহার করে এবং Twilight ক্রমাগত তার সেটিংস অটোমেটিক্যালি সামঞ্জস্য করতে থাকে। যার মাধ্যমে এই অ্যাপসটি আপনার মোবাইলে এটি নিশ্চিত করে যে, আপনি সর্বদা একটি ভালো আলোর পরিবেশে রয়েছেন, যা আপনার জন্য উপযুক্ত। আপনি একবার এই অ্যাপসটি সেটআপ করলে, পরবর্তীতে আর আপনাকে কখনো অ্যাপটি ওপেন করতে হবে না।
একটি ফিচারের কারণে আপনার জন্য Twilight বিশেষভাবে দরকারী হতে পারে। এটি হল, আপনি নির্দিষ্ট অ্যাপ গুলোর জন্য এটিকে অটোমেটিক্যালি Disable করে দিতে পারেন। এক্ষেত্রে যেমন, আপনি ইউটিউব কিংবা ফেসবুকের মত স্ট্রিমিং সাইট গুলো ব্যবহার করার সময় ভিডিওর কোয়ালিটি ঠিক দেখার জন্য নির্দিষ্ট কিছু আপের জন্য Blue Light Filter বন্ধ করতে পারেন।
Official Download @ Twilight
বেশিরভাগ ব্যবহারকারীদের কাছে ব্লু লাইট ফিল্টার এর জন্য Twilight অন্যতম সেরা একটি পছন্দ। কিন্তু আপনার ফোন যদি রুট করা থাকে, তাহলে Blue Light প্রটেকশনের জন্য আরও শক্তিশালী অ্যাপ হিসেবে আপনি Night Light (KCAL) ব্যবহার করতে পারেন।
একটি রুট অ্যাপ হিসেবে, এটি আপনার ডিসপ্লের আলোকে সরাসরি কন্ট্রোল করতে পারে। আপনি যখন একটি থার্ড পার্টি অ্যাপ কিংবা মোবাইলের Built-In ব্লু লাইট ফিল্টার ব্যবহার করে আপনার মোবাইলের ডিসপ্লে থেকে নীল আলো প্রটেকশন করতে চান, তখন এটি আপনার স্ক্রিনকে একটি লাল ভাব নিয়ে আসে। কিন্তু এর পরিবর্তে আপনি যদি Night Light (KCAL) রুট অ্যাপটি ব্যবহার করেন, তাহলে এটি ডিসপ্লে তে এরকম লাল আলোর পরিবর্তে স্ক্রিন থেকে আউটপুট হিসেবে নীল আলোর পরিমাণ হ্রাস করবে।
যদিও KCAL সবার জন্য নয়। এটি ব্যবহার করার জন্য আপনাকে অবশ্যই আপনার ফোনটি রুট করতে হবে এবং এটির জন্য আপনাকে Custom Kernel ইন্সটল করা লাগতে পারে। এই অ্যাপসটি গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় না। এজন্য আপনি এটি GitHub পেজে খুঁজতে পারেন অথবা থার্ড পার্টি অ্যাপ স্টোর হিসেবে F-Droid এর মাধ্যমে ডাউনলোড করতে পারেন।
অফিসিয়াল ওয়েবসাইট @ Night Light (KCAL)
ব্লু লাইট ফিল্টার অপশন চালু করলে, শুরুতে আপনার কাছে ডিসপ্লের সকল কিছু ঘোলা মনে হতে পারে। বিশেষ করে, এই ফিল্টার অপশনটি চালু করার পর আপনার স্ক্রিনে যখন লালচে ভাব চলে আসে। যদিও ব্লু লাইট ফিল্টারিং এর প্রভাবে আপনার অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মোটামুটি সহজ, কিন্তু তবুও কিছু লোক এটি পছন্দ করেন না।
আপনি যদি এরকম ভাবে অন্যান্য লোকদের মত সমস্ত অ্যাপে এরকম লালচে আভা নিতে পছন্দ না করেন, তাহলে আপনার জন্য Blue Light এর প্রভাব কমানোর আরো কিছু সহজ উপায় রয়েছে।
আপনি যদি এই মুহূর্তে একটি ফোন বা ট্যাবলেট ব্যবহার করেন, তাহলে যতটা সম্ভব Brightness কমিয়ে দিন এবং আপনার অ্যাপ থেকে Dark Mode এ স্যুইচ করুন। যেমন: ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, নোটপ্যাড এবং অন্যান্য অ্যাপ গুলোতে Dark Mode অপশন চালু করুন। আর তাহলেই Blue Light ফিল্টার চালু না করেও, এরকম সুবিধা পেতে পারেন।
মোবাইল থেকে নির্গত হওয়া Blue Light রাতে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যার ফলে, আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে এবং শারীরিক অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর উত্তম সমাধান হিসেবে আপনি রাতে দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করা বন্ধ করুন। আর যদি আপনাকে দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করতেই হয়, তাহলে ব্লু লাইট প্রটেকশন চালু করুন, যাতে ডিসপ্লে থেকে এই ক্ষতিকর আলো আপনার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলতে না পারে।
যদিও Blue Light ফিল্টার চালু করলে, বিষয়টি আপনার কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। কিন্তু, এটি ব্যবহার করা অত্যন্ত সহজ এবং আপনি এটির সাথে দ্রুতই অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারেন। মোবাইল স্ক্রিনের দিকে এক দৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকা কিংবা দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহারের সময় আপনার মাথাব্যথা কিংবা চোখের সমস্যা হলে, সেটি কমানোর জন্য আপনি এই ট্রিক্সস টি ফলো করতে পারেন। ধন্যবাদ, আসসালামু আলাইকুম।
আমি মো আতিকুর ইসলাম। কন্টেন্ট রাইটার, টেল টেক আইটি, গাইবান্ধা। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 4 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 421 টি টিউন ও 93 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 62 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 3 টিউনারকে ফলো করি।
“আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ছেড়ে দিবে, আল্লাহ্ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু অবশ্যই দান করবেন।” —হযরত মোহাম্মদ (সঃ)