ইন্টারনেট ছাড়া আমরা এখন সম্ভবত এক পা ও সামনে আগাতে পারি না। আমাদের জীবনে এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেটের প্রয়োজন নেই। খাবার-পোশাক থেকে শুরু করে চাকরি-ব্যবসা এমনকি শিক্ষা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই আমরা হয়ে আছি ইন্তারনেট নির্ভর। সত্যি কথা বলতে আমরা হয়ে আছি অতি-ইন্টারনেট নির্ভর।
কিছুদিন পর অবস্থা না এমন হয়ে যায় যে ইন্টারনেটের সাহায্য ছাড়া আমরা খেতে পারব না কিংবা গোসল করতে পারব না 😜😜😜। এমন মানুষ এখন অহরহই দেখা যায় যে সারাদিনই অনলাইনে থাকে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মাঝে ঘুমানো আর খুব প্রয়োজনীয় কিছু কাজ বাদে এরা অনলাইন থেকে যায় না।
ইন্টারনেটের প্রতি এমন নির্ভরশীলতার কারণে আমরা প্রভাবিত হচ্ছি ইন্টারনেট দ্বারা এবং ইন্টারনেট থেকে। প্রযুক্তির অভিনব সব আবিষ্কারের কারণে নতুন প্রজন্মের মানুষেরা ইন্টারনেটের প্রতি আর বেশি মাত্রায় নির্ভলশীল হয়ে পড়ছে। কারণ, নতুন নতুন সব প্রযুক্তি পণ্য বানানোই হচ্ছে ২৪ ঘন্টা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করার জন্য।
ইন্টারনেট অফ থিংস নামের নতুন টেক-বিপ্লবটি এর জন্য দায়ী। ইন্টারনেটের প্রতি নির্ভরশীলতা অবশ্যই ক্ষতিকর। আবার ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে উপকারও আছে অনেক। কিন্তু ইন্টারনেট থেকে উপকার পেতে হলে অবশ্যই ইন্টারনেটের ব্যবহারকে করতে হবে পরিমিত।
আমাদের আজকের টিউনের বিষয় ইন্টারনেট কিভাবে আমাদের মানসিক পরিবর্তন করছে। তো চলুন শুরু করা যাক।
জ্বী হ্যাঁ, ইন্টারনেট ব্যবহারে আপনার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, পেতে বাধ্য। স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই বোঝা যায় বই পড়ার থেকে ইন্টারনেটে সার্ফিং করা অনেক বেশি জটিল। কোন একটি সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে পেতে আমাদের অবশ্যই সুচিন্তিত কীওয়ার্ড লিখে সার্চ করতে হয়। প্রয়োজন হয় মস্তিষ্কের কাজের।
একটা গবেষণা করা হয় মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধদের মাঝে, তাদের একটি সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করতে বলা হয়। তখন করা একটি ব্রেন স্ক্যান থেকে দেখা যায় সাধারণ মানুষদের তুলনায় তাদের মস্তিষ্ক সার্চ করার সময় বেশি কার্যক্ষম ছিল। পরবর্তীতে তাদেরকে এক সপ্তাহ প্রতিদিন এক ঘন্টা করে ইন্টারনেটে তথ্য খুঁজে বের করতে বলা হয়। এবং এক সপ্তাহ পরের রিপোর্টে ইন্টারনেট ব্যবহার করায় তাদের মস্তিষ্ক ছিল সাধারণত যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না তাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি কার্যকরী।
এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় ইন্টারনেট সার্ফিং আমাদের শর্ট-টার্ম মেমোরি এবং দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বাড়ায়। তাই বলা যায় ইন্টারনেট ব্যবহার আমাদের মস্তিষ্ককে আরো বেশি কার্যক্ষম করে তুলে। বাড়িয়ে তুলে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা।
ইন্টারনেট আমদের করে দিয়েছে পৃথিবীর সবার সামনে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ। ফেসবুক, টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা সবাই চাই বেশি বেশি ফলোয়ার, লাইক, টিউমেন্ট এবং শেয়ার। আর এ সব কিছু পাবার জন্য অবশ্যই ভাল কিছু করতে হবে। কোন একটি স্ট্যাটাসে বেশি লাইক পাবার জন্য আমাদের স্ট্যাসটি অবশ্যই স্ট্যান্ডার্ড হতে হবে, মানুষ পছন্দ করবে এমন কিছু হতে হবে।
একটি ছবির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে ছবিটিকে হতে হবে আকর্ষনীয়, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য। আর এসব কিছু করার জন্য আমাদের চিন্তা করতে হবে, নিজের মেধা দিয়ে নতুন ধরনের সব ইউনিক জিনিস করতে হবে। ইন্তারনেটে আবার অনেকে গল্প লিখেন, কবিতা লিখেন, ফটোগ্রাফি করেন, প্রতিবেদন প্রকাশ করেন এমন সব কিছুতেই থাকতে হয় ভালো কিছু, নতুন কিছু যাতে মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
আর ভাল এবং নতুন কিছু করার চেষ্টা বাড়ায় আমাদের সৃজনশীলতা। কোটি মানুষের সামনে নিজেকে আলাদা ভাবে তুলে ধরার এবং সবার মাঝে পরিচিতি পাবার আশা থাকে সবার মাঝেই। আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেটা করার জন্যই আমাদের হতে হয় সৃজনশীল এবং অনন্য।
