বাংলাদেশে মোবাইল ফোন আগমনের প্রথম দিকের কিছু কথা

টিউন বিভাগ মোবাইলীয়
প্রকাশিত
জোসস করেছেন

বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে। সিটিসেল নিয়ে আসে প্রথম মোবাইল ফোন। এটা শুধু বাংলাদেশেই প্রথম ছিল না, উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ছিল। চড়া মূল্য এবং সীমিত নেটওয়ার্ক এর কারণে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের অল্প কিছু মানুষ এই ফোন ব্যবহার করতেো। গ্রামীণফোন ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম চালু করে প্রি-পেইড প্যাকেজ যার নাম ছিল ‘ইজি’।

নেটওয়ার্ক তেমন একটা সম্প্রসারণ না হওয়া এবং কারিগরি কারণে সীমিত আকারে সংযোগ বিক্রি করতো। বলা চলে ২০০১ সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের গতি কিছুটা বৃদ্ধি পায়। সেই সময় থেকে আমি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসছি। আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে এই প্রতিবেদনটা তৈরি করা হলো।

১। প্রি-পেইড প্যাকেজ কেনার ভীড়ঃ

গ্রামীণফোন তাদের প্রি-পেইড ‘ইজি’ প্যাকেজ বিক্রি করার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দেয়া শুরু করে ২০০১ সালের জুলাই মাস থেকে। সেই সময় থেকে লম্বা লাইন ধরে প্যাকেজ কিনতে দেখেছি। আমি নিজেও ২ ঘণ্টা লাইনে থেকে প্যাকেজ কিনতে পারিনি। খুব সীমিত আকারে তখন সংযোগ বিক্রি করতো। ২/১ এক দিনের মধ্যেই সব স্টক শেষ হয়ে যেত। পরবর্তী প্যাকেজের জন্য এক/দুই মাস অপেক্ষা করতে হতো। বলা চলে এই অবস্থা ছিল ২০০২ সাল পর্যন্ত।

২। প্রতি মিনিট কল চার্জ ৬ টাকাঃ

প্রি-পেইড প্যাকেজগুলোতে শুরু থেকেই প্রতি মিনিট কল চার্জ ভ্যাটসহ ৬.৭৫ টাকা ছিল। বলা যায় দীর্ঘ সময় ধরেই এই কল চার্জ চালু ছিল। বাংলালিংক আসার পর ২০০৫ সাল থেকে ফোন কলের ট্যারিফ কিছুটা কমতে শুরু করে।

৩। এক মিনিট পালসঃ

বলা চলে দীর্ঘ সময় ধরেই ১ মিনিট পালস ব্যবস্থা চালু ছিল। বাংলালিংক আসার পর ২০০৫ সাল থেকে ৩০ সেকেন্ড পালস ব্যবস্থা চালু হয়। আর ১০ সেকেন্ড পালস চালু হয় ২০১২ সালের ১২ই সেপেম্বর থেকে।

৪। কার্ডের মেয়াদ ২১ দিনঃ

তিনশত টাকা মূল্যমানের কার্ডের মেয়াদ ছিল ২১ দিন আর ছয়শত টাকা মূল্যমানের কার্ডের মেয়াদ ছিল ৪৫ দিন। আবার বাজারে সব সময় কার্ড পাওয়া যেত না। এই অবস্থা ছিল ২০০৫ সাল পর্যন্ত। তৎকালীন অপারেটর একটেল ই-ফিল সার্ভিস নিয়ে এলে ৬০০ টাকা রিচার্জ মেয়াদ ৬ মাস হয়। এর পর গ্রামীনফোনের ফ্লেক্সিলোড চালু হলে ৩০০ টাকার রিচার্জ মেয়াদ ১ বছর করা হয়।

৫। মিসড কল সংস্কৃতিঃ

কল চার্জ বেশি হওয়ার কারণে ২০০১ সাল থেকে মিসড কলের একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো। কেউ কেউ এটাকে সাঙ্কেতিকভাবে ব্যবহার করতো। যেমন – ১টা মিসড কল কি করতে হবে আবার পর পর ২টা মিসড কল হলে কি করতে হবে ইত্যাদি। এটা নেটওয়ার্ক এর প্রভাব ফেলতো। সেই সময় ‘মিসড কল’ ক্ষতিকর এটার ওপর বেশ কয়েকদিন সচতনামূলক ক্যাম্পেইনে নেমেছিল গ্রামীণফোন।

৬। সিম বিক্রির সংঘবদ্ধ বিজ্ঞাপণঃ

প্রথমদিকে শুধু একটা সিম ৫, ০০০ টাকা করে বিক্রি করার জন্য পত্রিকায় সংঘবদ্ধ বিজ্ঞাপণ দেয়া হত। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে এই রেট কমে আসে। বলা চলে বেশ কয়েক বছর ধরেই এই ব্যবসা চালু ছিল।

৭। নেটওয়ার্ক এর জন্য গাছে চড়াঃ

বলা যায় ২০০৩ সাল পর্যন্ত মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক তেমন একটা শক্তিশালী ছিল না। তাই যারা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেত সেই এলাকায় নেটওয়ার্ক না পেলে অনেক সময় গাছে চড়ে নেটওয়ার্ক খুঁজতো।

