এক সময় ইন্টারনেট, ল্যান্ডফোন এবং মোবাইল ফোনের ওপর ভিত্তি করে বেশ কিছু নতুন নতুন ব্যবসা এবং সেবা গড়ে উঠেছিলো। সে গুলোর কিছু ছিল বৈধ এবং কিছু ছিল অবৈধ ব্যবসা। প্রযুক্তির বিকাশ এবং আইনগত বাঁধার কারণে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু ব্যবসা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। সেই ধরনের কিছু ব্যবসা এবং সেবা নিয়ে আমি আলাপ করবো যে গুলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিলো।
বাংলাদেশে ইন্টারনেটের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। দৃকে চাকুরী করার সুবাধে ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ হয় ১৯৯৭ সাল থেকে। অর্থাৎ ২১ বছর আগে থেকে আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করি। কেননা দৃক ছিল প্রথম দিকের একটা আইএসপি। প্রযুক্তিগত কারণে শুরুতেই ইন্টারনেটের গতি ছিল অনেক কম। ডাটা ব্যবহারের খরচ ছিল অনেক বেশি। তখন কিন্তু ভলিউম বেসড ইন্টারনেটের বিল করা হতো না। বিল করা হতো মিনিট হিসেবে। শুরুর দিকে প্রতি মিনিট ইন্টারনেট ব্যবহারের ট্যারিফ ছিল ১ টাকা। গতি ছিল সর্বোচ্চ ১২৫ কেবিপিএস। ১৯৯৯ সালের দিকে কয়েকটা আইএসপি প্রি-পেইড ইন্টারনেট কার্ড বাজারে ছাড়ে। কার্ডগুলো ডায়াল আপ সংযোগের মাধ্যমে ব্যবহার করা যেত। প্রতি মিনিট ট্যারিফ ছিল ৫০ পয়সার মতো। এটার জন্য দরকার হতো ল্যান্ডফোনের সংযোগ। বেশ কয়েক বছর ধরে ঐ সব কার্ড বাজারে চালু ছিল।
ইন্টারনেট ব্যবহারকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালের দিকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠে সাইবার ক্যাফের ব্যবসা। প্রতি ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য ফি নেয়া হতো ৩০ থেকে ৬০ টাকা। যাদের বাসায় বা অফিসে ইন্টারনেটের সংযোগ ছিল না তারা সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। বলা চলে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই ব্যবসাটা জমজমাট ছিল।
২০০০ সালের দিকে টিএন্ডটি এর আইএসডি কলের ট্যারিফ ছিল অনেক বেশি। সেই সময় আমেরিকা বা কানাডায় ল্যান্ডফোন থেকে কলের ট্যারিফ ছিল প্রতি মিনিট ৩০ টাকার মতো। তখন কিছু ভিওআইপি ব্যবসা গড়ে ওঠে যা ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। ঢাকার আসাদ গেট থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেত তাদের বিজ্ঞাপণ। লেখা থাকত আমেরিকা ও কানাডায় ফোন করুন প্রতি মিনিট ১০ টাকা। আইনগত বাঁধার কারণে এই ব্যবসা বেশিদিন ধরে চলতে পারেনি।
৪। কলিং কার্ড
২০০২ সালের দিকে বাজারে কিছু কলিং পাওয়া যেত। ল্যান্ডফোন থেকে তাদের দেয়া পিন প্রেস করে খুব কম খরচে বিভিন্ন দেশে কল করা যেত। এটা মূলত ভিওআইপি প্রযুক্তি ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছিল। তবে আইনগত বাঁধার কারণে খুব বেশি দিন এই ব্যবসাও টিকে থাকতে পারেনি।
একটা সময় মোবাইল ফোনের প্রি-পেইড প্যাকেজ গুলোতে ল্যান্ডফোনের কোন সংযোগ ছিল না। প্রযুক্তিগত কারণে সেই সময় সংযোগ দেয়ার মত ধারণ ক্ষমতা ছিল না তৎকালীন টিএন্ডটি ফোনের। আর এটাকে কেন্দ্র করে কিছু প্রাইভেট পিএবিএক্স সার্ভিস গড়ে উঠেছিল ২০০১ সালের দিকে। তারা একটা সার্ভিস ফি নিয়ে মোবাইল টু মোবাইল প্যাকেজগুলোকে ল্যান্ডফোনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দিতো। যদিও এটা ছিল অনেক ব্যয়বহুল। মোবাইল ফোন গুলোতে টিএন্ডটি সংযোগের ব্যবস্থা চালু হলে ২০০৪ সাল থেকে এই ব্যবসা গুটিয়ে যায়।
১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোনের যাত্রার পর শুরু করা হয় পল্লীফোনের কার্যক্রম। এটা ছিল গ্রামীণফোন, জিটিসি এবং গ্রামীণ ব্যাংকের একটি মহৎ প্রয়াস। ভিলেজ ফোন অপারেটররা অধিকাংশই ছিল দুঃস্থ নারী। যারা গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। এছাড়াও যত্রতত্র ভাবে ২০০১ সাল থেকে বে-সরকারি ভাবে গড়ে ওঠে পিসিও ব্যবসা। শুরুর দিকে প্রতি মিনিটের জন্য কল চার্জ ছিল ১০ টাকা। এটা এক সময় ২ টাকাতে নেমে আসে। মোবাইল ফোনের গ্রাহক ব্যাপক হারে বেড়ে যাবার ফলে এই ব্যবসাটা এখন গুটিয়ে গেছে।