ইন্টারনেট আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাবও ফেলে। তার একটি রকমফের হল ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব। কোটি মানুষের প্লাটফর্ম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কোন একটি ছবি আপলোড করে অনেক সময় অনিরাপদ বোধ করেন। ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধই এর কারণ।
বিশেষ করে মেয়েরা নিরাপত্তাহীনয়তায় বেশি ভোগে। কেননা ফেসবুক বা টুইটারে আপলোড করা কোন একটি ছবি যে কেউ নিয়ে সেটা দিয়ে খারাপ কিছু তৈরী করতে বা খারাপ কাজে ব্যবহার করতে পারে। এর বাইরেও আছে নিজেকে প্রকাশের বা ফেমাস করার প্রচেষ্টা বেশি হয়ে গেলে মানুষ যে কোন কিছু করতে পারে, যা মারাত্মক রকম বিপজ্জনক।
সাইকোলজিস্টরা বলেন, সামাজিক মাধ্যমে বেশি আসক্ত ব্যক্তিরা বাস্তব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তারা মানুষের সাথে ঠিকমত কথা বলতে পারেন না। একাকী থাকেন। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়, সবসময় রাগ থাকে এমন আরো অনেক রকম ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন চলে আসে। যার প্রায় পুরোটাই খারাপ পরিবর্তন।
ইন্টারনেট দুনিয়া হাতের কাছে এনে দিয়েছে সবকিছু। ইন্টারনেটে হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় সব তথ্য। মানুষের হাতের কাছে সব চলে আসায় মনযোগের দরকার পড়ছে না বেশি একটা। আর এর প্রভাব পড়ছে বাস্তব জীবনেও। ইন্টারনেট নির্ভর মানুষের মনযোগ দেবার ক্ষমতা যাচ্ছে কমে।
একটি বিষয়ের প্রতি তারা মনোযোগ দিতে পারছে না আগের মত। এক গবেষণায় দেখা যায় ২০০০ সালে ৩০% মনযোগ ক্ষমতা ১২ সেকেন্ড থেকে ২০১৩ সালে সেটা ৮ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। সেই সাথে কমেছে সহ্যক্ষমতাও। সহনশীলতার মাত্রা ৪০ থেকে নেমে এসেছে ৩৫ এ।
একটি কাজের প্রতি মানুষের মনযোগ দেবার ক্ষমতা যখন কমেছে মাল্টি টাস্কিং বা একসাথে অনেক কাজ করার ক্ষমতা তখন গিয়েছে বেড়ে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন মানুষের মাল্টি টাস্কিং এর ক্ষমতা বেড়েছে। এই টিউনটি পড়ার সময় সাপনি কি গান শুনছেন? বা কফি খাচ্ছেন? তাহলে আপনিও মাল্টি টাস্কিং করছেন।
এই মাল্টিটাস্কিং এর ক্ষমতাই বেড়েছে অনেকগুণ। আগে যেখানে মাত্র ২% মানুষ একসাথে একের অধিক কাজ করতে পারত এখন আমরা সবাই প্রায় একসাথে অনেক কাজ করতে অভ্যস্ত। স্মার্টফোনগুলোর কল্যাণেই এই পরিস্থিতি।
একটা সময় ছিল যখন আমাদের অনেক কিছু মুখস্ত বা মনে রাখতে হত। এর মাঝে আছে কারো মোবাইল নাম্বার বা কারো বাসার ঠিকানা, কোন একটি সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন বা এমন কিছু। কিন্তু এখন আর মানুষকে কিছু মুখস্ত রাখতে হয় না.(বাংলাদেশের পড়াশোনার সিস্টেম ব্যাতীত)। যে কোন তথ্য পেয়ে যায় এক মুহূর্তেই।
আর তাই কমে গেছে মনে রাখার ক্ষমতা। আসলে কমে নি হয়ে গেছে রিপ্রোগ্রাম। মানে আমরা চেঞ্জ করে নিয়েছি মেমোরি স্টোরেজ, আগে সেটা ছিল মস্তিষ্ক আর এখন সেটা হয়ে গেছে গুগল বা উইকিপিডিয়া। এই ব্যাপারটা ভাল না মন্দ সেটা কখনই নিরুপণ করা যাবে না। কেননা ভাল মন্দ সবার কাছে আপেক্ষিক। কারো কাছে ব্যাপারটা ভাল হতে পারে আবার কারো কাছে হতে পারে জঘণ্য।
তো, ইন্টারনেট আপনাকে কি বানাচ্ছে? অনন্য মানসিক ক্ষমতা সম্পন্ন একজন সুপার হিউম্যান নাকি একজন বিকৃত মস্তিষ্কের ফ্রিক? আসলে ইন্টারনেট আপনাকে কিছুই বানাচ্ছে না। আপনি নিজেই নিজেকে বদলাচ্ছেন। সেটা কি ভাল না খারাপ?
একটু চিন্তা করুন। আমি জানি আপনি নিজেই সেরা, নিজের জন্য সেরা। টিউনটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ
আমি হাসিবুর ইসলাম নাসিফ। বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৌশল নেটওয়ার্ক - টেকটিউনস এ আমি 9 বছর 6 মাস যাবৎ যুক্ত আছি। টেকটিউনস আমি এ পর্যন্ত 43 টি টিউন ও 76 টি টিউমেন্ট করেছি। টেকটিউনসে আমার 3 ফলোয়ার আছে এবং আমি টেকটিউনসে 0 টিউনারকে ফলো করি।
বিষাদময় পৃথিবীতে আমি আনন্দ খুঁজে নিই সবকিছু থেকে। আর স্বপ্ন দেখি মহাকাশ ভেদ করে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেবার। স্বপ্নচারী আমার স্বপ্নগুলোই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে। হাত ধরে চলো স্বপ্ন দেখি একসাথে।
<<>>মুহাম্মদ জাফর ইকবালের একটি science fiction- এ এর ক্ষতিকর দিক বলা হয়েছে।