৮। এন্টেনার ব্যবহারঃ

নেটওয়ার্ক সম্প্রসরনের প্রথম দিকে যে সব এলাকায় দূর্বল নেটওয়ার্ক ছিল সেই সব এলাকার কিছু মানুষ এবং পল্লীফোনের অপারেটররা বিশেষ করে গ্রামের দুঃস্থ নারীরা এন্টেনা ব্যবহার করে পাবলিক কল অফিস (পিসিও) এর সেবা চালিয়ে গেছেন।

৯। মোবাইল টু মোবাইল সংযোগঃ

প্রি-পেইড প্যাকেজগুলোতে ২০০৫ সাল পর্যন্ত মোবাইল টু মোবাইল সংযোগ ছিল। মোবাইল ফোন থেকে ল্যান্ডফোন বা আইএসডি তে কল করার ব্যবস্থা ছিল না। প্রযুক্তিগত কারণে সেই সময় BTTB এর ল্যান্ডফোনের আন্তঃসংযোগ বাড়নো সম্ভব ছিল না।

১০। সিম রিপ্লেসেমেন্ট ফি ৫০০ টাকাঃ

সিম হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে প্রথম দিকে এটার রিপ্লেসেমেন্ট ফি রাখা হতো ভ্যাটসহ ৫৭৫ টাকা।

১১। লাইন রেন্ট ৫০০ টাকাঃ

শুরুর দিকে  Post Paid সংযোগের লাইন রেন্ট ছিল ৫০০ টাকা। ভ্যাটসহ প্রদান করতে  হতো ৫৭৫ টাকা। নির্দিষ্ট তারিখে বিল প্রদান না করলে আবার সংযোগ বিচ্ছন্ন করে দিত।

১২। ভাব নিয়ে চলাফেরাঃ

প্রথমদিকে যারা মোবাইলের সংযোগ কিনেছিলেন তারা বেশিরভাগই হ্যান্ডসেট পকেটে রাখতেন না। হাতে করে নিয়ে চলাফেরা করতেন। লক্ষ্য করা গেছে চলাফেরার সময় তারা একটা ভাব নিয়ে চলতেন।

১৩। পল্লীফোনের জয়জয়কারঃ

গ্রামে-গঞ্জে পাবলিক কল অফিস বলতে এক সময় পল্লীফোনকেই বুঝাতো। এমনও দেখা গেছে প্রবাসীর কোন কল এলে তারা মাইক লাগিয়ে ডাক দিত, অমুকের ফোন এসেছে। এটার জন্য তারা একটা ইনকামিং ফি নিত। আবার গ্রামের মানুষজন প্রয়োজনবোধে পল্লীফোনের মাধ্যমেই প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো, তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের খোঁজ খবর রাখতো।

১৪। বড় সাইজের হ্যান্ডসেটঃ

প্রথমদিকে প্যাকেজের সঙ্গে যে হ্যান্ডসেট গুলো পাওয়া যেত সেইগুলো ছিল ভারী, লম্বা এবং মোটা। আবার কিছু কিছু সেটের এন্টেনা থাকত। ফিচারে থাকত কিছু গেমস। সেই সময়কার কিছু জনপ্রিয় হ্যান্ডসেট ছিল সিমেন্স সি-২০, নোকিয়া ৩৩১০ ইত্যাদি।

১৫। টেলিকম ব্যবসার উত্থানঃ

নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে টেলিকম ব্যবসার উত্থান শুরু হয়ে যায় ২০০১ সাল থেকে। যত্রতত্র গড়ে উঠতে থাকে এই ব্যবসার দোকান।

১৬। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের প্রেস বিজ্ঞপ্তিঃ

গ্রামীণফোনের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালের ২৬শে মার্চ থেকে। বলা যায় ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন তাদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের প্রেস বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় দেখা যেত।

১৭। কলড্রপঃ

গ্রাহকের তুলনায় বিটিএস ছিল স্বল্প, সেই গুলোর ধারণ ক্ষমতাও ছিল অনেক কম। যার ফলে অনেক সময় কল করেও সংযোগ পাওয়া যেত না। বার বার চেষ্টা করতে হতো। আবার সংযোগ পাওয়া গেলেও ঘন ঘন কলড্রপ হতো। মাঝে মাঝে কথা উঠানামা করত, সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত।

১৮। ইনকামিং ফিঃ

প্রথমদিকে শুধু  Post Paid প্যাকেজগুলোতে BTTB এর ল্যান্ডফোনের ইনকামিং সংযোগ ছিল।  তবে ল্যান্ডফোনের ইনকামিং কল ফ্রি ছিল না। প্রতি মিনিট ভ্যাটসহ ৩.৭৫ টাকা ফি ধরা হত।

উপসংহারঃ

মোবাইল ফোন আগমনের প্রথমদিকে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। কল চার্জ অনেক বেশি ছিল, পালস ছিল এক মিনিট, নেটওয়ার্ক ভাল ছিল না। তবুও আমরা সেই সময় এই প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলাম। সময় এর প্রেক্ষাপটে সেটাই হয়ত ঠিক ছিল।

Level 4

আমি আব্দুল্লাহ আল ফারুক। Digital Marketer, Self Employed, Bogura। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 34 টি টিউন ও 20 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 23 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।


টিউনস


আরও টিউনস


টিউনারের আরও টিউনস


টিউমেন্টস