২০০৫ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন অপারেটর একটেল নিয়ে আসে ই-ফিল সার্ভিস। ৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত ১৩ ডিজিটের রিচার্জ পিন বিক্রি করতো। যেটা দিয়ে মোবাইল ফোন টপ আপ করা যেত। পরবর্তীতে গ্রামীণফোন নিয়ে আসে ফ্লেক্সিলোড সার্ভিস। এই সার্ভিসের সঙ্গে বহু লোক এক সময় জড়িত ছিল। এখন মোবাইল ব্যাংক তথা বিকাশ-রকেট, ইন্টারনেট ব্যাংক, ডেবিট এবং ক্রেডিট কার্ড দিয়ে খুব সহজেই নিজেদের মোবাইল ফোন টপ আপ করা যায়। এর ফলে এই ব্যবসাটা এখন রুগ্ন হয়ে পরেছে।
২০০৪ সাল থেকে বেশ কিছু বেসরকারি পিএসটিএন কোম্পানিকে লাইসেন্স প্রদান করে বিটিআরসি। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল র্যাংকসটেল, বিজয় ফোন, পিপলস ফোন, ন্যাশনাল ফোন, ঢাকা ফোন, যুবক ফোন, ওয়ানটেল, বাংলা ফোন, সেবা ফোন, ওয়ার্ল্ডটেল ইত্যাদি। ভিওআইপি কলের অভিযোগ, বিটিআরসি’র শর্তাবলী পালন না করা এবং বকেয়া বিল পরিশোধ না করার জন্য ২০১০ সালের দিকে বেশ কিছু কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করা হয়। ২০১১ সালের দিকে ৩টি কোম্পানির লাইসেন্স রি-ভ্যালিডেশন করা হলেও পরবর্তীতে কেউ ব্যবসা ধরে রাখতে পারেনি। এর মুল কারণ ছিল মোবাইল ফোনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারা। অনেকেই নিজ থেকেই লাইসেন্স সমর্পণ করেছে।
২০০৮ সালের দিকে বাংলালায়ন এবং কিউবি কে ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়। লাইসেন্স ফি বাবদ প্রতিটি কোম্পানি বিটিআরসি কে প্রদান করে ২১৫ কোটি টাকা। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং নানা ধরনের কাজে দুই কোম্পানি এ যাবদ ২০০০ কোটিরও বেশি টাকা খরচ করেছে। বিটিআরসি এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৩ সালের জুন মাসের দিকে তাদের মোট গ্রাহক ছিল ৫ লাখের মত। আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের মোট গ্রাহক এখন ৮০ হাজারের মতো। গত ৫ বছরে তারা ৮৪% গ্রাহক হারিয়েছে। এর মুল কারণ হলো অনেক পুরাতন প্রযুক্তি ব্যবহার করা, নিন্ম মানের সার্ভিস, মোবাইল অপারেটরের ৩জি-৪জি সার্ভিস শুরু করা, পাড়া-মহল্লায় কম খরচে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস প্রদান করা ইত্যাদি। কিউবি কিছুদিন আগে বাংলালায়ন এর সঙ্গে একীভূত হয়েছে। সীমিত পরিসরে বাংলালায়ন ৪জি এলটিই সার্ভিস চালু করলেও লাভজনকভাবে ব্যবসা করতে পারছে না।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০০০ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ই-টিউন (ইলেক্ট্রনিক মেইল) সার্ভিস চালু করে। এই সার্ভিসের মাধ্যমে টেক্সট মেসেস এবং স্ক্যান করা ছবি ই-মেইল আইডি তে পাঠানো এবং গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা হয়। প্রথম দিকে শুধু ঢাকা জিপিও তে এই সার্ভিস প্রদান করা হলেও পরবর্তীতে সারা দেশের আরও ১৫টি হেড টিউন অফিসে এই সার্ভিস চালু করা হয়। ডাক বিভাগের ওয়েবসাইটে এই সার্ভিসের কথা এখনো উল্লেখ করা আছে। তবে এই সার্ভিস এখনও প্রদান করা হয় কিনা জানি না। মূলত যাদের ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার ছিল না তাদের কথা চিন্তা করে ডাক বিভাগ এই সার্ভিস চালু করে।
আমরা দেখলাম সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে দেশের আইন-কানুন, প্রযুক্তির উন্নয়ন বা পরিবর্তন সংশ্লিস্ট ব্যবসার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। তাই আমরা যদি সব সময় আপডেট থাকতে না পারি তা হলে সেই ব্যবসা ভাল করতে পারবো না।
আমি আব্দুল্লাহ আল ফারুক। Digital Marketer, Self Employed, Bogura। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 11 বছর যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 34 টি টিউন ও 20 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 23 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।